লাতিন ভাষার কথা : ১

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত 'Latin: Kulturen, historien, språket' গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ 'A Natural History of Latin'-এর বাংলা ভাষান্তর ‘লাতিন ভাষার কথা’র ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু হলো মুক্তাঙ্গনে। [. . .]

latinTore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

 

 

মুখবন্ধ

প্রথমে বলি, সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। একটা কাজ অসমাপ্ত রেখে আরেকটা কাজ ‘মুক্তাঙ্গনে’ শুরু করার অনুরোধ রক্ষার সংকোচ। খানিকটা ভরসার কথা এই যে, বইটির আপাত তর্জমাযোগ্য প্রায় পৌনে ২০০ পৃষ্ঠার অর্ধেকের বেশি মোটামুটি পাতে দেবার মতো অনুবাদ হয়ে গেছে। মোট ৪৭টি পরিচ্ছেদের ২৯টি। বাকি অংশ একটু একটু করে এগোচ্ছে। এক-এক সপ্তাহে এক-একটি পরিচ্ছেদ এখানে প্রকাশ পেয়ে ২৯টি শেষ হতে হতে আশা করি বাকি অংশ অনুবাদ শেষ হয়ে যাবে।

এখন খুব সংক্ষেপে বলি বইটির কথা। এতো বিষয় থাকতে, এবং হাতে অসমাপ্ত বেশ কিছু কাজ থাকতে লাতিন ভাষা বিষয়ক একটি বই অনুবাদে কেন হাত দিলাম। বইটি পড়ে ভালো লেগেছিল। সেই ভালো লাগা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। আরেকটি কারণ বোধ হয়, উমবের্তো একো-র The Name of the Rose পাঠ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি-থাকা অনুবাদের সময় লাতিন ভাষার প্রতি গড়ে ওঠা একটি অকেজো, অলস অনুরাগ। আরেকটি অতি দূরবর্তী প্রভাবও কি থাকতে পারে? ছোটবেলা থেকেই বাসায় এ. টি. দেব-এর ইংলিশ টু বেঙ্গলি অভিধানটি দেখে আসছিলাম। সেটার শেষদিকে, Appendix অংশে কিছু লাতিন শব্দবন্ধ বাংলা মানে-সহ দেয়া ছিল। সেগুলো পড়তে ভালো লাগত (যদিও কেন যেন একটিই কেবল মনে গেঁথে গিয়েছিল: homo homi homini lupus [হোমো হমিনি লুপুস] — মানুষ মানুষের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ)।

যাই হোক, A Natural History of Latin বইটি মোট ৫টি অংশে বিভক্ত। Latin and the Romans, Latin and Europe, About the Grammar, Basic Vocabulary, Common Phrases and Expression। আপাতত ইচ্ছে, প্রথম ২টি অংশ অনুবাদ করার। পঞ্চম অংশের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এমন একটি মজার বই Amo, Amas, Amat and More সংগ্রহ করা হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেখান থেকে বেছে বেছে কিছু শব্দবন্ধ, উচ্চারণ আর তাদের মানে অনুবাদ করে পোস্ট করেছিলাম আনন কাননে, বেশ কিছুদিন আগে, এখনও করি মাঝে মাঝে। বই আকারে যদি লাতিন ভাষার কথা  বের হয় কোনো দিন, হয়তো সেসব শব্দবন্ধ ইত্যাদিও প্রথম দুই পরিচ্ছেদের সঙ্গী হবে।

. . .

লাতিন ও রোমকেরা

লিঙ্গুয়া লাতিনা (lingua latina) ::  প্রাথমিক পরিচয় 

লাতিন অনেক শব্দই বেশ সহজে চেনা যায়। গোড়াতেই সেরকম একটির কথা বলা যাক:

‘femina’

সহজেই অনুমেয়, শব্দটির মানে ‘নারী’। সারা দুনিয়ার নানান দেশে এই নামে মেয়েদের পত্রিকা বেরোয়, তাছাড়া, এ-নামে একটা সুগন্ধীর ব্র্যান্ডও আছে বৈকি। তারপর আছে সেটার সঙ্গে সম্পর্কিত আরো কিছু শব্দ, যেমন, ‘feminine’, ‘female’, ‘feminist’। আর এই শব্দটির সঙ্গে ফরাসি ‘femme’, মানে, ‘নারী’ শব্দটির সম্পর্ক খুঁজে পেতে খুব বেশি কল্পনা শক্তি লাগে বলে মনে হয় না। ভাষা নিয়ে — বিশেষ করে যে-ভাষা লাতিনের মতন এমন বহুবিস্তৃত, নানান শাখা-প্রশাখা ছড়ানো — তা নিয়ে নাড়াচাড়া বা চর্চা করার সময় প্রায়ই ঘটে এমনটি। লাতিন শব্দ কখনো কখনো একেবারে আনাম, নিটোলভাবেই ধার নেয়া হয়। বেশ ভারি ভারি, বিমূর্ত শব্দের অংশ হিসেবেও মাঝে মাঝে দেখা মেলে তাদের। ইংরেজি ভাষা প্রচুর ধার-কর্জ করেছে লাতিনের কাছ থেকে, এবং প্রায়-ই তা ফরাসির মধ্যস্থতায়। তাছাড়া, ফরাসি, হিস্পানি , ইতালীয় ভাষার সঙ্গে তো আরো বেশি মিল আছে লাতিনের — কারণ লাতিন থেকেই যে জন্ম ওই ভাষাগুলোর।

কাজেই, কারো ইংরেজি শব্দভাণ্ডার যদি ভালো হয় তাহলে তিনি যে সেই সঙ্গে বেশ কিছু লাতিন শব্দও জানেন তা আর বলে দেবার দরকার পড়ে না; আর যিনি হিস্পানি  বা ফরাসিভাষী তিনি তো জানবেন আরো বেশি। তবে কথাটি উল্টোভাবেও সত্যি। লাতিনের একটি প্রাথমিক শব্দভাণ্ডার যাঁর আয়ত্তে তিনি অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার অনেক শব্দ ঢের বেশি সহজে বুঝতে পারবেন।

আরো খানিকটা এগনো যাক তাহলে লাতিন নিয়ে।

‘femina clara’

এটা অবশ্য একটু কঠিন, যদিও ‘Claire’ আর ‘Clara’ ইংরেজি নাম, আর ‘clear’ লাতিন থেকে ধার করে পাওয়া (ফরাসি হয়ে)। লাতিনে শব্দটা সাধারণত বোঝাত ‘আলো’ বা ‘উজ্জ্বল’, যেমন ইংরেজিতে ‘a clear day’-তে বোঝায়। অবশ্য সেই সঙ্গে সেটা ‘ঝকঝকে’ বা ‘ বিখ্যাত’-ও বোঝাত। কাজেই ‘femina clara’ মানে হলো ‘a famous woman’ — ‘এক বিখ্যাত নারী’।

এই উদাহরণ থেকে আরেকটা ব্যাপার বোঝা যায়, আর তা হলো, লাতিন বাক্যে শব্দের ক্রম ইংরেজি বাক্যের শব্দক্রমের চাইতে ভিন্ন। সাধারণত,  একটি বিশেষণ — যেমন ‘clara’ — যে-শব্দকে বিশেষায়িত করে সেটার পরে বসে। {মজার বিষয় হল, সেমিটিক ভাষা আরবিতেও তাই — সাইয়েরা (গাড়ি)  জেদিদ (নতুন) = নতুন গাড়ি। ইংরেজিতে কিন্তু তার উল্টো, বলাই বাহুল্য:  new car — অনুবাদক}। এই একই শব্দক্রমটা দেখা যাবে এই পর্বের শিরোনামের শব্দবন্ধটায় (phrase): lingua latina। ইংরেজি ‘linguistics’ (ভাষাবিজ্ঞান) থেকে, অথবা খোদ ‘language’, বা ফরাসি শব্দ ‘langue’ (language) থেকে অনেকেই অনুমান করে নিতে পারেন যে ‘lingua’ মানে ‘language’। আর, ‘latina’ শব্দটির অর্থ যে ‘লাতিন’ সেটা তো জলের মতো পরিষ্কার। অতএব,  গোটা শব্দবন্ধ  ‘lingua latina’-র মানে দাঁড়াচ্ছে, ‘লাতিন ভাষা’ (the Latin language)।

‘lingua latina’ বা ‘femina clara’-র ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে এ-প্রশ্ন উঠতে পারে যে লাতিন কথা দুটোয় তো ইংরেজি ‘the’ বা definite article-এর তুল্যমূল্য কিছু নাই। লাতিন শব্দবন্ধ ‘femina clara’-র অনুবাদ করা যেতে পারে ‘a famous woman’ (এক / জনৈকা বিখ্যাত নারী ) বা ‘the famous woman’ (বিখ্যাত নারীটি) দুভাবেই, এবং সেটা নির্ভর করবে কন্টেক্সট বা বাক্যের প্রসঙ্গর ওপর। সত্যি বলতে কি, দুনিয়ার অধিকাংশ ভাষায় এটাই হলো গিয়ে কেতা। ডেফিনিট ও ইন্ডেফিনিট আর্টিকলের দেখা মেলে মোটের ওপর ইংলিশ, জার্মান আর ফরাসির মতো আধুনিক পশ্চিম ইউরোপীয় ভাষাগুলোতে।

লাতিন কিছু শব্দের দিকে তাকালে চট করে একটা ধারণা পাওয়া যাবে কোনটা সহজ আর কোনটা কঠিন। দেখা যায়, শব্দগুলোর অনেকেই আমাদের পরিচিত, বা অন্তত প্রায়ই কোনো লাতিন শব্দের সঙ্গে আপনি আপনার জানা কোনো ইংরেজি শব্দের কিছু মিল খুঁজে পাবেন। কিন্তু লাতিন এই শব্দগুলোকে জোড়া দিয়ে কি করে শব্দবন্ধ বা বাক্য রচনা করবেন — মানে ভাষাটির ব্যাকরণ — তা কিন্তু ইংরেজিতে এক্ষেত্রে যেসব নিয়ম প্রযোজ্য তা থেকে বেশ আলাদা।

আমরা যাকে রোমক বর্ণমালা বলি, লাতিন সেই বর্ণমালাতেই লেখা হয়, আর আমরা সবাই জানি ইংরেজি এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় ভাষার বেলাতেও কথাটি প্রযোজ্য। আমাদের স্ক্রিপ্ট আদতে তৈরি হয়েছিল লাতিন লেখার জন্যই, কাজেই হরফগুলো মোটামুটিভাবে সে-ভাষার ধ্বনির সঙ্গে বেশ ভালভাবেই মিলে যায়। এ-অব্দি যে-কটা শব্দের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে (femina, clara, lingua, Latina) সেগুলোর উচ্চারণ আমাদের প্রত্যাশার কাছাকাছি-ই বটে।

তবে অবশ্যই তফাত কিছু আছেই। প্রাচীন যুগের লাতিনে ‘c’ হরফটি ব্যবহৃত হতো সেই ধ্বনিটির প্রতিনিধি হিসেবে যা ইংরেজিতে ‘k’ দিয়ে বোঝানো হয় এংলো-স্যাক্সন উৎসজাত কিছু শব্দ, যেমন, ‘kill’ বা ‘king’-এর ক্ষেত্রে। ফরাসি প্রভাবের ফলে ‘c’-এর এই ব্যবহারটি রয়ে গেছে লাতিন উতসজাত ‘clear’ ও ‘castle’-এ, তবে তার পরে ‘e’ বা ‘i’ থাকলে সেখানে উচ্চারণটি হয়ে যায় [s] এর মতো (যেমন, celebrity, circle)। রোমকরা কখনো ‘c’ হরফটিকে ‘s’- ধ্বনি হিসেবে ব্যবহার করেনি; কাজেই লাতিন থেকে আসা অনেক শব্দ আমরা যেভাবে উচ্চারণ করি তা শুনলে অবাক-ই হতো তারা।

যেমন ধরুন, ‘cell’ শব্দটি উচ্চারণের সময় আমরা গোড়াতে একটা ‘s’- ধ্বনি ব্যবহার করি, যদিও সেটা লাতিন ‘cella’, মানে,  ‘কামরা, কক্ষ’ (room)-র ইংরেজি সংস্করণ, যেটা রোমকরা একটি প্রাথমিক [k] দিয়ে উচ্চারণ করত। লাতিন নাম ‘Cicero’ (যেটা রোমকরা মোটামুটি ‘কিকেরোও’-র মতো উচ্চারণ করত), ‘Caesar’  আর ‘Cecilia’-র বেলাতেও একই কথা খাটবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে, বৃটেন ও উত্তর ইউরোপে লাতিনের আধুনিক উচ্চারণ প্রাচীন কেতাগুলোকেই মেনে আসছে এবং ‘c’ বানান করা হয় এমন সব শব্দে ‘k’-ধ্বনি-ই ব্যবহার করা হয়।

কেন এসব পার্থক্য হচ্ছে তা বলতে গেলে খানিকটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দরকার পড়ে বৈ কি। কিন্তু সেগুলো পরে দেখা যাবে। লাতিনের উচ্চারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কিভাবে বদলে গেছে তার সঙ্গে এ-বিষয়টা জড়িত। আপাতত কেবল প্রাচীন রোমকরা কিভাবে তাদের ভাষার শব্দগুলো উচ্চারণ করতো সেদিকে একটু নজর দেয়া যাক।

স্বরবর্ণের ক্ষেত্রেও ইংরেজি আর লাতিনে অল্প-বিস্তর ফারাক আছে। লাতিনে পাঁচটি স্বরবর্ণ  — a, e, i, o এবং u; আধুনিক হিস্পানি এবং ইতালীয়তে এরা যেভাবে উচ্চারিত হয়, লাতিনেও এ-অক্ষরগুলো মোটামুটি সেভাবেই উচ্চারিত হতো। এই যেমন, রোম শহরের নাম ‘Roma’ শব্দটার কথাই ধরা যাক। এটি রোমকরা নিশ্চয়ই অনেকটা সেভাবেই উচ্চারণ করতো যেমনটা সেখানে বসবাসরত ইতালীয়রা করে থাকে আজ। একইভাবে, ‘casa’ (বাড়ি), ‘tu’ (তুমি), আর ‘luna’ (চাঁদ) — আধুনিক এই ইতালীয় বা হিস্পানি শব্দগুলো চিনতে বা বুঝতে রোমকদের খুব একটা অসুবিধা হতো না, কারণ, শব্দগুলোর উচ্চারণ গত দু’হাজার বছরে বদলায়নি বললেই চলে।

ইংরেজি শব্দ ‘wine’-এর ‘i’ এবং ‘fate’-এর ‘a’-তে যে সন্ধ্যক্ষর বা বা dipthong-এর মতো উচ্চারণ রয়েছে লাতিনের একক স্বরবর্ণগুলোর সেরকম কোনো উচ্চারণ না থাকলেও সেখানে তিনটে স্বরবর্ণের ক্রম রয়েছে যেগুলো সন্ধ্যক্ষরের মতোই উচ্চারিত হয়: যেমন, ‘ae’, যা উচ্চারিত হয় মোটামুটি ইংরেজি ‘I’-এর মতো, ‘oe’, ইংরেজি ‘boy’-এ যেমন, আর ‘au’, ইংরেজি ‘loud’-এ যেমন।

তো, এই ‘অল্পবিদ্যা’ দিয়েই প্রাচীন নিয়ম-কানুন মোতাবেক শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা যাবে লাতিন শব্দগুলো। যেমন, ‘Caesar’-এর রোমক উচ্চারণ ছিল আধুনিক জার্মানের ‘Kaiser’ (কাইযার, সম্রাট)-এর উচ্চারণের খুব কাছাকাছি, এবং সম্ভবত তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ দ্বিতীয় শব্দটি জার্মানরা লাতিন থেকেই ধার নিয়েছে।

মোদ্দা কথা, নিয়মটা হলো, প্রতিটি অক্ষরকে সেটা যা তার মতোই উচ্চারণ করা, আর, প্রতিটি হরফ সবক্ষেত্রে একইভাবে উচ্চারণ করা, ঠিক যেমন ইংরেজি ‘m’ আর ‘p’-এর বেলায় করা হয়।”

 

রোমের আদিকাল

লাতিনের দীর্ঘ ইতিহাসের শুরু মোটামুটি ২৭০০ বছর আগে। একটি ভাষা কিভাবে কোথায় আবির্ভূত হয় সে হদিসটি সবসময় খুব পরিষ্কার না হলেও লাতিনের ক্ষেত্রে উৎসভূমির ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। গোড়াতে ভাষাটি রোম নগর আর তার আশেপাশেই প্রচলিত ছিল। রোমকদের নিজেদের নানান গল্প-গাথা আর কিংবদন্তী বলছে নগরটির পত্তন হয়েছিল ৭৫৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দে। আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদ আর ইতিহাসবেত্তারা মনে করেন তারিখটা সত্যের বেশ কাছাকাছি। ধারণা করা হয়, খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে এমন একটি স্থানে ছোট্ট এক বসতি গড়ে উঠেছিল যা গোটা প্রাচীন যুগ ধরেই পরিচিত হবে রোমের কেন্দ্র হিসেবে — Forum Romanum বা রোমক চত্বর (?)। চত্বরটির একটি প্রান্ত খানিকটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে প্যালাতাইন পাহাড়ের দিকে, যেখানে এখনো দেখা মিলবে ‘Via scara’ বা ‘পবিত্র পথের’; নানান শোভাযাত্রা বা মিছিল হতো সেখানে। এই পথের পাশে প্রাচীন কিছু কুঁড়েঘরের ভগ্নাবশেষও পাওয়া গেছে।

ছোট্ট এই নগরে যে-জনগোষ্ঠী বাস করতো তাদের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না আমরা। তবে এটুকু বলা যায় যে তাদের ভাষা ছিল লাতিনের একটি প্রাচীন রূপ। প্রথম কয়েক শতাব্দী সম্ভবত সেটা ছিল নেহাতই একটা কথ্য ভাষা, তবে শিগগিরি নিশ্চয়ই লেখালেখির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল সে-ভাষাতে। Forum Romanum-এর একটি পাথরের গায়ে একটি উৎকীর্ণ লিপি রয়েছে, আর সেটা খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের বলে জানা গেছে। বেশ ভগ্নদশা সেই পাথরটির, লেখাটার পাঠোদ্ধার পুরোপুরি করা যায়নি, কিন্তু হরফগুলো যে লাতিন তা বোঝা যায়, আর ভাষাটা যে লাতিন তা-ও পরিষ্কার। কাজেই আমরা বলতে পারি, লাতিন ভাষার লেখ্যরূপ অন্তত আড়াই হাজার বছর পুরানো।

গোড়ার দিকের কয়েক শতাব্দীতে মাত্র কয়েক হাজার লোকের ছোটো একটি অনুল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী ছিল রোমকরা, যেমনটা সে-সময়ে আরো বেশ কয়েকটি ছিল ইতালিতে। Latium বলে একটি অঞ্চলে ছিল তারা; স্থানটির নাম কার্যত এখনো তাই। ইতালীয়তে সেটিকে বলে Lazio, বিখ্যাত রোমক ফুটবল টিমের নামের মতোই একেবারে। উত্তরে ছিল এট্রুস্কানেরা; তারা যেখানে থাকত সে-জায়গাটার নাম এখন তাস্কেনি, জনসংখ্যায় আর ক্ষমতার দিক দিয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তারা রোমকদের চাইতে।

একথা বলার অবকাশ রাখে না যে, লাতিন ভাষার সেই আদি দিনগুলোতে রোমের জীবন ঠিক কেমন ছিল তা জানা যায় না। তবে নগরটি যে নানান ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ছিল সেকথা ঠিক। আমরা অনেকেই জানি যে কিংবদন্তি অনুযায়ী, রোমুলাস নামে কেউ একজন রোম নগরীটি পত্তন করেন, আর তা করতে গিয়ে সহোদর রেমাসকে হত্যা করেন তিনি। তাঁরা যখন শিশু, তখন মেরে ফেলার জন্য এক নির্জন স্থানে রেখে আসা হয়েছিল তাদের, কিন্তু এক স্ত্রী-নেকড়ে স্তন্য দান করে তাদের প্রাণ বাঁচায় এবং পরে তাদেরকে নিরাপদ একটি আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সেকারণেই নগরটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকগুলোর একটি হচ্ছে স্ত্রী-নেকড়ে, যেটার একটি খুবই প্রাচীন ব্রোঞ্জ মূর্তি এখনো রাখা আছে। নগর পত্তন করার পর নগরটির ‘rex’ বা রাজা হন রোমুলাস। একই শব্দমূল রয়েছে লাতিন ‘regina’ (রানী, queen)-তে; সেটা আরো দেখা যায় ইংরেজি শব্দ ‘regent’-এ (যিনি রাজা বা রানীর বদলে বা হয়ে শাসন করেন) ও ‘regal’-এ (রাজকীয়, রাজোচিত)।

রমুলাসের পর ছয় ছয় জন রাজা আসেন, কিন্তু ৬ষ্ঠ জনকে সিংহাসনচ্যুত করা হয়, এবং তারপর এক নতুন ধরনের শাসনপদ্ধতি চালু হয়। ধারণা করা হয় যে, ৫০৯ খৃষ্ট পূর্বাব্দে ঘটনাটি ঘটে, আর ঐতিহাসিকভাবে তারিখটি যথাসম্ভব সঠিক বলেই স্বীকৃত।

রোমকদের কাছে রাজা খুব একটা কাম্য বা আহ্লাদের বস্তু ছিল না। রাজার হাতে শাসিত হওয়াকে তারা একরকম দাসত্ব বলেই গণ্য করত। যে-সব রাষ্ট্রে সে-ধরনের সরকার বা শাসনব্যবস্থা ছিল সেগুলোকে হীন চোখেই দেখত তারা। তাদের নিজেদের রাষ্ট্র ৫০৯ খৃষ্টাব্দ থেকেই ছিল একটি রিপাবলিক বা ‘res republic’, যার আক্ষরিক মানে ‘জনগণের বিষয় বা বস্তু’।

একটি ‘res republic’-এ সর্বোচ্চ ক্ষমতা রাজার হাতে থাকত না, বরং নীতিগতভাবে তা থাকত ‘populas’ বা জনগণের হাতে। ইতিহাসে বারবার নানান চেহারায় এ-ধরনের রাষ্ট্রের ধারণা দেখতে পাই আমরা। ফরাসি বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা রোমক রিপাবলিককে একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ বা নমুনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বেশ আশাবাদের সঙ্গেই এই ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন: ‘জনগণের সরকার, জনগণের তৈরি সরকার, জনগণের জন্য সরকার, পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে না।’ এই ধারণা আর মূল শব্দ দুটোই রোমকদের কাছ থেকে পাওয়া। কারণ, ইংরেজি শব্দ ‘people’ এসেছে লাতিন ‘populus’ থেকে, ফরাসি ‘peuple’ হয়ে।

আসলে রোমকদের যা ছিল তাকে গণতন্ত্র বলা কঠিন। রোমক রিপাবলিকের সবচাইতে বড় দাপ্তরিক পদে থাকতেন দু’জন, এবং তাঁদের কার্যকালের মেয়াদ থাকত প্রতিবারে এক বছর। কন্সাল (consul) বলা হতো তাঁদের। এই শব্দটি এখন সরকারের কূটনৈতিক বিভাগের একটি শাখার এক দপ্তরের নাম। জনগণের একটি সাধারণ সভাতে —  যাকে গণপরিষদ বলা হতো — সেখানে সাধারণ মানুষ এই কন্সালদের নির্বাচিত করতেন। নিজেদের মেয়াদকালে যথেষ্ট ক্ষমতা ধরতেন এই কন্সালরা, কিন্তু তাঁরা যেহেতু মাত্র এক বছরের অল্প সময়ের জন্য নির্বাচিত হতেন, এবং দুজনের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে কাজ করতে হতো তাঁদেরকে, তাই তাঁরা কেউই আসলে বেশিদিনের জন্য রাজনীতিতে আধিপত্য করতে পারতেন না।

রাজতন্ত্রের পর রোমে আসলে শুরু হয়েছিল ‘senatus’ নামের একটি পরিষদের শাসন। রোমক সিনেট গঠিত হতো কয়েকশ জনকে নিয়ে (সেটার ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা গেছে এই সংখ্যাটা থেকেছে ৩০০ থেকে ১০০০ জনের মধ্যে), এবং তাঁরা গণ পরিষদের সভ্যদের দ্বারা বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে নির্বাচিত হতেন। সিনেটে সদস্যরা হতেন কেবল তারাই যাঁরা সরকারী নানান দপ্তরের বিভিন্ন পদাধিকারী ছিলেন; যেমন, প্রাক্তন সব কন্সালই সিনেটের সদস্য হিসেবে থাকতেন। তাঁরা সবাই মাত্র এক বছরের জন্য বহাল থাকলেও, একবার সিনেটের সভ্য হওয়ার পর সারা জীবনই সেই সম্মান পেতেন তাঁরা। সিনেটই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতো।

আজ অনেক দেশেই সিনেট নামের রাজনৈতিক পরিষদ রয়েছে, আর সেসবের মধ্যে সবচাইতে পরিচিত নিশ্চয়ই মার্কিন সিনেট। মার্কিন এই প্রতিষ্ঠানটিকে যে এই নামে ডাকা হয় তাতেই পরিষ্কার বোঝা যায় মার্কিন সংবিধান রচনার সময় রোমক আদর্শ কতোটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছিল। লাতিন শব্দ ‘senatus’ আর ‘senex’ (বৃদ্ধজন) একই শব্দমূলের অধিকারী, কাজেই প্রথম কথাটির আদি অর্থ ছিল অনেকটা ‘বৃদ্ধদের সভা’। আর, সিনেট সদস্যরা যেহেতু আজীবন সেই পদে বহাল থাকতেন কাজেই সে-নামটি যে যথার্থই ছিল তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।

রোম তার ইতিহাসের প্রথম পর্বে উত্তরের প্রতিবেশী অর্থাৎ এট্রুস্কানদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল, আর রাজাদের বেশ কয়েকজনই ছিলেন এট্রুস্কান। রাজতন্ত্র থেকে রিপাবলিকে পালাবদলের সময় এই এট্রুস্কানদের কাছ থেকেও মুক্ত হতে হয়েছিল রোমকদের, আর তারপর থেকেই প্রকৃতপক্ষে শুরু তার আধিপত্য বিস্তারের পালা।

(ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

৫ comments

  1. মাসুদ করিম - ১ অক্টোবর ২০১৪ (৩:০৬ অপরাহ্ণ)

    গোটা প্রাচীন যুগ ধরেই পরিচিত হবে রোমের কেন্দ্র হিসেবে — Foum Romanum বা রোমক চত্বর (?)। চত্বরটির একটি প্রান্ত খানিকটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে প্যালাতাইন পাহাড়ের দিকে, যেখানে এখনো দেখা মিলবে ‘Via scara’ বা ‘পবিত্র পথের’; নানান শোভাযাত্রা বা মিছিল হতো সেখানে। এই পথের পাশে প্রাচীন কিছু কুঁড়েঘরের ভগ্নাবশেষও পাওয়া গেছে।

    হ্যাঁ, ওই ফোরুম আমার দেখা পৃথিবীর অসাধারণ জায়গাগুলোর একটা – এত প্রাচীন অথচ এত কাছের খুব কম জায়গাই আমি এজীবনে দেখেছি। আচ্ছা, আমি ভুল করছি না তো ফোরুমই ( FORUM) তো হবে, তাই না?

  2. জি এইচ হাবীব - ১৭ অক্টোবর ২০১৪ (৮:২২ অপরাহ্ণ)

    দুঃখিত, মাসুদ ভাই, বিলম্বিত উত্তরের জন্য। প্রথম কিছুদিন খেয়াল রেখেছিলাম কেউ কোনো মন্তব্য করেন কিনা, তার জবাব দেবার জন্য। যাই হোক, ঠিক-ই বলেছেন আপনি আমার জানামতে। শব্দটার উচ্চারণ ‘ফোরুম’-ই। অনেক ধন্যবাদ।

    • মাসুদ করিম - ১৮ অক্টোবর ২০১৪ (৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ)

      তাহলে তো বানানটা ঠিক করতে হবে – পোস্টে Foum লেখা, Forum করতে হবে।

  3. জি এইচ হাবীব - ২০ অক্টোবর ২০১৪ (১১:৩২ পূর্বাহ্ণ)

    ঠিক করা হয়েছে। অসংখ্য ধন্যবাদ।

  4. জিয়া আরেফিন আজাদ - ৩ জানুয়ারি ২০১৬ (২:০১ অপরাহ্ণ)

    ভাল লাগল। লেখকের কাছ থেকে ল্যাতিন ও বর্তমানে ইতালীদেশে প্রচলিত ইতালীয় ভাষার সম্পর্কে জানতে চাই।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.