ই. এইচ. গম্‌ব্রিখ্-এর শিল্পকথা : ১

যে যা-ই বলুন, দ্য স্টোরি অভ আর্ট-এর মতো বই অনুবাদে হাত দেয়া আমার জন্যে অপরাধের শামিল। কিন্তু আমি সেই অপরাধ না করে থাকতে পারিনি। কেন পারিনি সেটা বইটির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা তো খানিকটা উপলব্ধি করতে পারবেনই, এমনকী যাঁরা পরিচিত নন কিন্তু আমার এই ব্যর্থ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে পরিচিত হতে চাইবেন তাঁরাও বুঝতে পারবেন। [...]

গোড়াতেই নিজের কথা, অর্থাৎ, ব্যক্তিগত একটি সংকোচের কথা না বললে নিজের কাছেই আমাকে জড়োসড়ো হয়ে থাকতে হবে।

যে যা-ই বলুন, দ্য স্টোরি অভ আর্ট-এর মতো বই অনুবাদে হাত দেয়া আমার জন্যে অপরাধের শামিল। কিন্তু আমি সেই অপরাধ না করে থাকতে পারিনি। কেন পারিনি সেটা বইটির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা তো খানিকটা উপলব্ধি করতে পারবেনই, এমনকী যাঁরা পরিচিত নন কিন্তু আমার এই ব্যর্থ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে পরিচিত হতে চাইবেন তাঁরাও বুঝতে পারবেন। তবে, এরকম একটি অপরাধের গুরুতর প্রভাব আছে বলেই পাঠকের দরবারে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো — এটি নিতান্তই এ অভাজনের ব্যক্তিগত মত — এ-ভাষায় অনুবাদ করার মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি রয়ে গেছে যে বিষয়বস্তু এবং আয়তন, দু দিক থেকেই ওজনদার একটি বইয়ের একাধিক অনুবাদ করাটা আপাতত আমাদের জন্য বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে (লেখা বাহুল্য, দ্য স্টোরি অভ আর্ট সেরকমই একটি কিতাব)। কাজেই, শিল্পকলা বিষয়ে আমার মতো আনপড় লোকের হাতে দ্য স্টোরি অভ আর্ট অনুবাদ না হওয়াই ভালো ছিল। তাহলে যোগ্য কোনো ব্যক্তির হাতে বইটির যথাযোগ্য সমাদর হতো। কিন্তু এখন আর সেটি হওয়ার উপায় থাকলো না, সম্ভবত। আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলে আনন্দিত হওয়ার একটি উপলক্ষ পাবো।

কথাগুলো বিনয় বলে মনে করলে, পাঠক, আপনারা আমার ওপর অবিচার করবেন। বাংলাদেশে এটা একটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। যিনি যে কাজের জন্য উপযুক্ত তিনি তা না করে অন্য কাজ করেন। তাঁদের বেশিরভাগের সঙ্গেই আমার তফাৎ হচ্ছে তাঁরা সেজন্যে সংকোচ বোধ করেন না, আমি করি।

বইটি সম্পর্কে আমার আপাতত বিশেষ কিছু বলার নেই, অনেক কারণেই; তার একটি হচ্ছে, সে চেষ্টা না করে অনুবাদটি পাঠযোগ্য করার ব্যাপারেই আমার উৎসাহ বেশি। আর, সেই ইংরেজি প্রবাদটি তো আপনাদের জানাই আছে: “the proof of the pudding is in the eating”, তা সেটা অনুবাদের মাধ্যমে খাওয়া হলেও; মানে বলতে চাইছি, আরেকটি প্রবাদের শরণ নিয়ে, ধ্বংসাবশেষ দেখেই বোঝা যায় ইমারতটি একদা জাঁদরেল ছিল।

কিছুদিন আগে খানিকটা কৌতূহলবশেই ইউটিউবে গিয়ে বইটির নাম লিখে অনুসন্ধান করেছিলাম। যা পেলাম তা অপ্রত্যাশিত। প্রথমে পাওয়া গেলো একটি অডিওবুক-এর খবর। সেটিও মহামতি গম্‌ব্রিখ্ বিরচিত: আ লিটল হিস্ট্রি অভ্ দ্য ওয়ার্লড। তার নিচে দ্য স্টোরি অভ্ আর্ট বইটির পরিচ্ছেদ ধরে ধরে আলোচনার প্রায় মিনিট নয়ের একেকটি ভিডিও, একেকটি অধ্যায়ের জন্যে একাধিক ভিডিও। এটি চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদের একটি লিংক

কাজটি শুরু করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে, চট্টগ্রাম থেকে সদ্য-যাত্রা-শুরু-করা দৈনিক সুপ্রভাত নামের একটি পত্রিকায়। ধারাবাহিকভাবে প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয় লেখাটি কয়েক মাস ধরে। তারপর অনিবার্য কারণবশত তাতে ছেদ পড়ে। পরে আরো খানিকটা অংশসহ বইটির আংশিক অনুবাদ ছাপা হয় অধুনা প্রকাশনারহিত দৈনিক আজকের কাগজ-এর সাহিত্য সাময়িকী ‘সুবর্ণরেখা’-র ঈদ সংখ্যায়। আশা করছি এ-যাত্রা ‘মুক্তাঙ্গন’-এর সুবাদে কাজটি শেষ করতে পারবো। পাঠককে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
. . .

দ্য স্টোরি অভ্ আর্ট-কে শিল্পবিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর অন্যতম বলে অভিহিত করলে সম্ভবত অত্যুক্তি করা হয় না। এ-দাবির পক্ষে একটি জোরালো যুক্তি হচ্ছে, ১৯৫০ সালে প্রথম জনসমক্ষে উপস্থিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বইটির প্রায় ষাট লক্ষ কপি ক্রেতাদের হাতে গেছে, এবং প্রক্রিয়াটি ঘটমান বর্তমান।

আদিমতম গুহাচিত্র থেকে শুরু করে হাল আমলের নিরীক্ষামূলক শিল্প, অর্থাৎ সামগ্রিক শিল্প বিষয়ে একটি পরিচিতি বা উপক্রমণিকা হিসেবে নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে গ্রন্থটি। পৃথিবীর সব বয়সের এবং শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পাঠকই এ-গ্রন্থের রচয়িতা স্যার ই. এইচ. গম্‌ব্রিখ্-কে আবিষ্কার করেছেন এক প্রকৃত শিল্পী হিসেবে যিনি শিল্প সম্পর্কে তাঁর গভীর অনুরাগ স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করার এক বিরল গুণের সঙ্গে নিজের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অসাধারণ সম্মিলন ঘটিয়েছেন।

গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য, লেখক বলেছেন, ‘আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী সব গ্রন্থের পাতায় ভিড় করে থাকে যেসব নাম, সময় আর শৈলীর ঐশ্বর্য, তার মধ্যে একটি বোধগম্য শৃঙ্খলা আনা।’ দৃশ্যশিল্পের (ভিযুয়াল আর্ট)-এর মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে লেখক তাঁর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে শিল্পের ইতিহাসকে এমনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যাতে আমরা সেটাকে দেখতে পাই, ‘বিভিন্ন ঐতিহ্যের একটি নিরন্তর বুনন এবং পরিবর্তন’ হিসেবে, ‘যেখানে প্রতিটি শিল্পকর্মই অতীতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে’; অর্থাৎ, বলা যায়, তিনি শিল্পের এই ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন ‘আমাদের সময়কে পিরামিড যুগের সঙ্গে যুক্তকারী একটি সজীব পরম্পরা’ হিসেবে।

লেখক পরিচিতি:

বিগত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সবচেয়ে খ্যাতনামা শিল্প-ইতিহাসবিদ্ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক স্যার আর্নস্ট হান্স জোসেফ গম্‌ব্রিখ্ (Ernst Hans Josef Gombrich) ১৯০৯ সালে ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে থেরেসিয়ানাম, পরে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড ইন্সিটিটিউট অভ্ আর্ট হিস্ট্রি-তে জুলিয়াস ভন শ্লসার-এর কাছে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৩৬ সালে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগ দেন লন্ডনের ওয়ার্বার্গ ইন্সিটিউট-এ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিও মনিটর হিসেবে কাজ করেন বিবিসি-তে; যুদ্ধ শেষ হলে ফের যোগ দেন ওয়ার্বার্গ ইন্সিটিউট-এ। এই প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালক পদে বৃত হন ১৯৫৯ সালে। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজ্ঞ; মা এবং স্ত্রী দু’জনেই প্রতিভাধর পিয়ানোবাদক। ভিয়েনা কনযার্ভেটয়ারে তাঁর মা বিশ্বখ্যাত অস্ট্রীয় সুরস্রষ্টা আর্নল্ড শ্যেনবার্গ (১৮৭৪-১৯৫১)-এর সঙ্গে মাঝে মাঝে পিয়ানো বাজাতেন; গম্‌ব্রিখ্ নিজেও ছিলেন একজন ভালো চেলোবাদক।

১৯৭২ সালে নাইট উপাধি পান তিনি। ১৯৮৮ সালে ভূষিত হন ‘অর্ডার অভ্ মেরিট’ খেতাবে। ২০০১ সালের ৩রা নভেম্বর ৯২ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

তাঁর অন্যান্য বিশ্ববিশ্রুত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আর্ট অ্যান্ড ইল্যুশন: আ স্টাডি ইন দ্য সাইকোলজি অভ্ পিক্টোরিয়াল রিপ্রেজেন্টশন (১৯৬০), আ সেন্স অভ্ অর্ডার: আ স্টাডি ইন দ্য সাইকোলজি অভ্ ডেকোরেটিভ আর্ট (১৯৭৯), আর সেই সঙ্গে এগার খণ্ডের প্রবন্ধসংগ্রহ এবং রিভিউ।

মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন পূর্বে তিনি প্রেফারেন্স ফর দ্য প্রিমিটিভ্ নামের একটি গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করেন, যা ২০০২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়। বইটি তাঁর দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসল।

দ্য স্টোরি অভ্ আর্ট সম্পর্কে হ্রস্ব বা দীর্ঘ প্রশস্তিমূলক বাক্যের অন্ত নেই। আমরা কেবল উদ্ধৃত করছি প্যারিসে অবস্থিত Musée du Louvre-এর প্রেযিডেন্ট ডিরেক্টর পিয়ের রোজনবার্গ-এর একটি ছোট্ট উক্তি:

প্রায় মোনা লিসা-র মতোই বিখ্যাত, স্যার আর্নস্ট গম্‌ব্রিখ্-এর দ্য স্টোরি অভ্ আর্ট ঘটিয়েছে বৈদগ্ধ্য আর আনন্দের মেলবন্ধন।

. . .

শিল্পকথা
ই. এইচ. গম্‌ব্রিখ্

ভূ মি কা

একটি বিচিত্র ও আকর্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক দিক নির্দেশনার প্রয়োজন অনুভব করছেন এমন সবার জন্যে রচিত হয়েছে এই গ্রন্থটি। নবাগতদেরকে ছোটখাট নানান খুঁটিনাটি বিষয় দিয়ে হতবিহ্বল না করে গ্রন্থটি হয়ত তাঁদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে; আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী সব গ্রন্থের পাতায় পাতায় ভিড় করে থাকে যেসব নাম, সময় এবং শৈলীর ঐশ্বর্য সেসবের মধ্যে যাতে তাঁরা একটি বোধগম্য শৃঙ্খলা আনতে পারেন সে-বিষয়ে তাঁদেরকে সক্ষম করবে এবং যাতে তাঁরা এ-বিষয়ে আরো উন্নত বইপত্র ঘাঁটতে পারেন তার জন্যে উপযুক্ত করে তুলবে। গ্রন্থটি রচনার সময় আমি মুখ্যত তের থেকে উনিশ বছর বয়েসী সেই সমস্ত পাঠকের কথা ভেবেছি নিজে থেকেই যারা সদ্য আবিষ্কার করেছে শিল্পজগৎটি। তবে আমি কখনোই মনে করিনি যে তরুণদের জন্যে রচিত গ্রন্থ বয়স্কদের গ্রন্থ থেকে পৃথক হবে, শুধু এই বিষয়টি ছাড়া যে এসব গ্রন্থকে সবচেয়ে কঠোর সমালোচকের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে, সেই সমস্ত সমালোচক যাঁরা ভণিতাপূর্ণ, বিশেষগোষ্ঠী ব্যবহৃত ভাষা বা অর্থহীন মনোভাব শনাক্ত করতে এবং সেটার প্রতি বিরাগ পোষণ করায় তৎপর। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এগুলো এমনই ত্রুটি যা পাঠককে তার বাকি জীবনের জন্যে শিল্প সম্পর্কিত সমস্ত রচনার ব্যাপারে সন্দিহান করে তোলে। এই ত্রুটিগুলো এড়িয়ে চলবার আন্তরিক চেষ্টা করেছি আমি, চেষ্টা করেছি সহজ-সরল ভাষা ব্যবহারের, এমনকী সেটাকে সুচিন্তিত এবং পেশাদারী বলে মনে না হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও। অন্যদিকে অবশ্য, চিন্তার দুরূহতা আমি পরিহার করিনি। কাজেই আশা করি শিল্পবেত্তারা গতানুগতিকভাবে যে পরিভাষা ব্যবহার করেন তার ন্যূনতম অংশ ব্যবহারের পক্ষে আমার সিদ্ধান্তকে পাঠকেরা তাঁদের সঙ্গে ‘মুরুব্বীয়ানার সুরে কথা বলার’ কোনো ইচ্ছাপ্রসূত বলে মনে করবেন না। কারণ, পাঠককে আলোকিত নয় বরং মুগ্ধ করার জন্যে যাঁরা বৈজ্ঞানিক ভাষার অপব্যবহার করেন তাঁরাই কি উচ্চাসনে বসে আমাদের সঙ্গে মুরুব্বীয়ানার সুরে কথা বলছেন না?

এই গ্রন্থ রচনার সময় পারিভাষিক শব্দের সংখ্যা সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত ছাড়াও আরো কিছু বিশেষ স্বআরোপিত বিধি মেনে চলার চেষ্টা করেছি আমি, যার সব ক’টিই গ্রন্থটির রচয়িতা হিসেবে আমার জীবনকে কঠিন করে তুলেছে, যদিও পাঠকের জীবনকে তা খানিকটা সহজতর করলেও করতে পারে। এসব বিধির প্রথমটি ছিল, সেসব কাজ সম্পর্কে লিখবো না যেগুলোকে আমি চিত্রসহ উপস্থিত করতে পারবো না; আমি চাইনি লেখাটি স্রেফ কিছু নামের একটি তালিকায় পর্যবসিত হোক, যে নামগুলো — যাঁরা সেগুলো সম্পর্কে অবহিত নন — তাঁদের কাছে প্রায় বা একেবারেই কোনো অর্থ বহন করতো না, এবং যাঁরা জানেন তাঁদের কাছে অনাবশ্যক বলে বোধ হতো। যেসব শিল্পী এবং কাজের কথা আমি আলোচনা করতে পারতাম সেটার নির্বাচনকে এই নিয়মটি মুহূর্তেই সেই সমস্ত চিত্রের সংখ্যায় সীমাবদ্ধ করে ফেলল যেসব চিত্র গ্রন্থটি ধারণ করতে সক্ষম হবে। এই বিধিটি আমাকে উল্লেখ্য ও পরিহার্য বিষয় নির্বাচনের ব্যাপারে দ্বিগুণ কড়াকড়ি আরোপে বাধ্য করেছে। এবং এটি থেকেই উৎসারিত হয়েছে দ্বিতীয় বিধিটি, যা ছিল প্রকৃত শিল্পকর্মগুলোতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা, এবং যা নিছকই একটি ভিন্ন রুচি বা ফ্যাশনের নমুনা হিসেবে আকর্ষণীয় এমন যে-কোনো কিছুকে বাদ দেয়া। এই সিদ্ধান্তটির কারণে সাহিত্যরসের এক উল্লেখযোগ্য অংশ বিসর্জন দেয়া আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল।

সমালোচনার চাইতে প্রশংসা ঢের নীরস; তাছাড়া, মজাদার কিছু অস্বাভাবিকতার অন্তর্ভুক্তি হয়ত ক্ষণিক ভারমুক্তির আস্বাদই এনে দিত। তবে সেক্ষেত্রে পাঠক যুক্তিসঙ্গতভাবেই এ-প্রশ্ন করতে পারতেন যে আমি যা আপত্তিকর বলে মনে করেছি তা কেন একটি শিল্পবিষয়ক গ্রন্থে ঠাঁই পাবে, বিশেষত যদি তা করতে গিয়ে প্রকৃত কোনো মাস্টারপীসকে বাদ দিতে হতো। কাজেই, যেসব কাজ চিত্রসহ উপস্থাপিত হয়েছে তার সবই যে উৎকর্ষের সর্বোচ্চ মাপকাঠির প্রতিনিধিত্ব করে এমন দাবি যেমন আমি করতে পারছি না, তেমনি আমি চেষ্টা করেছি যাতে এমন কোনো কিছু গ্রন্থের অন্তর্গত না হয় যা আমার বিবেচনায় সেটার নিজস্ব বিশেষ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল নয়।

তৃতীয় বিধিটির বেলাতেও খানিকটা কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়োজন পড়েছে। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার নির্বাচনে মৌলিকতার পরিচয় দেবার প্রলোভন জয় করব, পাছে আমার নিজস্ব ব্যক্তিগত পছন্দের কাজগুলোর কারণে সুপরিচিত মাস্টারপীসগুলোর ঠাঁই না জোটে। শত হলেও, এ-গ্রন্থরচনার উদ্দেশ্য এটিকে স্রেফ কিছু সুন্দর জিনিসের একটি সংকলন হিসেবে তৈরি করা নয়; এটি তাঁদের জন্যে যারা একটি নতুন ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রত্যাশী, এবং তাঁদের কাছে আপাত ‘বহুলব্যবহৃত’ উদাহরণগুলোর পরিচিত উপস্থিতি কাঙ্ক্ষিত দিকচিহ্ন হিসেবেই কাজ করবে। তাছাড়া, সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলো নানান মানদণ্ডে প্রকৃত অর্থেই সেরা, এবং এ-গ্রন্থটি যদি পাঠককে সেসব কাজের দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে সাহায্য করে তাহলে সেটাই বরং অনেক বেশি কাজের কাজ হবে, অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত মাস্টারপীসগুলোর কারণে যদি আমি সেগুলোকে অবহেলা করতাম তার চাইতে।

কিন্তু তারপরেও যেসব বিখ্যাত কাজ আমাকে বাদ দিতে হয়েছে তার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। স্বীকার করা ভালো, হিন্দু বা এট্রুস্‌কান্‌ শিল্পের কোনো স্থান আমি দিতে পারিনি, কিংবা Quercia, Signorelli বা Carpaccio-এর মতো ওস্তাদ শিল্পীদেরও ঠাঁই হয়নি এখানে, অথবা এ-প্রসঙ্গে আরো বলা যেতে পারে Peter Vischer, Brouwer, Terborch, Canaletto, Corot-এর কথা বা আরো অসংখ্য শিল্পীর কথা যাঁরা আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। তাঁদের অন্তর্ভুক্তিতে গ্রন্থটির কলেবর বেড়ে যেতো দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ, এবং আমার ধারণা, তাতে করে শিল্পের একটি প্রাথমিক নির্দেশিকা হিসেবে এটির মূল্য হ্রাস পেতো। বর্জনের এই মর্মভেদী কাজটি করতে গিয়ে আরেকটি বিধি অনুসরণ করেছি আমি। যখনই কোনো সন্দেহের মুখোমুখি হয়েছি তখন সেরকম কোনো কাজ নিয়ে কথা বলাই শ্রেয় মনে করেছি যেটির মূল বা অরিজিনালটি আমি দেখেছি, যেগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় কেবল ছবি বা ফটোগ্রাফের মাধ্যমে সেগুলো নয়। এটাকে একটা পরম বিধি হিসেবে মান্য করতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু একজন শিল্পপ্রেমী মাঝে মধ্যেই ভ্রমণসংক্রান্ত যে সীমাবদ্ধতার শিকার হন তার জন্যে পাঠককে আমি শাস্তি দিতে চাইনি। তাছাড়া, আমার চূড়ান্ত বিধিটি হচ্ছে সেরকম কোনো চূড়ান্ত বিধি না রাখা।

তো, এই হচ্ছে আমার অনুসরণ করা যাবতীয় নেতিবাচক বিধি। ইতিবাচক উদ্দেশ্য খোদ গ্রন্থটি থেকেই প্রতীয়মান হওয়ার কথা। সহজ ভাষায় আবারও এমনভাবে শিল্পের কাহিনী বলতে হবে যাতে করে সে-কাহিনী পাঠককে এর স্বরূপটি বুঝতে সক্ষম করে তোলে এবং এর রসাস্বাদনে সাহায্য করে, যতোটা না উচ্ছ্বসিত বর্ণনার মাধ্যমে তারচেয়ে বেশি শিল্পের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাঠককে কিছু আভাস ইঙ্গিত দেয়ার মধ্য দিয়ে। এই পদ্ধতি অন্তত ভুলবোঝাবুঝির সবচেয়ে সাধারণ অর্থাৎ যা বারেবারে ঘটে সেরকম কারণগুলো দূর করতে এবং এমন এক ধরনের সমালোচনা রোধ করতে সাহায্য করবে যে-সমালোচনা শিল্পকর্মের মূল বিষয়টি অনুধাবনে পুরোপুরি অক্ষম। এটা ছাড়াও এ-গ্রন্থের আরো খানিকটা উচ্চাভিলাষী একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। যেসব শিল্পকর্ম এখানে আলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থটি সেগুলোকে তাদের ঐতিহাসিক পটভূমিতে স্থাপন করতে প্রয়াসী হয়েছে এবং তাতে করে সেসব মহৎ শিল্পীর শৈল্পিক উদ্দেশ্যটি হৃদয়ঙ্গম করার দিকে এগিয়েছে। কোনো এক সময় প্রতিটি প্রজন্মই তার পূর্ব প্রজন্মের মানদণ্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে; একটি শিল্পকর্ম যা করে কেবল তার মাধ্যমেই নয়, বরং সেই সঙ্গে সেটি যা করে না তার মাধ্যমেও সমসাময়িকদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করে। প্যারিসে পৌঁছে তরুণ মোৎসার্ট লক্ষ করেছিলেন — বাবার কাছে লেখা তাঁর চিঠি থেকে জানা যায় — সেখানকার ফ্যাশনদুরস্ত সব সিম্ফনী-ই একটি ত্বরিত ফিনেল (finale) দিয়ে শেষ হয়; কাজেই তিনি ঠিক করলেন তাঁর শেষ মুভমেন্টে তিনি একটি ধীর লয়ের সুর দিয়ে শ্রোতাদের চমকে দেবেন। এটা একটা মামুলি উদাহরণ, কিন্তু শিল্পের একটি ঐতিহাসিক সমঝদারিকে কোন দিকে লক্ষ্যস্থির করতে হবে এ-ঘটনাটি তা ঠিকই বলে দেয়। সবার থেকে স্বতন্ত্র হওয়ার আকুতি হয়ত শিল্পীর হাতিয়ারগুলোর মধ্যে সেরা বা মহত্তমটি নয়, কিন্তু এ-আকুতির অনুপস্থিতি নিতান্তই বিরল। আর এই উদ্দেশ্যগত ভিন্নতার সমঝদারি প্রায়শই অতীতের শিল্পের দিকে অগ্রসর হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথটি খুলে দেয়। উদ্দেশ্যের এই নিয়ত পরিবর্তনকে আমি আমার বর্ণনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করেছি প্রতিটি কাজই কীভাবে অনুকরণসূত্রে বা বৈপরীত্যে পূর্ববর্তী কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত তা দেখাতে। এমনকী রচনাটিকে একঘেয়ে করে ফেলার ঝুঁকি নিয়েও আমি তুলনার উদ্দেশ্যে বারেবারে সেইসব কাজের পুনরুল্লেখ করেছি যেসব কাজ বিভিন্ন শিল্পী এবং তাঁদের পূর্বগামীদের মধ্যেকার দূরত্ব নির্দেশ করে। উপস্থাপনার এই পদ্ধতিতে একটি অভাবিত বিপদ রয়েছে, যেটি এড়াতে পেরেছি বলে আশা পোষণ করলেও তার অনুল্লেখ সমীচীন হবে না। আর তা হলো, শিল্পজগতের নিয়ত পরিবর্তনকে একটি চলমান অগ্রগতি হিসেবে অতিসরল অপব্যাখ্যার বিপদ। একথা সত্যি যে প্রত্যেক শিল্পীই মনে করেন তিনি তাঁর পূর্ববর্তী প্রজন্মকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছেন, এবং তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি অদৃষ্টপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছেন। একজন শিল্পী যখন স্বীয় কীর্তির দিকে তাকিয়েছেন তখন মুক্তি এবং সাফল্যজনিত তৃপ্তির যে বোধ তিনি অনুভব করেছেন তার অংশীদার না হতে পারলে একটি শিল্পকর্ম বুঝে ওঠার আশা আমরা করতে পারি না। কিন্তু আমাদেরকে এটিও উপলব্ধি করতে হবে যে প্রতিটি অর্জন বা একটি বিশেষ দিকে অগ্রগতির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে অন্যদিকের একটি ক্ষতি বা অপ্রাপ্তি, এবং এই আত্মগত অগ্রগতি — সেটার গুরুত্ব সত্ত্বেও — শৈল্পিক মূল্যের দিক থেকে একটি নৈর্ব্যক্তিক বৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খায় না। বিমূর্তভাবে বর্ণনা করলে এসব কথা খানিকটা হতবুদ্ধিকর শোনাতে পারে। আশা করছি গ্রন্থে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

বিভিন্ন শিল্পকর্মের জন্যে বরাদ্দকৃত স্থান সম্পর্কে আরেকটি কথা। কারো কারো কাছে মনে হবে ভাস্কর্য এবং স্থাপত্যের তুলনায় চিত্রশিল্পকে অন্যায়ভাবে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। এই পক্ষপাতিত্বের একটি কারণ হচ্ছে, বিশালাকৃতির একটি দালানের কথা বাদই দেয়া গেল, একটি গোলাকার স্থাপত্যের তুলনায়ও একটি চিত্রকর্মের ছবিতে কম জিনিস খোয়া যায়। তাছাড়া, স্থাপত্যশৈলী সংক্রান্ত অসংখ্য দুর্দান্ত ইতিহাসগ্রন্থের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না আমার। অন্যদিকে, শিল্পের কথাকে এখানে যেভাবে দেখা হয়েছে সেটা স্থাপত্যসংক্রান্ত পটভূমি ছাড়া বর্ণনা করা যেতো না। প্রতিটি সময়পর্বের একটি বা দুটি ভবনের শৈলীসংক্রান্ত আলোচনাতে আমাকে সীমাবদ্ধ থাকতে হলেও প্রতিটি অধ্যায়ে এসব উদাহরণকেই আলোচনার প্রধান স্থান দিয়ে আমি ভারসাম্যটি স্থাপত্যের দিকেই ফিরিয়ে এনেছি। এতে হয়ত পাঠকদের পক্ষে প্রতিটি সময়পর্ব সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞানকে সমন্বিত করতে এবং এটাকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখতে সুবিধে হবে।

প্রতিটি অধ্যায়ের বাড়তি অংশ হিসেবে শিল্পীর জীবন ও জগতের একটি বৈশিষ্ট্যমূলক ছবি জুড়ে দিয়েছি আমি সংশ্লিষ্ট সময়পর্ব থেকে। এসব ছবি একটি স্বাধীন ছোট্ট সিরিজের সৃষ্টি করেছে যা একজন শিল্পী এবং তাঁর সময়কার জনগণের পরিবর্তনশীল সামাজিক অবস্থানকে ফুটিয়ে তুলেছে। এমনকী যেখানে শৈল্পিক মেধা ততটা উঁচুমানের নয়, সেখানেও এসব চিত্রগত দলিল হয়ত আমাদেরকে আমাদের মনের মাঝে সেই পরিপার্শ্বের একটি বাস্তব চিত্র তৈরিতে সাহায্য করবে যে-পরিপার্শ্বের ভেতর অতীতের শিল্প প্রাণ পেয়েছিল।

এলিজাবেথ সিনিয়রের সহৃদয় উৎসাহ না পেলে এ-গ্রন্থ কখনোই রচিত হতো না। লন্ডনে একটি বিমান আক্রমণে অকালমৃতা এলিজাবেথের প্রয়াণ তাঁর পরিচিতজনদের কাছে ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়েছিল। ড. লিওপোল্ড এট্‌লিঙ্গার, ড. এডিথ হফম্যান, ড. অটো ক্রুজ, মিসেস অলিভ রাইনার, মিসিস এডনা সুইটম্যান, আমার স্ত্রী এবং আমার পুত্র রিচার্ডের কাছেও আমি অসংখ্য মূল্যবান উপদেশ এবং সাহায্যের জন্যে ঋণী, সেই সঙ্গে ফাইডন প্রেসের কাছেও, এই গ্রন্থটিকে এর বর্তমান রূপটি দেয়ার জন্যে।

(ক্রমশ)

[২. প্রাক্‌কথন-এর সূচনাংশ]

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

25 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
25
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.