সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: নিম্নবর্ণিত কাহিনী সর্বসাধারণ প্রকাশকের বেলায় প্রযোজ্য নয়।
আপনি একজন বিশ্বাসপালক বা বিশ্বাসঘাতক (পড়ুন, লেখক বা অনুবাদক)। পৃষ্ঠপোষক (পড়ুন, প্রকাশক) আপনাকে বললেন, একটি কিতাব তর্জমার জন্য আপনি এই পরিমাণ টংকা লাভ করবেন। আপনি তাঁর আজ্ঞা পালন করলেন। কার্যত দেখা গেল, প্রতিশ্রুত টংকালাভ করতে গিয়ে আপনার প্রায় স্বর্গলাভের জোগাড় হচ্ছে, কারণ আপনি দেখলেন:
প্রকাশক চলে যান লবেজান ক’রে,
ধরেন না ফোন, চেনেন না পরে।
আর চিনিলেও ক’ন,
কপি সব পড়ে আছে, ইঁদুরের তরে।
ওদিকে,
চেকনাই কিন্তু তার বাড়ে দিনে দিনে,
গাড়ি-বাড়ি সব হয়, বই-বিক্রি বিনে।
এহ বাহ্য। আপনি ভিন্ন সূত্রে আরো জানতে পারলেন, আপনার তর্জমাকৃত গ্রন্থের জন্য প্রকাশক-প্রবর প্রচুর পরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে লাভ করেছেন মুখ্যত অনুবাদক নামক বিশ্বাসঘাতককে পারিশ্রমিক হিসেবে দেবার জন্য। অথচ তিনি আপনাকে তার বিন্দুবিসর্গ জানতে দেননি। মুষ্টিভিক্ষার মতো কিছু অর্থ প্রদান করেছেন অনেক দেন-দরবারের পর। পাঠক, অধমের কথা আপনার বিশ্বাস হলে কিছু বলার নেই; বিশ্বাস না হলে এ-সময়ের একজন নিবেদিত প্রাণ, জনপ্রিয়, বহুপ্রজ অথচ বিশ্বস্ত অনুবাদক শওকত হোসেন বর্ণিত সত্য ঘটনাটি শুনুন (মানে, পড়ুন)। ঘটনাক্রমে, এ-ঘটনার এক সাক্ষী আমি। রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত/প্রকাশিতব্য শওকত হোসেনের অতি সাম্প্রতিক অনুবাদ গ্রন্থের (ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর ব্যাটল ফর গড : আ হিস্ট্রি অভ্ ফান্ডামেন্টালিযম-এর অনুবাদ স্রষ্টার জন্য লড়াই: মৌলবাদের ইতিহাস) ভূমিকায় তিনি কথাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। আমি, তাঁর অনুমতি নিয়ে সেটির প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে ব্যবহার করেছি। আর, তাঁকে আমার ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি।
আরেকটি কথা, এসব কথা অনেক আগেই সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরা উচিত ছিল। কিন্তু, প্রথমত ভেবেছি নিজেকে সংশোধন ক’রে নেবেন ভদ্রলোক। দ্বিতীয়ত, শত হলেও, এটা নিতান্তই ঘরের কথা। রাষ্ট্র করতে চাইনি আমরা। না, নিজের কান খোয়ানোর লজ্জাকর খবর চাউর করতে চাইনি বলে নয়, কাক কাকের মাংস খায় না বলে। কিন্তু বায়স-মাংসভক্ষণ বায়সের অদৃষ্টলিখন ছিল বলেই মানতে হলো এখন।
আর বিলম্ব নয়। পড়ুন, শওকত হোসেন-এর বর্ণনায় ‘সন্দেশ’ সমাচার।
বইটি আরও আগে বের হওয়ার কথা ছিল। দেরি হবার কারণ প্রসঙ্গে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। এই বইটিসহ আমার অনূদিত আরও কিছু বই বের হওয়ার কথা ছিল আজিজ সুপার মার্কেটের সন্দেশ নামক প্রকাশনা সংস্থা থেকে। পাণ্ডুলিপিও জমা দিয়েছিলাম। এমনি এক সময় সহসা সুপ্রিয় অনুবাদক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অনুবাদক জনাব জি. এইচ. হাবীরের কাছে জানতে পারি সন্দেশের স্বত্বাধিকারী লুৎফর রহমান চৌধুরীর অপকর্মের ফিরিস্তি। জনাব লুৎফর রহমান অনুবাদকদের প্রতারিত করে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা থেকে অনূদিত গ্রন্থের বিপরীতে অনুবাদকদের নামে বরাদ্দ ও প্রেরিত প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এ খবর জানতে পেরে আমি নরওয়ের নরলা, কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ট্রান্সলেশন, ডাচ ফাউন্ডেশন ফর ট্রান্সলেশন ইত্যাদি বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে জনাব লুৎফর রহমানের অপকর্মের জ্বলন্ত প্রমাণ যোগাড় করি। তাতে জানা যায় এই তথাকথিত সাহিত্যসেবী আসলে একজন নিম্নশ্রেণীর তস্কর ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি বিভিন্ন বিদেশী প্রকাশনা সংস্থা ও লেখকদের এজেন্টদের সাথে নামী-অনামী লেখকদের বাংলাদেশের পাঠকদের সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার নামে খুবই সামান্য অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স (স্বত্ব নয়) হাতিয়ে নেন। তারপর অনুবাদকদের সাথে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট বইটি অনুবাদ করানোর জন্যে নামকাওয়াস্তে চুক্তি সম্পাদন করেন। কিন্তু সেই চুক্তির কথা গোপন করে তিনি উল্লেখিত বিদেশী সাহিত্য সংস্থাগুলোর কাছে অনুবাদকের সত্যিমিথ্যার মিশেল জীবনবৃত্তান্ত ও জাল স্বাক্ষরসহ সম্পূর্ণ ভিন্ন মিথ্যা চুক্তিপত্রের অনুলিপি জমা দিয়ে অনূদিত গ্রন্থের বিনিময়ে অনুবাদকের নামে বরাদ্দ অর্থের জন্যে আবেদন করেন এবং অনুবাদককে কিছুই না জানিয়ে সেই অর্থ বেমালুম তছরুপ করেন। এভাবে এপর্যন্ত তিনি বহু লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই ঘৃণ্য কাজ করে আসছেন। তাঁর এমনি প্রতারণার ফাঁদ থেকে বাংলাদেশের কোনও অনুবাদক রেহাই পাননি। নদে উপন্যাসের অনুবাদক আনিস পারভেজ, সোফির জগৎ ও শত বর্ষের নিঃসঙ্গতা’র নন্দিত অনুবাদক জি এইচ হাবীব, একটি অপহরণ সংবাদ ও বাগদাদে একশ দিন-এর অনুবাদক সিলেট মেট্রপলিটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুরেশ রঞ্জন বসাক, লাইফ অভ পাই ও টিন রঙা শাড়ীর অনুবাদক শিবব্রত বর্মণ, তাশ রহস্য-এর অনুবাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মণ, ক্যালি গ্যাংয়ের আসল ইতিহাস-এর অনুবাদক সালেহা চৌধুরীসহ কেউই বাদ যাননি। অথচ প্রকাশ্যে নিজেকে তিনি সাহিত্যসেবী হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, ভান করেন সাহিত্যের সেবা করতে গিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া, ভারতীয় পূর্বপ্রকাশিত বিভিন্ন অনুবাদও তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দের নামে প্রকাশ করে বর্ণিত সংস্থাগুলো থেকে অনুদানের অর্থ আদায় করে নিয়েছেন। সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুবাদকদের মাঝে জানাজানি হওয়ার পরও এবং প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও (বর্ণিত সংস্থাসমূহের ওয়েব সাইটে অনুসন্ধান করলেই এই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মিলবে) তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে গেছেন। অনেক চেষ্টা করেও আমি ও অন্য অনুবাদকগণ প্রাপ্য অনুদানের টাকা তো বটেই অন্যান্য অনূদিত গ্রন্থের বিনিময়ে চুক্তিমাফিক প্রতিশ্রুত অর্থও পাইনি। তিনি চুক্তিভঙ্গ ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন বলে পূর্বপ্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ প্রত্যাহারের কথা লিখিতভাবে জানানো সত্ত্বেও তিনি সেগুলোর বিপণন অব্যাহত রেখেছেন এবং দাখিল করা পাণ্ডুলিপি ফেরত চাইলেও ফেরত দেননি; যে কারণে অত্যন্ত পরিশ্রমসাপেক্ষ হলেও এ বইটি দ্বিতীয়বার অনুবাদ করতে হয়েছে। আমার আরও কয়েকটি অনূদিত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি এখনও অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছেন, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তাতে কান দেননি। বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখা এবং প্রতারণা থেকে দেশের অনুবাদকদের বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন এটাই কাম্য। আমি আন্তরিকভাবে আশাবাদী যে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা যথা-ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশের সাহিত্য জগৎকে লুৎফর রহমান চৌধুরীর মতো নিম্নশ্রেণীর তস্করের কবল থেকে উদ্ধার করে নিবেদিতপ্রাণ লেখক ও অনুবাদকদের প্রতারণার হাত থেকে রায় এগিয়ে আসবেন। পাঠক, লেখক ও অনুবাদকগণকে এই প্রকাশককে সামাজিকভাবে বর্জন করার আহ্বান জানাই। পাঠকদের একটি অন্যায় সম্পর্কে অবহিত করার জন্যেই এখানে এত কথা বলতে হলো। কারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটার হলে আমি সেজন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। প্রসঙ্গত, এই বক্তব্যের জন্যে রোদেলার প্রকাশক দায়বদ্ধ নন।
ধন্যবাদ।
শওকত হোসেন।
মালিবাগ, ঢাকা।
e-mail: saokot_nccbl@yahoo.com
