বছর কয়েক আগে, নিজের সামর্থ্যের কথা না ভেবেই, হাত দিয়েছিলাম আমার পক্ষে নিতান্তই অনুচিত এক দুঃসাহসিক কাজে। এক অনধিকার চর্চায়। ‘ইন্ধন’ ছিল যাঁদের তাঁরা ঘটনাক্রমে আমার শুভানুধ্যায়ী, প্রিয়জন!
কাজটি কী?
আজ (৩০শে মার্চ ২০০৯ খৃষ্টাব্দ) যাঁর জন্মের একশ বছর পূর্ণ হলো এবং বিগত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যিনি সবচেয়ে খ্যাতনামা শিল্প-ইতিহাসবিদ্ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত, সেই অধ্যাপক স্যার আর্নস্ট হান্স জোসেফ গম্ব্রিখ্ (Ernst Hans Josef Gombrich) — ই. এইচ. গম্ব্রিখ্ নামেই যাঁর প্রসিদ্ধি — তাঁর দ্য স্টোরি অভ্ আর্ট বইটির বাংলা অনুবাদে হাত দেয়া। ‘শিল্পকথা’ নামে লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল চট্টগ্রামের দৈনিক পত্রিকা সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এর সাহিত্য পাতায় (উল্লেখ্য, পত্রিকাটি তখন সদ্য তার যাত্রা শুরু করেছে সৈয়দ আবুল মকসুদের সম্পাদনায়)। আমার দুষ্পাঠ্য অনুবাদটি অবশ্য পাঠককে বেশি দিন সহ্য করতে হয়নি। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে, সুপ্রভাত-এ প্রকাশিত অংশটি খানিকটা সংশোধিত হয়ে ফের প্রকাশিত হয়েছিল, কিছু কাল পর, অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজ-এর সাহিত্য সাময়িকী সুবর্ণরেখা-র ঈদুল ফিৎর সংখ্যায়।
দ্য স্টোরি অভ্ আর্ট যেহেতু গম্ব্রিখের সবচাইতে বিখ্যাত গ্রন্থ তাই সেটা সম্পর্কে দু’চারটে কথা আগে বলে নিতে পারি। শিল্পবিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর একটি বলে এটিকে অভিহিত করলে সম্ভবত মোটেই বাড়িয়ে বলা হয় না। আর, এ-দাবির পক্ষে একটি জোরালো যুক্তি হচ্ছে, ১৯৫০ সালে প্রথম জনসমক্ষে উপস্থিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বইটির ষাট লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
আদিমতম গুহাচিত্র থেকে শুরু ক’রে হাল আমলের নিরীক্ষামূলক শিল্প, অর্থাৎ সামগ্রিক শিল্প বিষয়ে একটি পরিচিতি বা উপক্রমণিকা হিসেবে নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে গ্রন্থটি। পৃথিবীর সব বয়সের এবং শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পাঠকই এ-গ্রন্থের রচয়িতা স্যার ই. এইচ. গম্ব্রিখ্-কে আবিষ্কার করেছেন এক প্রকৃত শিল্পী হিসেবে যিনি শিল্প সম্পর্কে তাঁর গভীর অনুরাগ স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার এক বিরল গুণের সঙ্গে নিজের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অসাধারণ সম্মিলন ঘটিয়েছেন।
উল্লেখ্য, লেখকের মূল উদ্দিষ্ট কিন্তু ছিলেন তরুণ প্রজন্মের পাঠকই।
গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখক বলছেন,
আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী সব গ্রন্থের পাতায় ভিড় ক’রে থাকে যেসব নাম, সময় আর শৈলীর ঐশ্বর্য তার মধ্যে একটি বোধগম্য শৃঙ্খলা আনা।
দৃশ্যশিল্পের (ভিযুয়াল আর্ট) মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে লেখক তাঁর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে শিল্পের ইতিহাসকে এমনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যাতে আমরা সেটাকে দেখতে পাই, ‘বিভিন্ন ঐতিহ্যের একটি নিরন্তর বুনন এবং পরিবর্তন’ হিসেবে, যেখানে ‘প্রতিটি শিল্পকর্মই অতীতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে’; অর্থাৎ, বলা যায়, তিনি শিল্পের এই ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন ‘আমাদের সময়কে পিরামিড যুগের সঙ্গে যুক্তকারী একটি সজীব পরম্পরা’ হিসেবে।
দ্য স্টোরি অভ্ আর্ট সম্পর্কে হ্রস্ব বা দীর্ঘ প্রশস্তিমূলক বাক্যের অন্ত নেই। এ-প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা যেতে পারে প্যারিসে অবস্থিত লুভ্ মিউজিয়াম-এর প্রেযিডেন্ট ডিরেক্টর পিয়ের রোজনবার্গ-এর একটি ছোট্ট উক্তি:
প্রায় মোনা লিসা-র মতোই বিখ্যাত, স্যার আর্নস্ট গম্ব্রিখ্-এর দ্য স্টোরি অভ্ আর্ট ঘটিয়েছে বৈদগ্ধ্য আর আনন্দের মেলবন্ধন।
এবার ই. এইচ. গম্ব্রিখ্ সম্পর্কে কিছু তথ্য। তাঁর জন্ম ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে, ভিয়েনায়। বাবা ছিলেন আইনজ্ঞ; মা এবং স্ত্রী দু’জনেই প্রতিভাধর পিয়ানোবাদক। ভিয়েনা কনযার্ভেটয়ারে তাঁর মা বিশ্বখ্যাত অস্ট্রীয় সুরস্রষ্টা আর্নল্ড শ্যেনবার্গ (১৮৭৪-১৯৫১)-এর সঙ্গে মাঝে মাঝে পিয়ানো বাজাতেন; গম্ব্রিখ্ নিজেও ছিলেন একজন ভালো চেলোবাদক।
প্রথমে থেরেসিয়ানাম, পরে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড ইন্সটিটিউট অভ্ আর্ট হিস্ট্রি-তে জুলিয়াস ভন শ্লসার-এর কাছে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৩৬ সালে যোগ দেন লন্ডনের ওয়ার্বার্গ ইন্সটিটিউট-এ, গবেষণা সহকারী হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিও মনিটর হিসেবে কাজ করেন বিবিসি-তে; যুদ্ধ শেষ হলে ফের যোগ দেন ওয়ার্বার্গ ইন্সটিটিউট-এ। এই প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালক পদে বৃত হন ১৯৫৯ সালে।
১৯৭২ সালে নাইট উপাধি পান গম্ব্রিখ্। ১৯৮৮ সালে ভূষিত হন ‘অর্ডার অভ্ মেরিট’ খেতাবে। ২০০১ সালের ৩রা নভেম্বর ৯২ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তাঁর অন্যান্য বিশ্ববিশ্রুত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আর্ট অ্যান্ড ইল্যুশন : আ স্টাডি ইন দ্য সাইকোলজি অভ্ পিক্টোরিয়াল রিপ্রেজেন্টশন (১৯৬০), আ সেন্স অভ্ অর্ডার : আ স্টাডি ইন দ্য সাইকোলজি অভ্ ডেকোরেটিভ আর্ট (১৯৭৯), আর সেই সঙ্গে এগার খণ্ডের প্রবন্ধসংগ্রহ ও রিভিউ।
মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন পূর্বে তিনি প্রেফারেন্স ফর দ্য প্রিমিটিভ্ নামের একটি গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করেন, যা ২০০২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়। বইটির পেছনে রয়েছে তাঁর দীর্ঘদিনের নিরন্তর পরিশ্রম।
জন্মশতবার্ষিকীর এই শুভলগ্নে ই. এইচ. গম্ব্রিখের প্রতি জানাই আমাদের অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আশা করছি, বাংলাদেশের শিল্পরসিক এবং সাধারণ পাঠক এ-বছর বিশেষভাবে স্মরণ করবেন বিশ্ববরেণ্য এই লেখককে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৫ comments
রেজাউল করিম সুমন - ১৪ এপ্রিল ২০০৯ (৬:১৯ পূর্বাহ্ণ)
জি এইচ হাবীবকে অনেক ধন্যবাদ এই শতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলির জন্য।
নিঃসঙ্গতার একশ বছর বা সোফির জগৎ-এর অনুবাদকের পক্ষে দ্য স্টোরি অব আর্ট অনুবাদের সিদ্ধান্তকে ‘দুঃসাহসিক’ কাজ বলা কি ঠিক হবে?! আর কাজটা যে ‘অনুচিত’ হয়নি সে-বিষয়ে আশা করি সকলেই আমার সঙ্গে একমত হবেন।
শিল্পকলা বিষয়ে প্রায়-অজ্ঞ, আর ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ — উভয় শ্রেণীর পাঠককেই তৃপ্ত করতে পারে গম্ব্রিখের এই বইটি! আমার মতো যারা চারুকলার ছাত্র তাদের জন্য তো এটি অবশ্যপাঠ্য। যদিও এ বই আসলে নাকি লেখা হয়েছিল কিশোরবয়সীদের জন্য! গত ছয় দশক জুড়ে প্রতি বছরে এর গড় বিক্রি এক লক্ষ কপিরও বেশি!
শিল্পকথা-র আংশিক অনুবাদ পড়েছিলাম। পুরো অনুবাদটিই পড়বার আশায় দিন গুনছি। এ বই কেবল নিজে পড়েই মন ভরে না, অন্যদেরও ডেকে পড়াতে ইচ্ছে করে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নির্মাণ ওয়েবজিন-এ জি এইচ হাবীবের অনুবাদে ই. এইচ. গম্ব্রিখের শিল্পকথা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। অনুবাদকের কাছ থেকে এরই মধ্যে সানন্দ সম্মতি পেয়েছি। আশা করছি গম্ব্রিখের জন্মশতবর্ষে শিল্পকথা-র ধারাবাহিক প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারাটা আমাদের পক্ষে আনন্দের অভিজ্ঞতা হবে।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ (১০:৪৬ অপরাহ্ণ)
স্টোরি অভ আর্ট আমি পড়েছি প্রথমে স্থাপত্যের ছাত্রী হিসেবে, পরে পড়িয়েছি ক্লাসে- দুই সময়েই গভীর আনন্দ এবং বিস্ময়ের আকর ছিল বইটি, অনুবাদ করা হয়েছে জেনে অভিনন্দন জানাবার লোভ সম্বরণ করতে পারলামনা। অনুবাদটি পড়তে চাই।
রেজাউল করিম সুমন - ২ জানুয়ারি ২০১০ (১২:০৮ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ আপনাকে। হাবীব ভাই মুক্তাঙ্গনে নিয়মিত নন; তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছি আপনার অভিনন্দনের কথা।
অনিবার্য কারণে নির্মাণ ওয়েবজিন প্রকাশে দেরি হচ্ছে। আশা করছি এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে শিল্পকথা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
রেজাউল করিম সুমন - ১ জানুয়ারি ২০১১ (৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ)
@ সাগুফতা শারমীন তানিয়া
মুক্তাঙ্গনেই আজ থেকে শিল্পকথা-র ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু হলো।
5th in the alfabet - ১৭ এপ্রিল ২০১১ (৯:৪৯ পূর্বাহ্ণ)
শুরু করলাম –
জি এইচ হাবিব আমার প্রিয় অনেককিছু জানাতে পারবে
– তাই শেষ করতে দেরি হবে ।