গত কয়েক বছরে আমেরিকার থেকে ভারত অনেক এগিয়েছে। অবুঝ মার্কিনভক্তদের মধ্যেও ‘আমেরিকা গণতন্ত্রের বাতিঘর’ এই গল্প আর চলে না। অন্যদিকে গত এক দশকে ভারত দারুণভাবে জনমতের মধ্যে ক্যু ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে যে, ‘ভারত আফগানিস্তান নয়’, ‘ভারত পাকিস্তান নয়’, ‘ভারত হলো এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র’। অথচ বিশ্বে সরকারি হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যায় ভারত এক নম্বরে। এটা এমন এক দেশ যার ২৫ ভাগ এলাকায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কাশ্মীরই হোক আর উত্তর-পূর্ব প্রদেশগুলোই হোক বা হোক ছত্তিশগড় বা অন্ধ্র প্রদেশের কিছু এলাকা, এসবের খবর বাইরে আসে না। ভারত বিশাল ও বৈচিত্র্যময় এক এলাকা। হয়তো ছত্তিশগড়ে হত্যাকাণ্ড চলছে, ওদিকে তামিলনাড়ুতে জমেছে উৎসব অথবা ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে আদেলেইদে। আলো পড়ছে সেখানেই, যেখানে সেনসেক্সে স্টক মার্কেট চাঙা বা যেখানে বিনিয়োগ আসছে। আর অন্ধকারে রাখা এলাকাগুলোয় হত্যাকাণ্ড চলছে, কৃষকেরা আত্মহত্যা করছে — এ ধরনের কৃষকের সংখ্যা এখন এক লাখ ৩৬ হাজার ছাপিয়ে গেছে। ধরুন, কাশ্মীরের কথা। সেখানে এ পর্যন্ত ৬৮ থেকে ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। সেখানে বিশেষ ক্ষমতা আইনে সশস্ত্র বাহিনীর সেপাইরাও কেবল সন্দেহবশত গুলি করার বৈধতা পেয়েছে। কাশ্মীরে ইরাকের মতো পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইরাকে আমেরিকার রয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার সেনা। আর কাশ্মীরে ভারতের রয়েছে সাত লাখ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাকর্মী : সেনা, পুলিশ ও মিলিশিয়া। ভারত সরকার সেখানে মূলত যা করছে তা হলো কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছাকে দমন করা। কেন তারা গণভোটে এত ভীত? কেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র জানতেও ভয় পায় জনগণ কী চায়?
সন্ত্রাসী শিকারী ভারত
আমরা এখন এমন এক শিখরে পৌঁছেছি, যেখানে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা প্রসারিত করা হয়েছে। হিন্দু মৌলবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির আমলে সন্ত্রাসের অভিযোগ কেবল মুসলিমদের দিকেই তাক করা হতো। কিন্তু এখন সরকার যাদের জালে পুরতে চায়, কেবল ইসলামি সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায় তাদের আঁটানো যাচ্ছে না। কেননা ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদী’ হতে হলে তো নিদেনপক্ষে মুসলিম হতে হয়। কিন্তু যখন প্রকাণ্ড উন্নয়ন প্রকল্প ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরির জন্য ব্যাপক হারে উচ্ছেদ চলছে এবং যখন মানুষ তা রুখে দাঁড়াচ্ছে, তখন তাদেরও বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী। যেহেতু তাদের ইসলামি সন্ত্রাসী বলা সম্ভব না, সেহেতু তাদের বলা হচ্ছে মাওবাদী। সশস্ত্র প্রতিরোধ তা কাশ্মীরেই হোক আর মাওবাদী ক্যাডারদের দ্বারাই হোক, তা এখন বাস্তবতা। কিন্তু উভয় পক্ষই এগুলোকে বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। তাই যখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সন্ত্রাসবাদকে প্রধানতম ঘরোয়া হুমকি বলে ঘোষণা করেন, তখন বিভিন্ন রাজ্য সরকার যে কাউকে সন্ত্রাসী তকমা দেওয়ার উপযোগী আইন প্রণয়নে উৎসাহী হয়ে ওঠে। হয়তো আমাকেও তারা শাসাতে আসবে, যেহেতু আমি তাদের সমালোচনা করে বই লিখেছি। ছত্তিশগড়ে আমি যদি অরুন্ধতী রায় না হতাম, তাহলে জেলে পুরে দিত। কাশ্মীরের কেউ হতাম, আমাকে হয়তো গুলি করে দিত। প্রখ্যাত ডাক্তার বিনায়ক সেনের কথাই ধরুন। তিনি হাজার হাজার একর জমি বেআইনিভাবে করপোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার বিপক্ষে জনমত তৈরিতে উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জেলে ভরা হয়েছে। সুতরাং, সন্ত্রাসবাদের আওতা এতই বাড়ানো হয়েছে যে, যারা ধ্বংসাত্মক পথে উন্নয়ন চায় না, তাদেরও সন্ত্রাসবাদী বলে জেলে পোরা হবে এবং হচ্ছে।
করপোরেট ভারত
নব্বই দশকে যখন নিও লিবারেল মার্কিন মডেল ভারতে আমদানি করা হলো, তখন আমাদের লড়তে হয়েছে পানি-বিদ্যুৎ নিয়ে ব্যক্তিমালিকানায় ব্যবসার বিরুদ্ধে। এখন বিদ্যুৎ ও পানি স্থানীয় মানুষদের জন্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। এরপর করপোরেট কোম্পানিগুলো থাবা বাড়িয়েছে খনিজ সম্পদের ওপর। উড়িষ্যা ও ছত্তিশগড়ে তারা বিপুল বক্সাইট ও লোহা পেয়েছে। আমরা দেখছি চোখের সামনে ওইসব অঞ্চলকে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য বানানো হচ্ছে। তারা জানে স্থানীয় বাজারে এসব বিকাবে না। তাই ভবিষ্যতে ব্যবসার জন্য বক্সাইট-ভরা একটা আস্ত পাহাড় কেটে নেওয়া হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার মরুতে মজুদ করার জন্য। এসবই চলছে বন্দুকের জোরে।
কেউ যদি ভারতের ভৌগোলিক মানচিত্রের দিকে তাকান তো দেখতে পাবেন যেখানেই পাহাড় ও বন সেখানেই রয়েছে আদিবাসী, উপজাতি। এবং তাদের অরণ্য-বসতির তলায় রয়েছে খনিজ। প্রতিবেশগত ও সামাজিক দিক থেকে এসব অঞ্চল খুবই নাজুক হলেও তাদের ওপরই চড়াও হয়েছে বিরাট বিরাট বন্দুকওয়ালা। তাদের চূড়ান্ত ধ্বংসলীলার গ্রাসে পড়েছে সেখানকার প্রকৃতি ও মানুষ। যে টাটা কিছুকাল আগে পর্যন্ত ভালো ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাইত, তারাও এখন খ্যাপাটে আচরণ করছে। ছত্তিশগড় সরকারের সঙ্গে লোহার খনি নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কয়েক দিনের মাথায় সেখানে সালভা জুডামের জন্ম হলো। সালভা জুডাম হলো উচ্ছেদের শিকার জনগণের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার সন্ত্রাসী কর্মসূচি। বলা হচ্ছে, ওই সন্ত্রাসীরা জনগণের মিলিশিয়া। এ কেমন যুদ্ধ, যেখানে সরকারই জনগণের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় জনগণের আরেক অংশকে ধ্বংস করার জন্য? কার্যত এটা হলো মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সরকারের ভাড়াটে সন্ত্রাসী বাহিনী। এভাবে আমাদের নজর গৃহযুদ্ধের মধ্যে মাতিয়ে রেখে বসতি উচ্ছেদ করে খনিজ সম্পদ নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত পাকা করা হচ্ছে। যারা এসবের হোতা তারাই আবার পরিবেশ আন্দোলনে টাকা ঢালছে, মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দিচ্ছে পরিবেশপ্রেমের জন্য। যেমন জামসেদজি টাটা তহবিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, বুদ্ধিজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নানা কৌশলে অকাতরে অর্থ বিতরণ করছে। পুরোটাই যেন একটা নাটক। এসব বিষয়ে, দখলদারির কলাকৌশলের ব্যাপারে ভারতীয়দের কাছ থেকে মার্কিনিদের অনেক কিছুই শেখার আছে।
দলিত ভারত
বাইরের লোকদের কাছে ভারত এক আধ্যাত্মিক দেশ। অথচ ভারতীয় সমাজ হলো এক নির্দয় সমাজ। আর কোন সংস্কৃতিতে বর্ণপ্রথা টিকে আছে? ভারতীয় সভ্যতা যেভাবে দলিত সৃষ্টি করেছে, তালেবানরাও তা কখনো কল্পনা করতে পারবে না। দলিতরা হলো হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। তাদের স্থান সবকিছুর নিচে: ধর্মের, বিত্তের, সমাজের সবকিছুর। রুটিনমাফিক তাদের নির্যাতন করা যায়, খুন করা যায়। মার্কিন মিডিয়ায় এসবের কিছুই আসে না। বাঁচার জন্য তারা মুসলিম বা শিখ বা খ্রিষ্টান হয়। কিন্তু তার পরও তারা অস্পৃশ্যই থাকে, দলিতই থাকে। শিখদের মধ্যে এ রকম দলিতের হার ৩০ শতাংশ, তাদের ৯০ শতাংশই আবার ভূমিহীন মজুর। ভারতের সবখানেই ভাবা হয় যে, দলিত নারীদের উচ্চবর্ণের যে কেউ ভোগ বা ধর্ষণ করতে পারে।
অতএব, গরিবের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই গরিবদের ভাগ্য পাল্টায়নি। কেননা, সাদা সাহেবদের ফেলে দেওয়া বুট পায়ে দেশ চালাচ্ছে বাদামি সাহেবরা।
বিজেপির ভারত
গুজরাটের সাম্প্রদায়িক নিধনযজ্ঞে দেড় থেকে দুই হাজার মুসলিম কচুকাটা হয়, গণধর্ষিত হয় অজস্র নারী। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে উচ্ছেদ করা হয় দেড় লাখ মুসলিমকে। এখন তাদের বাস জঘন্য বস্তিতে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে তারা পঙ্গু। এসবই ছিল বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী অভিযানের অংশ। আমি বলতে চাই গণহত্যাকারী হওয়া সত্ত্বেও মোদী বিজয়ী হননি, মুসলিম হত্যার কৃতিত্বের জন্যই তিনি আবার নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৭ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মনে প্রশ্ন জাগে, গণতন্ত্র কী? নরেন্দ্র মোদীকে শয়তান ভাবার বিষয় নয় এটা, কেননা গণতন্ত্রের মাধ্যমেই তো আরও আরও নরেন্দ্র মোদীরা ক্ষমতায় আসার সুযোগ পাচ্ছে। মোদীরা জানে যে, গণতন্ত্রের সঙ্গে অধিকাংশের দাপটের সম্পর্ক রয়েছে, আর অধিকাংশের নামে শাসনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ফ্যাসিবাদের। মোদী ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ। তিনি সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে জনগণের একটা অংশকে একত্রিত করে নিজের লোক বানিয়েছেন। তিনি করপোরেটকে হাতে তুলে খাইয়েছেন। নাৎসি যুগে জার্মানিতেও ঠিক এ রকমটাই ঘটেছিল। ফ্যাসিবাদ ও বড় করপোরেশনের সম্পর্ক সুবিদিত। টাটা, রিল্যায়েন্স ও এ জাতীয় সবাই বলছে, গুজরাট হলো পুঁজিপতিদের স্বপ্নের গন্তব্য।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) একটি সাংস্কৃতিক চক্র, বিজেপি যার রাজনৈতিক শাখা। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইতালীয় ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির আদর্শে। তার পর থেকে কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে তা কাজ করে আসছে। তারা খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করে যে, জার্মানিতে ইহুদিরা যেমন, ভারতে মুসলিমেরা তেমন। ভারতীয় অনেক উদারতাবাদী একে ফ্যাসিবাদী মনে করেন না, কারণ ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তাঁরা দিব্যি খাপ খাইয়ে নেন। হিটলারের সঙ্গে তুলনা করায় মোদীর কিছু যায় আসে না। তাঁর ভাষায়, ‘সেটা গ্রহণযোগ্য’। গুজরাটের বাস্তবতায় এবং সেখানকার পাঠ্যপুস্তকে হিটলার খুবই নন্দিত হন।
সুতরাং গুজরাটে আমরা যা দেখছি, তা এক ধরনের ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদী একনায়ক এক জিনিস আর কোটি কোটি মানুষকে ঘৃণায় মাতিয়ে ভোটে বিজয়ী ফ্যাসিবাদী আরেক জিনিস। এখন গুজরাট চালাচ্ছে লাখো খুদে মোদী। সে সময় যে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছেন তিনি এখন গুজরাটের পুলিশ কমিশনার। অপরাধীরা স্বীকার করেছে কীভাবে কার মদদে তারা জীবন্ত মানুষ পুড়িয়েছে, কীভাবে মানুষকে টেনে টেনে ছিঁড়েছে, কীভাবে গণধর্ষণ করেছে। এসবের টেপ প্রকাশ করেছে তেহেলকা পত্রিকা, টেলিভিশনে তাদের সেই স্বীকৃতি প্রচারিতও হয়েছে। কিন্তু কারও কোনো বিচার হয়নি। (সম্প্রতি গুজরাট গণহত্যা তদন্তে গঠিত নানাবতী কমিশন মোদীকে নির্দোষ ঘোষণা করে)। আজ গুজরাটের সব প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়েছে মোদীর মতো লোকেরা। যতক্ষণ রাজ্য বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত ততক্ষণ টাটা, রিল্যায়েন্সসহ ধনীরা খুশি।
এসবের কারণে মানুষ আজ বেপরোয়া। এদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ নিজেই অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। মানুষ জানে কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়। তারা নিজেরাই নিজেদের বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলছে। আজ পৃথিবীর সব থেকে প্রচারিত গণতন্ত্রের থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
নয়া জমিদারতন্ত্রী ভারত
ভারতে একসময় জমিদারতন্ত্র ছিল। তা উচ্ছেদ করে বেশ কটি রাজ্যে ভূমি সংস্কার করা হয়। এর মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম। আজও কাশ্মীরের মানুষ এর সুবিধা ভোগ করে। এর বাইরে বাংলায়ও সফল ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে বড় জোত-জমিদারদের জমি চাষিদের হাতে দেওয়া হয়। আজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের নামে ঠিক এর উল্টো প্রক্রিয়া ঘটানো হচ্ছে। চাষিদের থেকে জমি কেড়ে নিয়ে করপোরেশনের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এ কাজ কেবল কংগ্রেসই করছে না, করছে বামপন্থী নামে পরিচিত সিপিএম-ও।
মার্কিন-ইসরায়েলি অক্ষে ভারত
একসময়কার জোটনিরপেক্ষ ভারত এখন জোটবদ্ধ রাষ্ট্র। সরকার মুখে খই ফুটিয়ে ঘোষণা করছে যে ভারত, আমেরিকা ও ইসরায়েল গলায় গলায় বন্ধু। আমরা দেখলাম পরমাণু চুক্তি, যৌথ সামরিক মহড়া ইত্যাদি। অথচ তারা ভুলে গেছে আমেরিকা তার অশ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গে কী করে। চিলির বেলায় মার্কিনপন্থী তৈরিতে আমেরিকাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। আর আমাদের বেলায়, আমাদের এলিট মহল আমেরিকার নজর কাড়তে সার বেঁধে লেজ নাড়াচ্ছে। এই এলিটরা ভারতের সব থেকে বড় বিচ্ছিন্নতাবাদকে জয়ী করেছে। তারা ভারতীয় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদী মহলের অংশ হয়ে গিয়েছে। প্রায় সব আমলা, রাজনীতিবিদ, বিচার বিভাগের প্রায় সব জ্যেষ্ঠ বিচারক, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোক ও বুদ্ধিজীবী প্রত্যেকেরই পুত্র-কন্যা-ভাই তথা আপন কেউ-না-কেউ আমেরিকায় বাস করে। সুতরাং সম্পর্কটা এখন অনেক বাস্তব ও আত্মীয়তাময়।
আমরা জানি ইসরায়েল হলো মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার খুঁটি এবং সব থেকে বেশি মার্কিন সাহায্যপুষ্ট রাষ্ট্র। সুতরাং আমেরিকা ও ইসরায়েল ধারণাগতভাবে আলাদা দুটি রাষ্ট্র নয়। এবং খেয়াল করলে দেখবেন, ইসরায়েল ও আমেরিকার মুসলিম বিদ্বেষের সঙ্গে ভারতের অধিকাংশ মানুষের মুসলিম বিদ্বেষ কীভাবে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
মনমোহন সিং-এর ভারত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জীবনে একটি নির্বাচনেও জয়ী হননি। তিনি বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের দেখানো পথ ছাড়া কিছু কল্পনাও করতে পারেন না। আমার ধারণা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাস বইও কখনো পড়ে দেখেননি তিনি। তিনিই কোনো সাবেক উপনিবেশের একমাত্র নেতা, যিনি ক্যামব্রিজে গিয়ে বক্তৃতা করে উপনিবেশবাদকে গণতন্ত্রের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং ব্রিটেনকে ভারতে রেখে যাওয়া নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানগুলো তথা পুলিশ, আমলাতন্ত্র ইত্যাদির জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসেন। সুতরাং এই ভারত এখনো উপনিবেশবাদী পথেই চলছে, কেবল ইংরেজের জায়গায় শাসন করছে উচ্চবর্ণের লোকেরা।
জেড নেট থেকে নেওয়া, ইংরেজি সাক্ষাৎকারের সংক্ষেপিত অনুবাদ
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৭ comments
ফারুক ওয়াসিফ - ১৫ অক্টোবর ২০০৮ (১১:১৭ পূর্বাহ্ণ)
এই অনুবাদটি জেড নেট থেকে নেয়া এবং 11পৃষ্ঠার একটি সাক্ষাতকার থেকে করা হয়েছে।
রায়হান রশিদ - ১৫ অক্টোবর ২০০৮ (৫:২৯ অপরাহ্ণ)
ফারুক ওয়াসিফকে ধন্যবাদ এই দারুণ সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করার জন্য। আসলে মন্তব্য করার মত কিছুই বাকী রাখেননি অরুন্ধতি রায়। কিছুদিন আগে তাঁর আরেকটি চমৎকার লেখা পড়ছিলাম: Listening to Grasshoppers (‘কাউন্টার কারেন্টস’ এবং ‘আউটলুক ইন্ডিয়া’ দু’জায়গাতেই প্রকাশিত)। লেখাটি ছিল গণহত্যা আর এ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক রাজনীতির টানাপোড়েন নিয়ে। আগ্রহীদের জন্য তাঁর আরো কিছু লেখার লিন্ক রয়েছে: এখানে (রেজিস্ট্রেশন করে পড়া যাবে)।
সুযোগ পেলেই ‘সবাই’ আমাদের এক পশলা বুঝিয়ে যাচ্ছে যে উন্নয়নের (অমুকের বা তমুকের মত) কোন বিকল্প নেই; আমাদের বোঝানো হচ্ছে ওখানেই আছে হোলি গ্রেইল। বোঝানো হচ্ছে বাকী সব গৌন, সে সব পরে ভাবলেও চলবে। আর এত সবের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে সাধারণ ‘মানুষ’। উন্নয়ন বিতর্কে যখন তাদের কন্ঠস্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে মিলিয়ে যেতে বসেছে, তখন ‘অরুন্ধতি’ অবশ্য পাঠ্য হয়ে ওঠে আমাদের সবার জন্য। ওয়াসিফকে আবারো ধন্যবাদ।
masud karim - ১৬ অক্টোবর ২০০৮ (১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ)
আমার মনে হয়, ভারত(উপমহাদেশ) এক মহাভারতীয় বাস্তবতার দিকে নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।পৌরাণিক অর্থে ন্যায়-অন্যায়ের জুয়োখেলা শুরু হয়েই গেছে। এখন শুধু কুরুক্ষেত্রের অপেক্ষা।পান্ডব ও কৌরবেরাও কুরুক্ষেত্র চায়নি,আমরাও চাই না।ইউরোপও দুটি মহাযুদ্ধ চায়নি।কিন্তু এ সবই ঘটেছে। যেভাবে উপমহাদেশ চলছে খুব কঠিন হবে একে এড়ানো।
ফারুক ওয়াসিফ - ১৭ অক্টোবর ২০০৮ (৭:১০ পূর্বাহ্ণ)
ভারত রাষ্ট্র এবং উপমহাদেশে ও বিশ্বে তার ভূমিকার মূল্যায়ন আজো সেভাবেই হয়, যেভাবে ভারতের শাসকশ্রেণী এবং তাদের মিডিয়া দেখতে পছন্দ করে। অর্থাৎ ভারত এক কল্যাণমূলক অগ্রসর রাষ্ট্র। এই ভক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকে নয়া সাম্রাজ্যবাদী ও আসন্ন ফ্যাসিবাদী উত্থানের বিপদটি। আমাদের দেশেও তথাকথিত আলোকিত বুদ্ধিজীবীতাও এভাবেই ভারতের ওপর শুভ-র সামিয়ানা টাঙিয়ে নিজেরাও আরাম পান, আধিপত্যবাদী ভারতীয় স্ট্যাবলিস্টমেন্টকেও আমোদ দেন। এমনকি ভারতের বৃহত্তম বাম দল সিপিএম-ও এই আরাম দেয়া ও পাওয়ার দলে। তারা এখন হাজির হয়েছে ভারতীয় পুঁজির রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে। বুর্জোয়ারা যা করতে দ্বিধা করে, সেটা তারা করে দিচ্ছে। অর্থাৎ উচ্ছেদ, বৃহত পুঁজিকে সেবা করা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আধিপত্যবাদকে বৈধ করা।
এসবের বিপরীতে অরুন্ধতি রায় এবং আরো কতিপয়ের লড়াইটা অভিনন্দনীয়। আর সবাই যাকে খলনায়ক মনে করে, অর্থাৎ সেই মাওবাদী এবং আসাম-কাশ্মীরের বিচিছন্নতাবাদী ও ইসলামী সন্ত্রাসীদের ভূমিকারও নতুন মূল্যায়ন করেন তিনি। আসলে এরা যে ভারতীয় রাষ্ট্রের উচ্চবর্ণবাসীদেরই প্রতিক্রিয়া, সেটা না বুঝলে সহজেই আমরা বুশের ওয়ার অন টেররের খপ্পরে পড়ে পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যাব। সেদিক থেকে অরূন্ধতি রায় আমাদের শিক্ষক।
ধন্যবাদ রায়হান রশীদ এবং মাসুদ করিম।
হাসান মোরশেদ - ১৯ অক্টোবর ২০০৮ (২:০৮ পূর্বাহ্ণ)
অনুবাদ চমৎকার ।
এটা কি ‘Choosing our weapons’ থেকে?
নিঝুম মজুমদার - ২০ অক্টোবর ২০০৮ (১:৫৪ পূর্বাহ্ণ)
অনুবাদটি বেশ ভালো লাগলো ।
মলিনা রায় - ২৭ মে ২০১৪ (৪:২৩ অপরাহ্ণ)
আসলে ইনার লেখা এতোই চমৎকার যে বলার আর কি বা থাকতে পারে । সত্যিই ভাবা যায়না যদি আমার দেশে এমন একজন থাকতো যে কোন কিছুকেই পরোয়া করেনা যা সত্যি তাই অকপটে বলতে পারে । আপনাকে ধন্যবাদ অনুবাদ করার জন্য ।