একুশে ফেব্রুয়ারি মৃত, তাকে ওরা ‘ইতিহাস’ বানিয়ে ফেলেছে। শহীদরা জীবন দিয়েছে সমষ্টির মধ্যে থেকে সমষ্টির হয়ে, তাদের ওরা নিঃসঙ্গ বীর করে দিয়েছে। একুশ ছিল ক্রোধ আর সংগ্রামের, আগুন নিভিয়ে তাকে ওরা বসিয়ে রেখেছে করুণ গানের আসরে। বাংলা আজ কাজের ভাষা — কাজের লোকের ভাষা হিসেবে সর্বত্র প্রচলিত — রাজভাষা তখনও এবং এখনো ইংরেজি। যাদের সন্তানেরা একুশ গড়েছে একাত্তর রচনা করেছে, সেই জনগণের বড় অংশ আজো তাদের মাতৃভাষার অক্ষর চেনে না। নিরক্ষর নিরস্ত্র দশায় তাই ভাষাকে তারা রক্ষা করতে পারে নাই বলে ভাষাও চলে গেছে অপরের দখলে। সমগ্র ভাষাভাষীর মর্যাদা না এলে ভাষাও পুজির গৃহভৃত্য হয়ে যায়, যেমনটা হয়েছে এই ভাষার নামের জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আজ নয়া উপনেবিশিক প্রভুদের কাছে আত্ম-সমর্পণের ধর্মগাথা। যে সমাজ একুশ থেকে একাত্তর হয়েছিল, সেই সমাজ অবশ, তার একাংশ বিহ্বল অন্য অংশ বিক্রিত। করপোরেট পুঁজির ভাবমূর্তি গঠনে সকল জাতীয় দিবসগুলি যখন ভাড়া খাটছে, তখন যা কিছু জাতীয় বলে প্রচার পায় তা আর স্বজাতীয় নয় বিজাতীয়’র উপনিবেশিক মুখোশ। ভাষাই দেশ, ভাষাভাষীরাই জনগণ, সেই ভাষাভাষীরা আজ সারা বিশ্বে একটি ছত্রভঙ্গ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে ভীরু ও অসম্মানিত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভাষা ও মানুষ মূর্ত হয় যে রাষ্ট্রবোধে সেই রাষ্ট্রবোধ পুজির মূল্যবোধের কাছে নিস্তেজ, সেই রাষ্ট্র সাম্রাজ্যের স্থানীয় সরকার পরিষদ বৈ আর কিছু নয়। এর জাতীয় সংগীত সাম্রাজ্যের কোনো এক কোণের এক ট্রাইবের ট্রাইবাল বেদনার কথাই বলে শুধু — যে দেশ লুপ্ত হচ্ছে সেই দেশের জন্য কান্নাই তো ’আমার সোনার বাংলার’ মধ্যে মাতম করে।
প্রত্যেকে যখন আমরা প্রত্যেকের মাথা ছাড়িয়ে উঠতে চাইছি তখণ দেশের সকল শহীদ মিনারগুলির মাথা পরাজয়ে নত ও লজ্জিত। শহীদের বেদীতে আগে রক্তদান হতো, এখন নীরবে অশ্রু ঝরে। সেই উপকথার স্মরণে শিশু-কিশোরেরা আজো বাঁশ-কাঠের মিনার বানায় — একদার বাঁশের কেল্লার মতো।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
তারেক আহমেদ - ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৮:১৩ অপরাহ্ণ)
আশ্চর্য কি জানেন,দৈনিক পত্রিকার মহাক্ষমতাধর সম্পাদকেরা এখন এইসব কর্পোরেট পুজির ভাড়া খাটায় ব্যস্ত হয়েছেন এখন।তাদের ‘দুনিয়া কাপানো ত্রিশ মিনিট’ এর সাথী এখন এসব কর্পোরেট বহুজাতিকরা,ভাষা নয়,সংস্কৃতি নয়,নয় কোন চেতনা–কেবল পুজিই যাদের প্রেরনা।সম্পাদকেরা এখন কতখানি সম্পাদক আর কতখানি জনসংযোগ কর্মকর্তা–সেটা তাদের এখন পাঠকদের ষ্পস্ট করে জানানোর সময় এসে গেছে।কারন,ভাষার অধিকার নিয়ে তাদের এই প্রহসন জাতীকে ঠাট্টা এবং তামাসাই করে যাচ্ছে কেবল ।
ফারুক ওয়াসিফ - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:০৮ পূর্বাহ্ণ)
তারা আমাদের অতীত দখল করতে চায়, অতীতের দাহ্যগুণকে নিস্তেজ করতে চায় ভবিষ্যতকে নিস্তেজ রাখার জন্য, যাতে ভবিষ্যতের বদল তাদের ইচ্ছাতেই হয়, মানুষের ইচ্ছায় নয়।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (২:১২ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ ফারুক ওয়াসিফ,
বাংলাভাষাকে নিয়ে অবহেলার শেষ নাই, কাড়াকাড়িও শেষ নাই। এখন যতভাবে পারা যায়, যত আন্দোলন-সংগ্রাম আছে, এর সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ বা ভুলিয়ে দেয়ার নানান ফন্দিফিকির শুরু হয়েছে। একুশের আন্দোলন-দ্রোহ এখন স্টেজ রিহার্সালের জিনিস হয়ে যাচ্ছে। শুধু স্মরণ করলেই হবে, আর কিছুরই দরকার নাই। এখন নিজেকে বদলানোর কালে আমরা আমাদের জীবনকে উৎসর্গের লীলায় জব্দ করে ফেলছি। যত জায়গা থেকে রস বার করা যায়, কর্পোরেট পুজিঁ আজ তাই করছে। দুনিয়া কাঁপানো দশদিনের শ্লোগান কাজে লাগিয়ে মহান একুশেকে নিয়ে লোকদেখানো নাটক বানিয়ে এখন পুজিঁ বাড়ানোর ধান্ধায় নামা হচ্ছে। কোন্ দিন না জানি বলে বসে, আপনাকে আর নিঃশ্বাস নিতে হবে না, কারণ তা লীজ নেয়া হয়ে গেছে। আসলে যতরকমের ভালোমানুষী কৌশল আছে তাই এখন হয় এনজিও না হয় কর্পোরেট পুজিঁ ভাড়া খাটানোর ধান্ধায় নেমেছে।
Anwar Hossain - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ)
আসুন আমরা আই সব সম্পাদকদের পদ লেহন থেকে বিরত থাকি। যারা কিনা গাছের গড়া কেটে আগায় পানি ঢালতে পছন্দ করেন।
মাসুদ করিম - ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ)
উৎসব আনন্দ প্রতিবাদ মুক্তি –এসব কিছুই রাষ্ট্রের শব্দ নয়। কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু এগুলো ব্যবহার করছে ফলে অবশ্যই এর জনতার শব্দার্থ মৃত। আর রাস্ট্র যখন কোনো শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে, তখন প্রথমেই তাতে বাণিজ্য জগতের অধিকার জন্মায়। এবং এভাবেই পৃষ্টপোষকতা চলে যায় বাণিজ্যের দখলে। আমরা নাগরিকেরা এই বাণিজ্য বেষ্টিত অবস্থানে থেকেই উদযাপনে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু নাগরিকদের মধ্যে আমরা যারা নিজেদের অবস্থানে তৃপ্ত কিন্তু সেই তৃপ্তি নিয়ে অস্বস্তিবোধ করি, এই অস্বস্তি নিয়ে যারা ভয় পাই, কিন্তু তারপরও ভাবি : আমার মনে হয় না আমাদের জীবনের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান নিয়েই আমরা একুশ উদযাপন করি। গত কয়েক বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমার একবারও ঢাকা যাওয়া হয়নি, তাই ঢাকার কথা বলতে পারব না, কিন্তু চট্টগ্রামে গত কয়েক বছর ‘ডেসটিনি’র দৃষ্টিকটু ‘টি শার্ট আচ্ছাদিত’ উপস্থিতি পুরো শহীদ মিনারের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এবং এদের উপস্থিতি এতই বেশি থাকে যে কখনো কখনো এমন মনে হতে পারে এ আয়োজন কি কোনো ‘ডেসটিনি’ সম্মেলনের? কিন্তু এ প্রবল উপস্থিতির পরেও যা থাকে, এবং এ প্রবল উপস্থিতির ভেতরে সবার মুখেই নিশ্চয় ‘বিজাতীয় উপনিবেশিক মুখোশ’ নয়, আমরা দেখব অনেক ভালোবাসার মুখ — এবং এরা মোটেই ‘ছত্রভঙ্গ’ ‘ভীরু’ ও ‘অসম্মানিত’ নয়। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের ভেতরের মানুষ হয়েও আমরা যারা এর মধ্যে অস্বস্তিবোধ করি, আমরা আপনার মতো সার্বক্ষণিক ক্রোধ সংগ্রাম রক্ত নিয়ে ভাবতে পারি না। আমরা উদযাপন নিয়ে ভাবি, উদযাপন করতে আমরা ভালবাসি। হতে পারে এ আমাদের ব্যর্থতা, কিন্তু পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের সার্বক্ষণিক বিরোধীদের কাছ থেকেই বা আমরা কি পাচ্ছি?
নিজাম কুতুবী - ১৯ মার্চ ২০১০ (১১:২৮ অপরাহ্ণ)
লেখাটির সাথে একমত হতে পারলামনা