কী মায়া না গাইলেন মাহুত রে
প্রায় পিঠাপিঠি চারটি সিনেমা হল। চারটিতেই একযোগে নাইট শো ভাঙলে সাতমাথার মোড়টা অনেকক্ষণ গমগম করতে থাকে মানুষের ভিড়ে। যে যেদিকেই যাক, সাতমাথায় আসতেই হয়। তারা আসে খেলাশেষে স্টেডিয়াম থেকে বেরুনো মানুষের মতো। একটু আগে দেখা সিনেমাটি গরম চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে না খেলে তাদের আশ মেটে না। সেটা মেটাতে আর দিনের শেষ আড্ডাবাজি সারতে বড়জোর আরও পনেরো মিনিট। রাত তখন বারোটা পেরোয়।
সাতটি রাস্তা যেখানে মিলেছে সেখানটায় চা-লাড্ডু-বনরুটি-পান-সিগারেটের দোকানগুলো ঘিরে কিছু লোক তার পরও খামোখা থেকে যায়। ঢাকা থেকে আসা যাত্রীদের ধরবে বলে পনেরো-বিশটা রিকশাও মোটামুটি জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের চালকেরা সাধারণত বগুড়ার পুবের যমুনার নদীভাঙা এলাকার কৃষক। লোকে বলে ‘পুবা’। বাদবাকিদের বেশির ভাগই রংপুর-কুড়িগ্রামের আধিয়ার। তখনো ঢাকার লোকেরা ‘মফিজ’ বলে এদের নাম ফাটায়নি। তবে তারা পরস্পরের ‘বাহে’, মানে ‘বাবা হে’। তাদের দেশ-গ্রামের পরিচয়ও নাকি ‘বাহের দেশ’।
যাত্রী না আসা পর্যন্ত এই বাহেরা রিকশার হ্যান্ডেলে পা, পিঁড়ির মতো সিট আর যাত্রীর আসনে শরীরটা এলিয়ে সটান শুয়ে জিরোয়। থানার দিকে যে রাস্তাটা গেছে তার গোড়ার ফ্রেন্ডস অডিওতে তখনই ফুল ভলিউমে বাজতে শুরু করবে বাবুল কিশোরের বিচ্ছেদী গান, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখি গো’, কিংবা ফেরদৌসী রহমান কি আর কারও কণ্ঠে ভাওয়াইয়া, ‘ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে’। এই মধ্যরাতে বিক্রিবাট্টার আশা না থাকলেও কী আশায় দোকান খুলে রেখে গানে গানে পত্র লেখা বা কাজল ভোমরার কথা বলে বোঝা ভার। হয়তো আমারই মনের খেয়াল, কিন্তু মনে হয় বিদেশ-বিভুঁইয়ে আছে বলেই ওরা এমন উতলা। ওদিকে ফেরদৌসী তাঁর পরমা গলায় গাইতে শুরু করেন—
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে\
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়
নারীর মন মোর বুরিয়া রয় রে\
ও কি গাড়িয়াল ভাই
কত কাঁদিম মুই নিধুয়া-পাথারে।
ও কি গাড়িয়াল ভাই
হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে।
তারা কি তবে নিধুয়া-পাথারে হাহাকার করে বেড়ানো কোনো নারীর জন্য পথে পথে বাওকুংটা বাতাসের মতো ‘ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে’? যখন আর সে মৈষাল নয়, নয় গাড়িয়াল বন্ধু; সে যখন ওই গরু বা মহিষের ঢংয়েই দুই উরু আর পাছা নাচিয়ে রিকশা চালায়, তখন তার চ্যাংড়া মনে কিসের ফাপর গুমরে মরে কে জানে?
বন্ধু কোন বা চরের মাঝে
এলা কেনে ঘণ্টির বাজন
না শোনেঙ মুই কানে মইষাল রে।
কৃষ্ণের বাঁশি শুনে নয়, গাড়িয়ালের গরুর গলার ঘণ্টি শুনে আকুল হয়ে বাড়ির বাহির হয় ভাওয়াইয়া রাধা। কিন্তু গাড়িয়ালের গাড়ি কি আর এ পথে আসে? মৈষাল গেছে সেই চেংড়িদের দেশে, যারা ‘জানে ধুলা পড়া’, যারা ‘ছল করিয়া কাড়িয়া নিবে/হাতের দোতরা মইষাল রে।’ এবং ‘সেই না দেশে পুরুষ বান্ধা/থাকে নারীর কেশে রে।’ কিন্তু আমাদের রাধাও কম যায় না। ওঝা যেমন সাপের বিষ ঝেড়ে নামায়, তেমনি ‘মুই অভাগী ঝারেঙ বন্ধুক/ক্যাশের আগাল দিয়া রে।’
বাহেদের পূর্বপুরুষ ছিল কৃষিসমাজের সবচেয়ে তলাকার মৈষাল-গাড়িয়াল—মূলত রাখাল। ভাওয়াইয়া গানের মর্মে যে বিরহ-বেদনার গল্প, তার নায়ক এই মৈষাল আর নায়িকা তার ‘যুবা নারী’। এরাই বাহের দেশের রাধা-কৃষ্ণ। তিস্তা বা ধরলা এদের যমুনা। নিধুয়া-পাথার এদের বৃন্দাবন, শিমিলা বৃক্ষ (শিমুল) এদের কদম, বগাবগি কিংবা ডাহুকডাহুকি এদের শুকসারি। আর চিলমারীর বন্দর এদের মথুরা। কৃষ্ণ যেমন মথুরায় গিয়ে আর ফেরে না, ভাওয়াইয়া নারী তার গাড়িয়াল বন্ধুকেও তেমনি হারায় চিলমারীর বন্দরে বা আরও ওপরে কোচবিহারের গোয়ালপাড়ায় কিংবা আসামের কামাখ্যা পাহাড়ে। কিংবা সে বান্ধা পড়ে ব্রহ্মপুত্র কি তিস্তার কোনো চরে জোতদারের বাথানে—
মৈষাল, বাথান কইরচেন বাড়ি—
যুবা নারী ঘরে থুইয়া,
কায় করেন চাকিরি মৈষাল রে।…
বাথান ছারেক, বাথান ছারেক রে
ও মৈষাল ঘুরিয়া আইসেক বাড়ি,
গলার হার বেচেয়া দিম মুঞি
ঐ চাকিরির কড়ি মৈষাল রে।
মৈষাল আর তার যুবা নারীর প্রেম-দাম্পত্য মিলনহীন। তারা যেন চিরবিরহী ডাহুক-ডাহুকি। সামন্ত সমাজে মৈষালের স্বাধীন কোনো ভূমিকা নেই। বাপ-ভাই আর স্বামীর শাসনে নারীটি অবরুদ্ধ। তার প্রেমিক পেটের টানে দূরের দেশে ঘোরে কিংবা আটকে যায় চাকরির ফাঁদে। এই করুণ জীবনের মর্মব্যথা ফুটে ওঠে আব্বাসউদ্দীনের গলায়—
উড়িয়া যায়রে চকোয়া পঙ্খি
বগীক বলে ঠারে
তোমার বগা বন্দী হইছে ধর্লা নদীর পারে।
এই কথা শুনিয়া বগী দুই পাখা মেলিল—
ওরে ধর্লা নদীর পাড়ে যায়া দরশন দিলরে;
বগাক দেখিয়া বগী কান্দেরে
বগীক দেখিয়া বগা কান্দেরে।
ভাওয়াইয়া নারী-পুরুষ এভাবে তাদের সমাজের বন্ধন আর জমিদারি শোষণের ফাঁদে বন্দী হয়ে পরস্পরের জন্য কাঁদে। কিংবদন্তির গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন, ‘এইসব ছবি কালিদাসের বা রবীন্দ্রনাথের হাত থেকে কোনো দিনই আসতে পারে না।’ কারণ, ‘প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও মিলনের সম্পর্ক যে জনসমাজের, তাদের কণ্ঠেই এই ধরনের গান জাগতে পারে।’ (গানের বাহিরানা) তাই ভাওয়াইয়া উত্তরের জনসমাজের জাতীয় গীত।
জনসমাজ বললে আসলে তেমন কিছু বোঝায় কি? আঠারো/উনিশ শতক পর্যন্ত বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর-কোচবিহার অঞ্চলে ব্যাপক আকারে নতুন জনবসতি ও আবাদের পত্তন হতে থাকে। বন কেটে পতিত জমি হাসিল করতে গিয়ে কোচ ও রাজবংশী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বাঙালি কৃষিজীবীরা একাকার হয়ে যায়। এদের বিরাট অংশ মুসলমানও হয় (রিচার্ড ই ইটন, রাইজ অব ইসলাম ইন বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার)। রাজবংশী ও কোচ সমাজের কৌম জীবনের ছাপ তাই ভাওয়াইয়া গানের পরতে পরতে। সংস্কৃতির ভেতর সমন্বয়ের মধ্যে সংঘাতের লক্ষণগুলো চামড়ায় বসন্ত দাগের মতো এখনো ধরা পড়ে। মৈষাল, গাড়িয়াল বা মাহুতের স্বাধীন বিচরণের আকাঙ্ক্ষা আর দরিদ্র কৃষক-কন্যার প্রণয়-প্রতিবাদ সেই ইশারাই করে।
এক নদীতে কয়েকটি স্রোতের মধ্যে একটি যেমন প্রধান, ভাওয়াইয়ার আবহে নারী-মনের বাসনা-বেদনা-বিদ্রোহ তেমনই এক প্রধান স্বর। নারীর এই নিরন্তর আকুলতাই ভাওয়াইয়া গানের প্রাণভোমরা। তাদের মনে তখনো কৌম সমাজের সাম্য ও প্রকৃতিবাসের টান ফুরায়নি। গণনাট্য সংঘের অন্যতম প্রাণপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস মনে করেন, নারীর স্বাধীন প্রেমকে রক্ষণশলীতার নিগড়ে বাঁধার চেষ্টা হলে ভাওয়াইয়া নারী তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বাপ-ভাই যখন তাকে বাল্য বয়সে স্বামী নামক এক অচেনা লোকের কাছে টাকা নিয়ে বিয়ে দেয়, সেই অভাগিনী তখন বাবা-ভাই ও সেই স্বামীকে ক্ষমা করে না। মন পোড়ে তার বগার জন্য, মৈষাল বা গাড়িয়াল বন্ধু বা প্রেমিক কাজল ভোমরার জন্য। মদাসক্ত স্বামীর অত্যাচারে জর্জরিত এই নারীর আশ্রয় তখন চ্যাংড়া দেবর।
থুইয়া আয় মোক বাপ ভাইয়ার দেশে রে
বাপ ভাই মোর দুরাচার
বেচেয়া খাইছে মোক দুরান্তর রে
বেচেয়া খাইছে মোক মদকিয়ার ঘরেরে।
তার কাছে, ‘স্বামী আমার যেমন তেমন/দ্যাওরা আমার মনের মতোন/দ্যাওরা মরলে হবো পাগল, হবো দেশান্তরী রে’। তার এমন প্রণয়ই তার প্রতিবাদ। সমাজপতিদের চাপে তার আপনকীয়া প্রেম যেখানে অবরুদ্ধ, সেখান থেকেই তা পাহাড়ের তলার ঝরনার মতো পরকীয়া প্রেমের খাতে বইতে শুরু করে। তার আপনকার প্রেমের কথাই সে বলে রাধা-কৃষ্ণের বরাতে। কিন্তু তার এই প্রেম রাধা-কৃষ্ণের লীলা নয়, এ তার ব্যক্তিগত ‘সোনার চান্দ’কে পাওয়ার বাসনা। আমরা দেখব, কৌম সমাজের আপনকীয়া প্রেম যখন নিয়ম ও শাস্ত্রের চাপে আর প্রকাশিত হতে পারছে না তখন তার প্রেমিক কালা হয়ে যায় কৃষ্ণ, আরও পরে প্রেমিক কৃষ্ণ প্রভু কৃষ্ণে রূপান্তরিত হন। কিন্তু ভাওয়াইয়া নারীর প্রেম নিজেকে বদলাতে অস্বীকার করে। তার মৈষাল তার আপনকীয়াই, পরকীয়া নয়। কীর্তন-পদাবলি ইত্যাদির সঙ্গে এখানেই তার তফাত। এ পার্থক্য কেবল সুরে বা ভাষায় নয়, এখানেই ভাওয়াইয়া নারীর নিজস্ব স্বর ও আবেগের বিশিষ্ট গড়নটিকে প্রেমের অন্যান্য আখ্যান থেকে আলাদা করা যায়।
দুই.
ভাওয়াইয়ার সুর-কাঠামো আধুনিক গান তো বটেই ‘লোকগীতি’র অন্য অন্য ধারা থেকেও আলাদা। অনেকে একে আর্য ঘরানার বাইরে অনার্য বাহিরানা হিসেবে চিনতে চান। লালনের গান বাউলে গাইলে এক রকম, ভাটিয়ালির ঢংয়ে গাইলে এক রকম আর রাবীন্দ্রিক ভঙ্গিতে গাইলে আরেক রকম। মনের ভাব প্রকাশেও পার্থক্যটা স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ যদি বলেন, ‘আমার মন কেমন করে’, ভাওয়াইয়া নারী বলবে, ‘সোনা বন্ধু বাদে রে কেমন করে গাও রে’। প্রেয়সীর বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ হলে ভাওয়াইয়া বলবে, ‘তুই কালা যেমন দান্তাল হাতি/মুঞিও নারী তেমন ভর যুবতীরে।’ এমন জীবন্ত আর মন-দেহের সপ্রাণ প্রকাশে কীর্তন বা বৈষ্ণব গানের কৃষ্ণের দেহজ কামের বর্ণনাকেও পানসে মনে হতে পারে। ভাব প্রকাশের সকল উপাদান ও রূপক কর্মের আর চারপাশের দেখা জগত্ থেকে নেওয়া। বিমূর্ততার কোনো সুযোগ সেখানে নেই।
বাহের দেশের প্রকৃতি চড়া সুরে বাজে। এই গান মানব-মানবীর ভাবাবেগকে প্রকৃতির উচ্ছ্বাস দিয়েই বোঝে। নিধুয়া-পাথারের রুক্ষতা আর তিস্তা বা ধরলার খরস্রোতের মতোই তাদের জীবন। প্রকৃতির লীলার মধ্যেই তারা তাদের জীবনের অর্থ ও মনের ভাষা খুঁজে পায়। মানবশরীর আর প্রকৃতিশরীরের আলোড়ন-বিলোড়ন ছাড়া কিছুই প্রকাশ হতে পারে না সেখানে। হয়তো তাদের মধ্যে তখনো শরীর আর মনের ভেদ জাগেনি। এ দুয়ের টানাপোড়েনে ভোগা বা এদের শাসন করার ধাত তাদের নয়।
তিন.
একটি প্রশ্ন তার পরও উঠতে পারে: গানের কল্পনা আর জীবনের বাস্তবতার মধ্যে কি কোনো যোগাযোগ ধরতে পারা সম্ভব? জীবনের কোন অভিজ্ঞতা থেকে আসে এই আবেগ, কীসে গড়া হয় ভাবনার ভুবন? দিগন্তে যেভাবে আকাশ আর মাটিকে মিলতে দেখেও সেই মিলন অধরা রয়ে যায়, শিল্প আর জীবনের সম্পর্কের সুতাটিও কি তেমনই অধরা? গীতিকার সুরকার আব্দুল লতিফের আত্মজীবনীতে বলা একটি ঘটনায় সেই সুতার একটা প্রান্ত যেন সহসা মিলে যায়। সেই গল্প দিয়েই শেষ করি: ভাষা আন্দোলনের পরে আব্দুল লতিফ হুলিয়া মাথায় পালিয়ে গিয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের এক গ্রামে, বন্ধুর বাড়িতে। গ্রামের সম্পন্ন কৃষক পরিবার। আদর-যত্নের কমতি নেই। কিন্তু বিড়ম্বনা শুরু হলো সেই বাড়ির পরিচারিকা মেয়েটিকে নিয়ে। চৌদ্দ-পনেরো হবে বয়স। দিনের বেলা সেবা-যত্ন যা করার করে, কিন্তু রাতে সে তাঁর ঘরে শুতে আসে। হাত-পা টিপে দিতে চায় ইত্যাদি। এহেন দশায় পড়ে তিনি ধরলেন শিল্পী বন্ধুকে। বন্ধু ততোধিক বিব্রত হয়ে যে ব্যাখ্যা দেন তা অনেকটা এ রকম। ওই অঞ্চলের রীতি হলো, অতিথি এলে বাড়ির ‘দাসী-বাঁদীদের’ দিয়ে তাঁকে খুশি রাখতে হয়। লতিফ সাহেব তারপর মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেন এবং জানতে পারেন তার বাড়ি রংপুরে। খুবই গরিব তারা। বাপ-ভাই তাকে এক রকম বেচেই দিয়েছে এদের কাছে। বলতে বলতে মেয়েটি কাঁদে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাওয়াইয়া গানের সংকলন ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি বইয়ে একটি গান দেখে চমকে উঠি। মনে হয় এটি যেন সেই মেয়েটিরই দুর্বিষহ জীবনের কথা—যা কাউকে বলা যায় না, এমনকি মাকেও না। গানটিতে এক অভাগিনী নারী বলছে—ও কাক তোমার হাতে আমি এই চিঠি তুলে দিলাম। তুমি এই চিঠি মাকে দিও। কিন্তু মা যখন জলের ধারে যাবে, তখন এ চিঠি দিয়ো না, মা জলে ঝাঁপ দিয়ে মরবে। মা যখন ভাত রাঁধে তখনো দিয়ো না, তাহলে মা অনলে ঝাঁপ দেবে। যখন মা শাড়ি পরবে, তখনো না, মা তাহলে সেই শাড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস নেবে। গানটির শেষে মেয়েটি বলছে—
পত্র থুইবেন কাগা সিথানের পরে
ওকি কাগা দেইখবে মাও মোর সকালে উঠিয়ারে।
গানের সুরে ও ভাষায় এক বিষাদসিন্ধুর কলকল ধ্বনি কি আমরা শুনতে পাচ্ছি? আব্দুল লতিফের বর্ণিত কাহিনীর মেয়েটিই যেন লিখেছে ওই চিঠি?
শিল্প ও জীবন হয়তো কোথাও মিলে আছে আমাদের অগোচরে; এমনকি ইতিহাসও। বাংলার লোকগীতি আসলে বাংলার পল্লী পরিবেশে বয়ে যাওয়া কৃষক জীবনের আখ্যান, আঞ্চলিকতার খোপে খোপে বেড়ে ওঠা এই ভূখণ্ডের মানবিক ইতিহাস। সেই মানুষের আদমসুরত ওখান থেকেই এঁকে নেওয়া সম্ভব। আমাদের নিম্নবর্গীয় সমাজের লিখিত সাহিত্য নেই বললেই চলে। যা আছে তা তাদের নিজস্ব লিখন নয়। একমাত্র লোকগান-লোকসাহিত্যই সেই আধার, সেখানে তাদের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-ভালোবাসার খাঁটি বয়ান আমরা শুনতে পারব। পাব সেই দেশজ মনের খোঁজ যা হয়তো বিদেশি শাসনে, নানান বিপরীত সাংস্কৃতিক চাপে নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি, বিকৃত হয়নি। আমাদের যৌথ মনের শৈশব জানতে তার কাছে তাই ফিরতেই হয়।
বাহের দেশ দূরের কোনো অঞ্চল নয়, কুড়িগ্রামের সীমান্তে তিস্তা, ধরলা আর ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে আড়াই হাজার বছর পুরোনো চিলমারীর বন্দর আজও আছে। সেই বন্দরে এখনো অজস্র দেশি নৌকা ভেড়ে। তার পরও চিলমারীর পথে-বন্দরে পা রেখে মনে হয় সেটা যেন অন্য কোনো জগত্, অন্য কোনো সময়। তার বাস যতটা বাস্তবে মনের গভীরেও ততটাই। গাড়িয়াল-মৈষাল-মাহুত বন্ধুরা সেখান থেকে আর ফিরতে পারে না। ভাওয়াইয়া নারী তার কাছে কিরা কাটে, ‘কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যান কয়া যান রে’। কিন্তু সে ফেরে না। কারণ, ‘মইষের চাকরির ভীষণ দায়, মনের বাঘ মইষালক ধরিয়া খায় রে’।
পিছুডাক মৈষালকে ছাড়ে না। সময়ের খাদ থেকেও কে যেন ফের জিজ্ঞেস করে, ‘ও তোমরা গেলে কি আসিবেন, আমার মাহুত বন্ধুরে।’
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৩০ অক্টোবর ২০০৯ (৭:০৭ অপরাহ্ণ)
ফারুফ ওয়াসিফ শুধু একটা অঞ্চলের গানকে, নারীর আকাঙ্ক্ষাকে, ভাওয়াইয়া গানকে আমাদের চৈতন্যে আনেননি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে একেবারে জলজ্যান্ত করে আমাদের চাক্ষুষ করলেন। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটিই তিনি করে দেখালেন, যেখানে এই ব্লগের প্রয়োজনীয়তা এবং কার্যকর ব্যবস্থাকেই আরও প্রাণময় করলেন যেন। ফারুফ ওয়াসিফ ও মুক্তাঙ্গনকে ভালোবাসা।
অলকেশ মিত্র - ৩০ অক্টোবর ২০০৯ (৭:৫৬ অপরাহ্ণ)
এই লেখা পড়ে, কিছুক্ষনের জন্য অদ্ভুত একটা ভালোলাগা, একটু বিষ্মৃতি এবং মনের ছবিতে অনেকদিনের আঁকা অসম্ভব মমতা মাখানো গ্রামীন জীবনের কিছু টুকরা স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল। লেখকের উল্লেখিত অঞ্চলে নিজের নিবাস না হলেও কোনভাবেই নিজের সত্ত্বাকে এই লেখার বিষয়বস্ত থেকে আলাদা করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, বার বার এই তো আমি, এই তো আসল আমি, এই তো আসলে আমরা এবং আমাদের দেশ।
আহমেদ মুনির - ৩০ অক্টোবর ২০০৯ (১০:৩৯ অপরাহ্ণ)
‘বাহের দেশে’র মানুষের অসম্ভব সুন্দর একটা ছবি উপহার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। সেখানকার মাটি, মানুষ আর তাদের গান আমাকে আচ্ছন্ন করে। আপনার লেখা পড়তে পড়তে বারবার ইলিয়াসের খোয়াবনামার কথা মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল রাঢ় বঙ্গের রুক্ষ মাটির উপর দাঁড়িয়ে ধুধু নিধুয়া পাথারের দিকে তাকিয়ে আছি। বহুদূর থেকে কানে আসছে ‘যদি বন্ধু যাইবার চাও, ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে’… গত চার-পাঁচ বছরে বেশ কয়েকবার জয়পুরহাট, বগুড়া এসব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। জয়পুরহাটেরই এক বন্ধুর বাড়িতে থাকার সময় শুনেছি তাদের ফসল কাটার উৎসবের কথা। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি অথবা শেষের দিকে আশেপাশের নানা অঞ্চল থেকে হাজির হয় বিচিত্র পেশার মানুষ। কেউ ধান কাটতে, কেউ চাল ভেঙে মুড়ি-চিড়া করতে। ফসল তোলার সময়টায় এই লোকগুলো ক্ষেতের পাশেই অস্থায়ী অস্তানা গাড়ে। সারাদিন খাটাখাটুনির শেষে সন্ধ্যার পর নতুন ভাঙানো মুড়ি, কাঁচা মরিচ আর সর্ষের তেল মাঝে রেখে গোল হয়ে বসে সকলে। কখনো কখনো সারারাত ধরে চলে গান। বন্ধুর মুখে এই গল্প শুনে খুব লোভ হয়েছিল এমন ঘটনা চাক্ষুষ করার। কিন্তু পায়ে যে শেকল বাঁধা! তার টানেই ফিরতে হলো। এখনো মাঝেমাঝে ভাবি তেমন কোনো সন্ধ্যার কথা। বাতাসে হালকা কুয়াশা, নতুন ধানের গন্ধের সঙ্গে কামলা-মজুরদের গায়ের গন্ধ মেশামেশি, তার মধ্যে বসে শুনছি আদি অকৃত্রিম ভলোবাসার গান। সেই গানের কথা আবারও আপনি মনে করিয়ে দিলেন। খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি…
মুক্তাঙ্গন - ১ নভেম্বর ২০০৯ (১:১৫ পূর্বাহ্ণ)
ফারুক ওয়াসিফ,
আমাদের মনযোগ আকর্ষিত হয়েছে যে আপনার এই পোস্টটি মুক্তাঙ্গন ছাড়াও সামহোয়ার ইন এবং প্রথম আলো সাময়িকীতেও ছাপানো হয়েছে প্রায় একই সময়ে। প্রথম আলো’র এন্ট্রিটির সাথে মুক্তাঙ্গনের নীতির বিরোধ নেই, কিন্তু অন্য আরেকটি কমিউনিটি ব্লগের প্রথম পাতায় সমসাময়িক ছাপানো পোস্টের ক্ষেত্রে মুক্তাঙ্গনের রি-পোস্ট সংক্রান্ত নীতিটি প্রযোজ্য, যেটির প্রণয়নে ওয়ার্কগ্রপের সদস্য হিসেবে আপনারও অংশগ্রহণ ছিল। বিস্তারিত এখানে (৭ নং নীতিটি দেখুন)। সম্প্রতি অন্য একটি পোস্টকে কেন্দ্র করেও ঠিক একই ধরণের বিতর্কের সূচনা হয়েছে, যা আমাদের সবার জন্যই বিব্রতকর (এখানে, এখানে এবং এখানে দেখুন )। নীতিমালার বৈষম্যহীন প্রয়োগের স্বার্থে আপনার এই পোস্টটি প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেয়া হল, তবে তা আপনার ব্যক্তিগত ব্লগ-পাতায় বহাল থাকবে। আশা করি সমবায়ী এই প্লাটফর্মের এই সহজ নীতিগুলোর বাস্তবায়নে ভবিষ্যতে আপনার কাছ থেকে আমরা আরও বেশী সহযোগিতা পাবো।
ধন্যবাদ।
মুক্তাঙ্গন মডারেশন টিম
ফারুক ওয়াসিফ - ১ নভেম্বর ২০০৯ (১২:০১ অপরাহ্ণ)
আমারই উচিত ছিল, বিধিগুলো দেখা নেওয়া। আর এখন যেহেতু দেখলাম, তাই বিস্মৃত হওয়ার আর কারণ নেই। জানিয়ে রাখি, এর আগেও এখানে দেওয়া পোস্ট অন্যত্রও দিয়েছি। কারণ বোধগম্য।
আমি আনুষ্ঠানিকভাবেই দুঃখ প্রকাশ করছি এবং সিদ্ধান্তটিকে অভিনন্দনের সঙ্গে গ্রহণ করছি।
মুক্তাঙ্গন - ১ নভেম্বর ২০০৯ (৬:৫৩ অপরাহ্ণ)
আপনাকে ধন্যবাদ, সহযোগিতার জন্য।