রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্নে গণতন্ত্রের চেতনা

একটি চমৎকার যোগসূত্র। জামিনের মেয়াদ বাড়ছে আগামী সরকারের মেয়াদ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। বেগম খালেদা জিয়া জামিন পেয়েছেন তিন মাসের। তারই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর একটি মামলায় জামিন পেয়েছেন ৮ মাসের। বর্তমান সরকারের মেয়াদ আছে মাত্র আড়াই মাস। আইন উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেছেন, ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত তারা থাকবেন। এরপর নতুন সরকার দায়িত্ব নেবে।

বর্তমান সরকার, একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব দিয়েই বিদায় নেবে এটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যারা এদেশে রাজনীতি করেন তাদেরও এর প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্খায়ই শীর্ষ রাজনীতিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। বেগম জিয়া ৩ মাসের জামিন পেয়েই বলেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আরও বেশি মামলা দেবেন। কি বিষয়ে মামলা হবে, কারা মামলা করবে এ ব্যাপারে বেগম জিয়া বেশি কিছু বলেননি। এদিকে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেই দিয়েছেন চারদলীয় জোটকে আগামী নির্বাচনে ঠেকানো যাবে না। এর সঙ্গে সমান্তরাল বিষয়টি হচ্ছে শেখ হাসিনা এখনও খালেদার মেয়াদে (অর্থাৎ এই সরকারে পটপরিবর্তনের পরবর্তী কিছুদিন পর্যন্ত) জামিন পাননি। এই দ্বিমুখী নীতি বর্তমান সরকার কেন গ্রহণ করছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট নয়, বর্তমান সরকারের শেষ ইচ্ছেগুলো কি!

এদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশে একটি মৌলবাদী চক্র ততোই সক্রিয় হয়ে উঠছে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে থেকে বাউল সাধন লালন সাঁইয়ের একটি ভাস্কর্য সরিয়ে নিয়েছে এই সরকার, এসব মৌলবাদীদের দাবির মুখে। ভাস্কর্যটি তৈরি করছিলেন শিল্পী মৃণাল হক। এ ঘটনার পরম্পরায় আবার নানা বক্তব্য শুরু করেছে একাত্তরের পরাজিত রাজাকার আলবদর চক্র। মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী নামের সেই পুরনো রাজাকার বলেছে, বাংলাদেশে প্রতিটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হবে ক্রমশ।

কি জঘন্য ধৃষ্টতা। পলাতক আসামি (?) আলী আহসান মুজাহিদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও তার সদস্যদের বৈঠকের পরপর রাজাকার জঙ্গিবাদী চক্র যে সাহস পেয়েছে, ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ার ঘটনা এরই উদাহরণ। দেশে জরুরি অবস্খা থাকার পরও এরা সমাবেশ করে ভাস্কর্য সরানোর হুমকি দেয় কীভাবে? নাকি বিশেষ ছায়া ব্যবস্খায় এসব জঙ্গিচক্রকে প্রোটেকশন দিচ্ছে বর্তমান সরকার?

একটি কথা বাঙালি জাতি খুব দৃঢ়ভাবেই জানে এবং বিশ্বাস করে সৃজনশীল ভাস্কর্য জাতিসত্তার শ্রদ্ধ মননের প্রতীক। শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলাসহ এ দেশের আনাচে-কানাচে অগণিত ভাস্কর্য বাঙালি জাতির স্মৃতি জাগানিয়া শক্তি ও প্রেরণার নিদর্শন। একটি রাইফেল হাতে কোন বীর মুক্তি সেনার ভাস্কর্য দেখলে কোন পরাজিত রাজাকারের গা জ্বালা হতেই পারে। তাই বলে কি সে ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে হবে?

ঠিক একইভাবে মরমীবাদ ও বাংলা সাহিত্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি কৃষ্টির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফকির লালন এই বদ্বীপে প্রখর চেতনায় অসাম্প্রদায়িক মলমন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। তার সঙ্গীত সাহিত্য কর্মই শুধু নয়, তার ভাবনা বাঙালির মননকে শুদ্ধ সমৃদ্ধ করেছে বহুগুণ এবং তার আদৃত হয়েছে গোটা বিশ্বের সাহিত্যমোদীর কাছে।

এসব মৌলবাদী জঙ্গিরা এদেশে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণের বিরোধিতা করেছে। এখন তারা লালনের ভাস্কর্য সহ্য করতে পারছে না। এসবের কাছে রাষ্ট্রপক্ষ নতজানু হচ্ছে বারবার। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ভমিকাও রহস্যজনক।

দুই
অনেক দর কষাকষি করে শেষ পর্যন্ত নাম পাল্টেছে জামায়াত। গেল সাঁইত্রিশ বছর তাদের নাম ছিল, ‘জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশ’। অনেকটা সঙ্গত কারণেই মনে করা হতো এটা ‘জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান’-এর একটি শাখা। এখন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’। তারা আরও বলেছে, ‘আল্লাহর আইন চাই’ এই মুখ্য শ্লোগান পরিবর্তন করে এখন থেকে তারা বলবে ‘ইসলামের শাসন চাই’। ছাত্রশিবিরও নাকি তাদের সহযোগী সংগঠন নয়!! এর মাধ্যমে জামায়াতের মৌলিক চরিত্রের কোন পরিবর্তন হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। বর্তমান নেতৃত্ব বদলে তারা আদৌ অঙ্গীকারবদ্ধ কি না, তাও তাদের বর্তমান নেতৃত্ব ও বর্তমান সরকারই ভাল জানে। তবে একটা সমঝোতা না হলে পুলিশের নাকের ডগার ওপর দিয়ে আলী আহসান মুজাহিদ, কীভাবে গিয়ে আদালতে হাজির হলেন তা রহস্যজনক তো বটেই। কি চমৎকার একটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে ওয়ান-ইলেভেনের চেতনাধারীরা। এর আলামত দেখছে দেশবাসী। দেখছে, পরাজিত শক্তির পুনর্বাসন।

হরকাতুল জেহাদ নামের দলটিও নতুন নামে নিবন করছে। তাদের নেতাদেরও টিভিতে দেখলাম। তাহলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেল, চক্রান্তকারী যে বা যারাই হোক না কেন তারা বর্তমান সরকারের সময়ে নতুন নামে আবির্ভত হতে পারবে। এই তা হলে ছিল ক্ষমতাসীনদের মনে? এটাই তাহলে ওয়ান-ইলেভেনের অন্যতম ফসল? বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার বলেছেন, তাদের নিবনে বাধ্য করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় দায়ে ফেলেই তাদের নিবন্ধিত করা হচ্ছে। না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, গণতন্ত্রের আদর্শ কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত কি কোন জোরদস্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে? একটি অতি সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ঘটনাটি মার্কিন রাজনীতিতে ব্যাপক মেরুকরণের সৃষ্টি করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের প্রথম মেয়াদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সেক্রেটারি অফ স্টেট) মি. কলিন পাওয়েল প্রকাশ্যে ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামাকে সমর্থন দিয়েছেন। কলিন পাওয়েল ঝানু রিপাবলিকান। তিনি মার্কিন জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। কলিন পাওয়েল বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বাঁচাতে বারাক ওবামার বিকল্প কোন নেতা এ মুহর্তে নেই। কেউ কেউ বলছেন, কলিন পাওয়েল নিজে কৃষ্ণাঙ্গ বলেই বারাক ওবামাকে সমর্থন দিয়েছেন। এ অভিযোগ খণ্ডন করে কলিন পাওয়েল বলেছেন, এটা যারা বলছে তারা হীনমন্য। তিনি তার গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে বিবেকপ্রসূত হয়েই বারাককে সমর্থন দিচ্ছেন। আর এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

বাংলাদেশে কি এমনটি কল্পনাও করা যাবে? যুদ্ধাপরাধীদের বয়কট করতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কি দাঁড়াবে এক কাতারে, না-দাঁড়াবে না। বরং সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগ নেতারাও জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করার সুযোগ খুঁজবে। জাতীয় অস্তিত্ব এভাবেই নড়বড়ে হয়েছে বারবার রাজনীতির ভাস্করবৃত্তির কাছে। এখন ঘাতক রাজাকাররা, প্রগতিবাদীদের রাজনীতির পাঠ দিচ্ছে। উপদেষ্টা হাসান আরিফ, ডা. হোসেন জিল্লুর, আনোয়ারুল ইকবাল, ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলামরা পাহারা দিচ্ছেন রাজাকারদের নিরাপত্তায়! জানি না, আর দেখার কি বাকি আছে।

নিউইয়র্ক, ২২ অক্টোবর ২০০৮

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

5 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
5
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.