একটা পরিকল্পিত আপসরফা চলছে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি তাদের কোন খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ। তার বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। পুলিশ বলছে, তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি ‘সংলাপ’ করছেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে, উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। সে ছবি দেশ-বিদেশের মানুষ টিভিতে দেখছে। কি আজব দেশ! কি অদ্ভুত সার্কাস! কবি শামসুর রাহমান বেঁচে নেই। না হয় তাকে হয়তো আরেকটি কবিতা লিখতে হতো। ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। দেশ যাচ্ছে কোথায়? কেন এভাবে বিবেক বন্ধক রেখে নির্বাচনের ডঙ্কা বাজানোর খেল পাতা হয়েছে? রাষ্ট্র এবং আইনের শাসনের মাঝে সম্পর্ক কি? এসব অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই, সরকারি নীতি-নির্ধারকদের কাছে।
উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান চমৎকার কথা বলেন। তিনি পাশ্চাত্য থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা তিনি জানেন, বোঝেন। জানেন আধুনিক মানুষের চাওয়া পাওয়াও। তার অনেক কথায় আমি বেশ নান্দনিকতার ছোঁয়া পাই। যেমন- ‘নির্বাচন থেকে অযোগ্য করে রাখা; ‘সংস্কারের সড়ক’ ইত্যাদি। সম্প্রতি তার বচনভাণ্ডারে নতুন একটি বাক্য যুক্ত হয়েছে। ‘উপলব্ধির বিবর্তন’। কাব্যিক শব্দগুলো শুনতে আমার খুব ভাল লেগেছে। তার ভাষায়, এদেশে মানুষের উপলব্ধির বিবর্তন হচ্ছে। বিবর্তন হতেই পারে। বিবর্তন ধারাটি হচ্ছে একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানুষ কালে কালে গ্রহণ-বর্জন দুটোই করেছে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষ ক্রমেই বিয়োগাত্মক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে যোগাত্মক কর্মকাণ্ডের দিকেই ঝুঁকেছে বেশি। গ্রহণ করেছে আধুনিকতা। সৃজনশীলতা, ক্রিয়েটিভ আউটলুক যে কোন মানুষ, সমাজকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
কোন সৃজনশীলতার দর্শন নিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ওয়ান-ইলেভেনের রণভেরি ভাসিয়েছিল, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট নয় এজন্য, তারা যা করতে চেয়ে শুরু করেছিল তা শুধু অসম্পূর্ণ নয়, জটিল হয়ে থেকে যাচ্ছে। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা মদদপুষ্ট হয়েছে ভিন্ন মেরুতে। যেমন বেশ কিছু দুর্নীতির বিচার অসমাপ্ত থাকার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতিবাজরাই পালে হাওয়া পেয়েছে। বহুল আলোচিত সেই ঘাতক রাজাকাররা দেশে ময়ুরপুচ্ছ মেলে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ খুঁজতে সাহসের দাপট দেখাচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে সেই খুনি-রাজাকাররা এখন তাদের গঠনতন্ত্রে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি যোগ করে জাতিকে নতুনভাবে আইওয়াসের সুযোগ নিচ্ছে। বলা যায়, এটা ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ধৃষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়। কারণ এই রাজাকাররা কখনই মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে- তা বাংলাদেশে কোন পাগলও বিশ্বাস করবে না। তাহলে কি নির্বাচনী নিবন্ধনের জন্য তারা পার পেতে চাইছে, এটাই কি উদ্দেশ্য? জানতে ইচ্ছে হয় এটাই কি উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের ভাষায় ‘উপলব্ধির বিবর্তন’?
সরকার কর্তৃক এই বিবর্তনে সঙ্গে হাঁটছে প্রধান দুই দলও। বিএনপি ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তা তাদের টাস্কফোর্স গঠনের ধরন ও প্রচেষ্টা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও দর কষাকষি শেষে নির্বাচনে যাবে তাও প্রায় নিশ্চিত। যদিও শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থিতার বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তা রাখছে দু’পক্ষই। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো।
দুই
বাংলাদেশে অনেক হালকা ঘটনাও মানুষের হাসির খোরাক হয়। ‘ডেমোক্রেসি ওয়াচের’ প্রধান তালেয়া রেহমানের একটি ক্ষুদ্র সাক্ষাৎকার দেখলাম চ্যানেল আইতে। তাতে তিনি বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য তার স্বামী শফিক রেহমানকে দায়ী করলেন! বিষয়টি হাসির উপপাদ্য বিষয় তো বটেই! আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ‘ডেমোক্রেসি ওয়াচের’ নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তালেয়া রহমান শুধু শফিক রেহমানের পত্নীই নন, এই সেদিনও খালেদা জিয়াকে সভা করতে দিয়েছেন তার বাসায়। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তালেয়া, খালেদাকে। এটা তো কোন নিরপেক্ষতার নিদর্শন নয়। এখন দেশবাসী দেখছে তালেয়া রেহমান দুই নারী নেত্রীর পক্ষে সমানতালে বক্তব্য দিয়ে সমতা রক্ষার চেষ্টা করছেন।
এই যে সমতা রক্ষার চেষ্টা, তা করছেন বর্তমান উপদেষ্টামণ্ডলীও। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির যেসব উপকরণ ফিল্ডে ছাড়া হয়েছে তা আদৌ নিরপেক্ষতার বীজ বপন করছে না বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে তা খুব কম সময়ের মধ্যেই অনুধাবন করতে পারবে দেশের মানুষ। এটা রাজনীতিকরাও জানেন এবং বোঝেন, এই দেশের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এবং গুরুত্ব দেশের মানুষের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। এবং দিতেই হয়। আর সে প্রক্রিয়াই ঐক্যবদ্ধ করতে পারে বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের হাতকে। কিন্তু অবাক হয়ে আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র। বর্তমান সরকার তাদের কাজের আগাম বৈধতা চাইছে। তা নিয়ে তারা দর কষাকষিও করছে বিভিন্ন দলের সঙ্গে।
বাংলাদেশের রাজনীতি বিদেশনির্ভর করতে রাজনীতিকরা কি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে? আমরা প্রায়ই দেখি বিদেশের বিভিন্ন দেশে (বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায়) বাংলাদেশ বিষয়ে শুনানি হয়। তাতে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনাও হয়। সম্প্রতি লন্ডনে হাউস অব লর্ডসে তেমনি একটি সেমিনার হয়েছে। এতে শেখ হাসিনা নিজে উপস্খিত থেকে বলছেন, বাংলাদেশে আদালতকে প্রভাবিত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করা হচ্ছে। নেপথ্যের এই মতলব যদি সত্য হয় তবে দেশের ভাগ্যে আরও দুর্ভোগ আছে তা নি:সন্দেহে বলা যায়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কি কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়? বিশ্বের কোথাও হয়েছে এমন নজির আছে? পাকিস্তানের দিকে দেখুন চোখ মেলে। যে আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ ছিল তিনিই এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। দেশের জনগণ কি তাকে ক্ষমা করে দিল? তার সব অবৈধ কর্ম (!) জায়েজ হয়ে গেল? উপমহাদেশ সেই বলয় থেকে এখনও বেরুতে পারেনি তা অস্বীকার করবে কে? কোন উপায় নেই অস্বীকার করার।
আমরা আবারও দেখছি বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের ঢাকাস্খ রাষ্ট্রদূতরা তাদের কুটনৈতিক চাল চেলেই যাচ্ছে না, তারা কথা বলছেন গা বাঁচিয়ে। সিলেটী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে ‘নল তল বর্ষা’। অর্থাৎ বর্ষার পানি বাঁশের খুঁটির ওপর দিয়েও যেতে পারে আবার খুঁটি স্পর্শ করে নিচ দিয়েও চলে যেতে পারে। নলটি তলিয়ে যেতে পারে অথবা নলের তলার স্পর্শ করতে পারে বর্ষার পানি।
এভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বানের ভবিষ্যদ্বাণী করছেন আমাদের বিদেশী প্রভুরা। আমরা বুঝে গেছি, এদেশের রাজনীতি বিদেশনির্ভর। আমরা জেনে গেছি, সামন্তবাদী বলয় থেকে বের হওয়ার সাধ্য বাংলাদেশের মানুষের নেই। ড. হোসেন জিল্লুর এবং তার পরিষদ কিছু আপ্তবাক্যই শুনিয়ে যাচ্ছেন। যা শুনতে খুব ভাল লাগছে। মানুষের কোন উপকারে আসছে বলে মনে হয় না।
নিউইয়র্ক, ১৫ অক্টোবর
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
নীড় সন্ধানী - ১৯ অক্টোবর ২০০৮ (৯:২৮ পূর্বাহ্ণ)
অন্য কথায় বলা যায় আমরা মেনে নিয়েছি সামন্ত বলয়ের অস্তিত্ব। বিদেশী প্রভুদের আশীর্বাদের ছায়া আমাদের ঘিরে রেখেছে ১৭৫৭ সাল থেকেই। ১৯৪৭ সালে প্রভু বদলানোর আন্দোলনে সফল হলাম। স্বধর্মের বিজাতীয় প্রভুর বৈমাত্রিক আদরে অতিষ্ট হয়ে ১৯৭১ সালে লক্ষ প্রানের আত্মত্যাগের বিপরীতে জীবনে প্রথম বার স্বজাতির শাসন পেলাম। কিন্তু বিজাতীয় শকুনের ছায়া এড়াতে পারলাম না। আমরা মাথা তুলে দাড়ানোর আগেই ঠোক্কর খেতে খেতে মরলাম। আবার জাগলাম। আবার ঘুমালাম। ছায়া আমাদের ছাড়ে না।
এখন ২০০৮। রাজনৈতিকগুলোর নিজেদের হিসেব নিজেরা বুঝে নেয়ার কোন আয়োজন দেখছি না। কুটনৈতিক পাড়ায় রাজনৈতিক অংক মিলানোর আভাস। সেই পুরোনো ঘ্রান। গেষ্ট হোষ্টের কাজে ব্যস্ত। ১৮ ডিসেম্বর আসছে। বিজয় মিছিল আর হরতাল কী আবার মুখোমুখি হবে রবিবারে?
ফকির ইলিয়াস - ২০ অক্টোবর ২০০৮ (২:১৬ পূর্বাহ্ণ)
হাঁ, সেটা হবার সম্ভাবনাই বেশী। দেশ আবারো মৌলবাদীদের দখলে। রাজাকার মুজাহিদ পুলিশের নাকের ডগার উপর দিয়ে আদালতে জামিন নিতে যায়। পুলিশ তাকে দেখে না।
মৌলবাদীদের দাবিতে সরিয়ে নেয়া হয় লালনের ভাস্কর্য। একসময়ের
সংস্কারবাদী ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইফুর রহমান বসে মিটিং করেন , খালেদা জিয়ার সাথে।সবই যেনো ফ্যাকাশে।
18 ডিসেম্বরের পর কি হবে , এর নমুনা এখনই দেখছি আমরা। নতিজা দেখতে বাকী দুইমাস। শকুনেরা তৎপর।
জাতি কি তাহলে মরা গরু ? এভাবেই ভক্ষিত হবে বার বার ????
নীড় সন্ধানী - ২০ অক্টোবর ২০০৮ (৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ)
পুরো জাতি কোন না কোন ভাবে আস্থার সংকটে ভুগছে। যারা প্রচলিত রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে তারা যেমন এই সংকটে নিপতিত, তেমনি আমার মতো যারা প্রচলিত নৈরাজ্যকর গনতন্ত্রের চেয়ে নিয়ন্ত্রিত শৃংখলায় বিশ্বাস করে বেশী, তারাও আস্থার সংকটে আছে।
১/১১ একটা অলৌকিক পরিবর্তন ঘটাবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। ১৯৭১ এর শকুন বাদে যে কোন শক্তিকে দেশ পরিচালনায় দেখতে রাজী ছিলাম যদি শৃংখলা ফিরিয়ে দিতে পারে। ১০০% দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ না হলেও অন্ততঃ একটা নতুন যাত্রা শুরু হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু পুরোনো শকুনদের সদর্প বিচরন, দেশকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ট চিত্রকলা, আমাদের আকাশে আশংকার ছায়াপাত করছে আবার।