প্রশ্নগুলো অত্যন্ত দীর্ঘ। কিন্তু উত্তর খুবই সংক্ষিপ্ত। প্রশ্ন হচ্ছে, যে জাতি রক্তবন্যা বইয়ে রাষ্ট্র স্বাধীন করেছিল, সে জাতির ভাগ্যে আজ এত দুর্ভোগ কেন? কেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছতে এত হোঁচট খেতে হচ্ছে। আর উত্তর হচ্ছে কিছুই হয়নি। কিছুই হচ্ছে না। কিছুই হবে না। যেমন ছিল তেমনি থেকে যাচ্ছে সবকিছু।
ঈদের ছুটি শেষ হলো। এখন দেশে চলছে দূর্গা পূজার উৎসব। ঈদে বেশকিছু টিভি অনুষ্ঠান দেখলাম। নন্দিত নাট্যকারের একটি নাটক দেখলাম। এর নাম ‘মহান চৈনিক চিকিৎসক ওয়াং পি’। হাসির নাটক। নাট্যকার খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন দেশ যেমন ছিল তেমনি অবস্খায় ফিরে যাচ্ছে। অভিনেতা ডা. এজাজ ছিলেন ‘মহান চৈনিক চিকিৎসক’। একটি ভণ্ড চিকিৎসকের চরিত্রে। নাটকের শেষ দৃশ্যে তিনি ‘থু’ বলে শেষ করেন তার সংলাপ।
হ্যাঁ, সবাই তাদের সেই পুরনো চরিত্রে ফিরে যাচ্ছে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজরা। নষ্ট রাজনীতির পালে এখন নতুন হাওয়া। প্রশিকার ড. কাজী ফারুক নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে মাঠে নেমেছেন। ‘সম্মিলিত নাগরিক আন্দোলন’। কারা এই দেশের নাগরিক? লুটেরা বণিক শ্রেণী, নাকি শোষিত মজলুম মানুষ, যারা ঘামে-শ্রমে কাটান প্রতিদিন? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। যারা যা করার কথা নয় তারাই তা করছে। সবকিছুই নাগরিক অধিকার। আর সে অধিকারে সুশীল ভাবনার ছড়াছড়ি। এই সুশীল ভাবনা আপামর মানুষের কোন কাজে আসে কি না সেদিকে নজর কারও আছে বলে মনে হয় না। মনে না হওয়ারই কথা। কারণ যারা শোষণ করে তাদের শ্রেণী চরিত্র একই।
সমাজে হোক আর রাজনীতিতে হোক। এরা মনে করে জনগণ তাদের তাঁবেদার। যা চাপিয়ে দেয়া হবে জনগণ তা মেনে নেবে। মেনে নেয়ও জনগণ। না নিয়ে উপায় থাকে না। মাঝে মাঝে জনতা বিদ্রোহীও হয়। জন্ম দেয় নতুন নতুন ফুলবাড়ীর।
নতুন অফিসে যাত্রা শুরু করেছে বিএনপির রাজনীতি। হাওয়া ভবনের আদলেই অনেকটা। এখন শুধু তারেক জিয়া নেই। এটি সভানেত্রী বেগম জিয়ার কার্যালয়। কথা ছিল শফিক রেহমানের বাসাটি ব্যবহার করা হবে অফিস হিসেবে। তা এখন বাদ দেয়া হয়েছে পত্রপত্রিকার সমালোচনার মুখে। বিএনপি ভেতরে ভেতরে রাজনীতিমুখী। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি করছে? তাদের অবস্খা যে খুব সুসংহত তা বলা যাবে না। শেখ হাসিনার স্খায়ী জামিন এখনও হয়নি। মামলাগুলোর খড়গের নতুন নতুন দামামা বাজানো হচ্ছে।
[sb]দুই.[/sb]
একটা বিষয় বেশ নিশ্চিত বর্তমান সরকার বেশকিছু ভিআইপিকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। যে কারণে বেশকিছু মামলার রশি ধরে টান দেয়া হচ্ছে জোরেশোরেই। সাইফুর রহমান ও আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে আবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আবার নেপথ্যে জামিনের ব্যবস্খাও করা হচ্ছে! তাহলে প্রকৃত ঘটনা কি? কি করার চেষ্টা করা হচ্ছে?
যারা মুক্তি পেয়েছেন কিংবা পাচ্ছেন, তারা নির্বাচন করতে পারবেন কি না, তাও নিশ্চিত নয়। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা নির্বাচনের জন্য তৈরি। সে কথা ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু কারা নির্বাচন করতে পারবে কারা পারবে না, বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত।
একদিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে নতুন দল তৈরির কারিগরি, দুটো বিপরীত ধর্মী না হলেও একটা গোপন ইচ্ছে থেকেই যাচ্ছে এর নেপথ্যে। সেটা কি তা জনগণ হয়তো সময় মতোই জানতে পারবে। কিন্তু কথা হচ্ছে তা থেকে দেশের মানুষের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু রয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। আর তা হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবু শেখ মুজিবুর রহমানও একসময় ভেবেছিলেন, এদেশে আলবদর রাজাকার আর কোনদিনই রাজনীতি করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে এর উল্টো ঘটনা। জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমেই একটি বিশেষ শ্রেণী ঘাতক দালালদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এদেশে সুদৃঢ় করে। পরে এরা ক্ষমতারও ভাগীদার হয়। আজ এই ২০০৮ সালেও যেভাবে দাবার ঘুঁটি পরিচালনা করা হচ্ছে তাতে সেই পরাজিত শক্তিকেই পুনর্বাসিত করার সুপ্ত ইচ্ছা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও বর্তমান সরকার এ বিষয়ে অত্যন্ত রহস্যজনক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
কীভাবে ওয়ান ইলেভেনের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে কিংবা আদৌ হবে কি না তা বর্তমান নীতিনির্ধারকরাই বলতে পারবেন। তবে জরুরি অবস্খার ছায়া বহাল রেখে তারা যে নির্বাচন করে পার পেতে চাইছেন তার সত্র ধরেই নির্বাচন পরবর্তী সময় উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। যে পক্ষ পরাজিত হবে তারাই এর রশি টানাটানিতে নেতৃত্ব দিতে পারে। সাময়িকভাবে, কৌশলগত কারণে নির্বাচন থেকে ‘বিরত রাখা’ নেতারা বিভিন্ন মারমুখী ইস্যুর নেতৃত্বে চলে আসতে পারে।
বাংলাদেশ এমন কোন গণতান্ত্রিক দেশ নয়, যে দেশের রাজনীতির বহমানতা পরিশুদ্ধ নেতা তৈরি করে। এদেশে নেতা গণতান্ত্রিকভাবে তৈরি হয় না। নেতা তৈরি হয় দলীয় প্রধানের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে। ফলে নবম জাতীয় সংসদে অনেক বিজ্ঞ নতুন মুখ দেখা যাবে বলে যারা ফুলঝুরি ওড়াচ্ছেন তা শেষ পর্যন্ত ফাঁকা বুলি বলেই প্রমাণিত হতে পারে। তার কারণ হচ্ছে, রাতারাতি গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলকে এদেশের মানুষ সহজে গ্রহণ করে না তা বার বারই প্রমাণিত হয়েছে।
বিকল্পধারা, গণফোরাম, এলডিপি, পিডিপি, সম্মিলিত নাগরিক আন্দোলন সবই দু’চারটার বেশি আসন পাওয়ার আপাতত সম্ভাবনা নেই। আমরা জানি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তারপরও যখন দেখি সহস্র শ্বেতাঙ্গ বারাক ওবামার ছবি বুকে লাগিয়ে দৃঢ় ভাষায় বলছেন ‘ইউ আর মাই লিডার,’ তখন মনে হয় মানুষ বৈষম্য দু:শাসনের বিরুদ্ধে জয়ী হবেই। আহা! বাংলাদেশের রাজনীতি যদি সে আলোকে পরিচালিত হতো। সুপ্রিয় পাঠক, শারদীয়া শুভেচ্ছা সবাইকে।
নিউইয়র্ক, ৮ অক্টোবর ২০০৮
