প্রেসিডেন্ট বুশ জাতিসংঘে যে ভাষণ দিয়েছেন তা মার্কিনি জনগণের মনে মোটেই রেখাপাত করতে পারেনি। তার কারণ একটিই। আট বছরের শাসনামলে বুশ গণ উন্নয়নের কোনো স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। যা বলেছেন সবই ফাঁকা বুলি। ছিল মিথ্যাশ্রিত নানা ফন্দিফিকিরও। তাই মার্কিনিরা খুবই ক্ষিপ্ত। বুশের বিদায় নিতে মাত্র ক’মাস বাকি। তাই তার কোনো দম্ভোক্তিই মানুষ আর শুনতে চাইছে না। বুশের এবারের জাতিসংঘ ভাষণকে রুটিন ওয়ার্ক বলেই বিবেচনা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকরা।
চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে যুক্তরাষ্ট্র। তা কাটিয়ে উঠতে বুশ খোলা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। দুই প্রধান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন ম্যাককেইন ও বারাক ওবামা সাড়া দিচ্ছেন বুশের ডাকে। বুশ বলেছেন, গোটা মার্কিনি অর্থনীতিই ‘হাইরিক্স’ এর মুখোমুখি। তিনি এ অবস্থাকে ‘দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক রি-সেশন’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। বুশ বলেছেন, ৭০০ বিলিয়ন ডলার রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দিয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা করার যে বিল উত্থাপিত হয়েছে তা দ্রুত পাস করার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এদিকে বুশের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে জন ম্যাককেইন ও বারাক ওবামা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই। এই বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘আমরা দেশ ও জাতির স্বার্থে এই চরম অর্থনৈতিক সংকটকে আর দীর্ঘ হতে দিতে পারি না। এটাই এখন আমাদের পথ ও সুযোগ, ঐক্যবদ্ধভাবে ওয়াশিংটনকে আবারো সকল শক্তি ও সাহায্য প্রদান করার। যাতে আমরা আমাদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারি’।
জন ম্যাককেইন ইতিমধ্যেই তার নির্বাচনী প্রচার সংক্ষিপ্ত করে মার্কিন কংগ্রেস সামিটে যোগ দিতে ওয়াশিংটনমুখী হচ্ছেন। বারাক ওবামাও যাচ্ছেন সে সামিটে।
এদিকে বড়ো বড়ো বেশকিছু স্টক মার্কেটিং কোম্পানি লেহমান ব্রাদার্স, গোল্ডম্যান শাকস, জেপি মরগান, মেরিল লিঞ্চÑ এগুলোতে ধস নেমে আসার প্রকৃত কারণ কী তা তদন্ত করে দেখতে মাঠে নেমেছে এফবিআই-এর বেশকটি টিম। কোনো ঘাপলা, দুর্নীতি করে এই ধস নামাতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের কোনো ভূমিকা আছে কিনা তা সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করে দেখবে এফবিআই। তারা রিপোর্ট প্রদান করবে মার্কিন কংগ্রেসে।
অর্থনীতির এই মন্দাবস্থায় নতুন নতুন পরিকল্পনা উপস্থাপন করে আবারো লাইমলাইটে চলে এসেছেন সিনেটর বারাক ওবামা। তিনি বলেছেন, আমি তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা মানুষ। আমি মানুষের দুঃখ-বেদনা অনুভব করতে পারি। আমরা ডেমোক্র্যাটরা যে পরিকল্পনা দিচ্ছি, তা জনগণ কর্তৃক গৃহীত হলে মাত্র চার বছরেই যুক্তরাষ্ট্র সব সংকট কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হবে।
এটা ঠিক, শিকাগো অঙ্গরাজ্যের সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার আগে মার্কিনিরা নামও জানতো না অত্যন্ত মেধাবী, ত্যাগী এই নেতা বারাক ওবামার। সিনেটর পদে পাস করার পরই তার নাম উচ্চারিত হতে থাকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে। শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়ন লাভে সমর্থ হন ডেমোক্রেটিক পার্টির।
দুই .
তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বের কথা আমরা উপমহাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে প্রায়ই শুনি। কিন্তু যারা গণপ্রতিনিধি, যারা সত্যিকারের তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা নেতা, তারা কি নির্বাচন এলে মনোনয়ন পান? না, এদের অধিকাংশ নেতাই মনোনয়নের মুখ দেখেন না।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেবে। কতোটা দেবে, তা দেখার বিষয়। তবে মহাজোট তৈরি করে আওয়ামী লীগ ওয়ান-ইলেভেন পূর্ববর্তী নির্বাচনের যে প্রস্তুতি নিয়েছিল তাতে মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্বের প্রাধান্য ছিল কি? না ছিল না। বরং জোট করতে গিয়ে কতিপয় চিহ্নিত মৌলবাদীদেরকেও মনোনয়ন তালিকায় নিয়ে এসেছিল আওয়ামী লীগ। যা ছিল মহান বিজয়ের চেতনাকে অবজ্ঞার শামিল। এবারো মহাজোটের মাধ্যমে তারা তেমনটি করবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।
একটি কথা খুবই স্পষ্ট, যে নেতার নিজ দেশমাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে না তার দ্বারা দেশ সেবা হয় না। হতে পারে না। আজ আওয়ামী লীগের মোর্চায় যেসব কট্টরপন্থী মৌলবাদীরা ভিড়তে চাইছে তারা প্রকৃত পক্ষে এই মাটিকে কতোটা ভালোবাসে তা প্রশ্নবিদ্ধ।
একই অবস্থা প্রযোজ্য বিএনপির বেলায়ও। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, আব্দুস সালাম পিন্টু, রুহুল কুদ্দুস দুলু, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বেশকিছু দাগি নেতাকে বিএনপি সরিয়ে দিতে পারে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী করবে তা তারাই জানে। তবে যারা সরাসরি জঙ্গি মদদ দিয়েছিল, যারা এই দেশে দফায় দফায় বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছিল তাদের তো এ দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকারই থাকার কথা নয়। তারা রাষ্ট্রের প্রতি, জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। রাষ্ট্রের আমানত রক্ষা করতে পারেনি।
বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছেন, দেখা যাক মহাজোট গড়ে তারা কী করতে পারে। এদিকে মৌলবাদী রাজাকার শক্তি জামাতকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনমুখী বিএনপি সব প্রস্তুতিই নিতে শুরু করেছে। দুই নেত্রীর সংলাপও শেষ পর্যন্ত হবে কিনা তা নিয়ে বাড়ছে সংশয়। রাষ্ট্রীয় নীতিমালা নির্ধারণে প্রধান দল, দলের নেতানেত্রীর মাঝে মুক্ত আলোচনা হতেই পারে। তা দূরত্বকে যেমন কমিয়ে দেয়, জাতীয় সংকটের ঘনঘটাকেও তেমনি লাঘব করে। বাংলাদেশে এই সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে উঠলে জাতি অনেকাংশেই মুক্তি পেতো। বাড়তো মানুষের মনে বিশ্বাস।
জাতীয় স্বার্থে ম্যাককেইন-ওবামা দুজনেই যৌথ বিবৃতি দিয়ে এক মঞ্চে দাঁড়াতে বিন্দুমাত্র দেরি কিংবা অবহেলা করেননি। একজন জাতীয় নেতার এটাই প্রধান দায়িত্ব। দেশকে ভালোবাসতে হলে ব্যক্তিগত হীন স্বার্থ পরিত্যাগ করতেই হয়। আর সে জন্য মৃত্যুভয়ও সত্যিকার নেতানেত্রীকে কাবু করতে পারে না। জনগণের আস্থা অর্জনে রাজনীতির স্বচ্ছ নৈতিকতাই পরিপুষ্ট করতে পারে একটি জাতীয় অবকাঠামো।