নির্বাচনের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের পটপরিবর্তন হয়। কিন্তু তা মানুষের ভাগ্য সবসময় বদলাতে পারে না। ভাগ্য বদলানোর জন্য দরকার রাজনৈতিক প্রত্যয়। বাংলাদেশে সে প্রত্যয় গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠলে রাজনীতিকরা মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে সর্বনাশ করতে পারতেন না। অথচ তেমনটিই ঘটেছে। প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়। রাজপথে মানুষ রক্ত দিয়েছে। তারপরও গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে এক ধরনের সামন্তবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতা একদলের হাত থেকে অন্যদলের হাতে গেছে। উপকৃত হয়েছে রাজনীতির দুষ্টগ্রহ। এরা জেঁকে বসেছে। রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থেই এদের সরাতে চাননি। বরং কাজে লাগাচ্ছেন নিজের মতো করে।
মানুষ এই দেশ থেকে স্বৈরশাসন হটালো। গণতন্ত্র আসবে বলে সাজলো দেশ। কিন্তু কথা দিয়েও প্রতারণা করলেন সেই রাজনীতিকরাই। তাদের যদি ন্যূনতম দরদ থাকত তবে এমনটি হতো না। নিজেদের সন্তানদের বিদেশে পাঠান তারা লেখাপড়ার জন্য। আর কৃষক-মজুরের সন্তানরা বটতলা, কদমতলায় দাঁড়িয়ে ছাত্ররাজনীতির ঝাণ্ডা ওড়ায়। তাদের ব্যবহার করা হয় হীন স্বার্থে।
জোট-বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির মৌলিক চরিত্র একটি। তারা বারবার জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। কাজের বেলায় দেখিয়েছে অন্য চরিত্র। সে চরিত্র লুটপাটের, দুর্নীতির, সন্ত্রাসের। মানুষকে আটকে রাখার চেষ্টা করেছে উভয় পক্ষই। শিক্ষিত হয়ে গেলে তীব্র প্রতিবাদী হয়ে যেতে পারে জনগণ। এ রকম একটি ভয় ছিল দুই প্রধান শিবিরেই। ফলে সাঁইত্রিশ বছরের বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও পর্যাপ্ত শিক্ষার ছোঁয়া নেই। বাজেট অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খাতে বেশি থাকলেও, শিক্ষা ক্ষেত্রে সবসময়ই রাখা হয়েছে অপ্রতুল। বদলানো হয়নি সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্খা। পানিপথের যুদ্ধ কিংবা নবাব আকবর-বাবরের বিবাহ কাহিনী এই প্রজন্মের শিক্ষার্থী না শিখলেও কিছু যাবে আসবে না। বলা যায় ওসবের এখন প্রয়োজনই নেই। এখন শিক্ষা ব্যবস্খা হওয়া চাই বিজ্ঞান প্রযুক্তি, আধুনিকতা নির্ভর। বাংলাদেশে যে টাকা লুটপাট করা হয় তা বাঁচিয়ে প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার দেয়ার কথা কোন সরকারই ভাবেনি। শিক্ষার উন্নয়নে তাদের রুটিন ছিল হতাশাজনক।
পরিস্খিতি বিষিয়ে উঠেছিল খুব। সরকারের সমান্তরাল, ভবন সর্বস্ব সরকার। পদলেহীদের তর্জন-গর্জন। স্খায়ী মসনদ দখলের স্বপ্ন। সবমিলিয়ে একটি সুদরপ্রসারী মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন ভবনওয়ালারা। সেটাতে বাদ সাধতেই একটা ওয়ান-ইলেভেন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
তার পরের দু’বছরের ঘটনা বেশ নাটকীয়। পজিটিভ-নেগেটিভ দু’ভাবেই সমালোচনা করা যাবে। তবে পর্ণ মল্যায়নের সময় এখনও এসেছে বলে মনে হয় না। একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বড় কঠিন। যারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, এরাও মুক্তি পাচ্ছেন কিভাবে? তাহলে কি রাষ্ট্রের ইচ্ছায় তাদেরকে মামলা দিয়ে আটকানো হয়েছিল? নাকি এরা দোষী হলেও তাদের দোষ এখন ঢেকে দিতে চাইছে রাষ্ট্র? এ রকম প্রশ্ন আরও আছে। সময়ে হয়তো প্রশ্নসংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
দুই
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর ’০৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২৪ ও ২৮ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাচন। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারই উপজেলা নির্বাচন করবে তা প্রায় নিশ্চিত। নির্বাচন নিয়ে বেশ জোরেই এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ। খুব সামান্যই দরত্ব এখন তাদের বর্তমান সরকারের সঙ্গে। তাদের কেন্দ্রীয় নেতারাও একে একে মুক্তি পাচ্ছেন। নির্বাচন হবে তা ধরে নিয়েই যদি আগানো যায়, তবে এর করণীয়ও ভাবতে হবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা পরিষদের প্রধান টিএইচ ইমাম। তার বক্তব্য টিভিতে শুনলাম। তারা নতুন নতুন পরিকল্পনা করছেন। প্রচারণা চালানো হবে ইসির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হবে।
এমন অনেক কথাই বললেন টিএইচ ইমাম। যারা দণ্ডপ্রাপ্ত নেতা এরা মনোনয়ন পাবেন কি না প্রশ্ন আছে তা নিয়েও। সরকার কিছু নেতার মনোনয়ন রহিত করতে তৎপর। এমন সংবাদ দীর্ঘদিন থেকেই দেখছি আমরা। বড় বড় দল কিংবা জোটের এসব নেতারা মনোনয়ন পান কি না তা দেখার বিষয়। অথবা টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রিত্ব পান কি না তাও বলে দেবে ভবিষ্যৎ সময়।
নির্বাচন নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির খেলা দু’পক্ষই খেলছে। সরকার পক্ষ এবং রাজনৈতিক দলগুলো উভয়েই তা খেলছে নিজের মতো করে। রাষ্ট্রের একটি সংবিধান তো আছেই। যারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ এরা এখন খুব সুবিধা করতে পারছেন না। বেশ চুপসে গেছে ‘জরুরি অবস্খায়’ জন্ম নেয়া দলগুলোও। নির্বাচনে অংশ নিয়ে দু-চারটা আসন তারা পেলেও তাতে কি? এমন আসন তো ’৯৬, ২০০১ সালেও কেউ কেউ পেয়েছিল। এমপি হয়ে যাওয়াই বাংলাদেশে তো শেষ কথা নয়।
প্রশ্নটা হচ্ছে নৈতিকতার। নীতিহীন রাজনীতি সবসময়ই অন্ত:সারশন্য। দলীয় পদ ছেড়ে দিলে ব্যাংক ব্যবসা থাকবে না এমন মানসিকতা নেতাদের। যার ফলে ক্ষমতায় গেলে হরতাল-আন্দোলন হবে না, সে নিশ্চয়তা তারা দিচ্ছেন না। দেয়ার ইচ্ছাও তাদের নেই। যদি ওয়ান-ইলেভেনের ছায়া নবম জাতীয় সংসদ-পরবর্তী সময়ে দ্রুত সরে যায়, তবে পরিস্খিতি খুবই নাজুক হয়ে উঠতে পারে। কারণ এককভাবে বিএনপি জোটের শাসন মেনে নেবে না আওয়ামী লীগের মহাজোট। আবার মহাজোটের শাসনও মেনে নেবে না চারদলীয় জোট। অতএব, গোলযোগ ছাড়া গত্যন্তর কি?
বিদেশের পত্রিকাগুলো লিখছে, জেনারেলরা সহসা ফিরছেন না। যদি না ফেরারই ইচ্ছে থাকে গোপনে, তবে তো পন্থাও উদ্ভাবিত হবে। সেটা কি হতে পারে? এই প্রশ্নের জবাবের সঙ্গেই নির্বাচন হওয়া-না হওয়ার সঙ্গতি খুঁজছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপি জোটের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর পালে এখনও হাওয়া লাগেনি। তারা ধীরে এগুচ্ছেন মনে হচ্ছে। তবে সমঝোতা শর্ত মানলে নির্বাচনে তাদের যেতেই হবে এমন ধারণা সরকারের। বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মতে আবার বিএনপি-জামায়াত জোটই ক্ষমতায় আসবে। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ ইমেজকেই তারা আয়না হিসেবে বিবেচনা করছেন।
তবে এটা এখন পর্যন্ত খুব নিশ্চিত, গণবিবেকের বুদ্ধিবৃত্তি কাজে লাগিয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা কোন দলই ভাবছে না। তাদের উভয়ের সামনেই এখন মামলা থেকে স্খায়ী মুক্তির স্বপ্ন। এই দুই বছরে যা ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা। আর্থিক, মানসিক দুটো ক্ষতিরই বদলা নেয়ার ইচ্ছেও আছে কারও কারও। যদি সেটাই সত্য হয়, তবে বাংলাদেশ আরও পিছিয়ে যেতে পারে। মৌলবাদী, সন্ত্রাসী গডফাদাররা মধ্যস্বত্বভোগে জোর তৎপর হতে পারে। এটা কখনোই কাম্য ছিল না। এখনও নয়। কিন্তু খুনিও তো জামিন পাচ্ছে। জামিন পেয়েই পালিয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে। সময় মতো আবার আসবে। কারণ দেশেই থেকে যাচ্ছে তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকরা। রমজান মাস শেষ হলেই নতুন তোড়জোড় দেখা যাবে। এরপর কি হবে তা দেখতে সবাই উদগ্রীব। একটা সৎ পরিবর্তনের হাওয়া সবার চাওয়া। সে হাওয়া বইবে কি? সুপ্রিয় পাঠক-পাঠিকা, সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
নিউইয়র্ক, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮
——————-