নির্বাচনকে সামনে রেখে চরম সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দা ক্রমশ চরমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ধস নামার পর স্টক মার্কেটেও নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। লেহমান ব্রাদার্স নামের বিখ্যাত স্টক ব্রোকার কোম্পানিটি ‘চ্যাপ্টার ইলেভেন’ দাখিলের মাধ্যমে ব্যাংকক্রাপসি করার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থনীতির এই দেউলিয়াপনা শঙ্কিত করে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবন।
ওয়াশিংটন মিচ্যুয়াল, গোল্ডম্যান শাকস প্রভৃতি বড় বড় কোম্পানিতেও শুরু হয়েছে নানা ধকল। বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল লেহমান ব্রাদার্স। নিউইয়র্কে ৬ হাজারসহ পুরো বিশ্বে ২৬ হাজার ২০০ কর্মজীবী ছিলেন এই কোম্পানিতে। দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ায় এরা সবাই চাকরি হারিয়েছেন।
মেরিল লিঞ্চ নামের আরেকটি ইনভেস্টম্যান্ট ব্যাংককে ৫০ বিলিয়ন মূল্যে কিনে নিয়েছে ব্যাংক অব আমেরিকা। মর্গেজ লগ্নিকারী দুটি সংস্থা ‘ফানি মে’ এবং ‘ফ্রেডি ম্যাক’কে সরকারি অনুদান দিয়ে চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগার।
সব মিলিয়ে এক বিপন্ন সময় অতিক্রম করছে যুক্তরাষ্ট্র। জর্জ বুশের শাসনকাল শেষ হওয়ার মাত্র ২ মাস আগে এই চরম সংকটাপন্ন অবস্থা আরও বিষিয়ে তুলেছে নাগরিক জীবন। রাজনীতিতে এখন মুখ্য আলোচনার বিষয় হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার ঘটনা। ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামা বলেছেন, বুশ প্রশাসনের চরম ক্রান্তিকালের শেষ পর্যায়ে আছি আমরা এখন। তার শাসনের ৮ বছর গোটা জাতিকে কয়েক যুগ পিছিয়ে দিয়েছে। বুশ প্রশাসন কখনোই ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করেনি। মধ্যশ্রেণীর জনজীবনের দিকে তাদের কোনো নজরই ছিল না। ফলে এখন আমরা এমন ঘোর সংকটে নিপতিত হয়েছি।
রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন ম্যাককেইন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ভিত অত্যন্ত মজবুত। এখন আমরা খুব ‘ডিফিকাল্ট টাইম’ অতিক্রম করছি। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমরা কখনোই জাতিকে আর এই দুঃসময়ের মুখোমুখি হতে দেব না। আমরা ওয়াল স্ট্রিটের রমরমা অবস্থা দ্রুত ফিরিয়ে আনব।
জন ম্যাককেইনের সুরেই কথা বলেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। তিনি বলেছেন, আমরা অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার জোর চেষ্টা করছি। প্রতিবেশী দেশগুলো এবং মিত্র শক্তির সহযোগিতায় আমরা অর্থনীতির সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব বলেই আমার বিশ্বাস।
বুশ কিংবা ম্যাককেইন যাই বলুন না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ চাইছেন ৮ বছর পর একটা পরিবর্তন আসুক। অবসান হোক রিপাবলিকান যুগের। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বারাক ওবামা এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে কি আছে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। একজন কৃষ্ণাঙ্গকে হোয়াইট হাউসের অধিকর্তা হিসেবে দেখতে মার্কিনী জাতি কতটা প্রস্তুত কিংবা আদৌ প্রস্তুত কি না, সে প্রশ্ন বারবার করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বারাক ওবামার মূল ভোটের পুঁজিতে হানা দেয়ারও সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন জন ম্যাককেইন।
জরিপে দেখা গেছে আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর সারাহ পলিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেয়ার পর জন ম্যাককেইনের পক্ষে মহিলা ভোট বেড়েছে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে হঠাৎ করেই জন ম্যাককেইনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। যদিও নিউইয়র্ক রাজ্যটি ডেমোক্রেটদের ভোটব্যাংক বলে পরিচিত।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ইরাক-আফগান ইস্যু, স্বাস্থ্যনীতির উন্নয়ন, শিক্ষা উন্নয়ন, গোয়েন্দা শক্তি বৃদ্ধি প্রভৃতি ইস্যুতে বারাক ওবামা জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছেন। অন্যদিকে সন্ত্রাস দমন, স্বদেশের স্বার্থরক্ষা, অভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব প্রভৃতি ইস্যুতে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছেন জন ম্যাককেইন। দেশব্যাপী জরিপে এই মুহূর্তে জন ম্যাককেইন ৭৯ ভাগ এবং বারাক ওবামা ৬৭ ভাগ জনপ্রিয়তা পেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে তা প্রায় প্রতিদিন উঠানামা করছে।
এ দিকে ক্ষমতার শেষ মাসগুলোতে এসেও বুশ প্রশাসনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব আরও অতিষ্ঠ করে তুলেছে মার্কিনী জনমানস। পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরুর হুমকি, ইরানে আক্রমণ পরিচালনার অভিলাষ বারবারই নিন্দিত হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিনী জনজীবনে রিসেশনের রাহুগ্রাস, এই প্রজন্মকে রিপাবলিকানদের প্রতি আরও ঘৃণাপ্রবণ করে তুলছে।

দৈনিক ডেসটিনি । ২১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ রোববার প্রকাশিত

ফকির ইলিয়াস

একটা সূর্য চাই, একটা চন্দ্র চাই / নদীর নীরব নগরে পসরা সাজাই ।।

৪ comments

  1. রায়হান রশিদ - ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৮:৪১ অপরাহ্ণ)

    লেখককে ধন্যবাদ।

    গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সবাই উচ্চারণ করে চলেছেন ‘মেল্টডাউন’, ‘মন্দা’, ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ ইত্যাদি শব্দগুলো। এসব শব্দমালার সাথে বাংলাদেশ বা এর ভাগ্যের আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কিনা, কিংবা থাকলে তার স্বরূপ কি, তা তুলে ধরাটা জরুরী। অন্তত জনমনে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে হলেও। বিদেশী প্রচার মাধ্যমের প্রায়োরিটির তালিকায় বাংলাদেশ পড়বে, এমনটা আশা করিনা। সুতরাং, আমাদেরকেই তুলে ধরতে হবে যোগসূত্রগুলো, সহজ সরল বাংলায়।

    অর্থনীতির এই জটিল বিষয়গুলো খুব যে বুঝি, তা বলবার কোন উপায় নেই। যারা বোঝেন, তারা ব্যাপারগুলো স্পষ্ট করলে ভালো হয়। ওয়াশিংটন মিউচুয়াল, গোল্ডম্যান স্যাকস এবং পশ্চিমের স্টক এক্সচেঞ্জের ধকল কিভাবে বাংলাদেশের মত দেশের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলছে বা ফেলতে পারে তা ব্যাখ্যা করলে সবাই উপকৃত হব। লেখককে অনুরোধ করবো বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য।

    আরেকটি ছোট বিষয়। কোন বিষয়ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট term ব্যবহার করার সময় এর সহজ মানেটা লিখে দিলে (টীকা আকারে হলেও) মনে হয় ভালো হয়। ‘চ্যাপ্টার ইলেভেন’ শব্দ দু’টির মানে গুটিকয় কর্পোরেট আইনজীবি, ব্যবসায়ী ফার্ম এবং আমেরিকা নিবাসীর বাইরে বাকী দুনিয়ার মানুষের কাছে অবোধ্য ঠেকতেই পারে।

    • ফকির ইলিয়াস - ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (২:৪২ পূর্বাহ্ণ)

      যুক্তরাষ্ট্রে হাওয়া দিলে দুনিয়ায় তুফান ছুটে। এমন একটা প্রবাদ আছে।
      দুনিয়া এখন ছোটো হয়ে আসছে ! বাংলার মানুষ মোবাইল ফোন চিনে , এর বিল কত টাকা , কিভাবে দিতে হবে তাও তো বুঝতে হবে ! নয় কি ?
      আম্রিকায় ”ষ্টক মার্কেটে ধ্বস ” এই দোহাই দিয়ে গোটা বিশ্বে দাম – দর
      উঠা নামা করতেই পারে । সে বিস্তারিত সবার ই জানা আজকাল।
      ”চ্যাপ্টার ইলেভেন” যুক্তরাষ্ট্রে বিজনেস ব্যাংক্রাপসি ( দেউলিয়া) ঘোষনার একটা ধারা।
      আমি অর্থনীতিবিদ নই। ক্ষুদ্র লেখক মাত্র। অতএব আমার সীমাবদ্ধতা তো
      থাকবেই ।ধন্যবাদ আপনাকে।

      • রায়হান রশিদ - ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:৩১ পূর্বাহ্ণ)

        যুক্তরাষ্ট্রে হাওয়া দিলে দুনিয়ায় তুফান ছুটে। . . . আম্রিকায় ”ষ্টক মার্কেটে ধ্বস ” এই দোহাই দিয়ে গোটা বিশ্বে দাম – দর উঠা নামা করতেই পারে।

        আপনার কথায় যুক্তি আছে। হয়তো সেই কারণেই আরো বেশী করে জানা দরকার সেই “তুফানের” স্বরূপ। নইলে আমাদের মত আম জনতারা বুঝবে কিভাবে কোনটা সত্যিকারের সংকট, আর কোনটা কৃত্রিম, কোনটা সিন্ডিকেটসৃষ্ট? আর সমস্যার স্বরূপই যদি না বুঝতে পারি, তাহলে তাকে মোকাবিলাই বা করবো কিভাবে আমরা?

        বিষয়গুলো কারো জানা থাকলে লিখুন না প্লীজ . . .

        • ফকির ইলিয়াস - ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৫৩ অপরাহ্ণ)

          দুনিয়াটা এখন পুঁজিবাদের চারণক্ষেত্র। ”গ্লাসনস্তো ” ও পেরেস্ত্রেইকা” র
          উত্থানের পর একক সামন্তবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। যারা একসময়
          সাদ্দাম, লাদেন কিংবা ওমর আব্দুর রহমান কে পুষেছিল , তারাই একসময়
          এদের বৈরী হয়ে ওঠে।
          তেলের নিয়ন্ত্রণ নিতে মিথ্যা অজুহাতে ইরাক যুদ্ধ না বাধালেও পারা যেতো।
          ট্রিলিয়ন ডলার ইরাক – আফগান যুদ্ধে খরচ হচ্ছে। সে ভর্তুকি তো দিতে
          হবেই।
          আমার মনে হয় কর্পোরেট সংকট সৃষ্টি করে সে ভর্তুকির অংশ টি গোটা বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.