নতুন সূর্যের প্রজ্বলনে প্রতিষ্ঠিত হোক জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ

উৎসবমুখর এখন বাংলাদেশ। এ উৎসব নির্বাচনের। এ উৎসব পরিবর্তনের। চারদিকে চলছে প্রতিশ্রুতির পালা। প্রার্থীরা ছুটছেন আনাচে-কানাচে। যারা কখনই এসব নেতাকে দেখেনি, তারা দেখছে­ এই তাদের সম্ভাব্য প্রতিনিধি। নির্বাচন নিয়ে নানা মেরুকরণ সবসময়ই হয়। এবারও হচ্ছে? একটি মহল মধ্যস্বত্বভোগে ব্যস্ত। তারা ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চাইছে। এই মহলটির নতুন পরিচয় এবার দেখছে দেশবাসী। খুনের হুমকি হলে সেটাকেও তারা বলছে­ এটা জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা!
ভারতীয় কিছু মিডিয়ায় খবর এসেছে­ আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের জন্য জঙ্গিবাদীরা তৎপর। এটা একটি মারাত্মক দু:সংবাদ। অথচ এই খবর বের হওয়ার পর চারদলীয় জোটের নেত্রী, রাজাকারদের মূল আশ্রয়দাতা খালেদা জিয়া কি প্রতিক্রিয়া দেখালেন? তিনি বললেন, পরিকল্পিতভাবে নাকি দেশকে জঙ্গিবাদী বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তার বক্তব্যের সারাংশ হচ্ছে­ শেখ হাসিনা সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এমন অপপ্রচার চালানোর প্রত্যয়ী হচ্ছেন। খালেদা জিয়া আরও বললেন, একটি উদার মুসলিম দেশ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণí করার চেষ্টা করছে একটি জোট।
কি জঘন্য মানসিকতা! হুমকি কে দিচ্ছে- কোথা থেকে আসছে তা তদন্তের দাবি না করে বরং তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই কথা বলা শুরু করলেন! এটা কি সহনশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিদর্শন? একজন দলপ্রধান কোন দায় নিয়ে এমন অসংলগ্ন কথা বলতে পারেন?
এর দু’দিন পরই কুমিল্লায় খালেদা জিয়ার জনসভার দেড় মাইল দূরে থেকে চারটি গ্রেনেডসহ তিনজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর পরই খালেদা জিয়া জনসভায় দাঁড়িয়ে বললেন, তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে­ কারা করছে এসব? এদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? যখন শেখ হাসিনা হুমকির সম্মুখীন হন­ তখন নীরব থাকেন খালেদা জিয়া, সস্তা জনপ্রিয়তার কথা বলেন। এখন তার জনসভার কাছাকাছি গ্রেনেড পাওয়ার পরই তিনি বুলি পাল্টিয়ে দিলেন। খালেদার ভাষায় দেশে ‘জঙ্গিবাদী নেই’। যদি তাই হয় তবে তার জনসভার কাছে কারা বোমা নিয়ে বসেছিল? গ্রেফতারকৃতদের প্রকৃত পরিচয় কি? খালেদা কি আড়ালে কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন?
ভাবতে অবাক লাগে­ খালেদা জিয়া সেসব জঙ্গি গডফাদারের পক্ষে ভোট চাইছেন। ২০০১-এর নির্বাচনে জিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের প্রতি কি আচরণ করেছিল জামায়াত-বিএনপির ক্যাডাররা তা জাতি এখনও ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি পূর্ণিমা রানীর প্রতি নারকীয় আচরণের কথা। চারদলীয় জোট এভাবেই তাদের জয়োল্লাস করে ২০০১ সালে। এর পরই ঘটতে থাকে মর্মান্তিক ঘটনাবলি একের পর এক। গণভবনের পাশাপাশি গড়ে ওঠে ‘হাওয়া ভবন’। এই ভবন থেকে পরিচালিত হতে থাকে প্যারালাল সরকার। বিএনপি মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের প্রত্যক্ষ সমর্থনে মাঠে নামে দানব বাংলাভাই। সে গাছে লটকিয়ে মানুষ হত্যার ভয়াবহ চিত্র দেখায় বিশ্ববাসীকে। সেই লোমহর্ষক ঘটনার পরও সংসদে দাঁড়িয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেন দেশে কোন জঙ্গি নেই।
এর পরের ঘটনাগুলো এখনও দেশবাসীর চোখের সামনে ভাসছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর আক্রমণ, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, শাহ কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ড, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড, দেশজুড়ে একসঙ্গে বোমা হামলা, এজলাসের বাইরে জোড়া বিচারক হত্যাকাণ্ড­ এভাবে একের পর এক ঘটতে থাকে রক্তের হোলিখেলা। না, এত কিছুর পরও পদত্যাগ করেননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। পদত্যাগ করেননি তার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। বরং সেই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে খুনের মদদ ও খুনিদের বাঁচানোর জন্য ২২ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে পরবর্তী সময়ে। দেশে তারেক-কোকো-বাবর-মামুনরা কেমন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল­ তা ভুলে যায়নি দেশবাসী। দৌড় সালাউদ্দিন, সন্ত্রাসী পিন্টু, লালু, বুলু, দুলুরা দেশবাসীকে মনে করেছিল তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। দেশের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান লালন করেছিলেন গৃহপালিত ভূমিখেকো দস্যুচক্র। নিজে বানিয়েছিলেন প্রাসাদ। হারিছ চৌধুরীরা নিয়ন্ত্রণ করছিল আন্ডারওয়ার্ল্ড।
দুই
বাংলাদেশের মানুষ সেসব দুর্বিষহ চিত্র ভুলে যায়নি। যাওয়ার নয়। এখন সেসব সন্ত্রাসী গডফাদারই হয়তো দলীয় না হয় স্বতন্ত্র মনোনয়ন নিয়ে ভোটে প্রার্থী হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগের ফন্সাঙ্কেনস্টাইন বলে যে জয়নাল হাজারী-হাজী সেলিম-শামীম ওসমান-ডা. ইকবালদের প্রচার করা হয়েছিল এরা কেউই এবার মনোনয়ন পায়নি। ভোটেও দাঁড়ায়নি। অথচ বিএনপির ক্যাডার এবং সন্ত্রাসী গডফাদার ভিপি জয়নাল, পিন্টু, বাবর, সা. কা, মওদুদ, ‘দৌড় সালাহউদ্দিন’, এহছানুল মিলনরা এবারও নির্বাচন করছেন। কারা দেশে সন্ত্রাস চায়­ আর কারা চায় না, তা অত্যন্তই পরিষ্কার এখন জাতির সামনে।
নির্বাচনের ঠিক পূর্বক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়তে নাকি মাত্র দু’বছর লাগবে। ২০১১ সালের মধ্যে তিনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে দেবেন।
এই সেই খালেদা জিয়া যিনি বলেছিলেন, ‘বোবা, শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়’। অতএব নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা তিনি মানেন না। কমনওয়েলথের কর্মকর্তা স্যার নিনিয়ান গিয়েও বুঝাতে পারেননি খালেদা জিয়াকে। তার আপসহীনতার রোষানলে পড়ে একের পর এক প্রাণ ঝরছিল বাংলাদেশে ’৯৪-৯৫ সালে।
এই সেই খালেদা জিয়া যিনি নিউইয়র্কে বলেছিলেন, ‘সিলেট বিভাগ গঠনের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই’। পরে তীব্র আন্দোলন করে সিলেটবাসী বিভাগ বাস্তবায়ন করেছিল। এই সেই খালেদা জিয়া যিনি এখন বলছেন, এই দেশ তার শিকড়ভূমি। তিনি দেশ ছেড়ে কোথাও যাননি। তাকে কেউ দেশ ছেড়ে যেতে আদৌ বলেছিল কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কেউ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া তো আর পালিয়ে যাওয়া নয়। আর খালেদার দুই পুত্র দেশে যে  পুকুরচুরির সম্ভার গড়ে তুলেছে­ সেগুলো পাহারা দেয়ার জন্যই তো তার দেশে থাকা জরুরি। তিনি না থাকলে সিঙ্গাপুরে পাচারকৃত কোটি টাকা উদ্ধারের জন্য দেন-দরবার করবে কে? মামুন-বাবর-লালু চক্রকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে কে?
২০০৬ পর্যন্ত যে অসমাপ্ত জঙ্গিতত্ত্বটি গড়তে পারেননি, খালেদা জিয়া এবার জিতে সেই অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করতে চান। শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন যারা ‘দেশ বেঁচো, মানুষ মারো’ নীতি চালু করেছিল­ তারা এখন দেশ বাঁচানোর শ্লোগান দিচ্ছে।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি জাতির জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জাতি নির্ধারণ করবে তারা কোন পথ বেছে নেবে। জঙ্গিবাদী অপশাসন নাকি আধুনিক মননের বাংলাদেশ। প্রজন্মকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এদেশে লালন-হাসান-কামরুল-জয়নুলের স্মৃতি থাকবে কি থাকবে না। জরুরি অবস্খার মধ্যে যারা লালন ভাস্কর্য, বলাকা ভাস্কর্য ভাঙার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে এরা রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ পেলে কি করতে পারে­ তা ভাবতে হবে। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গি হায়েনাদের ভোটে পরাজিত করে বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে­ এদেশে বাগান সাজাতে হলে আগে খালেদা জিয়ার তৈরি জঙ্গিবাদী জঙ্গল পরিষ্কার করতে হবে। আর এজন্য অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শক্তিকে বিজয়ী করার কোন বিকল্প নেই।
আধুনিক বিশ্বের মিডিয়াগুলো নির্বাচনের সময়, তাদের দেশের বিভিন্ন প্রার্থী, দলকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এনডোর্সমেন্ট করে। বাংলাদেশে সে প্রথা এখনও গড়ে ওঠেনি। এটি গড়ে  উঠলে সাধারণ মানুষের প্রার্থী বাছাই কাজটি বেশ সহজতর হতো।
যারা এই লালসবুজের পতাকাখচিত বদ্বীপটিকে মনেপ্রাণে ভালবাসেন, তাদের বিনীত অনুরোধ করি­ বুকে হাত দিয়ে শপথ নিন মৌলবাদমুক্ত, জঙ্গিবাদমুক্ত, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। সংগঠিত করুণ প্রতিটি প্রতিবেশীকে। যার যা কিছু আছে, তা দিয়ে প্রতিহত করুন এই দাবনশক্তিকে।
নিউইয়র্ক­ ২৪ ডিসেম্বর ২০০৮
======================

ফকির ইলিয়াস

একটা সূর্য চাই, একটা চন্দ্র চাই / নদীর নীরব নগরে পসরা সাজাই ।।

২ comments

  1. রণদীপম বসু - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৮ (৫:৩২ অপরাহ্ণ)

  2. সানোয়ার - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ (৮:১৮ অপরাহ্ণ)

    দানবশক্তিকে প্রতিহত করার প্রথম ধাপে পা রেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। দেখা যাক সামনের ৫ বছরে কতটা কী হয় …

    আপনার লেখা সব সময় পড়ি; কিন্তু এই ব্লগে কোনো যৌথ আলোচনায় আপনাকে অংশগ্রহণ করতে দেখি না! অন্যদের লেখা সম্পর্কেও আপনার মতামত পেলে আমরা সাধারণ পাঠক-পাঠিকারা উপকৃত হব। ধন্যবাদ।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.