‘যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ চাই’ এই প্রত্যয় ব্যক্ত করে পালিত হলো ২০০৮-এর বিজয় দিবস। এবারের বিজয় দিবস পালিত হলো এমন এক সময়ে, যখন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র আর ১৩ দিন বাকি। দেশ এখন নির্বাচনমুখী। বড় দুটি দলের দুই শীর্ষ নেত্রী বেরিয়েছেন ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণায়। তারা চষে বেড়াচ্ছেন জেলা থেকে জেলা। নিজ প্রতীক তুলে দিচ্ছেন নিজ নিজ দলের প্রার্থীদের হাতে। আর দেশের জনগণকে বলছেন, ভোট দিতে হবে তাদের প্রার্থীকেই। দুই নেত্রীর জনসমাবেশেই প্রচুর লোক সমাগম হচ্ছে। জনতার ঢেউ একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।
জনসমাগম দেখে বোঝার কোন উপায় নেই, কারা আগামী সংসদ নির্বাচনে পাস করবে। জানার কোন উপায় নেই রাষ্ট্রের জনগণের মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার চারপাশ ঘিরে রাখছেন সেই নেতারাই যারা বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে জেল-হাজতে ছিলেন। জোট সরকারের শাসনামলে তাদের দু:শাসনে ভীষণ আতঙ্কিত ছিলেন দেশের মানুষ। এ নেতাদের অনেকে এবার প্রার্থী হতে পারেননি। কিন্তু তারা মাঠে নেমেছেন, তাদের পছন্দের ছায়া প্রার্থীকে তারা সমর্থন দিচ্ছেন।
এটা খুবই স্পষ্ট দুটি প্রধান দলই চাইছে, দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক। কারণ নির্বাচিত সরকার এলে এতে রাজনীতিকদের কর্তৃত্ব থাকবে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো যা খুশি করতে পারবেন। যেমনটি তারা আগেও করেছেন। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির অভিযোগে কিছু কিছু প্রধান নেতা যে নিজ নিজ দলেই কোণঠাসা হয়ে আছেন তা তো দেশবাসী দেখছে। দেশের মানুষ দেখেছে দুটি প্রধান দলের সম্পাদকদের বর্তমান হাল-অবস্খা। একজন দল থেকে বিদায় নিয়েছেন। অন্যজনের সব ক্ষমতা ও খর্বিত হয়েছে। এখন সেই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বটি পালন করছেন, একজন ‘মুখপাত্র’, প্রকারান্তরে তিনিই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। এটাও বুঝতে পারছেন দেশবাসী। দুটি প্রধান দলে একটি নেপথ্য লুটপাট সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল, তা দুনেত্রীও জানতেন। তারপরও তারা তা কঠোর হাতে দমন করলেন না কেন? করলে তো আজ এমন দুরবস্খার সৃষ্টি হতো না রাজনীতির ময়দানে।
বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। তিনি সিলেট-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তার পক্ষে প্রচারণার জন্য বিএনপিপন্থি দু’জন বুদ্ধিজীবী সিলেটে গিয়েছিলেন। এই দু’জন শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমান। এদের পরিচয় দেশবাসীকে নতুন করে জানানোর দরকার নেই। এ দু’জন সাইফুর রহমানের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে অপর প্রতিদ্বন্দ্বী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। তাদের এই মিথ্যার বেসাতিগুলোকে আমার কোন ভাঁড়ের গল্প বলেই মনে হয়েছে।
সাইফুর রহমান সিলেট এবং মৌলভীবাজারে সন্ত্রাসের কেমন গডফাদার ছিলেন তা সে অঞ্চলের মানুষ ভালই বলতে পারবেন। সাইফুর রহমানের ছেলে নাসের রহমান ছিলেন সে এলাকার স্বঘোষিত রাজকুমার। তার হীন কৃতকর্মের শুধু একটি ঘটনাই আমি বলতে চাই।
লন্ডন থেকে ‘সাপ্তাহিক জনমত’ নামে একটি সাপ্তাহিকী প্রকাশিত হয় মহান মুক্তিসংগ্রামের বেশ পর্ব থেকেই। এ সাপ্তাহিকটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে ব্যাপক ভমিকা রাখে। সেই সাপ্তাহিক পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক নবাব উদ্দিন। একজন কৃতী লেখক, সাহসী সাংবাদিক হিসেবে দেশে-বিদেশে তার পরিচিতি আছে। জোট সরকারের সময়ে ‘জনমত’ পত্রিকায় সাইফুর রহমান, নাসের রহমান এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতির একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। এর কিছুদিন পর লন্ডন থেকে দেশে যান নবাব উদ্দিন। তিনিও মৌলভীবাজার এলাকার সন্তান। নবাব উদ্দিন বাড়িতে যাওয়ার পরপরই শুরু হয় ফোনে তাকে ধমক। সাইফুর রহমানের ভাড়াটে মাস্তানরা নবাব উদ্দিনকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে। তিনি স্খানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্খার কাছে সাহায্য চাইতে যান। তারাও বলেন, অর্থমন্ত্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের কিছুই করার নেই।
এই হুমকি চলতেই থাকে। নবাব উদ্দিন ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েন। তিনি লন্ডনে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হুমকিদাতারা তার খোঁজে হন্যে হয়ে বেরিয়ে পড়ে। ফলে তিনি খুব গোপনে চট্টগ্রামে চলে যান। এবং সেখান থেকে হোটেল ‘আগ্রাবাদ’-এর কর্ণধার মিসেস মনোয়ারা হাকিম আলীর সহযোগিতায় ভিন্ন পথে, প্রায় পালিয়ে লন্ডনে আসতে সমর্থ হন। এ নিয়ে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় সে সময় ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। এই হচ্ছে সাইফুর রহমানের গডফাদারতন্ত্র। যে রাজ্যে তিনি আরিফুল হক চৌধুরীর মতো অনেক ফন্সাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেছেন সিলেট বিভাগ অঞ্চলে। নিজ নামে, নিজ পত্নীর নামে সাইনবোর্ড দিয়েছেন যত্রতত্র। সেই সাইফুর রহমান কোন মুখে সিলেটে গিয়ে ভোট চাচ্ছেন? এই সাইফুর রহমানের ব্যক্তিগত হিংসার শিকার মৌলভীবাজার-২ এলাকার সাবেক এমপি এমএম শাহীন। ২০০১-এর নির্বাচনে সাইফুর রহমানের ব্যক্তিগত অনিচ্ছার কারণে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন পাননি এমএম শাহীন। পরে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনে করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুলতান মুহাম্মদ মনসুরকে হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন।
২০০৬ সালের শেষ দিকে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মৌলভীবাজারের কুলাউড়া (মৌলভীবাজার-২) অঞ্চল সফরে গিয়ে এমএম শাহীনকে দলে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু ২০০৮-এর নির্বাচনে এসে দেখা গেল এমএম শাহীনকে সে আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিল না। কেন দিল না? তাও হয়েছে সাইফুর রহমানের ব্যক্তিগত অনিচ্ছার করণেই। অথচ এই সাইফুর রহমান নিজে মান্নান ভঁইয়ার সংস্কারপন্থি বিএনপির ‘চেয়ারপারসন’ হয়েছিলেন। তিনি দখল করেছিলেন খালেদা জিয়ার চেয়ার। আজ সাইফুর রহমান ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে গেলেন? আজ তিনি হয়ে যাবেন সিলেট-১ আসনের অবতার? সাধারণ মানুষ তা মেনে নেবে? সাইফুর রহমানের গডফাদারতন্ত্রের অবসান মনেপ্রাণে চেয়েছে সিলেটের মানুষ। আমি আশা করি ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সিলেটবাসী সব গডফাদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সঠিক রায় দেবেন। পদদলিত করবেন সব পারিবারিক উচ্চাভিলাষ।
দেশের একটি বৃহৎ অংশ তরুণ সমাজ। মহাজোটের নেত্রী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দিন বদলের ডাক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দিন বদলের সনদ’-এর মাধ্যমে তারা ২০২১ সালের মধ্যে একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই প্রজন্ম এই তরুণ সমাজের ভোটাররা সেই দিন বদলের স্বপ্নটিই দেখছে। দেখছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সূর্যমুখ। দেখছে রাজাকারমুক্ত, যুদ্ধাপরাধীমুক্ত সোনার বাংলাদেশের ছবি। দেখছে সুখী বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তির বিজয় ভোর।
গেল কয়েকদিনে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। বিশেষ করে এবারের বিজয় দিবস আমি কাটিয়েছি ইন্টারনেটে আড্ডা দিয়ে।
যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, এদের মধ্যে আছেন একটি দৈনিকের উপ-সম্পাদক, একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক, একজন এমপি পদপ্রার্থী, একজন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার, দু’জন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক, একজন প্রকাশক এবং তিনজন কবি। সবাই একবাক্যে বলেছেন, আসছে ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষশক্তির বিপুল বিজয় হবে। আর এরা ক্ষমতায় গেলে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশে সংগঠিত হবে? এই প্রশ্নটির উত্তরও তারা দিয়েছেন ইতিবাচক। যে ক্ষণটির জন্য জাতি সাঁইত্রিশ বছর ধরে অপেক্ষা করছে।
লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশ এমন কোন মাটি নয়, যা গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ, রাজাকার হায়েনার হাতে জিম্মি থাকতে পারে। এসব রাজাকার যেসব আসনে দাঁড়িয়েছে, সেসব অঞ্চলের তেজী তরুণ-তরুণীদের গণমোর্চা গড়ে তোলার জন্য আমি বিনীত অনুরোধ জানাই। এদেশে আর কোন আলবদর-রাজাকার-আলশামস যেন এমপি হতে না পারে। আমি দেখেছি একাত্তরে তরুণ প্রজন্মের বীর মুক্তিযোদ্ধারা কি দুর্দান্ত সাহস নিয়ে যুদ্ধ করেছেন! আজকের তরুণ-তরুণীরাও তা পারবেন। হে তরুণ, এখন সময় সত্যের এখন সময় তোমাদের।
নিউইয়র্ক, ১৭ ডিসেম্বর ২০০৮