মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখে তার স্বপ্নের ডিঙাটি মাঝ নদীতে ডুবে যাচ্ছে। বাঁচতে চেষ্টা করে। বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। কারণ ডিঙাটির রক্ষকরা চায় না তরণীটি বাঁচুক। এভাবে অনেক স্বপ্নের সলিল সমাধি হয়ে যায়। মানুষ স্বপ্নের ওপর বিরক্ত হয়ে পড়ে। বাড়ে হতাশা। বাড়ে সামাজিক উৎপীড়ন। দুর্বৃত্তরা হাসে উল্লাসের হাসি।
বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক। দেশ নির্বাচনের মহাসড়কে। এমন প্রত্যয় বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। ইতোমধ্যে সরকার বনাম বিএনপির বিতণ্ডা হয়ে গেছে এক দফা। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, ইলেকশন কমিশন যেন সরে দাঁড়ায়। এর জবাবে উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর বলেছেন, বিএনপি নেত্রী তার হতাশা থেকে এমনটি বলছেন।
বিএনপি হতাশ কি না তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে দেশবাসী যে চরম হতাশ তা খুব স্পষ্ট। দেশবাসী যা চেয়েছিল, এর সিকি ভাগও পূরণ হয়নি। পূরণ না করেই বিদায় নিচ্ছে ওয়ান ইলেভেন খ্যাত তদারকি সরকার। নিজেদের অর্জন নিয়ে তারা খুবই তুষ্ট। কিন্তু জনগণ তুষ্ট নয় মোটেও। কারণ চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরা এখনও নানাভাবে সচল। এরা কেউ কেউ কারাগারে থেকেই কলকাঠি নাড়ছে। তারা ভুয়া মেডিকেল রেকর্ড দেখিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। খবর বেরিয়েছে, অনেকেই ভুয়া চিকিৎসার কথা বলে জামিন নেয়ার জন্য লাইনে আছে।
এসব চিহ্নিত দুর্নীতিবাজের এখন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পালা! তাদের আইনজীবীরা বলছেন, প্রার্থী হওয়ার পক্ষে আইনি চ্যালেঞ্জ করে একের পর এক মামলা তারা করবেন। রায় কি হবে তা জনগণ জানেন না। তবে জনগণ এটা জানেন অনেক রাষ্ট্রীয় পুকুর চুরির সঙ্গে এদের অনেকেই জড়িত। সরাসরি খুনের মদদও দিয়েছে কোন কোন নেতা। মন্ত্রিত্বে থেকে খুনিদের পুষেছে। মামলা না নেয়ার জন্য কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছে। জনসমাবেশে বোমা হামলার মদদ দিয়েছে। বোমা সাপ্লাই দিয়েছে। প্রতিপক্ষ রাজনীতিককে হত্যা করিয়েছে। এরা কারা, নাম বলার দরকার নেই। তারাও প্রার্থী হওয়ার জন্য মল্লযুদ্ধে নামছে! ভাবখানা এমন, তারা কিছুই করেনি!
নির্বাচনী হাওয়া আসার সঙ্গে সঙ্গেই সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করার বিভিন্ন দাবি উথাপিত হচ্ছে। এসব দাবি যারা করছেন তারা সমাজের উচ্চবিত্তের মানুষ। এরা সুশীল সমাজ। কিন্তু এই সমাজকে রাজনীতিকরা কি অতীতে তোয়াক্কা করেছে? না করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না। যে দেশে সিংহভাগ মানুষের ভোট টাকায় বিক্রি হয় সে দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটানোর স্বপ্ন খুবই কঠিন। মানুষ খেতে পারছে না। একটা মোটা কাপড় গায়ে দিতে পারছে না। তাই সামান্য টাকা পেলে বিবেক বিক্রি তো করবেই। দোষ দিয়ে লাভ কী?
দোষ তাদেরই যারা পরিকল্পিতভাবে মানুষকে এগুতে দেয়নি। দিচ্ছে না। দেবেও না। তেমনি ফাঁদ তৈরি করে বর্তমান সরকারও বিদায় নিচ্ছে। এটা খুবই নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় গেলে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের কোন বিচারই সম্পন্ন করবে না। তেমনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেও বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে না। ক্রমশ সবকিছু হিমাগারে যাবে। তামাদি হয়ে যাবে গণমানুষের স্বপ্ন। চাওয়ার আলো ঢেকে দেবে ঘন অকার। মানুষ নিমজ্জিত হবে আরও হতাশায়। আরও দুর্ভোগে।
দুই.
সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে গেছে। জরুরি অবস্খা শিথিল হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম মতপ্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠেছে। বেশ ভাল সংবাদ। সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ বলেছেন, সেনাবাহিনী যে কোন প্রয়োজনে দেশের মানুষের পাশে থাকবে। হ্যাঁ, তা তো থাকবেই। থাকা উচিত। এই বাহিনী রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনেই ব্রতী। তারা মানুষের সুখ-দু:খে পাশে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগুলোতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। ওয়ান ইলেভেনের অî-মধুর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রাজনীতিকরা নতুন করে ভাবার সুযোগ পেতে পারেন। তা ভবিষ্যৎ সার্বিক পরিস্খিতির ওপর কি প্রভাব ফেলে বা আদৌ কোন প্রভাব ফেলবে কিনা তাও দেখার বিষয়। তা হতে পারে পজেটিভ, বা নেগেটিভ।
তবে প্রধান দুটি দল বর্তমান তদারকি সরকারের সঙ্গে একটি গোপন সমঝোতার যে খতিয়ান সই করেছে, তাও দেখার পালা শুরু হবে দেশের মানুষের। যদি সেই সমঝোতার আলোকেই প্রধান দুই দলের বেশকিছু চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ‘অস্পর্শ’ থেকে যাওয়ার সুযোগ নেন, তবে বুঝতে হবে ওয়ান ইলেভেনের চেতনা খুবই ক্ষণস্খায়ী হবে। বিদেশে অবস্খানরত দুই প্রধান দলের শীর্ষ নেতারা দেশে ফিরে এক বছরের মধ্যেই নিজ নিজ আসনে জেঁকে বসবে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র অতীতে যেমন সঙ্কটের ছিল, ঠিক তেমনটি থেকেই যাচ্ছে। কারণ, বর্তমান তদারকি সরকার কোন দৃষ্টান্তমলক নজিরই স্খাপন সম্পন্ন করে যেতে পারল না। মনে রাখতে হবে শুরু করা মানেই শেষ করা নয়। আমার মতে, বাংলাদেশে গেল দু’বছরে যা ঘটে গেল তা ‘দুদক বিষয়ক ঝড়ো হাওয়া’। এই ঝড়ো হাওয়া বরং জনমনে হতাশা দ্বিগুণ করেছে। কারণ সাজাপ্রাপ্ত আসামিরাও বেরিয়ে এসে প্রমাণ করেছে তারা কিছুই করেনি! যারা বাকি আছে তাদেরও বেরুনোর পালা!
নতুন জোটবদ্ধ নির্বাচন, নিবন, জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে পার পাওয়া এর সবক’টি কাজেই সিদ্ধ বাংলাদেশের রাজনীতিকরা। ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলো নিবনের মাধ্যমে শুধু নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহসই খুঁজছে না, দেশের অস্তিত্বের খুঁটিতে আঘাত হানতে চাইছে। এটা ভীষণ পরিতাপের বিষয়, ওয়ান ইলেভেনের চেতনা নিয়ে যারা এসেছিলেন তারা মুখে বড় বড় কথা বললেও ঘাতক রাজাকারদের স্বার্থ বাঁচিয়ে গেলেন। যার ফলে বদর বাহিনীর কমান্ডার এখন বলার সাহস পাচ্ছে, অতীতের চেয়ে তারা সংগঠিত।
জনগণ হারছে। দেশ হেরে যাচ্ছে। কোন স্বার্থবাদী রাজনীতিকরা জিতল কিনা, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। যদি সব প্রধান দল নির্বাচনে অংশ নেয় তবুও একটি সংঘাতময় ভবিষ্যৎই অনিবার্য হবে তাই মনে হচ্ছে।
নিউইয়র্ক, ৪ নভেম্বর ২০০৮
