মস্কোতে ছিলাম দুই দশকের অধিককাল। দেখা হয়েছে সমাজতন্ত্রের সুদিন, গর্বাচ্যোভের পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত, ইয়েলৎসিনের প্রতিবিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের পতন, পুতিনের পুঁজিতন্ত্র। তার পরও যাতায়াত ছিল। এবার এলাম অনেক দিন পর। আমার ভালো লাগার শহরটিকে এখন আর চিনতে পারি না। নতুন নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি, অসংখ্য প্রাইভেট কার, বিদেশি পণ্যে ঠাসা দোকানপাট, সর্বত্র মানি এক্সচেঞ্জ, অতিশয় কর্মব্যস্ত মানুষ, ঝলমলে বাগান, বিশ্বের সেরা রাজধানীগুলোর সঙ্গে তুলনীয়। আমার মুগ্ধ হওয়ার কথা কিন্তু এক অদ্ভুত অস্বস্তি আমাকে তাড়া করে। কিছুতেই ভুলতে পারি না যে, অক্টোবর মহাবিপ্লব লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, ভেঙে গেছে দুনিয়াজোড়া মেহনতি মানুষের স্বপ্ন।
সন্দেহ নেই, যা ঘটেছে তার একটা ইতিহাস আছে। সমাজতন্ত্রের রুশি মডেল ইউরোপ কখনো গ্রহণ করেনি — সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা তো নয়ই, কমিউনিস্টরাও না। স্মরণ করা যেতে পারে, রোজা লুক্সেমবুর্গের সঙ্গে লেনিনের বিতর্কের কথা। রোজা জার্মানির জন্য ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ অনুমোদন করেননি, চেয়েছেন গণতন্ত্র। এই মতধারা সমাজতন্ত্রের পতন পর্যন্ত ইউরোপে অব্যাহত থেকেছে। ইতালি ও ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে রাশিয়ার মতানৈক্যের টানাপোড়েন চলেছে ক্রমাগত। পূর্ব ইউরোপের নবজাত সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। রাশিয়া সেইসব ‘বিদ্রোহ’ দমন করেছে বল প্রয়োগের মাধ্যমে। আর তাতে বিনষ্ট হয়েছে সমাজতন্ত্রের নতুন কোনো টেকসই মডেল উদ্ভবের সম্ভাবনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের জন্য তৈরি মার্কিন পুনর্গঠন পরিকল্পনায় সংগত কারণেই রাশিয়া শরিক হতে পারেনি, অধিকন্তু আত্মরক্ষার জন্য পরমাণু অস্ত্রসজ্জা নির্মাণের দুর্ভর বোঝা বইতে বাধ্য হয়েছে। এতে রাশিয়া সামরিক পরাশক্তি হতে পেরেছে, কিন্তু জনগণের চাহিদামতো ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে সফল হয়নি। সেই সঙ্গে ছিল অতিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা, স্বাধীন মতামত প্রকাশের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও অবাধ চলাচলে প্রতিবন্ধসহ নানা দমনমূলক দুর্ভোগ।
উন্নত পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে তখন বইছে উন্নয়নের জোয়ার, উদ্ভব ঘটেছে কল্যাণ রাষ্ট্রের, সর্বত্র সচ্ছলতার আবহ। রুশিরা স্বভাবতই তাতে আকৃষ্ট হয়েছে, নিজেদের বঞ্চিত ভেবেছে। এ পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামে রাশিয়ার উদার সাহায্যকে তারা সুনজরে দেখেনি এবং শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান যুদ্ধের রক্তক্ষরণ তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে থাকবে। মনে পড়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে রাশিয়ার অবদান নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আমার এক রুশি বন্ধুর মন্তব্য: ‘তোমার দেশে বিপ্লব মানে আমাদের আরও ভোগান্তি, দোকানে আরও লম্বা লাইন।’ উল্লেখ্য, তৃতীয় বিশ্বে ‘অপুঁজিবাদী উন্নয়ন’ বাস্তবায়নে রাশিয়া যে বিপুল সহায়তা জুগিয়েছিল তার সবই জলাঞ্জলি গেছে।
পুঁজিতন্ত্রের নিদান হেঁকে গেছেন কার্ল মার্ক্স, কিন্তু শেষ দিনক্ষণ বলে যাননি। সম্ভবত লেনিনও না। মার্ক্সবাদী লেখক ডেভিড হারভে সম্প্রতি বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মহাপ্রলয় কবে ঘটবে মোটামুটি তা বলা গেলেও পুঁজিতন্ত্রের পতন সম্পর্কে তেমন কিছু বলা একেবারেই অসম্ভব।’ হারভে আরও বলেছেন, তিনি কমিউনিজম চান, তবে রুশি মডেলের নয়।
মার্ক্সবাদীরা পুঁজিতন্ত্রে কল্যাণ রাষ্ট্রের সম্ভাব্য উদ্ভব পূর্বানুমান করতে পারেননি, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনও না। কিন্তু তাতে মার্ক্সের তত্ত্ব ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় না। সমাজতন্ত্রের পতন ও এককেন্দ্রিক বিশ্বে সেই পর্যায়িক-সংকট আবারও দেখা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বায়ন যাতে সংকুচিত স্থান-কালে শোষণ যে আরও ঘনীভূত হবে তাও মার্ক্স পূর্বানুমান করেছিলেন। এই মন্দা হয়তো কাটিয়ে ওঠা যাবে, কিন্তু যথারীতি খেসারত দিতে হবে ধনীদের নয়, সাধারণ মানুষকে।
কতকাল চলবে এই গোঁজামিল — creative destruction? পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি কি একসময় পুঁজির গুণগত পরিবর্তন ঘটাবে? হ্রাসমান প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিব্যাপ্ত পরিবেশদূষণ এবং ফলত limits of growth, ইত্যাকার সংকট পুঁজিতন্ত্র কীভাবে মোকাবিলা করবে? সঠিক উত্তর কারও জানা নেই। র্যাডিকাল পরিবেশবাদীরা উৎপাদন ও পরিভোগ পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন চান, যা আরেকটি ইউটোপিয়া মাত্র। মার্ক্স অবশ্য কমিউনিজমে মানুষ কর্তৃক মানুষ ও প্রকৃতি শোষণের অবসান দেখেছেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর মতো দীর্ঘ সময় আমাদের হাতে নেই। সামনে এখন অনিশ্চিত গন্তব্য। প্রাজ্ঞজন বহুকাল আগেই এই পরিস্থিতি পূর্বানুমান করেছিলেন, যা এখন আমাদের বেষ্টন করে ফেলেছে।
অতঃপর আমাদের ‘কী কর্তব্য?’ এরিখ হব্স্বাম সম্প্রতি (২০১১) প্রকাশিত তাঁর How to Change the World: Tales of Marx and Marxism বইটি এই বাক্য দিয়ে শেষ করেছেন, ‘Once again time has come to take Marx seriously’। বইটি মার্ক্সের তত্ত্ব প্রয়োগের সমালোচনায় পরিপূর্ণ।
লন্ডন
৮ সেপ্টেম্বর ২০১২
দ্বিজেন শর্মা
জন্ম ১৯২৯, সিলেট। উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক (ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল ও নটর ডেম কলেজ, ঢাকা); অনুবাদক, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক। বসবাস ঢাকায়। শখ : উদ্যান পরিকল্পনা।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
তনুশ্রী - ১৬ নভেম্বর ২০১২ (১১:২৮ পূর্বাহ্ণ)
দুই দশকেই, “সমাজতন্ত্রের সুদিন, গর্বাচ্যোভের পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত, ইয়েলৎসিনের প্রতিবিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের পতন, পুতিনের পুঁজিতন্ত্র” ! বেশি হয়ে গেছে!
অদিতি কবির - ১৭ নভেম্বর ২০১২ (৮:৫১ পূর্বাহ্ণ)
ঠিকভাবে পড়ুন। লেখা আছে দুই দশকের অধিককাল।
মাসুদ করিম - ১৭ নভেম্বর ২০১২ (৩:৫৬ অপরাহ্ণ)
সমাজ প্রগতি, অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরে — আমি ব্যক্তিগতভাবে মার্কসিজম বলতে এটাই বুঝি। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরে সমাজ প্রগতি এসেছিল অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি, অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি বলে সমাজ প্রগতির চাকা আর চলমান রাখা যাচ্ছিল না — তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছিল, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি বিলুপ্ত হয়নি — রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি আজো আছে। এখন এর উপর ভিত্তি করে যদি মার্কসিজমের সফলতা ব্যর্থতা বিচার করতে যাই, তাহলে এটা বলতে হয় মার্কসিজম সমাজ প্রগতিতে সফল ও কমিউনিস্ট পার্টির জন্য সফল কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তিতে বিফল। তার মানে ২:১ স্কোরে মার্কসিজমের সফলতার ভাগটাই বেশি, এবং তাহলে আমরা এটাও বলতে পারি মার্কসিজমের ইজম হিসাবে স্বীকৃতির পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিন মার্কসিজম নিয়ে আলোচনা কখনো বন্ধ হয়নি — কাজেই আমেরিকা ও ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দার পর এই আবার মার্কসের হুল্লোড়ের কোনো মানেই আমি খুঁজে পাই না, এবং যারা এই হুল্লোড়ে আছেন তাদের হুল্লোড়টা হাস্যকরও, কারণ বিশ্বঅর্থনীতি ও সমাজ এখন যে জটিল সমস্যায় সেখানে থেকে আবার মার্কসে ফিরে গিয়ে শুধু মার্কসিজম দিয়ে এর উত্তরণ ঘটবে না। এর উত্তরণের জন্য আমাদের ‘অনিশ্চিত গন্তব্য‘এর দিকেই হাঁটতে হবে, এবং সেহাঁটা কোনো নির্দিষ্ট ইজম নিয়ে হাঁটাটা হবে সবচেয়ে বিপদজনক।
মাসুদ করিম - ৫ মে ২০১৮ (১১:০৬ পূর্বাহ্ণ)