লিসিয়াস মানুষের নামকরণ করেছিলেন হোমো স্যাপিয়েন্স, অর্থাৎ জ্ঞানী জীব। কিন্তু সে যথার্থ জ্ঞানী হতে পারেনি। তার মধ্যে স্বার্থপরতা ও প্রতিযোগিতা প্রবৃত্তির মাত্রা অত্যধিক। ধর্ম ও সংস্কৃতির শত ধৌতনেও এই মলিনত্ব ঘোচেনি। পুঁজি হলো এইসব প্রবৃত্তির মূর্তরূপ। পুঁজির প্রকোপ প্রশমনে সাফল্য লাভের ওপরই মানুষের জ্ঞানী হওয়ার সম্ভাবনা নিহিত। [. . .]

বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে সম্প্রতি প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘রক্ষা করি পরিবেশ/গড়ি সোনার বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে পরিবেশবিদ, বন কর্মকর্তা ও সুধীজনের প্রদত্ত ভাষণের নির্যাস নিম্নরূপ।

ক. সরকার পরিবেশ সুরক্ষায় আন্তরিক। কিন্তু প্রভাবশালী কতিপয় পরিবেশনাশী ব্যক্তির দৌরাত্ম্যে সবকিছু ভন্ডুল হতে চলেছে। খ. পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি ও জীবনমান উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সমবেত উদ্যোগ। গ. টেকসই উন্নয়ন ধারণার বিকাশ ঘটান। ঘ. বন বিভাগের ওপর অত্যধিক কর্মচাপ এবং ফলত নানা ব্যর্থতা। ঙ. পরিবেশ ধ্বংস ও মনুষ্যবিলুপ্তির আশঙ্কা এক সমাবদ্ধ বাস্তবতা। এই বিজ্ঞ আলোচকদের নিয়েই এই পর্যালোচনা।

ক. কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির দাপটে সরকারের পরিবেশ রক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়া অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই আমাদের বাস্তবতা। এই ব্যক্তিবর্গ দেশের শিল্পপতি, যাঁরা প্রভূত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে সরকারকে স্বস্তিতে রেখেছেন। তাদের উৎপন্ন বর্জ্যের ব্যাপারে সরকারের পক্ষে কোনো কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া সংগত কারণেই যথেষ্ট কঠিন। কিছুদিন আগে এক দৈনিকে প্রকাশিত মিল্ক ভিটা কোম্পানির জনৈক কর্মকর্তার একটি লেখা পড়েছিলাম। তিনি একদা পরিবেশ অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন এবং ‘অত্যুৎসাহবশত’ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য শোধনে গাফিলতির দায়ে বড় অঙ্কের অর্থ জরিমানা করেছিলেন। ফল হয়েছিল হিতে বিপরীত। অতঃপর নির্বাসন বহু দূরের মিল্ক ভিটা কোম্পানিতে, যার সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এই হলো সরকারের পরিবেশ রক্ষা কর্মকাণ্ডের চালচিত্র।

আমরা এই বাস্তবতা ভুলে যাই যে প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়কালে প্রকৃতিকে ছাড় দেওয়া একটি অবান্তর প্রশ্ন। এতে পুঁজিপতি ও সরকার উভয়েরই ক্ষতি। কবে এই পুঁজি সঞ্চয়ের কাল শেষ হবে এবং সরকার পরিবেশ রক্ষায় কঠোর হবে বোঝা দুষ্কর।

ঢাকার আশপাশের নদীগুলো ইতিমধ্যে বর্জ্যাগার হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে সারা দেশে এই ধারার শিল্পায়ন বাস্তবায়িত হলে দেশের পরিবেশের হাল কেমন হবে, তা সহজেই অনুমেয়। দেশ তখন মনুষ্য বসবাসযোগ্য থাকবে তো? আরেকটি সমস্যাও দৃশ্যমান। শিল্পায়ন, অবকাঠামো ও আবাসন নির্মাণে আমরা প্রতিবছর ১ শতাংশ বা ততোধিক কৃষিজমি হারাচ্ছি। এই হার অব্যাহত থাকলে বা বৃদ্ধি পেলে শেষ পর্যন্ত কৃষি ও কৃষকের দুর্দশা কোথায় ঠেকবে, তা কেবল সরকারই জানে। অতি জনঘন দেশের নাজুক প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর সাবেকি উন্নয়নের চাপ কী ফল ফলাবে, বোঝা খুব কঠিন নয়। কিন্তু কীই-বা করার আছে? বিশ্বায়নের যুগে বিকল্প উন্নয়নধারা উদ্ভাবনের কোনো সুযোগ আমাদের নেই।

খ. পরিবেশবান্ধব অর্থনীতিও তার দ্বারা জীবনমান উন্নয়ন আমাদের পরিস্থিতিতে একটি অলীক স্বপ্ন। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত থাকলে আমার তা জানা নেই। সবুজ অর্থনীতি, সবুজ ব্যাংকিং ইত্যাকার প্রচারকে কেউ কেউ বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ধোঁয়াশা ছড়ানোর কৌশল মনে করেন। তারা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যাবে না।

আজকের উন্নত বিশ্ব উন্নত প্রযুক্তির দৌলতে এবং অনুন্নত দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটিয়েছে সত্যি, কিন্তু এই উন্নয়নের খেসারত দিতে দিতে গোটা জীবমণ্ডল এখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ওজোনস্তর ক্ষয়, বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রস্ফীতি ও জলবায়ু পরিবর্তন—এমন কয়েকটি বিপত্তির কথাই শুধু আমরা জানি, কিন্তু এগুলোর পরিসর ও অভিঘাতের যথার্থ স্বরূপ আমাদের অজানা। অতঃপর উন্নয়নশীল দেশের করণীয় কী? একজন বক্তা তো বলেই দিয়েছেন পশ্চিমা মডেলের উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগাল ধরতে উন্নয়নশীল দেশের জন্য আরও পাঁচটি পৃথিবীর সম্পদ প্রয়োজন হবে।

আরেকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নও জিজ্ঞাস্য: গোটা বিশ্ব সমপর্যায়ে শিল্পোন্নত হলে বাতাসে মানুষের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকবে তো? উল্লেখ্য, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দাদের অনুপাত ৩০:৭০।

গ. প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতামূলক টেকসই পরিপোষক উন্নয়নের ধারণাটি অন্তর্গতভাবে বিরোধপূর্ণ। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে সভ্যতার সূচনা থেকে এবং তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ প্রকৃতিকে যদৃচ্ছা লুণ্ঠন করে তার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি থেকে প্রত্যাঘাত আসার কোনো আশঙ্কা আমাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু তাই ঘটেছে এবং প্রবল আকারে। এ থেকেই টেকসই বা পরিপোষক উন্নয়ন ভাবনার জন্ম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতার বাতাবরণ সৃষ্টিতে আমরা কতটা স্বাধীন? ক্যাপিটাল বা পুঁজি এ ক্ষেত্রে প্রধান স্টেকহোল্ডার, যা পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। পুঁজি প্রকৃতির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শিল্পসভ্যতার চালিকাশক্তি। পুঁজিহীন আধুনিক সমাজব্যবস্থা অকল্পনীয়। তাই পুঁজিকে মান্য করে টেকসই বা পরিপোষক উন্নয়ন আদৌ সম্ভব কি না, তা বলা কঠিন।

ঘ. বন বিভাগের আহরণমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইদানীং প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব (অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জাতীয় বোটানিক গার্ডেন ইত্যাদি) ন্যস্ত হওয়ায় তাদের কর্মচাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বনাঞ্চলের মতো ব্যাপক পরিসরে আহরণ ও সংরক্ষণের মতো দুটি বিপরীতধর্মী কাজের সমন্বয় বিধান সত্যিই কঠিন। এমতাবস্থায় প্রকৃতিপ্রেমী তরুণদের নিয়ে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা অবশ্যই ভাবা যেতে পারে। এসব সংস্কার সম্পন্ন হলে বন বিভাগের কর্মকাণ্ড বিরোধমুক্ত, স্বচ্ছন্দ ও অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে।

ঙ. সশরীরে স্বর্গযাত্রায় ইচ্ছুক জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে বকরূপী যমরাজ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জগতে সবচেয়ে আশ্চর্য কী?’ উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, ‘মানুষ তার চতুর্দিকে অহরহ অজস্র মৃত্যু দেখে, কিন্তু সে আপন মৃত্যুর কথা ভুলে থাকে।’ আমরাও প্রতিনিয়ত প্রজাতিমৃত্যু দেখছি, কিন্তু নিজ প্রজাতির মৃত্যুর কথা ভুলেও ভাবি না। প্রজাতির জীবৎকাল প্রকৃতির সূক্ষ্ম ভারসাম্যে স্থিত, হেরফের ঘটলেই বিপন্নতা কিংবা বিনাশ। মৌমাছির মতো নগণ্য একটি পতঙ্গ বিলুপ্ত হলেও মানুষ বিপন্ন হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ এসব ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। শতবর্ষ আগে বিজ্ঞানীরা কার্বন ডাই-অক্সাইডের তাপধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছিলেন, কেউ কর্ণপাত করেনি। বায়ুমণ্ডলে অতিসামান্য মাত্রায় বিদ্যমান এই গ্যাস আজ কী তুলকালাম কাণ্ডই না ঘটিয়ে চলেছে। প্রকৃতির ভারসাম্য পাল্টে আমরা নিজেদের কতটা বিপন্ন করেছি, সে হিসাব কে মেলাবে!

পরিশেষ: মানুষের দম্ভ যতটা আকাশচুম্বীই হোক সে কোনো প্রজাতি উৎপাদন করতে পারে না, অথচ নিয়তই অজস্র প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটিয়ে চলেছে। প্রকৃতি পারে দুটিই। মানবজাতি ধ্বংস হলে সেটা হবে তার কৃতকর্মের ফল, প্রকৃতি তার পুনর্জনন ঘটাবে না। লিসিয়াস মানুষের নামকরণ করেছিলেন হোমো স্যাপিয়েন্স, অর্থাৎ জ্ঞানী জীব। কিন্তু সে যথার্থ জ্ঞানী হতে পারেনি। তার মধ্যে স্বার্থপরতা ও প্রতিযোগিতা প্রবৃত্তির মাত্রা অত্যধিক। ধর্ম ও সংস্কৃতির শত ধৌতনেও এই মলিনত্ব ঘোচেনি। পুঁজি হলো এইসব প্রবৃত্তির মূর্তরূপ। পুঁজির প্রকোপ প্রশমনে সাফল্য লাভের ওপরই মানুষের জ্ঞানী হওয়ার সম্ভাবনা নিহিত। বলা বাহুল্য, কাজটি সুকঠিন।

. . .

প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো

দ্বিজেন শর্মা

জন্ম ১৯২৯, সিলেট। উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক (ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল ও নটর ডেম কলেজ, ঢাকা); অনুবাদক, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক। বসবাস ঢাকায়। শখ : উদ্যান পরিকল্পনা।

১ comment

  1. মাহমুদুল হাসান - ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ (৭:১৯ অপরাহ্ণ)

    মানুষের দম্ভ যতটা আকাশচুম্বীই হোক সে কোনো প্রজাতি উৎপাদন করতে পারে না- কথাটা একেবারেই সত্য। এই দম্ভের কারনেই আজ আমাদের এই দশা। জানিনা ভবিষ্যতে আমাদের কি হবে …!!

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.