এবার কিন্তু ফেঁসে গেছে আওয়ামী লীগ। সত্যিই ফেঁসে গেছে। তাদের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার কিন্তু ধরেই নিয়েছিলো; তাদের ভাষ্য অনুযায়ী তরুণ প্রজন্মের সূর্যসন্তান যারা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিদার যেসব ছেলেমেয়ে দেশব্যাপী শাহবাগ বানিয়ে তুলেছে, সেই তারা সবাই আওয়ামী লীগের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নরম নরম কর্মসূচিই দিতে থাকবে। সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে চলবে। সবমিলে এদের সবাইকে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’জনিত নির্বাচনী ইস্যুর মধ্যে গিলে খাওয়া যাবে। মোটকথা, দেশব্যাপী গণজাগরণ মঞ্চের সব তরুণদের নিজেদের ভোটের রাজনীতির অঙ্গীভূত করবার স্বপ্ন দেখেছিলো আওয়ামী-নেতৃত্বাধীন জোট।
ব্যাপারটা এমন; সরকার আন্তজাতিক চাপ-ঠাপ দেখবে, দেশের মধ্যেকার রাজনৈতিক অবস্থা দেখবে, ভোটের রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ দেখবে আর সেই মাফিক সিদ্ধান্ত নেবে; ওদিকে শাহবাগ-সহ দেশব্যপী যারা জড়ো হয়েছে, তারা সরকারের সাথেই তাল মিলিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পারপাজ সার্ভ করবে। এমনটাই চেয়েছিলো তো সরকার। কে না জানে, যুদ্ধাপরাধীরা সরকারের এখনকার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের একমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার, যুদ্ধাপরাধীদের কাঙ্ক্ষিত বিচারটা এইখানে আওয়ামী লীগের কাছে ভোটের রাজনীতির থেকে বেশি কিছু নয়। কিন্তু রাজনীতির বাইরে থাকা হাজারো তরুণতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কিংবা জামায়াত নিষিদ্ধকরণের দাবিকে নিছক ভোট উৎরাবার হাতিয়ার হিসেবে দেখে না। এটা সত্যিইতো তাদের প্রাণের দাবি। সে-কারণেই আবির্ভাব রুমী স্কোয়াডের আমরণ অনশনের। সে-কারণেই আমার ফেইসবুক বন্ধু স্টেটাস লেখেন:
নির্বাচনের আগে `যুদ্ধাপরাধ‘ নামে একটি সেনসেশনাল প্রোডাক্ট বাজারে ছেড়েছে মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ, তবে রুমী স্কোয়াডের জন্য সুবিধা করতে পারছে না। জয় শাহবাগ, জয় বাংলা!– সাঈফ ইবনে রফিক
একটা বিভেদ তবে শুরু হয়েছে এবার সত্যিই। শুরু হয়েছে এমন না। প্রকট হয়েছে। দৃশ্যমান হয়েছে। এই বিভেদ আগে থেকেই ছিলো। সেটা হলো, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াতি রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রাণের দাবির সাথে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে রাজনীতির বিভেদ। এই বিভেদই দৃশ্যমান হয়ে রুমি স্কোয়াডের আমরণ অনশনের নামে হাজির হয়েছে দৃশ্যপটে।
রুমী স্কোয়াডের সোজা কথা, ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত-নিষিদ্ধের হিসেব-নিকেশ করার সুযোগ তারা দেবে না সরকারকে, জামায়াতকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করতে হবে এটাই তাদের দাবি। নইলে তারা অনশন করেই মরে যাবে! এখানে রাজনীতির নামগন্ধও নেই। এখানে ভোট জেতা-হারার হিসেব-নিকেশও নেই। এখানে আছে পরিচ্ছন্ন আবেগ। মানবতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে আপাত-মানবিক এক আবেগ। এই আবেগের তাৎপর্য যাই হোক না কেন, এই আবেগের গুরুত্ব বিশাল।
এই আবেগ সোজা কথায় ঘোষণা করেছে, সরকারকে আর তাদের খুশিমতোন, ভোটের রাজনীতির সুবিধে অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের বিচার আর জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে খেলতে দেবে না তরুণরা। এবার তারাই খেলবে। সরকার যেমন চাইবে, তরুণরা তেমন তেমন করে নড়বে না, এবার তরুণরা যেমন চাইবে, সরকারকে তেমন করে নড়তে হবে। মানে ওই যারা ঘেরাও করবার ঘোষণা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সেই শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্কোয়াড; আর ঐ যে সাত জন ছেলে-মেয়ে, ৭ থেকে ১৪, ৪ থেকে ১৬…১৭… জন ঘোষণা দিয়েছেন আমরণ অনশনের, রুমী স্কোয়াডের সেই তরুণরা মিলে বলেছে; মূল মঞ্চের সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে চান তারা। মোটকথা সরকারকে খেলতে দিতে চান না। নিজেরা খেলতে চান। নিজেরা মানে তরুণরা। তরুণরা মানে; তাদের ধারণামতে, জনসাধারণ। তো এইদিক থেকে ব্যাপারটা জরুরি ভীষণ যে, তরুণ প্রজন্মের একাংশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সরকারের আইন-বিচার নয়, তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সেটা নিবার্হী আদেশে।
নিবার্হী আদেশে কাউকে নিষিদ্ধ করা হোক, কারও মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে সংবাদপত্র-অনলাইন মিডিয়া-সহ সামাজিক যোগযোগের প্রক্রিয়া তথা ব্লগ-ফেইসবুক বন্ধ করে দেয়া হোক, সেটা আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না। আমি জামায়াত-শিবিরকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই মোকাবিলা করতে চাই, তাদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারণা জারি করতে চাই, সাংস্কৃতিকভাবে তাদের বর্জন করতে চাই। আজ জামায়াতকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করার দাবি যারা তুলছেন, সেই তাদেরকে সরকারের পছন্দ না হলে; তখন তাদেরকেও ওই নির্বাহী আদেশের বলেই তো নিষিদ্ধ করে দেয়া হতে পারে। আজকে যে প্রক্রিয়ায় জামায়াতিদের ফেইসবুক ব্লগ নিষিদ্ধ করতে বলা হচ্ছে, কালকে তো সেই একই প্রক্রিয়ায় আমার ফেইসবুক ব্লগও সরকার নিষিদ্ধ করতে পারে। তাই আমি প্রথমেই জানান দিয়ে রাখি, নির্বাহী আদেশ, কিংবা মত প্রকাশের অধিকার নিষিদ্ধ করবার দাবি আমার নাই। তবে এই যে রুমী স্কোয়াড আওয়াজ তুলেছে, জামায়াত শিবিরকে নিয়ে আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতি করতে দেবে না তারা, নিজেরাই তাদের বাপারে সিদ্ধান্ত নেবে — এটা ভীষণ আশাবাদী হবার মতো দিক। আমি এই স্পিরিটের প্রতি আমার নিরঙ্কুশ সমর্থন জানাচ্ছি। ওদের স্পিরিটটা রাজনীতি-বিরোধী কিন্তু! মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে আওয়ামীলীগ-নেতৃত্বাধীন জোট আর ওদিকে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটের রাজনীতির মাঠ; সেই মাঠে ঢুকে এরা ঘোষণা করেছে এখানে রাজনীতি চলবে না। প্রাণের দাবি পূরণ করতে হবে। জাহানারা ইমাম স্কোয়াড কিংবা রুমী স্কোয়াডের লড়াই তাই নষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই। রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণের একাংশ হিসেবে তরুণদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারের লড়াই।
জাহানারা-রুমী স্কোয়াডের সহযোদ্ধারা কতোদূর যাবেন, কী করতে পারবেন, তা নিশ্চিত করে বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। তরুণ প্রজন্মের বিপুল অংশের সমর্থন নিয়ে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটিকে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক এজেন্ডার বাইরে এনে আরও সংগঠিত আন্দোলন শুরু করলে আওয়ামীলীগের কি উপায় থাকবে, মঞ্চ দখল করে রাখবার? নাকি নাস্তিক-জামায়াত-শিবিরের নাতিপুতি বলে এদের নিরস্ত্র করবার চেষ্টাটাই চালিয়ে যাওয়া হবে, যে চেষ্টাটা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে? বলে রাখি, সেই চেষ্টা সফল হবে না। কেননা এই খেলা মানুষ বুঝে গেছে। নায়ারণগঞ্জ যেমন করে বুঝেছে জামায়াত শিবির নয়, আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসী নেতারাই খুন করেছে ত্বকীকে!
তাই আমার ধারণা, আওয়ামীলীগ নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই পারবে না, এই নয়া গেরিলাদের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে জড়াতে। তেমনটা করলে তারা ইতিহাসের আস্তাকূড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। হারিয়ে যাবে তাদের সবশেষ নির্বাচনী অস্ত্র: মুক্তিযদ্ধের সপক্ষ শক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের শক্তি নামক অস্ত্র। প্রমাণ হবে প্রতক্ষভাবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অবস্থান নয়, নিছক ভোট জেতার কৌশল! তবে আওয়ামী লীগের হায়া কম। তাদের বিগত ইতিহাস বেঈমানীর ইতিহাস (এখানে আওয়ামী লীগ আমার উদ্দিষ্ট বলে তাদের কথা তুললাম; খোদ রাজনীতি জিনিশটার মধ্যেই আছে বেঈমানীর অপরিহার্য উপাদান। সব রাজনৈতিক দলই কিন্তু বেঈমান)। আমাদের মনে না রেখে উপায় থাকে না, একাত্তরে গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তখনও মন্ত্রীত্ব-প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভে আকুল। এরপর স্বাধীনতাত্তোর কালে স্বৈরাচার এরশাদের প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেদের ১৫ দলীয় জোটকেও আওয়ামী লীগ একবার দেখিয়েছে, বেঈমানী কতো সোজা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালতের সাথে বেঈমানী করে এরপর জামায়াতকে নিয়ে তাদের জোটবদ্ধ আন্দোলন করবার কথাও ভোলেনি দেশের মানুষ। তো এবারও হয়তো তরুণ প্রজন্মের আবেগের সাথে বেঈমানী করতে পিছপা হবে না আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতির হিসেব-নিকেশের ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। ভোটের রাজনীতির স্বার্থে আওয়ামীজোট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুকে নিজেদের সুবিধেমতোন ব্যবহারের চেষ্টা করতে গিয়ে তাই এমন অবস্থানে যেতে পারে যে, আবার ২০০৭ সালের মতো করে, অথবা তার থেকেও ভয়াবহ আকারে সেনা-কর্পোরেট-সুশীল এক ভয়াবহ সরকারের কবলে পড়ি আমরা!
ওদিকে বিএনপি-জামায়াতও বেকায়দায়। প্রথমত শাহবাগকে কেবল আওয়ামী লীগের পাণ্ডাদের আন্দোলন বলে প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করলেও এ পর্যায়ে রুমী স্কোয়াডের আমরণ অনশন কিংবা জাহানারা ইমাম স্কোয়াডের ঘেরাও কর্মসূচি দৃশ্যমান করেছে এই বাস্তব যে, শাহবাগে যারা আছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগ নয়। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটিকে কেবল আওয়ামী লীগারদের দাবি, কিংবা ভোট জেতার স্বার্থের এক রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে দেখানোর সুযোগটা কমে গেল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের উপর এই স্কোয়াডের চাপের উদ্দিষ্ট তো জামায়াত-ই। আর সেই জামায়াতকে নিজেদের জোটের অঙ্গীভূত করে, ভোট জিততে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন যুগিয়ে যাবার কাজটি করে তারাও আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিকারীদের বিপরীতে। সেদিক থেকে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সবগুলোকেই বিপদে ফেলেছে জাহানারা-রুমী স্কোয়াড। সবমিলে তরুণরা খোদ ভোটের রাজনীতির বিরুদ্ধে, ক্ষমতা দখলের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ওরা এবার বলেছে, তাদের মতো করে আমরণ অনশন করতে না পারলেও যতোক্ষণ পারা যায় সবাই যেন তাদের সাথে যোগ দেয়। এই ভরসাতেই আমি যাবো। যতোক্ষণ পারি থাকব ওদের সাথে।
তবে রুমী স্কোয়াডের দাবিদাওয়া-সহ খোদ গণজাগরণের সামগ্রিক দাবি-দাওয়ার সাথে আমি পরিপূর্ণভাবে একমত নই। এই ভিন্নমত-সমেত আমাকে, আমাদের আরও অনেক অনেক ভিন্নমতকে তারা যদি ধারণ করতে পারে, তো তাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের সীমা সঙ্কুচিত হবে ক্রমশঃ।
