আমরা সবাই ইতোমধ্যে জানি যে বালুচিস্থান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা যেমন স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন বালুচরা মুক্তি সংগ্রামে ব্রতী? বিশিষ্ট বালুচ অধ্যাপক সীমা খানের মতে, ’ধর্ম’ এবং ’নৃ–তত্ত্ব’-এই দ্বিবিধ পরিচয়ের আবর্তে নিক্ষিপ্ত বালুচরা বাঙালীদের মতই ইসলাম ধর্ম ও জাতিগত আত্ম–পরিচয়ের সঙ্কটে ভুগছে। সীমা তাঁর ‘Trapped between Religion and Ethnicity: Identity Politics against the Baloch in Iran and Pakistan’ প্রবন্ধে বালুচ জাতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত খুঁজতে গিয়ে কীভাবে ঐতিহাসিকেরা বালুচিস্থান এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় বালুচ ও অন্যান্য নৃ–গোষ্ঠির ভেতরকার সংস্কৃতি ও ভাষাগত সম্বন্ধ সূত্র বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন, তার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছেন। ১৯০৪ সালে ইতিহাসবিদ ডেমস প্রথম বালুচ ইতিহাস এবং ভাষা বিষয়ে অনুসন্ধানে ব্রতী হন। তিনি বর্তমানের ইরাণের কেরমান এলাকাকেই বালুচ জাতির সম্ভাব্য বিন্দু বলে মনে করেন (এম, আহমেদ এবং বালুচ, পৃষ্ঠা ২)। পশুচারী বা অর্দ্ধ–যাযাবর বালুচরা তাদের মূল পশুচারণ এলাকাগুলো জুড়ে নিয়মিত ভিত্তিতে যাতায়াত বা অভিবাসনের পথ খুঁজে বের করেছিল (ব্রিসিগ, ২০০৪; দাশতি, ২০১২, উইরসিং, ২০০৮)। প্রায় ৩০০০ বছর ধরে বালুচেরা ইরাণী মালভূমির দক্ষিণ এবং পূর্বের প্রান্তগুলোয় তাদের ’চরৈবেতি’ অব্যাহত রেখেছিল। তবে বারো শতকে প্রথম পারস্য, আফগানিস্থান এবং ভারতের ভেতর দিয়ে প্রসারিত একটি চিরস্থায়ী ভূ–খন্ডে বালুচরা চিরস্থায়ী ভাবে বসতি গড়ার উদ্যোগ নেয়। কয়েক শতকের পরিসরে এবং অভিবাসন ও বসতি গাড়ার প্রক্রিয়ায়, বালুচরা নিজেদের ভেতর বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠিকে আত্মীকরণ করে নেয় (ব্রিসিগ, ২০০৪; দাশতি, ২০১২, উইরসিং, ২০০৮)। তবে পাশাপাশি প্রতিটি বালুচ গোত্রই যার যার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখেছে (ব্রিসিগ, ২০০৪, পৃষ্ঠা ২২)। আজো বালুচেরা যার যার নিজস্ব গোষ্ঠি পরিচয়ে পরিচিত হতে গর্ব বোধ করে। মূলত: পারস্য, আফগানিস্থান এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মত শক্তিশালী প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যই বালুচেরা পার্শ্ববর্তী অনেক ছোট ছোট জন–গোষ্ঠিকে আত্মীকৃত করেছিল। চৌদ্দ শতকে মীর চাকার খান রিন্দ প্রথম বালুচ গোষ্ঠিগুলোর ভেতর একটি ’গোত্রীয় কনফেডারেশন’ গড়ে তোলেন যাতে করে গোটা বালুচ জাতিকে একটি শিথিল প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় এনে ঐক্যবদ্ধ করা যায় (ব্রিসিগ, পৃষ্ঠা ১৩৯)। এই কনফেডারেশন পশ্চিমে কিরমান থেকে উত্তর–পূর্বে আফগানিস্থান এবং দক্ষিণ–পূর্বে সিন্ধু ও পাঞ্জাব থেকে দক্ষিণে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বালুচ জাতির একত্রীকরণের লক্ষ্যে চাকার খানের গৃহীত এই উদ্যোগ সত্যিই অসাধারণ ছিল। তবে ১৬৬৬ সালে প্রথম ’কালাত কনফেডারেশন’ গঠিত হলে তা’ চাকার খানের হাতে গঠিত কনফেডারেশনকে ছাড়িয়ে যায় (এম.আহমেদ, পৃষ্ঠা ৯৯)। আঠারো শতকে কালাতের ষষ্ঠ খান বা মীর নাসির খান বালুচ গোষ্ঠিগুলোর আওতাধীন ভূ–খন্ডের অধিকাংশ সুসংহত করে দক্ষিণ–পূর্বে আফগানিস্থান, মাকরান (পাকিস্থান), খারান থেকে কোয়েটা মার্ডার পিক (পাকিস্থান) এবং বন্দর আব্বাস পর্যন্ত (ইরাণ) ও পাকিস্থানের পাঞ্জাবের প্রান্তে দেরা গাজি খানের আওতাধীন এলাকা সমন্বিত করা হয় (আহমাদ, পৃষ্ঠা ৭৬, ব্রিসিগ, পৃষ্ঠা ১৫০)। মীর নাসির খানের শাসনাধীনে বালুচদের এই কনফেডারেশন আরো শক্তিশালী হয় এবং ২৫,০০০ সৈন্যের এক নিয়মিত সেনাবাহিনী, একটি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং দু’টো আইন পরিষদ (’হাউস অফ লর্ডস’ এবং ’হাউস অফ কমন্স’) প্রতিষ্ঠিত হয় (এম.আহমেদ এবং বালুচ, পৃষ্ঠা ৩)।
তবে মধ্য–উনিশ শতকেই বৃটিশেরা প্রথম কালাত কনফেডারেশনের আওতাধীন ভূ–খন্ডের প্রতি কিছুটা মনোযোগী হয়। কালাতের ভূ–রাজনৈতিক অবস্থান রুশ এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভেতর প্রতিরক্ষা রেখা হিসেবে কাজ করতো। এই রেখা ধরেই বৃটিশ বাহিনী মধ্য এশিয়া, ইরাণ এবং আফগানিস্থানে বৃটিশ সেনাবাহিনীকে অভিগম্যতা দিয়েছে এবং গোটা এলাকায় তাদের প্রভাব সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে (দ্যুন, ২০০৬, বৈদেশিক নীতি কেন্দ্র, ২০০৬, পৃষ্ঠা ১৩, সীমা খান, পৃষ্ঠা ৭, সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা ১৫৮)।
‘সে সময়ে কালাত ছিল খুবই ছোট এবং প্রভাবহীন একটি রাষ্ট্র। কালাতের শাসক খানেরা তাই ধীরে ধীরে তাঁদের সদৃশ কিছু গোষ্ঠির গোত্রপতিদের সাহায্য চাইলেন এবং তাঁদের সাহায্য নিশ্চিত করতে এই গোত্রপতিদের জমিদারি দেওয়া হলো। কোন কোন ক্ষেত্রে, খানদের সরাসরি সাহায্য করার জন্যও এমনটা করা হলো।’ (আহমেদ ও অন্যান্য, পৃষ্ঠা ৬২)। স্থানীয় শাসকদের সাথে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরের পর বৃটিশ বাণিজ্য ও সামরিক গাড়িগুলো বালুচ কনফেডারেশনের ভেতর দিয়ে যাবার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সমন্বিত একটি পথও খুঁজে বের করা হয়। স্থানীয় শাসকদের অনুমতি অবশ্য রাজনৈতিক আলাপ–আলোচনা এবং সশস্ত্র সামরিক অভিযানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় (ব্রিসিগ, পৃষ্ঠা ১৫৯, মারি, পৃষ্ঠা ১৭)। কিন্তু দ্বিতীয় মীর নাসির আলী খানের শাসনাধিনে কালাত কনফেডারশনের অধিবাসীরা এসব চুক্তি প্রত্যাখান করে এবং উল্টো বৃটিশ সেনাবাহিনীকে তারা আক্রমণ করে। বৃটিশ বাহিনীর ছিল আধুনিক প্রযুক্তি আর স্থানীয়রা তাদের শতাব্দী প্রাচীন রণকৌশল বা হাতিয়ার নিয়ে বৃটিশ বাহিনীকে মোকাবেলা করে। ফলাফল হিসেবে বৃটিশ গোটা বালুচিস্থানকে তিন ভাগে ভাগ করে তিনটি রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়: পারস্য বা ইরাণ, আফগানিস্থান এবং বৃটিশ ভারত (দাশতি, পৃষ্ঠা ৩, এ. খান, পৃষ্ঠা ১০৭৩, সীমা খান, পৃষ্ঠা ৩৮–৪০ এবং সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা ১৫৮)। বালুচ ভূমিকে তিন টুকরো করার সময় এর ২৫ শতাংশ চলে যায় গোল্ডস্মিথ রেখা হয়ে পারস্য বা ইরাণের ভেতরে, ড্যুরান্ড রেখা হয়ে আফগানিস্থান এবং বৃটিশ ভারতের ভেতর বালুচ ভূমির উত্তরাংশ চলে যায়। হেরাক্লিদেস এই প্রক্রিয়াকে ‘বি–গোত্রীকরণের বদলে পুন:গোত্রীকরণ’ বলে আখ্যায়িত করেন (পৃষ্ঠা, ৭: হেরাক্লিদেস, ১৯৯১)।
আজকের বালুচিস্থান ইরাণ, পাকিস্থান এবং আফগানিস্থান তথা তিনটি রাষ্ট্রে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া এক ভূ–খন্ড ও জন–গোষ্ঠি।
ইরাণ, পাকিস্থান ও আফগানিস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বালুচ জাতি–সত্ত্বা
ইতিহাসের কালপ্রবাহে বালুচরা একটি স্বাধীণ ভাষা–ভিত্তিক এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে যারা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছে পাকিস্থানে এবং এছাড়াও ইরাণ, আফগানিস্থান, ওমান, বাহরাইন এবং তুর্কমেনিস্থানে রয়েছে (ব্রিসিগ, পৃষ্ঠা ৬৪, দাশতি, পৃষ্ঠা ১–৩, সামাদ– পৃষ্ঠা ৩০৬ ও তাহেরী– পৃষ্ঠা ৭)। বৃটিশের সহসা ছুরিকাঘাতে তিন টুকরো হওয়া বালুচেরা এই নতুন সীমান্তরেখাগুলো স্বীকার করতে চাইলো না, যেহেতু তা’ সীমান্তরেখার এপারে ওপারে অসংখ্য পরিবার এবং গোষ্ঠিকে ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন করেছে। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই সীমান্তরেখাগুলোর কারণে আফগানিস্থান, পাকিস্থান বা ইরাণে বহু অ–বালুচ জন–গোষ্ঠির সাথে তাদের থাকতে হলো যার বলে জন–গোষ্ঠিগুলোর ভেতর ক্রমাগত নানা দ্বন্দ লেগেই রইলো (এসমান, পৃষ্ঠা ৬৯)। দুই শতাব্দী আগে ইউরোপে উদ্ভাবিত ’জাতীয়তাবাদ’ নামের রাজনৈতিক দর্শন একমাত্র এন্টার্কটিকা ব্যতীত বাকি পৃথিবীর সব ভূ–খন্ডকে পৃথক পৃথক জাতি–রাষ্ট্রে বিভক্ত করে বৈশ্বিক রাজনৈতিক মানচিত্রকে আমূল বদলে দিয়েছে। কিন্তু এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নৃ–তাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুরা তথাকথিত ’জাতীয় সংহতি’ গঠন প্রক্রিয়ায় নানা সমস্যা ও ব্যর্থতার মুখোমুখি হচ্ছে– যা সমকালীন পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বটে (বার্চ, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৩)।
এই তিনটি রাষ্ট্রেই বালুচ জনতার অভিন্ন বঞ্চণা বোধের কারণ হচ্ছে মূলধারার জন–গোষ্ঠি থেকে আর্থ–সামাজিক প্রশ্নে হাজার গুণে পিছিয়ে থাকা (হুদা ও অন্যান্য– পৃষ্ঠা ৩৮, ২০১১)।
তাত্ত্বিক রূপরেখা
যে কোন সমাজেই, সমান সুযোগের অভাব ’সব পেয়েছি’ এবং ’কিছুই পাইনি’-দের ভেতর একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে। ’কিছুই পাইনি’ গোষ্ঠি তার বঞ্চণাকে তার আত্ম–পরিচয়ের সাথে মিলায় যা বাকি সমাজে পরষ্পরের সম্মিলন প্রয়াসে আরো বাঁধা দেয়। সমাজের বিভিন্ন বর্গের ভেতর সুবিধার অসম বণ্টন সমাজকে শুধু দূর্বলই করে না, নিজেকে ’বঞ্চিত’ এবং ’প্রান্তিক’ বোধ করা জন–গোষ্ঠি তার কণ্ঠস্বর তুলে ধরা এবং সংগঠিত হবার ক্ষেত্রে ’আত্ম–পরিচয়’কে একটি শক্তিশালী এবং সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করে। বতর্মান পৃথিবীর মানব সমাজগুলোয় বিভাজনের মুখ হিসেবে গ্যুয়েলকে মূলত: শ্রেণি, জাত–পাত, ধর্ম, ভাষা, গাত্র বর্ণ, নৃ–তাত্ত্বি¡ক পরিচয় এবং গোষ্ঠিকে সণাক্ত করেন। এছাড়াও একটি এলাকার আদিবাসী জন–গোষ্ঠি বনাম বহিরাগত গোষ্ঠি, অভিবাসী বনাম ভূমিপুত্র, পশুচারী বনাম ভূমিপুত্র, কৃষক বনাম সামন্ত প্রভু, নাগরিক বনাম গ্রামীণ জনগোষ্ঠি এবং কেন্দ্র বনাম প্রান্ত জাতীয় অসংখ্য বিভাজন রয়েছে (গ্যুয়েলকে, ২০১২, পৃষ্ঠা ১৪)। কোন জন–গোষ্ঠির ’নৃ–তাত্ত্বিক পরিচয়’ অবশ্য অজির্ত হয় না, বরং সামাজিক মূল্যবোধ, ভাষা, রীতি–নীতি, আচার–অনুষ্ঠান, ধর্ম–বিশ্বাস এবং নৃ–তাত্ত্বিক গড়নের মাধ্যমে এই পরিচয় উত্তরাধিকার সূত্রে একটি জন–গোষ্ঠি বহন করে চলে (এসমান, পৃষ্ঠা ২৮–২০০৪, স্মিথ, পৃষ্ঠা–২২, ১৯৭৯ ও তাম্বিয়াহ, ১৯৮৯– পৃষ্ঠা ৩৩৫)। প্রশ্ন হলো বালুচ জন–গোষ্ঠি কীভাবে তার সুনির্দিষ্ট জাতিগত এবং ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে শোষিত হয়েছে।
বালুচিস্থান: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
পাকিস্থান এবং ইরাণ– এই দুই রাষ্ট্রেই বালুচ জনগণ তাদের সামাজিক–রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে। অনুন্নত এই এলাকায় বালুচরা তাদের জীবনের নিম্ন মানের পেছনে পাকিস্থানে পাঞ্জাবি সংখ্যাগুরুদের হাতে জাতিগত কারণে বঞ্চিত হওয়া এবং ইরাণে শিয়া সংখ্যাগুরুদের হাতে সুন্নী সংখ্যালঘু হিসেবে বঞ্চিত হওয়াকে দায়ি করে। তবে এসব বিষয়ে উপযুক্ত তথ্য–প্রমাণের খোঁজ করতে গেলে দুই দেশেই গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য ও অন্যান্য সুবিধা থেকে গবেষকরা বঞ্চিত হয়ে থাকেন (হামিদ ও অন্যান্য, ২০১৯– পৃষ্ঠা ১৩৩, সিয়াল এবং বাসিত, ২০১২– পৃষ্ঠা ১০–১১)।
পাকিস্থানের বালুচ জন–গোষ্ঠি
১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বৃটিশ ভারত বিভক্ত হবার সময় কালাত রাজ্য এবং এর সাথে সংযুক্ত, অন্য তিনটি প্রান্তিক রাজ্য (খারান, মাকরান এবং লাসবেলা) নিয়ে পাকিস্থানের আওতায় ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় পূর্ব বালুচিস্থান। প্রায় ৩৪৭,১৯০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট বালুচিস্থান গোটা পাকিস্থানের ৪৩.৬ শতাংশ ভ‚মির মালিক (দাশতি, ২০১৭, সীমা খান, ২০২১: পৃষ্ঠা ৫)। তবে, ’পাকিস্থান পরিসংখ্যান ব্যুরো’র মতে আয়তনে বৃহত্তম প্রদেশ হলেও জনসংখ্যা এখানে অপ্রত‚ল এবং বেশ ছড়ানো–ছিটানো। এই প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ১২ মিলিয়ন (১২,৩৪৪,৪০৮) যা গোটা পাকিস্থানের জনসংখ্যার (২০৭,৭৭৪,০০০) মাত্র ৬ শতাংশ এবং এই ৬ শতাংশ মানুষও দু’টো ভাগে বিভক্ত– পশতুন এবং বালুচ। পাকিস্থানে গড় জন–ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটাওে ২৬০.৮৮ হলেও বালুচিস্থানে প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মাত্র ৩৫.৫৩ জন অধিবাসী বাস করে (পাকিস্থান পরিসংখ্যান ব্যুরো, সীমা খান, ২০২১– পৃষ্ঠা–৬)। রাজধানী শহর কোয়েটা এবং জন–গোষ্ঠির বিন্যাসে এই প্রদেশ সবচেয়ে বিচিত্র। জন–গোষ্ঠির ৪৫% শতাংশ বালুচ (মুখ্যত: ব্রাহভি) এবং পূর্ব বালুচিস্থানের দক্ষিণে সন্নিবেশিত এবং দ্বিতীয় জন–গোষ্ঠি হলো পাশতুন (৩২% শতাংশ)। পাশতুনরা মূলত: কোয়েটা এবং উত্তরের প্রান্তিক জনপদগুলোয় বসবাস করে। বালুচ এবং পশতুন ছাড়াও ব্রাহভি, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, হাজারা, আফ্রিকা থেকে আগত মাকরানী জন–গোষ্ঠি এবং আরো অনেক ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠি এখানে বাস করে। এছাড়া একটি উল্লেখযোগ্য অ–মুসলিম জন–গোষ্ঠিও রয়েছে (হিন্দু– ০.৪৯%, ক্রিশ্চিয়ান– ০.৪০%, কাদিয়ানী– ০.১৫% এবং পিছিয়ে পড়া জন–গোষ্ঠি সমূহ– ০.১০%)। মারি, বুগতি, ব্রাউহি, জামালদিনি, রক্ষানী, বিজেঞ্জো, বোলেদাই, বাঙ্গুলজাই, উমরানী, জামালী, কায়সারানী এবং ক্ষেত্রান সহ নানা গোত্রে বিভক্ত এই বালুচ সমাজ (ব্রিসিগ, ২০০৪– পৃষ্ঠা ৬০)।
১৯৪৭ সালে পাকিস্থান গঠিত হবার পর থেকে কালাত রাজ্য এবং এর পার্শ্ববর্তী তিনটি প্রান্তিক রাজ্য ক্রমাগত ভাবে পাকিস্থানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে এসেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস, তামা, ইউরেনিয়াম, সোনা, কয়লা, রূপা, প্লাটিনাম এবং তেল সম্পদে সমৃদ্ধ বালুচিস্থান তার সম্পদের ন্যায্য হিস্যা কখনোই কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পায়নি। পূর্ব বালুচিস্থানে ১৯৫২ সালে প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কৃত হলেও বাদবাকি পাকিস্থান এই গ্যাস তাদের শিল্প–কারখানা ও গার্হস্থ্য খাতে ব্যবহার করতে পারলেও খোদ বালুচরাই তাদের নিজেদের সম্পদে অভিগম্যতা বঞ্চিত ছিল। শুধু গার্হস্থ্য খাতে নয়, ফয়সলাবাদ, শিয়ালকোট, লাহোর, গুজরানওয়ালা এবং করাচীর কল–কারখানাগুলোয় পূর্ব বালুচিস্থানের সস্তা গ্যাস বা জ্বালানীর ব্যবহারের অধিকার পেলেও বালুচিস্থান এই অধিকার পায় আর ১৯৮৩ সালে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসার্ভেশন অফ নেচার এ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস’ পাকিস্থানের কেন্দ্রীয় সরকারকে বালুচ ঘরগুলোয় প্রাকৃতিক গ্যাস দেবার জন্য চাপ দেয়। নয়তো প্রদেশটির অরণ্য এবং বিশেষত: জুনিপার বৃক্ষরাজি ধ্বংস হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় (আইইউসিএন, ২০০০:৯৫)। এ যেন পূর্ব বাংলার পাটের উপর পশ্চিম পাকিস্থানের বড় শহরগুলোর শোভিত হবার ইতিহাসই মনে করিয়ে দেয়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে বালুচিস্থানও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ এবং ২০০৬ থেকে অদ্যাবধি দু’টো গণবিদ্রোহ সঙ্ঘটিত হয়। এছাড়া ১৯৪৮, ১৯৫৮ এবং ১৯৬৩ সালে স্থানীয় পর্যায়ে তিনটি গেরিলা প্রতিরোধ হয় যা পাক বাহিনী দমন করে। ১৯৬৩ সালে শের মোহাম্মদ মারি একটি নতুন গেরিলা আন্দোলন সংগঠিত করলেও ১৯৬৯ সালে অস্ত্র বিরতি ঘোষিত হয়। তবে ১৯৭৩ এবং ১৯৭৭ সালে জন–বিক্ষোভের মুখে পাকিস্থান কেন্দ্রীয় সরকার সশস্ত্র যোদ্ধা ব্যতীত নিরীহ বেসামরিক জনতার উপরেও বিমান আক্রমণ করে। ২০০৬ সালে নওয়াব আকবর খান বুগতি, এক বিখ্যাত বালুচ সর্দার, সশস্ত্র যোদ্ধা এবং পাক সেনাবাহিনীর ভেতর এ্যাম্বুশে নিহত হন যা বালুচ–সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোয় তীব্র প্রতিবাদ ও দাঙ্গার সূচনা করে। পাক সেনাবাহিনী এই বিক্ষোভ দমনে নানা মাত্রার মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। বালুচ শহরগুলোয় আধুনিক শিক্ষার বিস্তারের সাথে বালুচ তারুণ্য তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালে পাকিস্থানের ’ন্যাচারাল ডিজ্যাস্টার কনসোর্টিয়াম– এনডিসি’-র একটি হিসাবে দেখা যায় যে পাকিস্থানের ৩৯% শতাংশ বহু–মাত্রিক দরিদ্রদের ভেতর ৭১ শতাংশই বালুচ। কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্বিকারত্বই বালুচ জনতাকে দিন দিন বিক্ষুব্ধ করে তুলছে। গৃহায়ণ, স্বাস্থ্য সেবা এবং শিক্ষার মত মৌলিক সুবিধাগুলোয় অনভিগম্যতার পাশাপাশি জলবায়ুর দিক থেকে খরা ও পাহাড়ি ঢলে বিপন্ন বালুচিস্থানের প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বরাদ্দ খুবই কম। ১৯৭০ সালে ভোলার জলোচ্ছাসে পূর্ব বাংলায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু এবং কেন্দ্রীয় পাক সরকারের নির্বিকারত্ব বিক্ষোভের বারুদ কেমন উস্কে দিয়েছিল তা’ আমরা ভুলে যাইনি। প্রদেশটিতে কর্ম–সংস্থানের হারও খুব কম। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক, বেসামরিক ও সামরিক খাতে তাদের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব বাঙ্গালীদের মতই বালুচদেরও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। গোটা পাকিস্থানে পাঞ্জাবিরা যদি হয় মোট জনসংখ্যার ৫২.৯৬% শতাংশ, তবে বালুচ–পাশতুন–ব্রাহভিরা সবাই মিলে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫% শতাংশ (৬,২৮১,০৮৭– পাকিস্থান পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০১৭) যা তাদের বঞ্চণার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়।
আসলে বৃটিশ আমলেই পাঞ্জাব থেকে বিপুল পরিমাণ কৃষি রাজস্ব আদায় হতো বলে বৃটিশ সরকারই এই প্রদেশের রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্য বাড়ানোয় অনেক টাকা খরচ করেছে যা পূর্ব বালুচিস্থানের উষর, নিষ্ফলা জমি ও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা স্বল্প জনসংখ্যার প্রদেশে হয়নি। স্বাধীণতার পর পাক সরকার এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নে তেমন কোন বিনিয়োগ করেনি। এছাড়া পশতুন সেটেলারদের বসিয়ে পাক সরকার বালুচদের নিজ ভূমে সংখ্যালঘু করার প্রচেষ্টাতেও লিপ্ত। এছাড়া ১৯৮০ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্থান আক্রমণ করলে এবং ২০০১ সালে মার্কিনীরা এখানে ন্যাটো শক্তিগুলোর অভিযান চালালে তাজিক, উজবেক, হাজারা, তুর্কমেন এবং বালুচ সহ নানা জন–গোষ্ঠির মানুষ বালুচিস্থানে প্রবেশ করলেও বালুচরা এর ভেতর ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ (গাজদার ও অন্যান্য, ২০১০– পৃষ্ঠা ১৭)।
ইরাণের বালুচ জন–গোষ্ঠি
বালুচ ইতিহাসের শুরু কিন্তÍ ইরাণেই (পশ্চিম বালুচিস্থানে)। তেরো শতক থেকে ইরাণের বালুচ অংশ থেকে বালুচরা এই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে বলে বালুচিস্থান বিশেষজ্ঞ সেলিগ হ্যারিসন মনে করেন।
ইরাণের অন্তর্গত বালুচিস্থান ’সিয়েস্তান ওয়া বালুচিস্থান’ নামে পরিচিত এবং জাহেদান এর রাজধানী শহর। ইরাণের মাত্র ১১ শতাংশ ভৌগোলিক আয়তনের অধিকারী পশ্চিম বালুচিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ মাত্র। পাকিস্থানের বালুচদের মত ইরাণী বালুচরাও পশুচারণ ভিত্তিক অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। রিগি, ইয়ারাহমাদজি, নৌরি, গর্জেজ, ইসমাইলজাই, মীর বালোচজাই এবং জামশেদজাই গোত্রগুলো এখানকার প্রধান গোত্র। মানবাধিকার লঙ্ঘন ব্যতীতও সিয়েস্তান ও বালুচিস্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অর্থনৈতিক–সাংস্কৃতিক বৈষম্য, সীমিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অভিগম্যতার অভাব এখানে রয়েছে।
ইরাণের সংবিধানে পার্সী জাতি–সত্ত্বাকে অধিকতর মান্যতা প্রদানের কারণে বালুচ ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত এবং চাকরির বাজারও তাই তাদের হাতের মুঠোয় নেই। ইরাণী বালুচরা প্রায়ই নিজেদের ’তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক’ মনে করে। জনপরিসরেও বালুচ ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্কুলগুলোতে স্বীকৃত নয়। পাকিস্থানের মত ইরানী বালুচিস্থানেও কেন্দ্রীয় সরকার অন্য জাতি–গোষ্ঠির মানুষ এনে বালুচদের সংখ্যালঘু করছে। অতীতের বালুচ সংখ্যা–গরিষ্ঠ বন্দর আব্বাস, কেরমান এবং সিস্তানে পার্সী–নিয়ন্ত্রিত ’জাতিগত একাত্মকরণ’ প্রক্রিয়া চলছে।
সবচেয়ে যেটা দু:খজনক যে ইরাণের শিয়া ইসলাম বালুচ সহ অন্যান্য সুন্নী জন–গোষ্ঠিকে নিজস্ব মসজিদ নির্মাণেরও অনুমতি দেয় না। ইরাণে ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে সুন্নী মুসলিমদের প্রতি বঞ্চণা বেড়েছে (মাঙ্ঘেবাতি, ২০১৫, পৃষ্ঠা ২২–২৭)।
বালুচিস্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন:
ভারতীয় গবেষক আশীষ সিংয়ের প্রবন্ধ ‘Balochistan: A Land Silenced by Guns, Ignored by the World’ অনুযায়ী, পাকিস্থানের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ পূর্ণ প্রদেশ হয়েও এই প্রদেশই যেন সবচেয়ে বেশি বিক্ষত ও রক্তাক্ত।
বালুচিস্থানের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল অনুযায়ী, মার্চ ২০২৫–এ ১৫১ টি জোরপূর্বক অপহরণ ও ৮০টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪৪টি বলপূর্বক অপহরণ ও ৪৬টি হত্যার ঘটনা ঘটে। আর এই তথ্য বা পরিসংখ্যানগুলো নিছকই সংখ্যা ত’ শুধু নয়– ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন জীবন, ভেঙ্গে পড়া পরিবার এবং শোকে মুহ্যমান একটি গোটা প্রদেশের কাহিনী (দ্য বালোচিস্থান পোস্ট)। এই প্রদেশে প্রতিটি পরিবারের নিত্য ব্যবহৃত শব্দাবলীর একটি তাই ’নিখোঁজ ব্যক্তি।’ বালুচ নেত্রী মাহরাং বালুচের তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর তাই ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। তাদের জাতীয় সঙ্গীতের বাণী ’মা চুকেন বালুচ’ প্রসারিত হচ্ছে অন্তর্জালের দুনিয়ায়।
ইতোমধ্যে ৫৮তম জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল অধিবেশনে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন বেলুচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট (বিএনএম) এর পররাষ্ট্র সচিব ফাহিম বালুচ। তিনি মাহরাং বালুচ, সাম্মি দীন বালুচ, বেবো বালুচসহ আরো অনেক কর্মীর সাম্প্রতিক আটকের নিন্দা জানান।
ফাহিম বালুচ উল্লেখ করেন, সম্প্রতি কোয়েটা শহরে ১৩টি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের পরিবারের সম্মতি ছাড়াই সেগুলো এনে স্থানীয় একটি কবরস্থানে তাড়াহুড়ো করে দাফন করা হয়েছে। পরদিন সেই কবরগুলো খোঁড়া অবস্থায় পাওয়া যায়, পশুরা সেগুলো নষ্ট করছিল। পরবর্তীতে নিহতদের পরিবার লাশগুলো যথাযথ শনাক্তকরণ এবং দাফনের দাবিতে বিক্ষোভ করে।
তবে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের সেগুলো দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে মাহরাং বালুচ, বেবো বালুচ এবং সাম্মি দীন বালুচসহ বেশ কয়েকজন বালুচ মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে (২৯ মার্চ ২০২৫, দৈনিক কালের কণ্ঠ)।
বালুচ জাতীয় সঙ্গীত:
We are the sons of the Baloch, Free and sovereign, Masters of our own destiny;The earth panics from our wrath, Castles shake in fear, We are tigers, Fearless defenders (of those who seek our help);We are an encouragement to our fathers, The pride and honor of our mothers and sisters, Support of our brothers;Our blood one day, Will be required by our nation, We will prove to the lullabies given by mothers;We have sucked the milk of honor honor, In the shadow of swords, Red blood in our eyes shows descent from martyrs;We are defenders of the helpless and the poor, We have destroyed the castle of terror, The days of oppression have gone forever. Natio Natus | মা চুকেন বালুচ
আমরা বালুচের পুত্র, মুক্ত, সার্বভৌম নিজ নিয়তির নিজেই নিয়ন্তা;
পৃথিবী আমাদের ক্রোধে কাঁপে প্রাসাদেরা ভয়ে থরথর আমরা ত’ ব্যঘ্র নির্ভীক রক্ষাকারী (শরণাগতকে দেই চির বরাভয়);
আমারা আমাদের পিতাদের প্রেরণা, মা ও বোণেদের গর্ব এবং সম্মান, ভাইদের সহায়তা।
আমাদের লহু আমাদের তাজা খুন লাগবে জাতির ভাঙ্গতে পায়ের বেড়ি মাদের গাওয়া ঘুম পাড়ানি গানের যোগ্য যেন হয়ে উঠতে পারি।
তরবারীর ঘোর ছায়াঞ্চলে দুধ খেয়েছি মায়ের সম্মানে শহীদের বংশে জন্মেছি বলেই ত’ দু’চোখ দ্যাখো এখনো কেমন রাঙা।
অসহায় আর গরীবকেই বাঁচাই, ছিন্ন করেছি ভয়ের প্রাসাদ যত… শোষণের যত ইমারত গেল টুটে চিরতরে ভেঙ্গে এসেছে রাঙা ভোর।
|
শেষকথা:
চেক আইনবিদ কারেল ভাসাকের মতে, ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মানবাধিকার (চিন্তা–বাক স্বাধীণতা–মত প্রকাশ–ধর্মাচরণের স্বাধীণতা) বা রুশ বিপ্লবের প্রেক্ষিতে আর্থ–সামাজিক মানবাধিকার (অন্ন–বস্ত্র–বাসস্থান–রোগারোগ্য–শিক্ষা)-র যুগের পর অন্ত্য–চল্লিশ ও পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক থেকে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় বিউপনীবেশীকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয় বা ‘আত্ম–নিয়ন্ত্রণের অধিকার’ তথা ‘তৃতীয় প্রজন্মের’ যে মানবাধিকার সূচীত হতে থাকে, তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। পাকিস্থানের মত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ বা বাংলাদেশের পাবর্ত্য চট্টগ্রাম সহ নানা জায়গাতেই নিপীড়িত নৃ–গোষ্ঠিগুলোর আত্ম–নিয়ন্ত্রণের অধিকার কিন্ত রয়েছে।
কিন্ত কেন বহু ভাষা–ভাষী বা নানা নৃ–গোষ্ঠি বা জাতি–সত্ত্বা সম্পন্ন রাষ্ট্রগুলোয় ’আত্ম–নিয়ন্ত্রণের অধিকার’লড়াই তীব্র হয়ে উঠছে? এর উত্তর ’ইউরোপীয় জাতি–রাষ্ট্রে’-র ইতিহাসে।
ভারতের পরিবেশ নারীবাদী বন্দনা শিবার মতে, রোমান ‘Natio’ শব্দ থেকে আধুনিক ‘Nation’ শব্দটির জন্ম। ’শব্দটির মূলগত অর্থ ‘Natus’ অর্থাত নবজাতক। ‘Natio’ অর্থ কোন ব্যক্তির জন্মস্থান, তার কৌমগোষ্ঠী, অঞ্চল ইত্যাদি। নিজেদের তারা বলত ’Populus Romanus ’ বা ‘রোমের নাগরিক।‘ অনেকটা এই প্রাচীন রোমকদের কায়দায় বিসমার্ক, আব্রাহাম লিঙ্কন, স্ট্যালিন বা মার্শাল টিটোদের হাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য জাতিসত্তার সমাহারে গঠিত হয়েছে বড় বড় জাতি–রাষ্ট্র, সৈনিক পুরুষদের ‘নয়া পিতৃভূমি।’ কেননা রেনেসাঁর সম্প্রসারণবাদী অর্থনীতির জন্য বিশাল এলাকা, বিশাল জনসংখ্যা, প্রচুর খনিজসম্পদ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ওয়ালেরস্টাইনের ভাষায়, ’These new nation-states, these fatherlands, swallowed up smaller countries and tribes and homogenized them within a new ‘national culture,’ ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া এই রাষ্ট্রকাঠামো, মাতৃভূমির এই ’পুরুষায়ণ’-ই যুগোশ্লাভিয়া, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বহু বড় রাষ্ট্রে ভাঙন বা বিচ্ছিন্নতার সুর বেজে ওঠার বড় কারণ (বন্দনা শিবা, ইকো–ফেমিনিজম: উদ্ধৃত: অদিতি ফাল্গুনী, খসড়া খাতা: নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও বিবিধ প্রসঙ্গ)। সেই সাথে জাতি–রাষ্ট্রের ‘প্রদেশ’গুলোর ভেতর বৈষম্যও একটি বড় কারণ ত’ অবশ্যই । ভারতেও যেমন হিন্দি ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারত বা পূর্ব ভারত সহ ভারতের নানা রাজ্যের মানুষই বিক্ষুদ্ধ।
বালুচ জনগণের স্বাধীণতা আন্দোলন কত দূর যাবে বা এমনকি স্বাধীণতা পেলেও বাংলাদেশের মতই ’নৃ–তাত্ত্বিক’ও ’ধর্মীয় বিরোধ’ সেখানে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে কিনা তা’ বলবে একমাত্র সময়।
তথ্য সূত্র:
১. Trapped between religion and ethnicity: identity politics against the Baloch in Iran and Pakistan, Seema Khan & Costus Laostides (Full article: Trapped between religion and ethnicity: identity politics against the Baloch in Iran and Pakistan).
২. Balochistan: A Land Silenced by Guns, Ignored by the World by Ashish Singh (Balochistan: A Land Silenced by Guns, Ignored by the World | Countercurrents).
৩. Ma Chuken Balochani English Lyrics (https://brahvitime.blogspot.com/2014/03/ma-chuken-balochani-english-lyrics.html).
৪. Ahmad, S. I. (1992). Balochistan: Its strategic importance. Royal Book Company.
৫. Breseeg, T. M. (2004). Baloch nationalism: Its origin and development. Royal Book Company.
৬. Ahmed, M. (2020). The dynamics of (ethno) nationalism and federalism in postcolonial Balochistan, Pakistan. Journal of Asian and African Studies, 55(7), 979–1006. https://doi.org/10.1177/0021909619900216.
৭. Dashti, N. (2012). The Baloch and Balochistan: A historical account from the beginning to fall of the Baloch State. Trafford Publishing.
৮. Gazdar, H., Kaker, S. A., & Khan, I. (2010). Buffer zone, colonial enclave or urban hub? Quetta: Between four regions and two wars, crisis states. LSE DESTIN (Development Studies Institute).
৯. দৈনিক কালের কণ্ঠ (২৫শে মার্চ)।
১০. Vandans Shiva (Eco-Feminism by Maria Mies and Vandana Shiva), উদ্ধৃত: পরিবেশ নারীবাদ, খসড়া খাতা: নারীবাদী সাহিত্যতত্ত¡ ও বিবিধ প্রসঙ্গ (দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০২০, প্রথম মুদ্রণ: ২০০১, পৃষ্ঠা: ৪২)।
১১. Wirsing, R. (2008). Baloch Nationalism and the geopolitics of energy resources: The changing concept of separatism in Pakistan. The U.S. Army War College, The Strategic Studies Institute.
