আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হবে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তাদের গঠনতন্ত্রে মৌলিক পরিবর্তন না আনলে এই নিবন্ধনে অংশ নিতে পারবে না। অন্যদিকে জামায়াত তার ‘ইসলামী রাজনৈতিক‘ চরিত্রটি হারাবে যদি কমিশনের এই শর্ত মানতে চায়। এ এক উভয় সংকট জামায়াতের জন্য!
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের নিবন্ধন সংক্রান্ত অংশের দুটি শর্ত জামায়াত নেতাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে তুলেছে, কারন শর্ত মানতে গেলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের অস্তিত্বই হুমকির সম্মূখীন হবে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রথম শর্তটিতে বলা হয়েছে:
a political party shall not be qualified for registration if the objectives laid down in its constitution are contradictory to the constitution of the People’s Republic of Bangladesh.
তরজমা: ‘কোন রাজনৈতিক দলের দলীয় গঠনতন্ত্র যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের কোন বিধানের পরিপন্থী হয়, তবে সেই দল নিবন্ধনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে’।
জামায়াতের গঠনতন্ত্র পরিষ্কারভাবে বাংলাদেশের সংবিধান (যা এই ভুখন্ডের চূড়ান্ত আইন) বিরোধী। বাংলাদেশের বাদবাকি আইন, অধ্যাদেশ, কার্যাবলীসমুহ কোনভাবেই সংবিধানের বিরূদ্ধাচরণ করতে পারে না। যদি করে তবে ঐ সকল আইন, অধ্যাদেশ, কার্যাবলীসমুহ আপনা আপনিই বাতিল বলে গন্য হবে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ভুমিকাতে বলা আছে:
“…. it shall be a fundamental aim of the state to realise through the democratic process a socialist society, free from exploitation, a society in which the rule of law, fundamental human rights and freedom, equality and justice, political, economic and social will be secured for all citizens.”
তরজমা: ….গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা–যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।
অন্যদিকে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জামায়াতের লক্ষ্য হল ‘ইসলামের শাসন কায়েমের মাধ্যমে’ মানবজাতির জন্য শান্তি ও কল্যাণ অর্জন করা। এছাড়াও জামায়াতের গঠনতন্ত্র ‘আল্লাহ ও সৎলোকের’ ‘অর্গানাইজড’ শাসন কায়েমের মধ্য দিয়ে দমনপীড়ন ও অন্যায় খতম করার কথাও বলে থাকে। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ভুমিকায় এরশাদ করা হচ্ছে যে আল্লা মানবজাতিকে পাঠিয়েছেন পৃথিবীর বুকে খিলাফত (ইসলামী শাসনব্যাবস্থা) চালু করতে, এবং মানবজাতিকে দায়িত্ব দিয়েছেন ‘মনুষ্য প্রণীত’ আইন বাতিল করে ‘আল্লাহ প্রদত্ত’ আইন ও জীবনব্যবস্থা চর্চা করতে।
এটা প্রতীয়মাণ হচ্ছে যে জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশ সংবিধানের মূল লক্ষ্যের সাথেও বিরোধে লিপ্ত। কারণ, জামাতের নীতিমালানুসারে বাংলাদেশের সংবিধান ‘মন্যুষ্য প্রণীত’ বিধায় সরাসরি বাতিলযোগ্য। জামায়াতের নীতিমালায় এমন আরো অনেক কিছু পাওয়া যায় যা বাংলাদেশ সংবিধানের সরাসরি পরিপন্থী। যেমন: সংবিধানের পরিচ্ছেদ ৭(১) অনুসারে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা জনগণের এবং এই ক্ষমতা শুধুমাত্র সংবিধানের আওতা ও ক্ষমতাবলেই প্রযোজ্য’। সুতরাং, জামায়াত যদি নিবন্ধিত হবার কোনরকম ইচ্ছাও রাখে তবে প্রথমেই তার গঠনতন্ত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সংবিধানের ধারাসমূহের সাথে সাযুজ্য লাভ করতে হবে।
জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশটির দ্বিতীয় শর্তটি হল: নিবন্ধনেচ্ছু রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে যদি ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও লৈঙ্গিক কোন প্রকার বৈষম্য দৃশ্যমান থাকে তবে ঐ দল নিবন্ধনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। এই শর্তটি সরাসরি বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদ থেকে এসেছে। কিন্তু জামায়াতের গঠনতন্ত্রানুসারে, শুধুমাত্র ধার্মিক মুসলমানগনই কেবল দলের সদস্য বা নেতৃত্বে আসতে পারবে। জামায়াতে যোগ দিতে হলে একজন মুসলমানকে আল্লাহ ও তার নবী’র প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের ছবক নিতে হয়, এবং শুধুমাত্র আল্লাহ ও রসূলের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার কড়ার দিতে হয়। মোদ্দা কথায়, শুধুমাত্র ধার্মিক মুসলমানগনই কেবল এই দলের নেতৃত্বের হকদার। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, জামায়াতের গঠনতন্ত্রের এই মৌলিক বৈশিষ্টটি বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক মানবাধিকারের বিধানের সরাসরি বিরূদ্ধে যায়। যদি কোন দল ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য চর্চা করতে চায় এবং এই চর্চাকে তাদের ‘অধিকার’ বলে দাবি করে তবে তার অর্থ হবে কার্যত বাংলাদেশ সংবিধানের আলোচ্য অংশগুলিকে অগ্রাহ্য করা । আবার শর্ত মানতে গেলে জামায়াতের দিক থেকে তার অর্থ দাঁড়ায় – দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অমুসলিমদেরও দলে যোগ দেবার ও নেতৃত্বলাভের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া।
জামাত আরেকটি শর্ত নিয়েও গাঁইগুই করছে। নারী অংশগ্রহণ সংক্রান্ত এই শর্তটিতে বলা হয়েছে নিবন্ধনেচ্ছু যেকোন দলের সংবিধানে এই সদুদ্দেশ্য পরিষ্কার দৃশ্যমান থাকতে হবে যে দলটি ২০২০ সাল নাগাদ তার কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল কমিটিতে নূন্যতম এক তৃতীয়াংশ নারী সদস্যের অংশগ্রহণ বাস্তবায়নে ইচ্ছাশীল।
আগস্ট ১৯ তারিখে এই অধ্যাদেশ জারি হবার পরেই জামাতের সেক্রেটারি আলী আহসান মুজাহিদ উচ্চ আদালতে উপোরোক্ত তিনটি শর্তের বিরূদ্ধে একটি রিট পিটিশন দাখিল করে। তার মতে এই তিনটি শর্ত ‘অসাংবিধানিক’। যাই হোক, মহান উচ্চ আদালত ২৮শে আগস্ট সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের এই তিনটি শর্ত কেন ‘অবৈধ’ ঘোষিত হবে না। যখন সরকার এর উত্তর প্রস্তুতে ব্যস্ত, এদিকে নির্বাচন কমিশনে দলগুলির নিবন্ধনের সময়সীমা পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। অক্টোবর ১৫ যার শেষ দিবস।
এমতাবস্থায়, বিএনপি-জামাত জোটের শরীক জামাতে ইসলামী খোদ নিবন্ধন পদ্ধতিটাই বাতিল ঘোষনা করতে হাউকাউ করছে। বিএনপিকেও তারা নিজেদের পাশে পাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছিলো। যদিও উক্ত তিন শর্তে বিএনপির কিছুই যায় আসে না, কারণ যেকোন সময় যে কোন পরিবর্তন আনতে পারে বিএনপি দলের গঠনতন্ত্রে।
আশ্চর্যের বিষয় এই, যে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলির রাজনৈতিক কর্মকান্ডে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও, শুধুমাত্র আইনটির পরিপূর্ণ প্রয়োগ না হবার কারনেই এই ধরনের দলগুলি গত তিন দশক ধরে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও ১৯৭২ এর সংবিধান ধর্মের ওপর ভিত্তি করে যে কোন প্রকার সংগঠন, রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিলো। জামায়াত, যারা ১৯৭১ এ বাঙলাদেশ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিলো, এই সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আপনিতেই ভেঙ্গে গিয়েছিলো। জিয়াউর রহমান পরে সংবিধানে কাঁটাছেড়া করে জামায়াতকে আবার পুনর্গঠিত হবার সুযোগ করে দিয়েছিলো।
তবে ১৯৭৪ এর বিশেষ ক্ষমতা আইন (Special Powers Act) এখনো বলবৎ, এবং জামাতের শাস্তি হতে পারে এই আইন ভঙ্গ করার দায়ে। পঁচাত্তর পরবর্তী সকল সরকারই ১৯৭৪ বিশেষ ক্ষমতা আইনটি ব্যবহার করেছে প্রতিপক্ষকে দমনে অথচ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দমনে আইনটি বরাবরই নিরব দর্শকের ভুমিকা নিয়েছে।
ডেইলিস্টারে শওকত লিটনের নিবন্ধের অনুবাদ
সর্বশেষ: প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, বিএনপি এবং জামায়াত লিখিত আবেদনে নিবন্ধিত হবার জন্য এক সপ্তাহ বেশি সময় চেয়েছে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
রায়হান রশিদ - ১২ অক্টোবর ২০০৮ (৮:২১ অপরাহ্ণ)
বুঝি একেই বলে শাপে বর ! every cloud has a silver lining. . . !
মাসুদ করিম - ১৪ অক্টোবর ২০০৮ (৩:৩৫ পূর্বাহ্ণ)
জামায়াতের এখনকার যে অর্থনৈতিক ভিত্তি কোনো সংবিধান পরিপন্থী কার্যক্রম ও দলীয় গঠনতন্ত্রে সংবিধান পরিপন্থী যে কোনো অনুচ্ছেদের জন্য কোনো ধরনের সমস্যায় জামায়াত কোনোভাবেই পড়বে বলে আমার মনে হয় না। নিবন্ধনের জন্য এক সপ্তাহ বেশী সময়েই তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। ‘জামায়াত ইসলামি বাংলাদেশ’ হবে ‘বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামি’ : বাংলাদেশ আগে লিখলেই বাংলাদেশ বড় হবে, দেশপ্রেমের বিষয়টির সুরাহা হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর ‘বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামি’ -এর জন্ম।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কোনো ধনাত্মক বা ঋণাত্মক ভূমিকা নেই, কারণ তার তো তখন জন্মই হয়নি।কাজেই বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা পরবর্তী স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামি’-কে ঠিক যুদ্ধাপরাধী বিষয়ক সেক্টর কমান্ডার প্রণীত মানববন্ধন,ইফতার পার্টি ও এসএমএস প্রচারণার দ্বারা কিছুই করা যাবে না। বরং জামায়াতের জন্য শাপে বর যা হলো : বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য শব্দ ‘রাজাকার’-এর প্রতিশব্দ হলো ‘যুদ্ধাপরাধী’! আমরা আনন্দিত যে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি তার স্বরূপে নতুন মেকআপের কিছু অমোঘ ছোঁয়ায় হয় উঠবে আরো আকর্ষণীয়!
একটি ছোট্ট প্রচলিত গল্প : একটা লোকের বাছুর জঙ্গলে চরতে চরতে হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে সে ধরে নিল, কেউ নিশ্চয় চুরি করেছে। সে মানত করল, “ঈশ্বর, যে চুরি করেছে তাকে যদি সামনে পাই তাহলে একটা পাঁঠা উৎসর্গ করব তোমার নামে।’’ সঙ্গে সঙ্গে একটা বাঘ তার সামনে হাজির। বাঘ বলল, “আমিই তোমার বাছুরটাকে চুরি করে খেয়েছি। আমাকে কী বলবে বলো।’’ বাঘ দেখে তো লোকটার আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া।সে তখন করুণ কণ্ঠে প্রার্থনা করল, “হে ঈশ্বর, আমাকে এই বাঘের হাত থেকে বাঁচাও। তোমার নামে একটা বড় ভেড়া উৎসর্গ করব।’’