বিশ্বজুড়ে স্টক মার্কেট ডুবছে, ফলাফল বিনিয়োগ আড়তীরা পাততাড়ি গুটিয়ে ত্রাহি মধুসুদন! পুঁজিবাদ কি তবে ফেলু মিত্তির হতে যাচ্ছে? একে কি আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা উচিত, নাকি যেটুকু লাগাম ধরা আছে সেটুকুও খুলে নেয়া উচিত? মুদ্রা-আড়তীদের আপসে একীভূত হয়ে যাওয়া কি আসলেই কোন ধরনের সমাধান? দাদন সদাগর, রাজনীতিক, চিন্তাবিদ, সংখ্যাবেত্তা এদের কাছে সম্প্রতি বিবিসি’র এক আলোচনায় প্রশ্নগুলি রাখা হয়েছিলো। আসুন দেখি তাদের কি মত এ বিষয়গুলিতে:
নোয়াম চমস্কি: দার্শনিক, রাজনীতি চিন্তাবিদ এবং ভাষাবিদ
পুঁজিচালিত বাজারব্যাবস্থার কয়েকটা বেশ বড় ধরনের গলদ আছে। এই যেমন বিপদে পড়লে সে খেলোয়ার দর্শক সকলকে নিয়ে হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ে। মচ্ছবের ধারে কাছেও ছিলো না এমন প্রচুর লোক বেধড়ক বিপদে পড়ে বসে থাকে। পুঁজিপতি যখন খেলা সাজায়, সে শুধু নিজের ক্ষতি হলে কি করবে সেটা ভেবে রাখে, যদিও তার উচিত ছিলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সব পক্ষের জন্যই বিপদকালীন ব্যাবস্থা রাখা। ঠিক এ কারনেই বছর দশেক আগে মুদ্রাব্যাবস্থার লাগাম খুলে দেয়ার বিপদ সম্পর্কে জন ইয়াটওয়েল এবং ল্যান্স টাইলর বলেছিলেন ‘অদক্ষ আর ভঙ্গুর বিনিয়োগ বাজার কখনোই ঝুঁকি গায়ে মাখতে চায় না।’ আর আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি কি করে সবার জীবিকা হুমকির সম্মুখিন।
আসলে এই সম্ভ্যাব্য আপদটা সত্যিকার বিপদে পরিনত হয়েছিলো যখন বিল ক্লিনটন বিনিয়োগ ব্যাবসায় ‘নতুনত্ব আনার’ অজুহাতে বিনিয়োগ ব্যাবসার লাগাম একেবারেই খুলে দিয়েছিলো। বিনিয়োগ বিশষজ্ঞ নমি প্রিনসের ভাষায় যেটা ছিলো একটা আত্ম-ঘাতী পদক্ষেপ; পুরো অর্থনীতির ও মার্কিন ব্যাংকিঙের ওপর মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি নড়িয়ে দেবার সেটা জন্য যথেষ্টই ছিলো। তবে (মার্কিন) সরকারের এই অভূতপূর্ব হস্তক্ষেপ আমাদের মেনে নেওয়া উচিত কি অনুচিত সে তক্কো উঠার আগেই সবাই উপলব্ধি করেছে কি ভীষন অগনতান্ত্রিক এই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। ঝুঁকি আর ক্ষতির ভাগ সে জনগনের ঘাড়ে চাপাতে সিদ্ধহস্ত, অথচ লাভ ভাগাভাগির কথা আসলেই মুখে কুলুপ আঁটে।
যদিও রাস্ট্র হওয়ার কথা ছিলো জনগনের, শুধুমাত্র পুঁজিপতিদের নয়।
টনি বেন: প্রাক্তন লেবার সাংসদ এবং কেবিনেট মন্ত্রী
‘অর্থনীতির বর্তমান এই সংকটের একটা বৈশ্বিক মাত্রা আছে। ত্রিশের দশকের চে’ও ভয়াবহ রূপ নিয়ে এসেছে সে এবার। এই আতঙ্কময় আবহাওয়ায় আমজনতা মুষড়ে পড়ে, সুবিধাভোগীরা তাদের নিষ্পেষনের সুযোগটা নেয়, ক্ষমতা দখলে যেমনটা নিয়েছিলো হিটলার। আমরা এটাকে জনগনের ‘যতোখুশি ঋণ করো, সরকারমশাই বাধা দেবে না’ যুগের ইতি বলে ধরে নিতে পারি। এই সংকটের ফলস্বরূপ বিশাল একটা জনগোষ্ঠী তাদের কর্মসংস্থান, মাথা গোঁজার ঠাই, জীবিকার মান হারাবে। সেই জনগোষ্ঠীর মনে তখন প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক ‘যুদ্ধের জন্য তো তোমাদের হাতে অফুরন্ত সম্পদ আছে… ইরাকে আফগানিস্তানে তোমরা বোমার হোলি খেল্ছ, তবে এই সংকট সামাল দেবার বেলায় তোমাদের ভাঁড়ার হঠাৎ খালি কেন?’ তখন স্বভাবতই নীতিমালার কার্যকারিতা নিয়ে একটা জোর প্রশ্ন উঠবে, বিনিয়োগ অবকাঠামোয় যে পরিষ্কার ধ্বস নেমেছে, তার কড়িবর্গা ছিলো আসলে সরকারী নজরদারি-হীন বাজার ।
পিটার জে: অর্থনীতিবিদ, ব্যাঙ্ক অফ ইংলন্ডের ডিরেক্টর এবং বিবিসি’র প্রাক্তন অর্থনীতি সম্পাদক
নয়াদিল্লির ঠিক বাইরে, রয়েছে একটুকরো পতিত জমি, সেখানে ঘুরে বেড়ায় ঘেয়ো কুকুর আর বুনো সজারু। এরই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে প্রাক্তন ব্রিটিশ রাজের পরিত্যাক্ত মুর্তিমালা… রাজা, রাণী আর ভাইসরয়… ঘিরে থাকা ধুসরতার দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে…। বিনিয়োগ পুঁজিবাদের ২০০৮ সালের দৃশ্যমান বিপুল পতনকে রূপায়িত করতে এই রূপকটা বড় দাগ কেটে যায় মনে। যেন অনেকটা শেলি’র অগমান্ডিয়াজ, রাজাদের রাজা, রোদন করছে… ‘দেখে যাও, কতো কিই না ছিলো আমার… রয়ে গেছে শুধুই শুন্যতা… দিগন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়িই সঙ্গী আমার শেষ মুর্তিটির’।
ওয়াল স্ট্রীটের মহীরুহ নামগুলি যখন ধ্বসে পড়ছে, তাদের আত্মশ্লাঘা আর ক্ষীনদৃষ্টির কারনে গত আটদশকের দেখা সবচে তুমুল অর্থনৈতিক ঝড় যখন তাদের উপড়ে ফেলছে, আমাদের কি আদৌ চমকিত হওয়া উচিত? আমরা, যারা কিনা এতোই বিপুল জ্ঞানী? কেনো আমরা দেখতে পেলাম না নাকের ডগায় এসে পড়া ঝড়টাকে?
উত্তরটা সত্য এবং ভীষন তিতে! পুঁজিবাদের অর্ন্তনিহিত গোঁজামিল গুলি মার্ক্সিজম যে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছিলো তা এই আমরাই অবহেলা করছিলাম। সত্তরের দশকে মার্ক্সিজমের দৃশ্যমান পতন দেখে এর বাণীগুলিকে কি এই আমরাই অবজ্ঞা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি? যদিও কিছু বুড়ো মনে করতো ওয়াল্টার বেঘোট আর জে এম কেইন্স এর একপ্রকার মিশ্রনে পাকানো অর্থনীতি কোনদি্নও মন্দায় ধ্বসবে না! যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরপরে আরো সাবধান হবে, আশা করা যায়! এখন বড্ডো মনে পড়ছে স্বর্গত বন্ধু পল ফুটের কথা। পঞ্চাশের দশকে বেচারার সাথে প্রচুর র্তক করতাম, ইদানিং তার আত্মার কাছে মিনতি করতে ইচ্ছে করে, ‘বন্ধু, পারলে ক্ষমা করে দিও, মনে হয় তুমিই ঠিক বলেছিলে।’
তরূণ প্রজন্মের কাছে ত্রিশের দশক পুরোন কাহিনীবিশেষ। তৎপরবর্তী সবগুলো সংকটই যেহেতু কাটিয়ে ওঠা গিয়েছিলো, ফলস্বরূপ অর্জিত আত্মম্ভরিতাকে আমরা সফলতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ধরতে পারি। কিন্তু এখন, অর্থনীতির উড়নচন্ডী ভাবগতিকে জমিয়ে রাখা আত্মম্ভরিতা দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমাদের বুঝতে হবে উন্নয়নের মই যতোই লম্বা হবে, তার পতন ততোটাই বিভৎস হতে বাধ্য। পুঁজিবাদের এই ক্ষত কোনদিনও শুকাবার নয়, এমনকি বুড়ো এলান গ্রীনস্প্যানও পারবে না এর দাওয়াই দিতে। কারন মানুষের মনস্তত্ব কোনদিনও বদলাবার নয়!!
প্রফেসর প্যাট্রিক মিনফোর্ড: অর্থনীতিবিদ
অর্থনীতির বর্তমান ধ্বংসাবশেষের মাঝে থেকে শোনা যাচ্ছে নীতিমালার বিশাল পরিবর্তন আর পুঁজিপতিদের অতি মুনাফা খর্ব করার দাবী। আমাদের এই প্রেক্ষিতে প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, বেজল এগ্রিমে্ন্টের আওতায় এখনই বিপুল পরিমান নীতমালাপাঁশে অর্থনৈতিক যন্ত্রটি আবদ্ধ! সমস্যাটা আসলে ব্যাঙ্কগুলির নীতিমালা গুলিকে ফাঁকিদেবার নানা পন্থা আবিষ্কার করে ফেলেছিলো। প্রথমেই এই ফাঁকিবাজির দ্বার বন্ধ করতে হবে।
দ্বীতিয়ত: বিনিয়োগ ঘরগুলি যেমন ল্যম্যান ব্রাদার্স, যারা কিভাবে কিভাবে যেন কানুনের উর্ধে ছিলো, তাদের বাঁধতে হবে। অবশ্য এই ব্যাঙ্ক নামীয় পশুগুলি এখন এতোটাই রক্তাক্ত, যে আশা করা যায় ভবিষ্যতে এরা সুবোধ বালকের মতো আচরন করবে। বরঞ্চ এদের উৎসাহ দেয়া উচিত যাতে নিয়মের মধ্যে থেকে তারা আবার উঠে দাঁড়াতে পারে। পুঁজিবাদের অবশ্যই সুনাম আছে মানুষের জীবিকার টেকসই মান উন্নয়ন করার। তবে ব্যাঙ্কগুলি যে জানে চুড়ান্ত বিপদের দিনে ধার নেবার জন্য জনগনের ট্যাক্সের টাকা তাদের জন্য জমানো আছে, সে ধারনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে, জনগনকে বাঁচানোর জন্যই এটা করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের এখন দরকার এমন একটা ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থা যেখানে সমাজের প্রত্যেক স্তরই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল নিতে পারে। এ সঙ্ক্রান্ত নীতিমালায় পরিবর্তন আনার আগে এই বিষয়গুলি ভেবে দেখা জরুরী।
ড. জন ড্যানিয়েলসন: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেটস্ গ্রুপের সদস্য
শোনা যাচ্ছে, বিনিয়োগ আড়তীদের একীভূত হয়ে যাওয়া, রাষ্ট্রীয়করন অথবা দেউলিয়াত্ব নাকি পুরোনো ব্যাঙ্কিক ব্যাবস্থার ভরাডুবি লক্ষন, ভবিষ্যতে এদের নাকি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করা হবে, অনেকটা পঞ্চাশের দশকের পৃথিবীর মতো। এটা করলে আসলে নিজের পায়েই কুড়াল মারা হবে। সেই পৃথিবী দেখতে অনেকটা কিউবা অথবা উত্তর কোরিয়ার মতো হবে।
এটা ঠিক, যে কিছু ব্যাঙ্ক সরকারী নীতিনির্ধারক আর সরকারের সাথে যোগসাজশে অপকর্ম করতে গিয়ে বেশ ভালই ধরা খেয়েছে। তবুও আমাদের উচিত পরিস্থিতি সামাল দেবার সঠিক উপায়টা ধরে রাখা। একসময় আমরা ঠিকই বেরিয়ে আসবো এই গাড্ডা থেকে। শিক্ষা নেবে ব্যাঙ্কগুলি যে সম্পদ কখনোই জটিল করা উচিত না, তাতে কেউই মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না। মুদ্রা-তারল্য বিষয়টা সবসময়ই ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থা আর সে সম্পর্কিত নীতিমালার কেন্দ্রে থাকবে। বর্তমান আইনগুলি পরিমার্জন করেই বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়! ব্যাপারটা বেদনাদায়ক হবে যদি এই সমস্যার প্রতিউত্তরটা কুচিন্তিত, রাজনৈতক উদ্যেশ্যপ্রণোদিত, এবং অতিমাত্রায় কঠোর হয়। ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধির জন্য একটা মুক্ত বিনিয়োগ ব্যাবস্থা বড়ই জরুরী। দয়া করে আমাদের ত্রিশ বা পঞ্চাশের দশকের মতো পরিস্থিতিতে ফেলবেন না।
বার্নার্ড বার্বার: ট্রেডার্স ই্উনিয়ন কনগ্রেসের সাধারন সম্পাদক
এটা মোটেও পুঁজিবাদের শেষ সংকট নয়। বলা যায় পুঁজিবাদের একটা রূপের শেষ দেখলাম আমরা। বাস্তবতাটা হলো, পুঁজিবাদের কোন একক অর্থনৈতিক কাঠামো নেই। ইউরোপের সামাজিক বাজার ব্যাবস্থার সাথে মার্কিন ইঙ্গ-স্যাক্সন ব্যাবস্থার বিপুল ফারাক দৃশ্যমান। সমাজতন্ত্র পতন-পরবর্তী রাশিয়া আর চৈনিক হাঁসজারুর কথা না হয় নাই বললাম। গত কিছুদিন আমরা যা দেখলাম তা আসলে একটা ভ্রান্ত-বিশ্বাসের শেষ ক’টা নিশ্বাস ছিলো। এটা সেই অন্ধ বিশ্বাস স্বল্পমেয়াদী মুনাফার খাতিরে যে কোন প্রকার নিয়ম নীতি ছিঁড়েখুড়ে ফেলতে সে কুন্ঠাবোধ করেনি। ইতোমধ্যেই মার্কিন ফ্রেডি, ফেনি, এআইজি আর ব্রিটিশ নর্দান-রক’র রাষ্ট্রায়াত্বকরনের সাথে সাথে উবে গেছে আরেকটা ভ্রান্ত ধারনা যে রাষ্ট্রের এসব ক্ষেত্রে কোন ভুমিকাই থাকা উচিত নয়।
নতুন একটা শিক্ষা নেয়া উচিত আমাদের: বিনিয়োগকেই আমরা দুনিয়ার সেরা ব্যাবসা হিসেবে দেখছিলাম। যেন অন্য কোন ব্যাবসার অস্তিত্বই নেই। গতানুগতিক উৎপাদন শিল্প, সৃষ্টিশীল ক্ষেত্রগুলির কথা আমরা ভুলতেই বসেছিলাম। এবার বলার সময় এসেছে ‘নিও-লিবারেলিজম’ তোমার আত্মার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। কিন্তু রাজনীতির ওপর এর প্রভাবটা কেমন হবে ভাবতে গেলেই গোলকধাঁধায় পড়ে যাই। ভোটাররাও একই দ্বিধায় ভুগছে। তারা ডানপন্থীদের ভোট দিতে চায় সত্য, কিন্তু একই সাথে বামপন্থীদের বেশ কিছু নীতির বেলায়ও প্রসন্ন। ধনীকে বেশি বেশি কর দিতে বাধ্য করা, এনার্জি কম্পানিগুলিকে নিয়ন্ত্রন করা জাতীয় ব্যাপারগুলিতে তারা বেশ একাট্টা বলেই মনে হচ্ছে।
[মূল: বিবিসি ভিউপয়েন্ট এ কয়েকজনের মতামতের ভাবানুবাদ]