মর্টগেজ মানে হোলো কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে কড়ি ধার করে বাড়ি কেনা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: কাবুলিওয়ালা (এখন তাদের গালভরা নাম ‘মর্টগেজ লেন্ডার’) টাকা ধার দেবে। ঋণীকে ২৫ বছর মেয়াদে সেটা শোধ করতে হবে। আদতে দাম পড়ে যাবে সোয়াগুন। কিন্তু তাতে কি! সবার কাছেতো আর বাপের দেয়া থোক টাকা থাকে না, তাই তরুন চাকুরেকে হাত পাততে হয় এদের কাছে। কাগজপত্তর ফয়সালা হলে উঠে পড়া বাড়িতে।
বাড়ি নামে আপনার, যতোদিন মাসেকাবারে কিস্তি দেবেন কাবুলিওয়ালাকে। কপাল ভালো হলে, বছর পঁচিশেক পর আপনি মুক্ত। কপাল আরো ভালো থাকলে ক’বছর পড়েই বাড়ির দাম বেড়ে যায়। এ বাড়ি বেচে দিয়ে কেনা আর বেচার ব্যাবধান, মানে মুনাফা, থোক কিছু টাকা হাতে আসে, সেটা জমা দিয়ে আরেকটা মর্গেজ । এভাবে চলতে থাকে। প্রতিবারই কিন্তু ঘড়ি আবার ২৫ বছরের জন্য গোনা শুরু করবে!
তবে আজকালকার কাবুলিরা আবার বেজায় চালাক! নানান রকম জটিল হিসেবের চক্করে ফেলে ক’বছর গেলেই দেখেবেন মাসের আয়ের বেশিরভাগটাই নিয়ে গেছে মুখপোড়া কাবুলিটা! কপালের ফেরে একবার যদি আয় ব্যায়ের হিসাবে গড়বড় করতে পারেন তবেই সেরেছে! মাফ নেই, ক’মাস পড়েই আসবে আদালতের সমন, ঘটনা খারাপ হয়ে গেলে বাড়ি ফেরৎ নিয়ে যাবে।
এই আতংক জাগানিয়া ঘটনার ইংরেজি নাম রি-পজেশন।
বাড়ি নিলামে চড়ায় তখন কাবুলিওয়ালা, সে চায় যতো তাড়াতাড়ি এই ফেল্টুস্ আপদ থেকে মু্ক্তি ততোই বাঁচোয়া! এজন্য লোকসান দিয়ে হলেও তারা বাড়িটার হাত থেকে মুক্ত হয়! এখানে ছোট্ট একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো, বাড়ির জন্য প্রাথমিক ভাবে যে দাম শোধ করা হয়েছিলো তার পুরোটা কাবুলিওয়ালা কখনোই ফেরৎ পায় না। মানে হোল কিছু টাকা কাবুলিওয়ালার ঝোলা থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলে। আর আপনি যা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মাসে মাসে, তার প্রায় সবটাই এই মামলা সেই মামলায় উবে যায়!
আপনার হাতে হারিকেন।
কাবুলিওয়ালার দিক থেকে দেখলে, বছরওয়ারী এরকম কয়েকটা ঘটনা অবশ্য তার গন্ডার চামড়ায় লাগে না।
সবই ঠিক ছিলো! আম্রিকায় বাড়ি বাড়ি বুদ্বুদটার আগে পর্যন্ত।
বুদ্বুদ হলো… ঐ যে কোলা ব্যাঙটার পেট ফোলানোর মতো, গরুর সাথে পাল্লা দিতে গিয়েছিলো। রাখতে পারেনি। ফুউউউসসসস্ করে ফেঁসে গেল সেরকমই বাড়ির বুদ্বুদটা।
লক্ষনগুলি এরকম… বাড়ির দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকে, সেটা আর সব কিছুরই বাড়ে। বুদ্বুদটা তৈরি হয় তখনি, যখন দাম বাড়ার হার তেজি ঘোড়ার মতো লাফ দিয়ে দিয়ে এগোয়। পুরো দেশে একই সাথে বাড়ির দাম পাল্লা দিয়ে দিয়ে বাড়তে বাড়তে এতো উচুতে উঠে যায় যে বেচারা ম্যাঙ্গোপিপল একসময় হাঁপিয়ে উঠে হাল ছেড়ে দেয়। কিস্তি দিয়ে আর কুলোতে না পেরে বাড়ি হারানোর সম্ভাবনা আছে দেখতে পেলে বাড়ির মালিক হাত ধুয়ে ফেলে। তখন নিয়ম মতো আসল মালিক কাবুলিওয়ালা এসে বাড়িটা নিয়ে নেয় দখলে। কিন্তু কাবুলিতো বাড়ি চায় না, সে চায় টাকা ফেরৎ, ওদিকে তার হাতে এখন রিপজেশন নেয়া মেলা বাড়ি, তারাতারি হাত বদল করে ফেলতে চায় সে। কিন্তু কে কিনবে! ফলে তীব্র তারল্য সংকটে পড়ে কাবুলি, কাবুলির চাচা সহ সংস্লিষ্ট সকলেই!
কাবুলিওয়ালার গন্ডার চামড়ায়ও তখন হালকা আঁচ লাগতে শুরু করে…
এতোদিন কাবুলিওয়ালা দলিল জমা দিয়ে কয়েকটা বড়ো গোলা থেকে টাকা আনতো। গোলার রইস, সেই দলিল তার বিনিয়োগকারীরকে দিতো গ্যারেন্টি হিসেবে। এভাবেই চলছিলো।
আমেরিকায় এমন দুই টাকার গোলার নাম ‘ফেনি ম্যে’ আর ‘ফ্রেডি ম্যাক’। গত ত্রিশ বছর যাবৎ এই দুই অতিশয় গুরুত্বপূর্ন টাইমবোম টিক টিক করে আসছিলো। বেচারাদের এখন বোধহয় পটল তুলবার সময় হয়েছে। কারন কড়ির গোলা নিজেরাই শুন্য হয়ে গেছে। এই দুই গোলা আবার সরকারী/বেসরকারী হাঁসজারু মালিকানায়। অর্থ্যাৎ, ডুবে যাবার দশা হলে গাঁটের পয়সা দিয়ে এদের বাঁচাতে হবে দেশের জনগনকেই ; সেই একই জনগন, যাদের বাড়ি ফেরৎ নিয়ে গেছে কাবুলিওয়ালা। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা যাকে বলে! আর এটাই হলো বুদবুদের ফেঁসে যাওয়ার আরেকটা দিক!
সোজা বাংলায়, টাকার গোলা ইদানীং শুন্য হয়ে পড়েছে। ছোট কাবুলিরা ধার দেবার জন্য আর টাকা পাচ্ছে না। বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকা সত্বেও দেবার মতো কারো হাতেই আর টাকা নেই। মুদ্রা স্রোতস্বীণি শুকিয়ে ঠাঠা।
বাড়ির দাম পড়ে গেছে হাটুরও নিচে। সবাই তাই যার যার বাড়ি ভাড়ায় দিয়ে দিচ্ছে! আবার বাড়ি বিক্রি করতে চাইলেও কেউ পারছে না। কিনবে কে! যে কিনবে তারও যে মর্গেজ চাই! ওদিকে মর্গেজের কলস শুন্য! এ এক বিষম গিট্টু লেগে গেছে টাকার বাজারে।
২০০১ সালে ‘ডট-কম’ ফুস্ হয়ে যাবার কথা মনে আছে নিশ্চয়? ২০০৩ সালে এসে সেই ধাক্বা সামলাবার জন্য যেসব ব্যাবস্থা নিয়েছিলো কড়ির আড়তীরা, তার মাঝে একটা ছিলো ‘দেদারসে নতুন বাড়ি বানাও’ দাওয়াই। ২০০৫ সালে এক হিসেব মতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নুতন বাড়ি বিক্কিরি হয়েছে প্রায় তের লক্ষ! তখনকার পরিস্থিতি ধামাচাপা সামাল দেয়া গেলেও এখন এই দাওয়াই হিতে বিপরীত গ্যঙ্গ্রিন আকারে এখন পুরো দুনিয়া ধরে টান দিয়েছে।
সাথে যোগ দিয়েছে তেলের দাম বৃদ্ধি, খাবারের দুষ্প্রাপ্যতা…দাম বৃদ্ধি, ফলে সবধরনের মুল্যস্ফীতি!
আগামী কয়েক দশকে দুর্ভিক্ষ আর গন্ডগোলে পৃথিবীর জনসংখ্য পাঁচ বিলিয়নে নেমে এলে আমি আশ্চর্য হবো না।
আর সেটাই কি বিল্ডারবার্গ গ্রুপের অনেকগুলো লক্ষ্যের একটা নয়?
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
রায়হান রশিদ - ২৭ আগস্ট ২০০৮ (৭:১৫ অপরাহ্ণ)
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আটলান্টিকের দুই পাশে হাউজিং মার্কেট, মর্টগেজ, রিপজেশন ইত্যাদি নিয়ে খবর আর আলোচনার ছড়াছড়ি। আপনার লেখা পড়ে কিছু বিষয় পরিস্কার হল। ধন্যবাদ। কিন্তু এর সাথে ভবিষ্যত পৃথিবীর অস্থিরতাজনিত জনসংখ্যা হ্রাসের প্রেডিকশান এবং তার সাথে বিল্ডার্সবার্গ গ্রুপের যোগাযোগটা স্পষ্ট হলনা। একটু ব্যাখ্যা করা যায় কি?
আরিফুর রহমান - ২৮ আগস্ট ২০০৮ (১২:২২ অপরাহ্ণ)
ধৈর্য ধরে এই http://www.zeitgeistmovie.com/ মুভিটা দেখার আমন্ত্রন রইল।
অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে।
ধন্যবাদ।
রায়হান রশিদ - ২৮ আগস্ট ২০০৮ (৬:২৮ অপরাহ্ণ)
দেখলাম প্রথম পর্ব আজ সন্ধ্যায়। মনে হচ্ছে আবার দেখতে হবে কিছু কিছু ব্যাপার বোঝার জন্য। দ্বিতীয় পর্বের অপেক্ষায় রইলাম অক্টোবর পর্যন্ত। একটা জিনিস অবশ্য স্পষ্ট হলনা। আমেরিকায় যদি ইনকাম ট্যাক্স সংক্রান্ত কোন বৈধ আইনই না থেকে থাকে (ছবিটিতে আই আর এস কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী), তাহলে:
ক) প্রতিবছর কিসের উপর ভিত্তি করে সে দেশে ট্যাক্স বাড়ানো বা কমানো হয় আইন সভায়?
খ) কোন্ আইনের বলে আই আর এস এজেন্টরা কর ফাঁকিদানকারীদের প্রসিকিউট করে? বা কোন আইনেই বা তাদের বিচার সংঘটিত হয়?
একটা কথা শুনেছিলাম। ‘৬০ এর দশকে নোয়াম চমস্কির মতো কয়েকজন নাকি সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন কর দানের বিরুদ্ধে। বিষয়টা কারো বিস্তারিত জানা থাকলে লিখে জানাবেন কি? আপাতত চমস্কির এই সাক্ষাৎকারটা পড়া যেতে পারে।
রাজামশাই - ২৮ আগস্ট ২০০৮ (৫:০১ পূর্বাহ্ণ)
ওরে আরিফ আছিস কেমন ?
পড়লাম
আরিফুর রহমান - ২৮ আগস্ট ২০০৮ (৩:৩১ অপরাহ্ণ)
ওহে! ফুল বাগানের মালী… ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ প্রবাদটার মানে জানো? 😉
সৈয়দ তাজরুল হোসেন - ২৮ আগস্ট ২০০৮ (১০:৪২ অপরাহ্ণ)
ক্রমশ ধ্বশঃমান প্রপার্টির বাজার সম্পর্কে ইদানিংকার আলোচিত বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য আরিফকে ধন্যবাদ । তবে কিছু বিশ্লেষন অতি সরল মনে হয়েছে, যেমনঃ
আসলে বিষয়টা মনে হয় আরেকটু জটিল, যদি শুধু মাত্র গোলা শুন্য হয়ে যাওয়াটা-ই সমস্যা হত, তা হলে সেগুলো ভরে দেয়ার জন্য সরকারি টাকশালের দরজা খুলে দেয়া হত বহু আগেই । মর্টগেজ গ্রহনকারীরা তাদের ঋন পরিশোধের যে সামর্থ তার চেয়ে অনেক বেশি ঋন করে যেহেতু এখন আর তা পরিশোধ করতে পারছে না সেখান থেকেই বোধ করি সমস্যার শুরু । (কেন লোকজন সামর্থের অতীত ঋন নিল কিংবা কেন তারা কিস্তি শোধে ব্যার্থ হচ্ছে সে অন্য আলোচনা, এ বিষয়ে বিষদে কেউ লিখতে পারেন)
নিকট ভবিষ্যতে নানান সংঘাত ও অন্যান্য কারনে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিল্ডারবার্গ গ্রুপের কিছু একটা শংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করেছেন । সেটা কিছুটা ধোয়াশাই থেকে গেলো । এ বিষয়ে ম্যালথাসের যে থিওরী সেটিও আজকাল কমই গ্রাহ্য ।