বইটি পড়ে ইস্তক শৈশবে বিচরণ করছি । দক্ষিণের বারান্দা । লেখক, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি, মোহনলাল গঙ্গোপাদ্যায় ।
একজন আত্মীয়াকে দিয়েছিলাম পড়তে, বললেন, শিশুদের জন্যে লেখা মনে হলো । একটু অবাক হলাম । শৈশবের কথা লিখলেই সেটা কি শিশুদের? নাকি আমরা বুড়ো হয়ে শৈশবে ফিরতে ভুলে গেছি!
অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় সকলকার মত, ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা, রাজকাহিনী বা নালক পড়ে, ছোট বয়েসেই । আমার বুড়ো প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ আমাকে মার্জনা করুন, কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা কিশোর-সাহিত্যের শতদল সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছে বলে মনে হয় | কিশোরদের মন ধরতে তিনি বেশি সক্ষম, অন্য তত্কালীন লেখকের চেয়ে । তারপর আরো লেখক এসে তুলি ধরেছেন, শব্দ দিয়ে ছবি এঁকেছেন, তবে গোড়ার কাজটা অনেকটাই তাঁর। ভাষার স্বচ্ছতা, সাম্পান-ঋজুতা, মিষ্টি স্বকীয়তা, বৈঠকী ইনফরমাল চাল, শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা, এই সব নিয়ে কৈশোরক স্রোতস্বিনী থেকে সর্বহৃদয়-গ্রাহ্য সমুদ্রে পৌঁছেছেন অবন ঠাকুর ।
তাঁর সেই প্রিয় পাঁচ নম্বর বাড়ি, (জোড়াসাঁকোর পাশের বাড়ি) তাঁর জীবন নিয়ে কৌতুহল ছিল খুব । বইটি anecdotes এ ভরা, কিন্তু তার ভেতর থেকে সম্পূর্ণ মানুষটাকে চোখের সামনে পেতে একটুও অসুবিধে হয় না ।
স্মৃতিমেদুর বাড়িটি তাঁদের, যেদিন বিক্রি করে দিয়ে চলে যেতে হলো, সেইদিন সেই ঘটনায় অনুরণিত হয়ে নাতি মোহনলাল তার গভীর ও অমূল্য স্মৃতির খনি থেকে তাঁর শৈশব কৈশোর ও প্রথম তারুণ্য বিজড়িত সেই বাড়িটি, এবং বাড়িতে যাঁরা ছিলেন সেই তিন ভাই – অবনীন্দ্র, সমরেন্দ্র ও গগনেন্দ্রর স্মৃতিময় খনিজ উদ্ধার করেছেন । রীতিমত ঝরঝরে স্ফটিক-গদ্যে ।
শৈশবে কি কি করেছিলেন, তাই শুধু দেখা হয় না, শৈশব বিকশিত হতে হলে কেমন মানুষের দরকার আশেপাশে, তারও একটা ছোটখাটো দৃষ্টান্ত বোধ হয় পাওয়া যায়।
অবনীন্দ্রনাথ যে অবনীন্দ্রনাথ, এ কথা ভুলে গিয়েই পাঠকের বেশি আনন্দ; নাতির সঙ্গে ‘স্বপ্ন-মোড়কে’ স্বপ্ন লিখে হাতেলেখা একটি পত্রিকা চালু করতে উত্সাহ দিচ্ছেন, নিজে লিখছেন, পাথর কোড়াচ্ছেন, যাত্রা পালা লিখছেন, যাত্রায় সবাইকে ঢুকিয়ে নিয়ে উত্সাহ দিচ্ছেন, বাগানে জাপানি মালিকে দিয়ে বনসাই করাচ্ছেন, ভাঙ্গা পাথরবাটি দিয়ে চমত্কার ভাস্কর্য বানিয়ে ফেলছেন, আরব্য রজনীর গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে ছবি আঁকছেন, বাগানে বিদেশী পাখি আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করছেন, তাদের ছেড়ে দিচ্ছেন — যেন তারা পাঁচ নম্বরের বাগান আলো করে থাকে, লবন আন্দোলনের সময় নারকোল গাছের পাতা পুড়িয়ে খাস দেশী লবন তৈরী করে ফেলছেন অতি সহজে ।
এমন কোনো সৃষ্টিশীল কাজ নেই, যা তিনি করতে নারাজ। বরং একবার খেয়াল চাপলে হলো, দুর্বার বেগে সৃষ্টির ধারা ছুটবে ।
আর ছবি তো চলছেই – শুধু থেমেছিল ৮ বছর, যখন তাঁর খেয়াল চাপে মায়থলোজি থেকে যাত্রা পালা লেখার ।
শিল্প আগে না শিল্পী আগে? তুলি কলম না থাকলে, শিল্পের উপাদান না থাকলে কি শিল্প থেমে থাকত? অবনীন্দ্রনাথ তাঁর নাতিকে সম্পূর্ণ আঙ্গুলে-ঘষা এক খানা দুর্দান্ত ছবি এঁকে পরে চারকোলে আঁকা একটি ছবির সঙ্গে সেটি তুলনা করে দেখিয়ে দেন, শিল্পী তাঁর শিল্পের উপাদান, উপায় বের করে নেবেই!
মানুষের মুখ নয়, মুখোশ চিত্রিত করছেন দারুণ দ্রুত। আসে পাশের চাকরবাকরদের সঙ্গেও তাঁর যে কী মধুর সম্পর্ক (রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও দেখেছি এমনটা ছিল), কত যে রঙ্গ রস আর কৌতুক, বলে শেষ করা যায় না ।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘কত্তাবাবা’, অর্থাত রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময় নাটকের দল নিয়ে আগমন ও বিশাল সমারোহে নাটক করা, সেই সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে সবার জীবন । অর্থাৎ জীবনটা একটা পুরো দস্তুর কর্মঠ, কৌতুহলী, নির্ভার আনন্দ-যজ্ঞ ।
অবনীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে দারুন প্র্যাকটিকাল, আবার অফুরন্ত মানবিক । তাঁর অক্ষয় তূণ – রঙের বাক্সের রং শেষই হত না যেন | রং-এর দাম যে বোঝে না, তার ছবি আঁকার দরকার নেই, এই বলে এক উত্সাহী শিক্ষানবিশ-কে তাড়িয়ে দেন একবার — ছাত্রটি রঙের ব্যাপারে খুবই অমিতব্যয়ী ছিল ।
দেখনাই, জনসভা করে জয়ন্তী পালন, শোকসভা করে শোকপ্রকাশ, পছন্দ করতেন না মোটেই এই তিন ভাই । সব আয়োজনের শৈল্পিক সুক্ষ্মতা বড় চোখে পড়ে । নম্রতাও শিল্প বটে । রবীন্দ্রনাথ-এর কোনো বিশেষ নামকরা সফরের পর, ছোট ছেলেমেয়েদের দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন পদ্মকোরক। নিজেরা ছিলেন পেছনে ।
জানা হলো যে ওই বাড়িতে পল্লী কবি জসীমুদ্দিন অনেক দিন ছিলেন । তাঁকে নিয়ে অনেক মজার মজার ‘অকাব্যিক’ anecdotes পাওয়া যায় ।
এই সূত্রে এটাও জানা হলো যে রবীন্দ্রনাথের ৬৫ তম জন্মদিনে তাঁকে বই দিয়ে ওজন করা হয়েছিল, এবং সেই বই বিতরণ করা হয়েছিল । মোগল আমলে নাকি নবাবদের বা নবাবপুত্রদের সোনা দিয়ে ওজন করা হত, এবং সেই সোনা বিতরণ করা হত জনসাধারন্যে। রবি ঠাকুরের ক্ষেত্রে লক্ষ্মী নয়, সরস্বতীকে ছড়িয়ে দেয়া হলো!
অবনীন্দ্রনাথের কৌতুহল ও এক্সপেরিমেন্টের নেশা রং, তুলি, বাগান, লেখালেখি, যাত্রা পালা, মঞ্চ-সজ্জা, রন্ধন-বিদ্যা, ভাস্কর্য, পড়াশুনো সব দিকেই সর্বগ্রাসী। আবার ভারতের অসহযোগ আন্দোলনে বিদেশী দ্রব্য পরিহার করার সময় বিদেশী রঙ-ও অনেক দিন ব্যবহার করেননি| সেই সময় অনবদ্য উপায়ে বাড়িতে বসে সাধারণ জিনিস দিয়ে সম্পূর্ণ নিজের মত করে দেশী রঙ বানিয়েছেন ।
রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে সকলেই এক এক জন জায়ান্ট, রবীন্দ্রনাথের বটবৃক্ষের আসে পাশে তাঁরা অনেকেই ছায়া-চাপা পড়ে গেছেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ অসম্ভব ঘরকুনো এবং প্রচার-বিমুখ মানসিকতার হওয়া সত্ত্বেও বড় বেশি দৈত্যকায় — তাঁকে না দেখে উপায় নেই, বিস্মিত ও আপ্লুত না হয়ে উপায় নেই ।
অনেক আশ্রিত চাকর ছিল, বংশ পরম্পরায় মেথর ছিল — এই বাড়ির কাজের লোক বা আশ্রিতরাই ছিল সংখ্যগুরু | বহু দিনের জমিদারী সূত্রে পাওয়া পয়সায়, এই তিন ভাই ব্যক্তিগত ভাবে মিতব্যয়ী চালে কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে দরাজ দাক্ষিন্যে এই ‘খেয়ালী আর্টিস্ট’-এর জীবন কাটিয়েছেন — দারুণ লোভ হয় দেখে ।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সমাজের ওপর, পৃথিবীর ওপর যে অর্থনৈতিক ধাক্কা পড়ল, তার ফলেই দেনার বিষয়গুলি, দারিদ্র্যের বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠতে থাকে । এবং শেষে বেহাত হয়ে যায় ৫ নম্বর বাড়ি। সেই সঙ্গেই শেষ হয় এই গল্প ।
আর বইটি পড়ার পর পাঠকের মনে হয়, শৈশবের হারিয়ে যাওয়া কোনো একটি সময় খুঁজে পাওয়া গেল ।
কেন হারিয়ে গেল সেই বাড়ি? যার সত্ত্বা বেঁচে থাকলে এই তিন ভাই ও তাঁদের ঘিরে গড়ে ওঠা আশ্চর্য জাদুপুরী সংরক্ষণ করা যেত কিছুটা? কেন অবনীন্দ্রনাথে হরেদরে বেচে দিলেন তাঁর শত শত ছবি, পুরনো জিনিস বিক্রির দোকানে? চোখ ফেটে জল আসে ভাবলে। উদাসী হাওয়ার পথে পথে সমস্ত আনন্দ-যজ্ঞ-ভগ্নাবশেষ ভেসে যায়। কেবল থাকে আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে, এক আলোড়ন-আবেগ-আনন্দ উস্কে দেয়া স্মৃতিকথা ।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
ASM Firoz - ৯ নভেম্বর ২০১৬ (৮:০০ অপরাহ্ণ)
কোন কোন পরিস্থিতিতে মানুষ ধান ভানতে শিবের গীত গায়? যে পরিস্থিতি এবং যত কারণেই মানুষ শিবের গীত গাক না কেন আমার ক্ষেত্রে এলেমের ঘাটতির কারণে আনন্দময়ীর সাথে পাল্লা দিয়ে অবন ঠাকুর সম্পর্কে একাডেমীক আলোচনায় মেতে ওঠা ততটা সহজ হবেনা, এই বিবেচনায়, একই সঙ্গে অবন ঠাকুর প্রসঙ্গের মধ্য দিয়ে কৌশলে ঘুরপথে ভিন্ন প্রসঙ্গে পৌছনোর একটা নির্লজ্জ বাসনা-ই আজকে আমার শিবের গীত গাইবার বড় কারণ হয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্লগ মোডারেটর সাহেবদের প্রহরার চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখানে পৌছনো কতটা সহজ হবে জানিনা, তবে মওলা মওলা বলে চেষ্টাতে নামতে দোষ কী? আনন্দময়ী আপনি লিখেছেন- কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা কিশোর-সাহিত্যর শতদল সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছে বলে মনে হয়। কিশোরদের মন ধরতে তিনি বেশি সক্ষম, অন্য তৎকালীন লেখকের চেয়ে। তারপর আরও লেখক এসে তুলি ধরেছেন, শব্দ দিয়ে ছবি এঁকেছেন, কিন্তু গোড়ার কাজটা অনেকটাই তাঁর।—-। আমরাও মানি অবনীন্দ্রনাথের অবদানের কথা বিশেষ করে কিশোর সাহিত্যের শুরুর দিককার সময়ে তাঁর অবদান। তবে আপনি আপনার প্রেমিক রবীন্দ্রনাথের কাছে মার্জনা চাইবার বিনয় করলেও আমরা কখনও মার্জনা চাইব না এবং মার্জনা চেয়ে অন্য কোথাও যাবনা কারণ ওটাইতো মূল ভাণ্ড। অবনীন্দ্রনাথও নিজেকে সমৃদ্ধ করতে গ্রহণ করেছিলেন ওখান থেকে, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে। মাত্র বানান শিখাবার ছলে সহজ পাঠের অসাধারণ সব গল্পগুলো, কবিতাগুলো অপ্রচলিত কিছু ছড়া যেমন- মাঠের শেষে গ্রাম,/সাতপুরিয়া নাম।/চাষের তেমন সুবিধা নেই কৃপণ মাটির গুনে/ পঁয়ত্রিশ ঘর তাঁতির বসত, ব্যবসা জাজিম বুনে। এবং আঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে/পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে/জীর্ণ ফাটল-ধরা এক কোণে তারি/অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী।/আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর/আছে এক ল্যাজ-কাটা ভক্ত কুকুর। জাতীয় অজস্র আছে। এছাড়া শিশু, শিশু ভোলানাথ, ডাকঘর এ ধরণের হাল্কা, গভীর কত কিছুই না তিনি দিলেন আমাদের শিশু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে! ডাকঘরের কথা আসতেই মনে পড়ে গেল মেক্সিকোর তলুকা শহরের এক আশিতীপর বৃদ্ধ চিত্র শিল্পীর কথা। এক বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তিনিও আমার মত আমন্ত্রিত। আমন্ত্রণ বাড়ির লোকজনদের কাছে যখন জানলেন আমি বাংলাভাষী বাঙ্গালী তখন তাঁর আনন্দ দেখে কে! তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে স্প্যানিশ ভাষাতে কত কথাই যে বলে গেলেন কে বলবে! তাঁর সব কথা শেষ হবার পর বাড়ির লোকজন আমাকে যা বলল তাতে বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক কিশোর বয়সে স্প্যানিশ অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটক পড়েছিলেন তাঁর স্কুল পাঠ্যতে। অমলের করুণ কাহিনী তাঁকে এতটাই আলোড়িত, এতটাই আবেগ মথিত করেছিল যে তিনি কষ্টের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন ছিলেন অনেক দিন। কেঁদেছিলেনও বটে। এখনও তাঁর কাছে ডাকঘর নাটকটি অনেক বড় লেখকের বড় রচনার চাইতেও বড় মনে হয়। রবীন্দ্রনাথকেও তাঁর অনেক বড় মনে হয়েছিল এবং এখনও হয়। আর আমার কদরটা হয়েছিল বাংলা বা বাঙ্গালী অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ভাষার মানুষ ছিলাম বলে। ভদ্রলোক পরে তাঁর আঁকা একটা ছবি দিয়েছিলেন আমাকে। যাহোক, অবন ঠাকুরের সময়টা বাংলা সাহিত্যে শিশু সাহিত্য বিকশিত হবার একেবারে শুরুর সময়। কিন্তু ওই সময়েই অর্থাৎ তাঁর সময়ের সামান্য কিছু আগে এবং পরে তিন চার জন মানুষের হাত ধরে শিশু সাহিত্য যে উচ্চতাই পৌঁছেছিল পরে কিন্তু আর তেমন হয় নাই। আমার মনে হয় আঁকা আঁকির সঙ্গে এবং সঙ্গীতের সঙ্গে কোথায় যেন উৎকৃষ্ট শিশু সাহিত্যের একটা যোগ আছে। তা নইলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ শিশু সাহিত্য লিখিয়েরা সবাই যে গভীরভাবে সঙ্গীত এবং চিত্রশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তা কি কেবলই কাকতালীয়? আর আবন ঠাকুর! অবন ঠাকুরতো ছবি আঁকতেন না ছবি লিখতেন তাই তার ছবি হয়েছে যেমন বাঙময় তার লেখা হয়েছে তেমনই চিত্রময়। আনন্দময়ীর প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ আর আমার গুরু রবীন্দ্রনাথ। কত সহজে এঁকে গুরু বলা যায় তাইনা? কত কাল ধরে কত লোক এঁকে গুরু বলে আসছে কে তার হিসাব রাখে! একজন তো এক বৈঠকেই বাইশ জনের গুরু বানিয়ে দিলেন তাঁকে। আবার নম্বরও ফেললেন। ‘শিষ্যের’ নম্বর বা ক্রম। নিজেকে রাখলেন বাইশ নম্বরে আর বিশিদাকে রাখলেন শীর্ষে অর্থাৎ এক নম্বরে। তাঁর জবানীতেই বলি- বিশিদা থেকে আমি পর্যন্ত আমরা বাইশজন ছিলুম গুরুদেবের শিষ্য তার মধ্যে বিশিদা ছিলেন এক নম্বর আর আমি বাইশ নম্বর। নম্বর ফেলবার বিনয়ও কী অসাধারণ! খোলামেলা আর বৈঠকি পণ্ডিত ছিলেন তো, তাই লিখতেন কম বলতেন বেশি, আর যা বলতেন বৈঠকে বসেই বলতেন। তাঁর কথা দিয়ে নাকি কমলা লেবুর গন্ধ বেরত। অন্য কারো নয়, তাঁর ব্যাপারে এটা সয়ং রবীন্দ্রনাথেরই মন্তব্য। এক হিসাবে তিনি আমার সতীর্থ অথবা বলা যায় গুরুভাই। কিন্তু না তাঁকেও আমি গুরু মানি। আমার দ্বিতীয় গুরু তিনি। গুরু হবার সব গুন আমি পেয়েছি তাঁর মধ্যে। আচ্ছা বলুনতো সাধারণ মানুষ কবি হয় কখন? বা কবিতা লেখে কখন? সাধারণত প্রেমে পড়লে, তাইতো? এছাড়া প্রকৃতি কিম্বা মনোমুগ্ধকর কোন কিছুর দর্শনও মানুষকে কবি বানিয়ে ফেলে। আমার দ্বিতীয় গুরু কিন্তু এপথে কবি হন না। হন উলটো পথে। প্রকৃতির শ্যামলিমায় মুগ্ধ হন না তিনি। তখন কবিতা আসে না তাঁর। মুগ্ধ হন প্রকৃতির রুক্ষতায়। আর তখনই আসে তাঁর কবিতা। বড় বড় কবিতা। এক সময় ভারতবর্ষের পূর্ব হতে পশ্চিমে যেতে হয়েছিল তাঁকে ট্রেনে চড়ে। এই ট্রেনেই তাঁর ক্যাবভাব জেগে ওঠে এবং ট্রেনের মধ্যেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তবে ট্রেন পূর্ব দিকে বঙ্গ অঞ্চলে অর্থাৎ সবুজ শ্যামল প্রকৃতির মধ্যে থাকতে থাকতে কিন্তু তাঁর মনে কাব্য ভাব জাগেনি। জাগল কখন? ট্রেন যখন বঙ্গদেশ ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে পশ্চিমের রুক্ষ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে, তখন। লিখে ফেললেন তিনি ঢাউস এক কবিতা! কবিতা লিখে আবার মন্তব্যও লিখলেন- আহা কবিতার কি ছিরি! পশ্চিমের মাঠের চেয়েও নীরস কর্কশ। গুরুদেব যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এ-পদ্য ছাপানো হয়নি। ছাপলে নির্ঘাত শাপ। আর গুরু শাপ ব্রহ্ম শাপ! মানুষে মানুষের বন্ধুত্ব তো কত কারণেই নষ্ট হতে পারে, এই যেমন বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দেয়া, বন্ধুর সঙ্গে স্বার্থপরের মত আচরণ করা এ ধরণের আরও অনেক ঘটনাই বন্ধুত্ব নষ্ট হবার কারণ হতে পারে। কিন্তু আমার এই গুরুর ভাগ্যটি এতই খারাপ ছিল যে কোন কারণ না ঘটিয়েও কোন দোষ না করেও কেবলমাত্র তোপবাজ (লন টেনিস খেলয়ার) হওয়া এবং তোপবাজি করার কারণেই এক পরম বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্ব খোয়াতে হয়েছিল তাঁকে। ঘটনাটি ঘটেছিল গান্ধারীদের দেশে। মানে গান্ধারীর বাপের বাড়ীর দেশে। কর্মব্যপদেশে আমার গুরু সেখানে থাকতেন। সেখানে এক চাষার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল তাঁর। গভীর বন্ধুত্ব। কৃপণ মাটির গুনে ওদেশে ফসল তেমন একটা ফলেনা। আর ফললেও তার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয় চাষাদের। এরই মধ্যে পাহাড়ের উপত্যকাই চাষ করে, সেচ দিয়ে সবুজ ফলিয়েছেন গুরুর চাষা বন্ধুটি। তিনিও যান সেখানে প্রায়-ই দেখতে। দুজনের মধ্যে অনেক কথা, অনেক গল্প হয়। চাষ আবাদের গল্প, পরিবারের গল্প আরও যত রকমের গল্প দুই বন্ধুর মধ্যে হতে পারে তার সবই। চাষাটির বাড়ী থেকে আসা খাবারও দুই বন্ধু ভাগ করে খান।
চাষার বন্ধু শিক্ষকতা করেন, তাহলে মক্তবের শিক্ষক নিশ্চয়। এই নিয়ে চাষাটির কী যে গর্ব! বন্ধু মক্তবের শিক্ষক এটা ভাবতেই গর্বে বুক ভরে যায় তাঁর। গ্রামের সবাইকেই চাষা শোনান তাঁর বন্ধুর কথা। বন্ধুর এলেমের কথা। এমন ধারা বন্ধুত্ব- এর আবহেও ছন্দপতন হল একদিন। চাষা বদলে গেলেন কেমন যেন! বন্ধুকে দেখলেও মিশতে চান না। কথা বলতে চান না। কেমন যেন ভয় পান, আর পালিয়ে যান। আবার অদ্ভুত আচরণের কারণও বলতে চান না। অনেক সাধা-সাধির পর মুখ খুললেন চাষা। জানা গেল ‘মইনু-উস সুলতানে’ আর ‘তোপবাজি’র কাহিনী। শহরে গিয়েছিলেন চাষা লাকড়ি বেচতে। সন্ধ্যায় ফেরার সময় তোপবাজির এলাকা দিয়েই ফিরছিলেন তিনি গ্রামে। দেখেন চোখ ধাঁধানো আলোয় তোপবাজির মাঠে তাঁর বন্ধুটি তোপবাজিতে ব্যাস্ত। আর বন্ধুর এই তোপবাজি যার তার সঙ্গে নয়, সয়ং মইনু-উস সুলতানের সঙ্গে। এরপরও কী তোপবাজির এলাকায় থাকা যায়? জোরে জোরে পা চালিয়ে এলাকা ত্যাগ করলেন চাষা। না আর ওসব বন্ধুত্ব টন্ধুত্ব নয়। কারণ বন্ধু ছলনা করেছেন তার সঙ্গে। মইনু-উস সুলতানের সঙ্গে কী যে সে কিসিমের লোক তোপবাজি করতে পারে? চেনা হয়ে গেছে বন্ধুকে তার। অতবড় লোকের সঙ্গে কী বন্ধুত্ব করা যায়? বন্ধুত্ব করলে বিপদে পড়তে হতে পারে। অতএব আর বন্ধুত্ব নয় এটাই তাঁর শেষ সিদ্ধান্ত। আর আমার গুরু? না কোন দোষ না করেও বিদেশ বিভুয়ে আমার গুরু হলেন বন্ধুহীন। আগেই বলেছি বৈঠকি গল্পে গুরু ছিলেন তুলনারহিত। আর একই সঙ্গে তাঁর ভাণ্ডারও ছিল আফুরান মজার মজার গল্পে ঠাসা। যা আপনারাও ভালই জানেন। সজনিকান্ত দাশ, শনিবারের চিঠির সম্পাদকীয় স্তম্ভে ‘বিরুদ্ধ’ সমালোচনা লিখতে লিখতে রবীন্দ্রনাথকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন। গুরু রবীন্দ্রনাথেরই যখন বিপর্যস্ত অবস্থা তখন তাঁর শিষ্যদের মান কদর যে সজনি দাশের কাছে কতটা ছিল তা বলাই বাহুল্য! এই সজনি দাশ, আমার দ্বিতীয় গুরু এবং আরও অনেকের একটি দল সম্ভবত কোন সম্মেলনে যোগ দিতে কলকাতার বাইরে কোন এক শহরে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের সবাইকে একটি হোটেলে থাকতে হয়েছিল। এরমধ্যে একটি ছুটির দিনে দলের সকলেই ছিলেন হোটেলে এবং স্বাভাবিকভাবেই গুরুর ঘরে বৈঠকি আড্ডাতে। সেদিনের আড্ডার বিষয় ছিল ‘মদ’। দেশী চোলাই মদ এবং তাড়ি থেকে শুরু করে তাবৎ বিদেশী মদ যেমন- হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, শ্যাম্পেন, তাকিলা, ভদকা, র্্যাম, জিন এমনি আজস্র মদের উৎপত্তি স্থল, কোন দেশ বা এলাকার মদারুরা কোন মদ বেশি পছন্দ করেন এবং কেন করেন, মদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মদের কদর কেন বাড়ে, মদের কোন গুন মদারুদেরকে খোলামেলা করে এমনি মদ সম্পর্কিত হাজারো প্রশ্নের উৎপত্তি এবং নিষ্পত্তি করছিলেন গুরু বৈঠকে বসে সেদিন। এদিকে সজনি বাবু বাইরে কোথাও যাবেন আর সঙ্গে নেবেন তাঁর পেয়ারের কোন মানুষকে। কিন্তু গুরু হোটেলে বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যে সহজে কাউকে তাঁদের রুমে পাওয়া যাবেনা এই সত্যটি তাঁর জানা ছিলনা। রুমে রুমে খুঁজে কাউকে না পেয়ে সজনি বাবু ক্যাজুয়ালী গুরুর রুমে উঁকি দিলেন আর তখনি দেখলেন মদ নিয়ে জমে ওঠা আড্ডাতে মসগুল সবাই। নাক উঁচু সজনিকান্ত কৌতূহল নিয়ে বসলেন একটু সময়ের জন্য। কিন্তু মদ নিয়ে আড্ডার ‘মদ’ গিলতে গিলতে তাঁর ‘একটু সময়’ বেহুঁশ সময় হয়ে কখন যে গড়িয়ে দুঘণ্টা পার করে দিল বুঝতেই পারলেন না তিনি। সেদিনের মত আর বাইরে বেরোনো হোলনা তাঁর। তবে কতটা এলেমের যে মালিক আমার গুরু তা সেদিন হারে হারে বুঝেছিলেন তিনি। এই গুরুর আড্ডা থেকেই পাওয়া ভাণ্ডারের গল্প। ভাণ্ডারে ছিল শান্তিনিকেতনের একজন আশ্রম বালক। মহারাষ্ট্র থেকে রবীন্দ্রনাথের জীব্বদশাতেই এসেছিল সে শান্তিনিকেতনে তপোবনীক শিক্ষা লাভের জন্য। আসবার সময় তার দিদিমা তাকে একটা আধুলি দিয়েছিলেন ফকির দরবেশকে দান করতে। ছত্রপতি গতায়ু হওয়ার পর রঘুজি ভোশলে আর ভাস্কর পণ্ডিতেরা যে দুর্নাম কামিয়েছিল মারাঠিদের জন্য, সে দুর্নাম ততদিনে ঘুচে গেছে বোধহয় তাই ভাণ্ডারেরা বিদ্যা-শিক্ষা, দান-ধ্যান এসব ভাল কাজে অংশ নিতে শুরু করেছে পুরোদস্তুর। মহারাষ্ট্র হতে বঙ্গদেশ পর্যন্ত আসা অবধি ভাণ্ডারে ভালো কোন ফকির বা দরবেশের দেখা পায়নি তাই দিদিমার দেয়া আধুলিটি তার সঙ্গেই থেকে গেছে। একদিন সে দেখে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জের মধ্য দিয়ে আলখাল্লা পরা ফকির দরবেশের মত দেখতে শ্মশ্রু মণ্ডিত একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন। ওমনি ভাণ্ডারের মনে হল সে দরবেশের দেখা পেয়ে গেছে এখন দিদিমার দেয়া আধুলিটা তাঁকে দিতে হবে। আধুলিটি নিয়ে দৌড়ে পৌঁছল সে দরবেশের কাছে। এরপর আধুলিটি যখন সে দরবেশের হাতে দিতে গেল, তখন হতচকিত দরবেশ সেটি গ্রহণ না করে একটু সরে গেলেন। ভাণ্ডারের ধারণা হল দরবেশ আধুলিটির নির্ভেজালতার বিষয়ে সন্ধিহান আর সেই কারণেই তিনি সেটি গ্রহণ করছেন না। ভাণ্ডারে দরবেশকে আশ্বস্ত করতে চাইল আধুলিটির খাঁটিত্ত্বর ব্যাপারে। বলল- মাত ডরনা, নকলি নাহি ইয়ে আসলি আঠান্নী হাই। দিদিমা মুঝে ইয়ে দিয়াথা কই ফাকির নাতো কই দরবেশকো দেনেকে লিয়ে। আজতক মুঝে কৈ দরবেশ নেহী মিলা, আব আপকো যাব মিলা তাব ইয়ে আপ লিজিয়ে, সাচ সাচ ইয়ে আসলি আঠান্নী হায়। দরবেশ কি বুঝলেন তা তিনিই জানেন তবে তিনি ভাণ্ডারের দান গ্রহন করলেন। এর কিছুদিন পর মারাঠি রক্তের উত্তরাধিকার ভাণ্ডারে ডানপিটেগিরি, দুরন্তপনা এবং অন্যান্য আশ্রম বালকদের সঙ্গে মারামারি এধরণের বহুবিধ কাজে তার পারঙ্গমতা প্রদর্শন করতে শুরু করল। কোন শাস্তিই তাকে এসব থেকে বিরত করাতে পারেনা। আশ্রম আধিকারিকগণ অস্থির হয়ে উঠলেন ভাণ্ডারের দুরন্তপনাই। শেষে উপায়ন্ত না দেখে গুরুদেবের কাছেই নালিশ ঠুকতে বাধ্য হলেন তাঁরা। গুরুদেব এলেন বালকাশ্রমে। সবাইকে নিয়ে বসলেন, সবকিছু শুনলেন এরপর ভাণ্ডারেকে বললেন- ভাণ্ডারে তুইতো এমন ছিলিনা! যখন প্রথম এসেছিলি তখনতো অনেক দান-ধ্যান করতি সবাইকে, আমাকেও তো একটা আস্ত আধুলি দান করেছিলি, তাহলে এখন এমন কেন হয়েছিস? কেন এত দুরন্তপনা করিস, কেন মারধোর করিস এখন সবাইকে? এরপর ভাণ্ডারে সত্যিই বদলে গিয়েছল। আর দুরন্তপনা মারামারি এসব কিছুই করত না। আরও পরে আশ্রমের অনেককিছুই রপ্ত করে ফেলেছিল সে। প্রায়ই গলা ছেড়ে অনেকটা শুদ্ধ উচ্চারণেই গায়তো-এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার/ আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার। আনন্দময়ীকে খুব ছোট দেখেছি ওর শিশু বয়সে। সবদিক থেকে বড় হয়েছে এখন। এটা দেখে গর্ব হয়। বড় তো হবেই, যে রক্তের উত্তরাধিকার! ওর বাবা অর্থাৎ সুব্রত স্যারের মত প্রকৃত ভদ্রলোক আমি জীবনে খুব বেশি একটা দেখিনি। বর্ষামঙ্গলে সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে শুনতাম আর সেদিন আনন্দময়ীর কণ্ঠে শুনলাম- কে দিল আবার আঘাত। সুচিত্রা মিত্রের মত বড় শিল্পীর সঙ্গে তুলনা আমি করব না, তবে ওর গাওয়া অন্তত ওই গানে আমি প্রচুরের সন্ধান পেয়েছি। ওই গানে ওকে ব্যতিক্রমী এক মহৎ শিল্পী মনে হয়েছে। হৃদয়ে ছিলে জেগে দেখি আজ শরত মেঘে গানটি নীলিমা সেনের কণ্ঠে সবচেয়ে করুণা বিগলিত হয় যে দুটি চরনে- কী যে গান গাহিতে চাই/বাণী মোর খুঁজে না পাই।- ওর কণ্ঠে শোনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু রেকর্ড পায়নি। ভবিষ্যতে পেলে শুনবো।