বইটি পড়ে ইস্তক শৈশবে বিচরণ করছি । দক্ষিণের বারান্দা । লেখক, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি, মোহনলাল গঙ্গোপাদ্যায় ।
একজন আত্মীয়াকে দিয়েছিলাম পড়তে, বললেন, শিশুদের জন্যে লেখা মনে হলো । একটু অবাক হলাম । শৈশবের কথা লিখলেই সেটা কি শিশুদের? নাকি আমরা বুড়ো হয়ে শৈশবে ফিরতে ভুলে গেছি!
অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় সকলকার মত, ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা, রাজকাহিনী বা নালক পড়ে, ছোট বয়েসেই । আমার বুড়ো প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ আমাকে মার্জনা করুন, কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা কিশোর-সাহিত্যের শতদল সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছে বলে মনে হয় | কিশোরদের মন ধরতে তিনি বেশি সক্ষম, অন্য তত্কালীন লেখকের চেয়ে । তারপর আরো লেখক এসে তুলি ধরেছেন, শব্দ দিয়ে ছবি এঁকেছেন, তবে গোড়ার কাজটা অনেকটাই তাঁর। ভাষার স্বচ্ছতা, সাম্পান-ঋজুতা, মিষ্টি স্বকীয়তা, বৈঠকী ইনফরমাল চাল, শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা, এই সব নিয়ে কৈশোরক স্রোতস্বিনী থেকে সর্বহৃদয়-গ্রাহ্য সমুদ্রে পৌঁছেছেন অবন ঠাকুর ।
তাঁর সেই প্রিয় পাঁচ নম্বর বাড়ি, (জোড়াসাঁকোর পাশের বাড়ি) তাঁর জীবন নিয়ে কৌতুহল ছিল খুব । বইটি anecdotes এ ভরা, কিন্তু তার ভেতর থেকে সম্পূর্ণ মানুষটাকে চোখের সামনে পেতে একটুও অসুবিধে হয় না ।
স্মৃতিমেদুর বাড়িটি তাঁদের, যেদিন বিক্রি করে দিয়ে চলে যেতে হলো, সেইদিন সেই ঘটনায় অনুরণিত হয়ে নাতি মোহনলাল তার গভীর ও অমূল্য স্মৃতির খনি থেকে তাঁর শৈশব কৈশোর ও প্রথম তারুণ্য বিজড়িত সেই বাড়িটি, এবং বাড়িতে যাঁরা ছিলেন সেই তিন ভাই – অবনীন্দ্র, সমরেন্দ্র ও গগনেন্দ্রর স্মৃতিময় খনিজ উদ্ধার করেছেন । রীতিমত ঝরঝরে স্ফটিক-গদ্যে ।
শৈশবে কি কি করেছিলেন, তাই শুধু দেখা হয় না, শৈশব বিকশিত হতে হলে কেমন মানুষের দরকার আশেপাশে, তারও একটা ছোটখাটো দৃষ্টান্ত বোধ হয় পাওয়া যায়।
অবনীন্দ্রনাথ যে অবনীন্দ্রনাথ, এ কথা ভুলে গিয়েই পাঠকের বেশি আনন্দ; নাতির সঙ্গে ‘স্বপ্ন-মোড়কে’ স্বপ্ন লিখে হাতেলেখা একটি পত্রিকা চালু করতে উত্সাহ দিচ্ছেন, নিজে লিখছেন, পাথর কোড়াচ্ছেন, যাত্রা পালা লিখছেন, যাত্রায় সবাইকে ঢুকিয়ে নিয়ে উত্সাহ দিচ্ছেন, বাগানে জাপানি মালিকে দিয়ে বনসাই করাচ্ছেন, ভাঙ্গা পাথরবাটি দিয়ে চমত্কার ভাস্কর্য বানিয়ে ফেলছেন, আরব্য রজনীর গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে ছবি আঁকছেন, বাগানে বিদেশী পাখি আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করছেন, তাদের ছেড়ে দিচ্ছেন — যেন তারা পাঁচ নম্বরের বাগান আলো করে থাকে, লবন আন্দোলনের সময় নারকোল গাছের পাতা পুড়িয়ে খাস দেশী লবন তৈরী করে ফেলছেন অতি সহজে ।
এমন কোনো সৃষ্টিশীল কাজ নেই, যা তিনি করতে নারাজ। বরং একবার খেয়াল চাপলে হলো, দুর্বার বেগে সৃষ্টির ধারা ছুটবে ।
আর ছবি তো চলছেই – শুধু থেমেছিল ৮ বছর, যখন তাঁর খেয়াল চাপে মায়থলোজি থেকে যাত্রা পালা লেখার ।
শিল্প আগে না শিল্পী আগে? তুলি কলম না থাকলে, শিল্পের উপাদান না থাকলে কি শিল্প থেমে থাকত? অবনীন্দ্রনাথ তাঁর নাতিকে সম্পূর্ণ আঙ্গুলে-ঘষা এক খানা দুর্দান্ত ছবি এঁকে পরে চারকোলে আঁকা একটি ছবির সঙ্গে সেটি তুলনা করে দেখিয়ে দেন, শিল্পী তাঁর শিল্পের উপাদান, উপায় বের করে নেবেই!
মানুষের মুখ নয়, মুখোশ চিত্রিত করছেন দারুণ দ্রুত। আসে পাশের চাকরবাকরদের সঙ্গেও তাঁর যে কী মধুর সম্পর্ক (রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও দেখেছি এমনটা ছিল), কত যে রঙ্গ রস আর কৌতুক, বলে শেষ করা যায় না ।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘কত্তাবাবা’, অর্থাত রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময় নাটকের দল নিয়ে আগমন ও বিশাল সমারোহে নাটক করা, সেই সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে সবার জীবন । অর্থাৎ জীবনটা একটা পুরো দস্তুর কর্মঠ, কৌতুহলী, নির্ভার আনন্দ-যজ্ঞ ।
অবনীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে দারুন প্র্যাকটিকাল, আবার অফুরন্ত মানবিক । তাঁর অক্ষয় তূণ – রঙের বাক্সের রং শেষই হত না যেন | রং-এর দাম যে বোঝে না, তার ছবি আঁকার দরকার নেই, এই বলে এক উত্সাহী শিক্ষানবিশ-কে তাড়িয়ে দেন একবার — ছাত্রটি রঙের ব্যাপারে খুবই অমিতব্যয়ী ছিল ।
দেখনাই, জনসভা করে জয়ন্তী পালন, শোকসভা করে শোকপ্রকাশ, পছন্দ করতেন না মোটেই এই তিন ভাই । সব আয়োজনের শৈল্পিক সুক্ষ্মতা বড় চোখে পড়ে । নম্রতাও শিল্প বটে । রবীন্দ্রনাথ-এর কোনো বিশেষ নামকরা সফরের পর, ছোট ছেলেমেয়েদের দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন পদ্মকোরক। নিজেরা ছিলেন পেছনে ।
জানা হলো যে ওই বাড়িতে পল্লী কবি জসীমুদ্দিন অনেক দিন ছিলেন । তাঁকে নিয়ে অনেক মজার মজার ‘অকাব্যিক’ anecdotes পাওয়া যায় ।
এই সূত্রে এটাও জানা হলো যে রবীন্দ্রনাথের ৬৫ তম জন্মদিনে তাঁকে বই দিয়ে ওজন করা হয়েছিল, এবং সেই বই বিতরণ করা হয়েছিল । মোগল আমলে নাকি নবাবদের বা নবাবপুত্রদের সোনা দিয়ে ওজন করা হত, এবং সেই সোনা বিতরণ করা হত জনসাধারন্যে। রবি ঠাকুরের ক্ষেত্রে লক্ষ্মী নয়, সরস্বতীকে ছড়িয়ে দেয়া হলো!
অবনীন্দ্রনাথের কৌতুহল ও এক্সপেরিমেন্টের নেশা রং, তুলি, বাগান, লেখালেখি, যাত্রা পালা, মঞ্চ-সজ্জা, রন্ধন-বিদ্যা, ভাস্কর্য, পড়াশুনো সব দিকেই সর্বগ্রাসী। আবার ভারতের অসহযোগ আন্দোলনে বিদেশী দ্রব্য পরিহার করার সময় বিদেশী রঙ-ও অনেক দিন ব্যবহার করেননি| সেই সময় অনবদ্য উপায়ে বাড়িতে বসে সাধারণ জিনিস দিয়ে সম্পূর্ণ নিজের মত করে দেশী রঙ বানিয়েছেন ।
রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে সকলেই এক এক জন জায়ান্ট, রবীন্দ্রনাথের বটবৃক্ষের আসে পাশে তাঁরা অনেকেই ছায়া-চাপা পড়ে গেছেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ অসম্ভব ঘরকুনো এবং প্রচার-বিমুখ মানসিকতার হওয়া সত্ত্বেও বড় বেশি দৈত্যকায় — তাঁকে না দেখে উপায় নেই, বিস্মিত ও আপ্লুত না হয়ে উপায় নেই ।
অনেক আশ্রিত চাকর ছিল, বংশ পরম্পরায় মেথর ছিল — এই বাড়ির কাজের লোক বা আশ্রিতরাই ছিল সংখ্যগুরু | বহু দিনের জমিদারী সূত্রে পাওয়া পয়সায়, এই তিন ভাই ব্যক্তিগত ভাবে মিতব্যয়ী চালে কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে দরাজ দাক্ষিন্যে এই ‘খেয়ালী আর্টিস্ট’-এর জীবন কাটিয়েছেন — দারুণ লোভ হয় দেখে ।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সমাজের ওপর, পৃথিবীর ওপর যে অর্থনৈতিক ধাক্কা পড়ল, তার ফলেই দেনার বিষয়গুলি, দারিদ্র্যের বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠতে থাকে । এবং শেষে বেহাত হয়ে যায় ৫ নম্বর বাড়ি। সেই সঙ্গেই শেষ হয় এই গল্প ।
আর বইটি পড়ার পর পাঠকের মনে হয়, শৈশবের হারিয়ে যাওয়া কোনো একটি সময় খুঁজে পাওয়া গেল ।
কেন হারিয়ে গেল সেই বাড়ি? যার সত্ত্বা বেঁচে থাকলে এই তিন ভাই ও তাঁদের ঘিরে গড়ে ওঠা আশ্চর্য জাদুপুরী সংরক্ষণ করা যেত কিছুটা? কেন অবনীন্দ্রনাথে হরেদরে বেচে দিলেন তাঁর শত শত ছবি, পুরনো জিনিস বিক্রির দোকানে? চোখ ফেটে জল আসে ভাবলে। উদাসী হাওয়ার পথে পথে সমস্ত আনন্দ-যজ্ঞ-ভগ্নাবশেষ ভেসে যায়। কেবল থাকে আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে, এক আলোড়ন-আবেগ-আনন্দ উস্কে দেয়া স্মৃতিকথা ।