দা সিক্রেট লাইফ অফ বিজ। লেখিকা সু মংক কিড। এক সময়কার নিউ ইওর্ক বেস্ট সেলার ছিল বইটি। বর্ণবাদী সময়ের এক মাতৃহীন মেয়ের শৈশবের আশ্চর্য মানবিক কাহিনী — ১৯৬০ এর দশকের একটি চতুর্দশী কিশোরীর ধ্বস্ত জীবনের কথা, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে, তার আত্মপরিচয় আর আত্মবিশ্বাসের পুনরুদ্ধার। খুব সহজে লেখা গেল কথাগুলো। কিন্তু মেয়েটির জীবনের অন্ধকার ও জটিলতাকে তুলে ধরা সহজ নয়।
প্রথমত বইটিতে যে গল্প বোনা হয়েছে তা যে কোনো দিক থেকে দারুণ নাটকীয় । কিন্তু কে বলে জীবনে নাটকীয়তা নেই ? মার্ক টোয়েনের যুগলবন্দী টম সয়ার আর হাকল বেরি ফিনেই তো আছে একের পর এক লোমহর্ষক নাটুকেপনা, তাই বলে কি সত্য নয় ! শৈশবের বুদ্ধিমত্তা, বিপন্নতাও কি কম আছে, গল্পে উপন্যাসে। হারপার লী-র পুলিত্জার পাওয়া উপন্যাস টু কিল আ মকিং বার্ডের কথা মনে পড়ে যায় । সেখানে দুইজন শিশুর ছোট চোখের চাহনিতে ধরা পড়ে যায় সব সত্য-মিথ্যা ।
আর এখানে নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে আছে জীবনের হারিয়ে যাওয়া ভুঁই উদঘাটন । একটু একটু করে রহস্য উন্মোচন। যা যেকোনো ভালো গল্প লিখিয়ের বাঁধা-ধরা গুণ ।
সাদামাঠা ভাবে বললে গল্পের শুরুটা এরকম : লিলি মেয়েটি মাতৃহীন কিশোরী । তার বাবাকে সে নাম ধরেই ডাকে – কারণ তার কাছে সে বাবার কোনো পরিচয়ই পায়না, তাদের মধ্যে ব্যবধান গড়ে তলে তার বাবার জীবন-বিদ্বেষী মনোভাব, অবিশ্বাস, আর নিষ্ঠুর অবহেলা ।
মা-র একটি মাত্র দিনের স্মৃতি তার আছে, যেদিন মা মারা যান, আচম্বিত, সুটকেস গুছিয়ে নিতে নিতে, যেন কোথাও চলে যাচ্ছেন, বাবার হঠাত-আবির্ভাব, দুজনের বাকবিতন্ডা, মা-র মরিয়া হয়ে আত্মরক্ষার তাগিদে রিভলভার বের করা, হাত থেকে সেটা ছিটকে যাওয়া বাবার জোরাজোরিতে । লিলির বয়েস মাত্র ৪, সে কী যেন ভেবে মাকে সেটা তুলে দিতে যায়, এবং সেইসময় ঘটনাটি ঘটে । রিভলভার থেকে আচম্বিত গুলি বেরিয়ে আসে । এইটুকুই স্মৃতি । মেয়েটি জানে তার মা মৃত, এবং যেহেতু মেয়েটির বুদ্ধি খুব কম নয়, সে মনে করে তার অনিয়ন্ত্রিত অবুঝ হাতেই সেদিন মা মারা যায় । মা-কে ছাড়া সে কিছু চায় না । আর মা-কে সে হত্যা করেছে । কিন্তু এই কষ্ট তার জীবনকে শুধু আলোড়িত করে তাই না, এই কষ্টকে কেন্দ্র করে তার জীবন আবর্তিত হয় । এই গুপ্ত কষ্টটি সে শুধু এক জনের সঙ্গেই ভাগ করে নিতে পারে, কিন্তু সেটা তার বাবা নয়, কারণ বাবা একজন জীবন্ত আগ্নেয়গিরি তার জীবনে ।
এভাবেই শুরু হয় গল্প । কিন্তু মেয়েটির এই সমস্ত অপ্রকাশ্য বোবা বেদনায় নয়, মেয়েটির জীবনে ট্রাজেডী আরো আছে — মা না থাকার সমস্যা ও অভাব ব্যাপ্ত হয় স্কুলে ও সামাজিক জীবনে — লিলি চাইলেও স্কুলে অন্য মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারেনা তার পোশাক পরিচ্ছেদে, আর কে না জানে উঠতি বয়েসের মেয়েদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার নিদারুণ ক্ষুধা । বাবা থেকেও নেই, জন্মদিনে একটি ছোট উপহার চেয়েও পায়না । তার মা-র জায়গাটি পূরণ না করতে পারলেও, কিছুটা ভার নেয়, তাদের বাড়িতে শ্রম দিতে আসা কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাটি, যার নাম রোজালিন । রোজালিন মেয়েটিকে ভালবাসে, এটিও লিলি একদিন বুঝতে শেখে ; রোজালিন তার হয়ে তার বাবার অকারণ অত্যাচার-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিল ।
সিভিল মুভমেন্টের সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার প্রথম প্রতিষ্ঠিত হলে রোজালিন সগৌরবে যখন ভোট দিতে বের হয়, এমনই এক সময়, একটি তীব্র বর্ণবাদী ঘটনার সংকটে দাঁড়িয়ে, রোজালিনকে বর্ণবাদীদের হাতে মার খেতে হয়, এবং বিনা অপরাধে তাকেই জেলে যেতে হয় । তার আঘাত গুরুতর হওয়ায় তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয় । একই সঙ্গে বহুদিনের বেদনা, ক্ষোভ, আর মাকে নিয়ে অনন্ত জিজ্ঞাসায় ভারাক্রান্ত হয়ে, এবং মা-র সম্পর্কে বাবার একটি নিষ্ঠুর আপত্তিকর কথা শুনে, লিলি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ; কিন্তু রোজালিন কে হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে সঙ্গে নিয়ে, তবেই । কারণ সে জানে রোজালিন ছাড়া পেলে ওই বর্ণবাদী চক্রের হাতে মারা পড়তে পারে । কি করে, কোথায় এসে দাঁড়ায় লিলি ও রোজালিন, তার বর্ণনা তাক-লাগানো । বার বার মার্ক টোয়েন মনে পড়ে যায় ।
মৃত মা-র একটি পুরনো উপহার-পাওয়া কৃষ্ণাঙ্গ মেরির ছবির বদৌলতে খুঁজতে খুঁজতে লিলি ভিন শহরে এসে দাঁড়ায় তিন কৃষ্ণাঙ্গ সহদরার বাড়িতে — তার ধারণা এরা তার মাকে চিনতেন । বয়জ্যেষ্ঠ মহিলা অগাস্ট, মধুর ভান্ডারী । তার মানে মধু চাষী । লিলি ও রোজালিন আত্মগোপন করে মিশে যায় তাদের সঙ্গে, শ্রম দেয়ার বিনিময়ে জীবিকার নিশ্চয়তা পায় ।
মধু চাষ করার খুবই মনোগ্রাহী ও জটিল পদ্ধতি এই বই-এর পরতে পরতে স্বভাবতই আছে। সত্যি বলতে কি, শুধু এই বর্ণনার চমকেই বইটি বেশ আলাদা করে চেনা যেত । কিন্তু তার পর মৌমাছিদের উন্মোচিত জটিল গহীন জীবন ও মধু-চাষ একটু রূপক অর্থ নিয়ে নেয় এখানে, বিভিন্ন স্তরে । প্রত্যেক পাতায় উদ্ধৃত করার মত লাইন পেয়েছি । মৌমাছির মধ্যেই যখন কাজ করতে হবে তখন সাবধানতা নেয়ার পরও, মৌমাছির হুলের আঘাত খেতে হবে তা বলাই বাহুল্য । কিন্তু কখনো এদের আঘাত দেয়া যাবে না, এই হলো অগাস্টের শিক্ষা। ভয় পেলেও ওদের আঘাত করনা, ওদের মনে মনে ভালবাসা পাঠাও । আশ্চর্য, যেন তিক্ততা, অরাজক ক্রোধকে জয় করে ভালবাসায় ঋদ্ধ হয়ে, বড় হয়ে ওঠারই শিক্ষা । লিলি এভাবেই শান্ত ও দুর্মর হয়ে ওঠে ।
অগাস্ট কি আদৌ বোঝে ওদের রহস্য, ওদের আত্মগোপনের চেষ্টা ? বুঝুক বা না বুঝুক , কোনো চাপ দেয় না সেই রহস্য উদঘাটনের । এই মানসিক মুক্তি, এবং এই সংশয়হীন আশ্রয় লিলির ভাঙ্গাচোরা মাটিকে শক্ত করতে থাকে । যদিও অগাস্টের বোন জুন লিলির আবির্ভাব ও থাকাকে সহজ ভাবে নিতে পারেনা ।
একজন কৃষ্ণাঙ্গ মাতৃমূর্তি মেরি-কে ঘিরে ক্রীতদাস দের ঊত্থানের গল্প ফিরে ফিরে আসে । এখানে অবহেলিত মা মেরির রং কালো, কষ্টিপাথরের মত, এরকমই এক ছবি ওদের কোটি কোটি মধুর শিশির ওপর – যেখানে ছবির ওপরে লেখা থাকে : ‘ব্ল্যাক ম্যাডোনা’ । এই ব্ল্যাক ম্যাডোনার ছবিটি ছিল লিলির মা-র একটি স্মৃতি-চিহ্ন, এটি সম্বল করেই লিলি বের হয়েছিল তার মাকে খুঁজতে । তাই ছবিটি শুধু মা-কে খুঁজে পাওয়া নয়, মা-কে নতুন আঙ্গিকে খুঁজে পাওয়ার একটি ইঙ্গিত যেন নির্দেশ করে । আক্ষরিক ভাবেই তো লিলি সেই সব কৃষ্ণাঙ্গ মা-দের খুঁজে পায় । তারা বিয়ে করেননি, অনেকটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের বিবাহিত জীবনে বন্দী-দশায় থাকতে হয় বলেই । কিন্তু তাদের মাতৃহৃদয় অথৈ ।
বইটিতে আরো মিশে আছে মার্টিন লুথার কিং-এর নেতৃত্বে আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট-এর আংশিক পরিচয়, তার আলো ছড়িয়ে পড়া, এবং এই টালমাটাল সময়ের এনে দেওয়া ‘নিগ্রো’ দের ভোটাধিকার । কিন্তু সেই দশকে কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের বিচ্ছেদ, বিভক্তি, ঘৃণা, অবিশ্বাস-এর সম্পর্কটা কেমন ছিল? সৌভাগ্যের কথা, এইসব কথা বলতে এখন আর কারুর লজ্জা নেই । তাই বিংশ শতাব্দীতে বসে লেখা এই উপন্যাসে খুব খুঁটিনাটিতে বর্ণ-বিদ্বেষের চেহারা দেখানো হয়, পাশাপাশি তার সহজ মানবিক উত্তরণ । লিলির কিশোর প্রেম এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক, যে তারই সঙ্গে অগাস্টের খামারে মধু-চাষ করতে আসে ।
বইটিতে আমার চমকপ্রদ লাগে এর বাস্তবতার ভেতরে তলিয়ে যাওয়া পরাবাস্তব আরো একটি আত্মিক মাত্র যোগ হওয়ায় ।তবে মনে রাখতে হবে এটি কোনো অবাস্তব জগত সৃষ্টি করে নয়; একটি মিস্টিক মাত্রা থাকলেও আসলে অগাস্ট ও তার বোন-দের মানবিকতা পুরোপুরি মাটি-ঘেঁষা, তাদের বোধ কাঁচের মত স্বচ্ছ । কালো মেরির কাছে তাদের প্রণতি আসলে সেই মানব-হৃদয়ের অন্তর্লীন শক্তির অভিমুখে ধাবিত হয়, যে শক্তি একদিকে আগুন জ্বালিয়ে মুক্ত করে, অন্য দিকে আশ্রয়ের উষ্ণতা দেয় |
কি ভাবে বর্ণবাদী ঘৃণাময় একটি পরিবেশে, এরা নতজানু না হয়ে, তিক্ততা জয় করে, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকে, কি করে তার চেয়েও বেশি, ভালবাসাকে ধারণ করে মস্ত ফুর্তিতে বেঁচে থাকে, সেই বর্ণনা চোখে জল আনে । আবার পর-মুহুর্তেই হাসির দমক ওঠে, কারণ বইটি সূক্ষ্মতম হিউমারে পরিপূর্ণ ।
অগাস্ট-রা একা নয়, এদের সঙ্গে যোগ হয় আরো অনেক বর্ণময় কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র, আত্মিক সম্পর্কে, এবং কাজের সম্পর্কে । কিছু দারুন নাটুকে ও কমিক চরিত্রও আছে । তবে এই নারীদের জীবনকে টালমাটাল করার মত অনেক অভাবিত ঝড়-ও ওঠে ।
অগাস্টের ছোটবোন মে, একটি বর্ণবাদী প্রেক্ষিতে আত্মহত্যা করে; মে ছোট থেকেই অন্য রকম, অন্যের যন্ত্রণা কে সে নিজের বলে মনে করে, আর এক সময় তার এই যন্ত্রণা সহ্যের অতীত হয় । এই রকম একজন ভীষণ স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিশেষ মানুষকে কি করে `হ্যান্ডল’ করত তার বড় বোনেরা ? বড়ই মধুর সেই বর্ণনা । এটি একটি সাধারণ আত্মহত্যা নয় । মে মরে গিয়ে যেন স্বেচ্ছায় তার দুই বোনের জন্যে আরো মুক্ত ভাবে, পূর্ণ ভাবে বাঁচবার পথ খুলে দিয়ে যায় ।
শ্রমণ-এর মত ধীর, আলোময়, গহন অগাস্টের কাছে কি মার পরিচয় ও আত্মপরিচয় ফিরে পায় লিলি? শেষ পর্যন্ত তার চেয়েও আরো কিছু বেশি । শেষ পর্যন্ত একটি আশ্রয় ছাড়াও বড়, বিস্তীর্ণ মাতৃত্ব পায় সেখানে । একটি নয়, অনেক গুলি মা-কে পায় লিলি ।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
সাব্বির হোসাইন - ৭ আগস্ট ২০১৩ (১:৫৬ অপরাহ্ণ)
বইটি পড়ার লোভ লাগিয়ে দিলেন…
আনন্দময়ী মজুমদার - ২৬ আগস্ট ২০১৩ (৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
পড়ে নিন, খুব ভাল লাগবে নিশ্চয়ই ঃ)