চিত্রশিল্পীরা
চিত্রশিল্পীদের বিষয়ে আমার কিছু স্থির পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে। এ-কথা সত্য সঙ্গীত-রচয়িতাদের ব্যাপারেও।
যেসব শিল্পীকে গণ্য করা হয় তালিকার সবচেয়ে ওপরের বলে তাদেরকেই আমার কাছে সবচে কম আকর্ষণীয় মনে হয়, যেমন লেনার্দো দা ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, রেমব্রান্ট প্রমুখ। অল্প কজনের নাম বলি, আমার ভালো লাগে রেনোয়া, ভ্যান গঘ, মাতিস্, স্যুরা, গগ্যাঁ, হিয়েরোনিমাস বশ্, ব্র্যুগেল, ভ্যান আইক প্রমুখের কাজ। অনেক সময় এদের চাইতেও কম নামী ও অচেনা অজানা সৌখিন শিল্পীদের কাজও আমার বেশি ভালো লাগে।
আমি রেনোয়াকে পূজা করি। ছবি আঁকার প্রতি তাঁর ভালোবাসা এত তীব্র ছিল যে তুলির প্রথম টান দেবার আগে তিনি শূন্য ক্যানভাসে চুমু খেতেন। আমি এটাকেই বলি ভালেবাসা! তাঁর আঁকা নারীচিত্রগুলো ছিল অত্যন্ত স্বাদু, যেন মাংসের জয়গান।
আমি ভ্যান গঘকেও শ্রদ্ধা করি, যেমনটা করি বিখ্যাত চেলোবাদক পাবলো কাসালকে। তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন যিনি জানতেন ভালোবাসা কাকে বলে। নারীদের প্রতি তাঁর মনোভাৰ এত শ্রদ্ধাভরা ছিল যে তিনি একটি গরীব মেয়েকে বিয়ে করে বসেন যেন তার যত্নআত্তি করতে পারেন, যতটা না ভালোবাসা তার চেয়েও বেশি তার প্রতি দরদ ও উদ্বগের কারণে। তাঁর কাজে এক ধরনের আলোর উদ্ভাস লক্ষ্য করি আমরা যদিও তাঁর নিজের জীবন ছিল নানাকারণে একটি ট্র্যাজেডি বিশেষ।
হিয়েরোনিমাস বশ্ সমস্ত শিল্পীর মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে রাহসিক ধরনের। তাঁর কাজ তীব্র রকম উর্বর ও অত্যাশ্চর্য কল্পনার ফসল। তিনি তাঁর কল্পনা ও স্বপ্নের দানবীয় উপাদানসমূহ দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন, আবার একইসঙ্গে তাঁর দানব ও দৈত্যরা দেবতার মত পাখা মেলতেও পারতো। তাঁর দৃষ্টি ছিল অদ্ভুত ও সুন্দর।
বয়োজ্যেষ্ঠ ব্র্যুগেল কৃষকজীবনের ছবিগুলোতে তাঁর সময়ের আত্মাটিকে ধরতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর বাসনাময়তাকে বর্ণনা করেছেন। বাঁচা, কাজ করা, খাওয়া, পান করা, নাচা ও হুল্লোড় এটাই ছিল তাঁর ছবির মূল উপজীব্য। বিষয়ের প্রতি তুমুল উৎসাহ তাঁর পরিশীলন ও কৌশলের খামতিকে পুষিয়ে দেয়।
আমার বিবেচনায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম হচ্ছে বেলজিয়াম-এর ঘেন্ট শহরে রক্ষিত ভ্যান আইকের অ্যাডোরেশন অভ দ্য ল্যাম্ব। পৃথিবীর চোখে আমি হচ্ছি একজন অধার্মিক মানুষ আর আমি কিনা এই অতিধার্মিক একটি ছবির প্রেমে পড়েছি! এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন চিত্রটির ঠিক কোন বিষয়টা আমাকে এরকম আপ্লুত করে। হয়তবা এ ছবির ক্যানভাস থেকে যে অনুভূতিটুকু বিচ্ছুরিত হয় সেটা অপূর্ব ও অসাধারণ।
গগ্যাঁর প্রতি আমার পক্ষপাত জন্মে তাঁর দৈবিক ও দানবিক গুণাবলীর জন্য। এবং তাঁর আঁকা দেহাতি নারীরা এককথায় দুর্দান্ত রকম সুন্দর বলে। তিনি তাদের লোকজ ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে দারুণভাবে উপস্থাপন করেন। আমি তাঁর রং ব্যবহারকে পছন্দ করি এবং তাঁর ভঙ্গির সরাসরি ও সহজ সৌন্দর্যের প্রশংসা করি।
আমি ট্রপিক অভ ক্যান্সার বইয়ে মাতিসকে নিয়ে একটা উজ্জ্বল প্রবন্ধ লিখি। এর পুনরাবৃত্তি করার অর্থ একে খাটো করা।
স্যুরা আমার বিবেচনায় একজন তুখোড় নির্মাণশিল্পী। তাঁর রংএর প্রতিটি পোঁচ, প্রতিটি বিন্দুর প্রয়োগ যেন এক একটি ইট, যা দিয়ে তিনি তিলতিল করে সেইসব অসাধারণ চিত্রকর্মগুলো নির্মাণ করেন।
শিল্পী হিসাবে পিকাসোকে আমার উজ্জ্বলতম বলে মনে হয়। আমি আপনাদের বলেছি পিকাসোকে মানুষ হিসাবে আমি কী মনে করি। তাঁর গের্নিকা আমাকে জয় করে নেয়। আমি বিশেষভাবে পছন্দ করি তাঁর আঁকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কর্তিত মানবদেহরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, নারীদের মস্তক ও স্তন, চোখ ও নাকের দৃশ্যটি।
জলরঙ এর প্রতি আমার ভালোবাসার কথা আমি লিখেছি দ্য ওয়াটার্স রিগ্লিটারাইজ্ড্, দ্য এঞ্জেল ইজ মাই ওয়াটারমার্ক, টু পেইন্ট ইজ টু লাভ এগেইন ইত্যাদি রচনায়। অনেকে আমাকে বলেন আমার কাজে নাকি পিকাসোর খুব প্রভাব কিন্তু আমি সেরকম কিছু দেখি না। আমার কাজ একেবারেই আলাদা, তা সরল ও আদিম। আমি কখনোই বড় শিল্পী হতে চাই নি, আমার কাজে বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ খুবই কম। সেগুলো অনেকটা বাচ্চাদের আঁকা ছবির মত- সরাসরি, সরল ও দরদভরা। পিকাসোর পর্যায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করাটাও হবে একটা অবাস্তব ও আজগুবি বিষয়।
আপনারা জানেন ভ্লামিন্ক পিকাসোকে পছন্দ করতেন না। তিনি কোথায় যেন মন্তব্য করেছিলেন “আমি ক্যুবিস্ট পিকাসোকে দেখেছি, নীল পিকাসোকে দেখেছি, গোলাপী পিকাসোকে দেখেছি কিন্তু কোথাও কখনো পিকাসো পিকাসোকে দেখি নি।”
ভ্লামিন্ক ও উত্রিয়ো খুব ভালো বন্ধু ছিলেন, যাকে বলা যায় একপাত্রের সঙ্গী। ভ্লামিন্ক ছিলেন বেলজীয়, একজন বড়সড় মানুষ এবং চমৎকার বক্তা। শারীরিকভাবে উত্রিয়ো ছিলেন তাঁর ঠিক বিপরীত, একজন রুক্ষসুক্ষ ব্যক্তিত্ব কেননা তিনি খুব বেশি মদ্যপান করতেন। আপনারা তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে কল্পনা করে দেখুন কী হাস্যকরই না লাগবে ছবিটা।
একদিন তাঁরা এক শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তাঁরা শবদেহের পেছন পেছন হাঁটছিলেন, গল্পে মশগুল তাঁরা খুব ভালো সময় কাটাচ্ছিলেন। তাঁরা একে অপরে একেবারে বুঁদ হয়ে ছিলেন, হঠাৎ একজন অপরজনকে বলেন “আপনি একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছেন না?” তাঁরা তাকিয়ে দেখেন শবদেহের পরিবর্তে তাঁরা একটা ময়লা ফেলার ট্রাকের পেছন পেছন হাঁটছেন। মগ্ন আলোচনার মধ্যে তাঁরা শবদেহকে হারিয়ে ফেলেছিলেন।
আরো কত শিল্পী রয়েছেন আমি যাঁদের কথা বলি নি, কিন্তু তাই বলে তাঁদের প্রতি আমার অনুরাগ তাতে নাই হয়ে যায় না। আমি সত্যি সত্যি সারা রাত এ বিষয়ে কথা বলতে পারি। আমি দেখেছি যে, লেখকদের চেয়ে শিল্পীরা অনেক বেশি সুস্থ স্বভাবের। লেখকরা বড় বেশি বিমূর্ত, তাঁরা বড় বেশি মাথার ভেতর বাস করেন। আর শিল্পীরা তাঁদের সবটুকু নিয়ে অনেক পরিপূর্ণভাবে বাঁচেন।
একজন শিল্পী আছেন যিনি যতটা সুন্দর করে লিখেছেন ঠিক ততটাই সুন্দর করে এঁকেছেন। তিনি হকুসাই, বিখ্যাত জাপানী শিল্পগুরু। আমি আমার লেখা বিগ সুর অ্যান্ড দ্য অরেঞ্জেস অফ হিয়েরোনিমাস বশ থেকে উদ্ধৃত করবো, আমাকে একটা কপি এনে দেবেন? আমি আপনাদের কিছু পড়ে শোনাতে চাই। এটি নিজের কাজের প্রতি কারো দরদ বিষয়ে একটি অসাধারণ লেখা। তিনি সব শিল্পীদের বিষয়েই বলেন, তা সেটা চিত্রশিল্পী কি লেখকই হোন না কেন।
(হেনরি বইটা হাতে নিয়ে হকুসাইয়ের দ্য আর্টক্রেজি ওল্ডম্যান লেখাটি থেকে পড়তে থাকেন।)
ছয় বছর বয়সে চিত্রকলা বিষয়ে সচেতন হবার পর থেকেই আমি একে ভালোবেসে আসছি। পঞ্চাশ বছর বয়সে আমি কিছু ছবি আঁকি যেগুলোকে মোটামোটি ভালো বলতে পারি, তবে সত্তরের আগ পর্যন্ত আমি এমন কিছু করি নি যেগুলোর কোন মূল্য আছে বলা যায়। তিয়াত্তর বছর বয়সে আমি অবশেষে প্রকৃতির প্রতিটি অনুষঙ্গকে আয়ত্ত করতে পারি- পাখি, মাছ, প্রাণী, পতঙ্গ, গাছ, ঘাষ সবকিছু। আমার যখন আশি হবে আমার আরো কিছুটা উন্নতি হবে, এবং নব্বই বছর বয়সে আমি হয়তো শিল্পের গোপন সত্যকে চিনতে শিখবো সত্যিসত্যি। আমি যখন একশতে পৌঁছাবো তখন আমার কাজ সত্যিকার অর্থেই উচ্চাঙ্গের হয়ে উঠবে, আর আমার চূড়ান্ত গন্তেব্য আমি পৌঁছাতে পারবো যখন আমার বয়স একশ দশ হবে, যখন আমার আঁকা প্রতিটি রেখা ও বিন্দু জীবনের রসে ভরে উঠবে।
(হেনরি দৃশ্যত খুব আলোড়িত হয়েছিলেন এই শেষ বাক্যটিতে। তিনি যখন বইটি নামিয়ে রাখেন তখন কাঁদছিলেন।)
লেখক, অনুবাদক, সংস্কৃতিকর্মী
