সম্প্রতি ইসলাম ও মুক্তচিন্তা বিষয়ক একটা প্রবন্ধে ইসলামের স্বর্ণযুগের কয়েকজন চিন্তাবিদের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে : আজকের যে-কোনো মুসলিম দেশে এঁরা যদি বসবাস করতেন তবে এঁদের স্থান হত কারাগারে কিংবা উগ্র চিন্তাভাবনার লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হতেন তাঁরা। ‘ইসলাম এণ্ড ফ্রিডম অব থট’ নামের এই নিবন্ধটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক :
চতুর্দশ শতকের জ্ঞানতাপস আরব ঐতিহাসিক ইবনে খলদুন, সেই সময়কালেরই আরেকজন লেখক ইবনে বতুতা এবং এগার শতকের ইসলামি পণ্ডিত আবু রায়হান মুহাম্মদ আল বেরুনি তাদের সময়কালে তাদের চিন্তাভাবনার জন্য খুব একটা স্বচ্ছন্দ ছিলেন না, কিন্তু তারা মানুষের জন্য কল্যাণকর জ্ঞান সাধনার পথ থেকে সরে আসেননি। ইসলামের ঐতিহ্যই ছিল তখন জ্ঞান সাধনা ও তা ছড়িয়ে দেয়া। কিন্তু বর্তমানে কোনো মুসলিম দেশে এরা বসবাস করলে এদের স্থান হত কারাগারে কিংবা ধর্মের নামে এরা আক্রমণের শিকার হতেন।
( ‘Islam and Freedom of Thought’, Akbur Ahmed and Lawrence Rosan)
মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে আজ কমবেশি একই রকম চিত্র দেখা যাবে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত একটা প্রবল অসহিষ্ণুতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্মের নামে মুক্তচিন্তার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। পাকিস্তানের মতো কোনো কোনো দেশে চালু হয়েছে ইসলামি শরিয়া আইন। সে-দেশের বহু শিক্ষক, গবেষক এমনকী নিজ ছাত্রের অভিযোগে ব্লাশফেমি আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন। নিউইর্য়ক টাইমস ম্যাগাজিনের ১৭ জুন ২০০১ সংখ্যার প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছিল মিশরের খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী সাদ এদ্দিন ইব্রাহিমের ছবি। জনপ্রিয় এই গবেষক বর্তমানে অন্তরীণ আছেন মিশরের জেলখানায়। তাঁকে সে-দেশের সরকার ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের চর হিসেবে অভিহিত করেছে। কেবল তা-ই নয়, অভিযোগ আনা হয়েছে সমকামিতার। তবে মিশর সরকারের রাগের কারণ এসব নয়, কায়রোর ভোটারদের নিয়ে তিনি যে-গবেষণাটি করেছিলেন তা-ই শাসকগোষ্ঠীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল : কেন মুসলিম তরুণরা জঙ্গিদের দলে যোগ দিচ্ছে। উল্লেখ্য, আরব বিশ্ব ও পাশ্চাত্য উভয় পক্ষই ড. ইব্রাহিমের এই গ্রেপ্তারে নীরব ভূমিকা নিয়েছে। সত্য উদঘাটনের যে-প্রক্রিয়া ইব্রাহিম শুরু করেছিলেন, তা থেমে যাওয়ায় সব পক্ষই স্বস্তি পেয়েছে বলেই মনে হয়। ড. ইব্রাহিমের ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বের অসহিষ্ণুতার উদাহরণের সমাপ্তি ঘটেনি। এমন ঘটনা নানা প্রান্তেই ঘটছে।
বাংলাদেশে ১৯২৬ সালে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর অন্যতম তরুণ সদস্য ছিলেন আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩)। এঁদের মধ্যে সমকালের সাহিত্য ও রাজনীতিতে সম্ভবত আবুল ফজলই সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিলেন। ‘সীমাবদ্ধ জ্ঞান’ এবং ‘আড়ষ্ট বুদ্ধিকে’ মুক্ত করার যে-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তিনি তার অগ্রভাগে ছিলেন। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তিনি ধর্মীয় সংস্কার পরিত্যাগ করতে পেরেছিলেন। ওয়াহিদুল হকের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক :
মৃত্যুকালে তিনি (আবুল ফজলের বাবা) উঠতি যুবক পুত্র আবুল ফজলকে বলে গেলেন, মৃত্যুকালীন শেষ ইচ্ছা হিসেবে পুত্র যেন আজীবন দাড়ি রাখে। … লেখালেখির রোগে পাওয়া পুত্রকে বলে গেলেন লিখবেই যখন কুফরি বাংলায় লিখো না। উর্দু, ফারসি জায়েজ, আরবি সর্বোত্তম। আবুল ফজল, যাঁর জীবনের ইষ্টমন্ত্র ছিল মাথা নত না করা, যে মন্ত্রানুযায়ী তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি তাৎপর্য সন্ধান করেছেন, পিতার প্রথম ইচ্ছাটি পূরণ করেছিলেন, দ্বিতীয় ইচ্ছাটির লঙ্ঘন করেছেন কেমন যেন জেদের বশেই, যেন অশেষ পুণ্যবান সেই জ্ঞানের বঙ্গসরস্বতীর পূজা করে গেলেন তিনি অনেককাল পর্যন্তই — একজন ধর্মপ্রাণ ও সমাজ সচেতন সমাজবর্গী মুসলমান হিসেবে, শেষ পর্যায়ে সব বিভাজন উৎসারী বিশ্বমানব হিসেবে।
আবুল ফজল তবু ধর্মকে পুরোপুরি ছাড়েননি, সমাজকেও প্রত্যাখ্যান করেন না তিনি। তবু এই দুটো ক্ষেত্রকেই ভেতর থেকে সংশোধন করার জন্য লড়েছেন আজীবন। মানবমুক্তির প্রশ্নটিকে আদৌ তিনি ধর্মাশ্রিত ভাবেননি। তবে আবুল ফজলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেও দ্বিধা করেন না। আহমদ ছফা তাঁর বাঙালি মুসলমানের মন বইটি রচনার প্রেক্ষাপট হিসেবে একদিন হঠাৎ আবুল ফজলের সঙ্গে সাক্ষাতের যে-বিবরণ দেন, তার সত্যাসত্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব পাঠকের। আবুল ফজল নিজের শেষ জীবনে ক্ষমতার কাছাকাছি এসে নিজেকে ভিন্ন পরিচয়ে চিহ্নিত করতে তৎপর ছিলেন বলে আহমদ ছফা অভিযোগ করেন। ছফার এই অভিযোগের সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। তবে জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা তিনি কী কারণে হয়েছিলেন তা ওয়াহিদুল হকের কাছে রহস্য কিংবা অব্যাখ্যাতই মনে হয়েছে। কিন্তু এ-কথা ঠিক, ক্ষমতার লিপ্সা আবুল ফজলের ছিল না। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার লোভকে জয় করে তিনি ফিরেও এসেছিলেন আবার তাঁর প্রিয় শহর চট্টগ্রামে। তবে অনেকের অভিযোগ : স্বাধীনতা-পরবর্তী ‘বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দেয়ার যে পরিকল্পনা হয়েছিল’ আবুল ফজল তার বিরোধিতা করেছিলেন। অরুণ সেনের লেখা থেকেই হয়তো এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে :
শুধু পিতা বা আত্মীয়স্বজন নয়, মাদ্রাসা শিক্ষকদের সঙ্গেও, ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপারে অসম্মতি সত্ত্বেও একাত্মতা অনুভব করতেন। তাদের ধর্মীয় আচার আচরণের ব্যাপারে তাঁর ছিল উদাসীনতা, কখনো কখনো ‘গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ’, বেশ তীব্র প্রতিবাদ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্যে নানা সূত্রে উদারতা বা নীতিবোধ বা রুচিও খুঁজে পেতেন। … অথচ মাদ্রাসায় পড়ে তাঁর কখনো ধর্মভাবই জাগেনি — তাই, সে-সময়ে কাছাকাছি কোনো মসজিদ থেকে ‘পাঁচবেলা উচ্চস্বরে ডাক’ তার কাছে মনে হতো ‘নিদ্রার ব্যাঘাত’। চট্টগ্রামের জুমা মসজিদের বড় ইমামের ছেলে হয়েও সুরাপাঠে ধাতস্থ হননি তিনি। এ দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বোত্তীর্ণ ভারসাম্য তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর আন্দোলন এদেশের মানুষের মন থেকে বুদ্ধির আড়ষ্টতা ও কূপমণ্ডূকতাকে দূর করতে পারেনি। ৬০, ৭০, ৮০-র দশকের এ-দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যতদূর এগিয়েছিল, এ কয়েক দশকে ততদূর পিছিয়ে গেছে। সমসাময়িক বিশ্বে মুসলমানিত্বের প্রবল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সর্বগ্রাসী মনোভাবের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানিত্বের পুনর্জাগরণ ঘটছে। এখন তাই বাঙালি মুসলমান মুক্তচিন্তার মানুষ হওয়ার চেষ্টাও হয়তো করে না। সেই অন্তর্গত তাগিদ তার নেই। আজ তাই আবুল ফজলদের যুগের অবসানের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দানকারী সত্যিকারের মুক্তচিন্তার মানুষ।
আসলে মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তার স্থান আছে কি না — এই প্রশ্ন এখনও বেশ জোরেসোরেই উত্থাপিত হচ্ছে। টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান ও ইরাক দখলের কারণে এক ধরনের আত্মসচেতনতা তৈরি হয়েছে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যে। অন্যায় এই যুদ্ধের বিরোধিতা করতে গিয়ে পশ্চাৎপদ সংস্কার ও মূল্যবোধ এরা নিজের অজান্তেই আবারও পুনরুজ্জীবিত করেছেন। নিপীড়নের লক্ষ্যে পরিণত হওয়ার কারণেই হয়তো নিজের দিকে তাকাতেই ভুলে গেছেন মুসলমান দেশগুলোর শিক্ষিত লোকজন। আত্মসমালোচনার পথ রুদ্ধ করে, মুক্তচিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে বিচ্ছিন্ন এক-একটা দ্বীপে পরিণত হয়েছে মুসলিম দেশগুলো। অথচ এসব মুসলিম সমাজে গত কয়েক দশক আগেও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার লোকের অভাব ছিল না। মাত্র ৩৮ বছর আগে ধর্মনিরপেক্ষ সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। অথচ সেই দেশটিকেই আজ ‘মডারেট মুসলিম’ পরিচয়ের জন্য লড়তে হচ্ছে ভেতরে-বাইরে। কোথায় কী বলব না বলব — এই বিষয়ে নিন্ত্রয়ণবোধ আমাদের নিজেদের মধ্যেই প্রখর। তবু অনিচ্ছাকৃত ভুল তো ঘটতেই পারে! কাটুর্নিস্ট আরিফের কথা তো ভুলে যাওয়ার কথা নয় আমাদের। ভোলার কথা নয় হুমায়ুন আজাদের সেই রক্তাক্ত চেহারা।
বর্তমানে তাই এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে : এখনকার মুসলিম সমাজ আদৌ মুক্তচিন্তাকে স্বীকার করে কি না? এমন সমাজে প্রকৃত প্রজ্ঞার দেখা পাওয়া সম্ভব কি না? প্রশ্ন তোলা হয়েছে, মুসলিম বিশ্বের এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি আর উঠে আসবে যারা নারী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী? যারা ঐতিহ্যিক ধ্যানধারণা লালন করেও আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করতে পারবেন?
চট্টগ্রামে বসবাসরত। পেশা : লেখালেখি। জীবিকা : সাংবাদিকতা।