সম্প্রতি ইসলাম ও মুক্তচিন্তা বিষয়ক একটা প্রবন্ধে ইসলামের স্বর্ণযুগের কয়েকজন চিন্তাবিদের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে : আজকের যে-কোনো মুসলিম দেশে এঁরা যদি বসবাস করতেন তবে এঁদের স্থান হত কারাগারে কিংবা উগ্র চিন্তাভাবনার লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হতেন তাঁরা। [...]

fazalabul

সম্প্রতি ইসলাম ও মুক্তচিন্তা বিষয়ক একটা প্রবন্ধে ইসলামের স্বর্ণযুগের কয়েকজন চিন্তাবিদের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে : আজকের যে-কোনো মুসলিম দেশে এঁরা যদি বসবাস করতেন তবে এঁদের স্থান হত কারাগারে কিংবা উগ্র চিন্তাভাবনার লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হতেন তাঁরা। ‘ইসলাম এণ্ড ফ্রিডম অব থট’ নামের এই নিবন্ধটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক :

চতুর্দশ শতকের জ্ঞানতাপস আরব ঐতিহাসিক ইবনে খলদুন, সেই সময়কালেরই আরেকজন লেখক ইবনে বতুতা এবং এগার শতকের ইসলামি পণ্ডিত আবু রায়হান মুহাম্মদ আল বেরুনি তাদের সময়কালে তাদের চিন্তাভাবনার জন্য খুব একটা স্বচ্ছন্দ ছিলেন না, কিন্তু তারা মানুষের জন্য কল্যাণকর জ্ঞান সাধনার পথ থেকে সরে আসেননি। ইসলামের ঐতিহ্যই ছিল তখন জ্ঞান সাধনা ও তা ছড়িয়ে দেয়া। কিন্তু বর্তমানে কোনো মুসলিম দেশে এরা বসবাস করলে এদের স্থান হত কারাগারে কিংবা ধর্মের নামে এরা আক্রমণের শিকার হতেন।

( ‘Islam and Freedom of Thought’, Akbur Ahmed and Lawrence Rosan)

মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে আজ কমবেশি একই রকম চিত্র দেখা যাবে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত একটা প্রবল অসহিষ্ণুতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্মের নামে মুক্তচিন্তার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। পাকিস্তানের মতো কোনো কোনো দেশে চালু হয়েছে ইসলামি শরিয়া আইন। সে-দেশের বহু শিক্ষক, গবেষক এমনকী নিজ ছাত্রের অভিযোগে ব্লাশফেমি আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন। নিউইর্য়ক টাইমস ম্যাগাজিনের ১৭ জুন ২০০১ সংখ্যার প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছিল মিশরের খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী সাদ এদ্দিন ইব্রাহিমের ছবি। জনপ্রিয় এই গবেষক বর্তমানে অন্তরীণ আছেন মিশরের জেলখানায়। তাঁকে সে-দেশের সরকার ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের চর হিসেবে অভিহিত করেছে। কেবল তা-ই নয়, অভিযোগ আনা হয়েছে সমকামিতার। তবে মিশর সরকারের রাগের কারণ এসব নয়, কায়রোর ভোটারদের নিয়ে তিনি যে-গবেষণাটি করেছিলেন তা-ই শাসকগোষ্ঠীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল : কেন মুসলিম তরুণরা জঙ্গিদের দলে যোগ দিচ্ছে। উল্লেখ্য, আরব বিশ্ব ও পাশ্চাত্য উভয় পক্ষই ড. ইব্রাহিমের এই গ্রেপ্তারে নীরব ভূমিকা নিয়েছে। সত্য উদঘাটনের যে-প্রক্রিয়া ইব্রাহিম শুরু করেছিলেন, তা থেমে যাওয়ায় সব পক্ষই স্বস্তি পেয়েছে বলেই মনে হয়। ড. ইব্রাহিমের ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বের অসহিষ্ণুতার উদাহরণের সমাপ্তি ঘটেনি। এমন ঘটনা নানা প্রান্তেই ঘটছে।

বাংলাদেশে ১৯২৬ সালে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর অন্যতম তরুণ সদস্য ছিলেন আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩)। এঁদের মধ্যে সমকালের সাহিত্য ও রাজনীতিতে সম্ভবত আবুল ফজলই সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিলেন। ‘সীমাবদ্ধ জ্ঞান’ এবং ‘আড়ষ্ট বুদ্ধিকে’ মুক্ত করার যে-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তিনি তার অগ্রভাগে ছিলেন। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তিনি ধর্মীয় সংস্কার পরিত্যাগ করতে পেরেছিলেন। ওয়াহিদুল হকের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক :

মৃত্যুকালে তিনি (আবুল ফজলের বাবা) উঠতি যুবক পুত্র আবুল ফজলকে বলে গেলেন, মৃত্যুকালীন শেষ ইচ্ছা হিসেবে পুত্র যেন আজীবন দাড়ি রাখে। … লেখালেখির রোগে পাওয়া পুত্রকে বলে গেলেন লিখবেই যখন কুফরি বাংলায় লিখো না। উর্দু, ফারসি জায়েজ, আরবি সর্বোত্তম। আবুল ফজল, যাঁর জীবনের ইষ্টমন্ত্র ছিল মাথা নত না করা, যে মন্ত্রানুযায়ী তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি তাৎপর্য সন্ধান করেছেন, পিতার প্রথম ইচ্ছাটি পূরণ করেছিলেন, দ্বিতীয় ইচ্ছাটির লঙ্ঘন করেছেন কেমন যেন জেদের বশেই, যেন অশেষ পুণ্যবান সেই জ্ঞানের বঙ্গসরস্বতীর পূজা করে গেলেন তিনি অনেককাল পর্যন্তই — একজন ধর্মপ্রাণ ও সমাজ সচেতন সমাজবর্গী মুসলমান হিসেবে, শেষ পর্যায়ে সব বিভাজন উৎসারী বিশ্বমানব হিসেবে।

আবুল ফজল তবু ধর্মকে পুরোপুরি ছাড়েননি, সমাজকেও প্রত্যাখ্যান করেন না তিনি। তবু এই দুটো ক্ষেত্রকেই ভেতর থেকে সংশোধন করার জন্য লড়েছেন আজীবন। মানবমুক্তির প্রশ্নটিকে আদৌ তিনি ধর্মাশ্রিত ভাবেননি। তবে আবুল ফজলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেও দ্বিধা করেন না। আহমদ ছফা তাঁর বাঙালি মুসলমানের মন বইটি রচনার প্রেক্ষাপট হিসেবে একদিন হঠাৎ আবুল ফজলের সঙ্গে সাক্ষাতের যে-বিবরণ দেন, তার সত্যাসত্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব পাঠকের। আবুল ফজল নিজের শেষ জীবনে ক্ষমতার কাছাকাছি এসে নিজেকে ভিন্ন পরিচয়ে চিহ্নিত করতে তৎপর ছিলেন বলে আহমদ ছফা অভিযোগ করেন। ছফার এই অভিযোগের সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। তবে জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা তিনি কী কারণে হয়েছিলেন তা ওয়াহিদুল হকের কাছে রহস্য কিংবা অব্যাখ্যাতই মনে হয়েছে। কিন্তু এ-কথা ঠিক, ক্ষমতার লিপ্সা আবুল ফজলের ছিল না। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার লোভকে জয় করে তিনি ফিরেও এসেছিলেন আবার তাঁর প্রিয় শহর চট্টগ্রামে। তবে অনেকের অভিযোগ : স্বাধীনতা-পরবর্তী ‘বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দেয়ার যে পরিকল্পনা হয়েছিল’ আবুল ফজল তার বিরোধিতা করেছিলেন। অরুণ সেনের লেখা থেকেই হয়তো এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে :

শুধু পিতা বা আত্মীয়স্বজন নয়, মাদ্রাসা শিক্ষকদের সঙ্গেও, ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপারে অসম্মতি সত্ত্বেও একাত্মতা অনুভব করতেন। তাদের ধর্মীয় আচার আচরণের ব্যাপারে তাঁর ছিল উদাসীনতা, কখনো কখনো ‘গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ’, বেশ তীব্র প্রতিবাদ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্যে নানা সূত্রে উদারতা বা নীতিবোধ বা রুচিও খুঁজে পেতেন। … অথচ মাদ্রাসায় পড়ে তাঁর কখনো ধর্মভাবই জাগেনি — তাই, সে-সময়ে কাছাকাছি কোনো মসজিদ থেকে ‘পাঁচবেলা উচ্চস্বরে ডাক’ তার কাছে মনে হতো ‘নিদ্রার ব্যাঘাত’। চট্টগ্রামের জুমা মসজিদের বড় ইমামের ছেলে হয়েও সুরাপাঠে ধাতস্থ হননি তিনি। এ দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বোত্তীর্ণ ভারসাম্য তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর আন্দোলন এদেশের মানুষের মন থেকে বুদ্ধির আড়ষ্টতা ও কূপমণ্ডূকতাকে দূর করতে পারেনি। ৬০, ৭০, ৮০-র দশকের এ-দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যতদূর এগিয়েছিল, এ কয়েক দশকে ততদূর পিছিয়ে গেছে। সমসাময়িক বিশ্বে মুসলমানিত্বের প্রবল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সর্বগ্রাসী মনোভাবের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানিত্বের পুনর্জাগরণ ঘটছে। এখন তাই বাঙালি মুসলমান মুক্তচিন্তার মানুষ হওয়ার চেষ্টাও হয়তো করে না। সেই অন্তর্গত তাগিদ তার নেই। আজ তাই আবুল ফজলদের যুগের অবসানের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দানকারী সত্যিকারের মুক্তচিন্তার মানুষ।

আসলে মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তার স্থান আছে কি না — এই প্রশ্ন এখনও বেশ জোরেসোরেই উত্থাপিত হচ্ছে। টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান ও ইরাক দখলের কারণে এক ধরনের আত্মসচেতনতা তৈরি হয়েছে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যে। অন্যায় এই যুদ্ধের বিরোধিতা করতে গিয়ে পশ্চাৎপদ সংস্কার ও মূল্যবোধ এরা নিজের অজান্তেই আবারও পুনরুজ্জীবিত করেছেন। নিপীড়নের লক্ষ্যে পরিণত হওয়ার কারণেই হয়তো নিজের দিকে তাকাতেই ভুলে গেছেন মুসলমান দেশগুলোর শিক্ষিত লোকজন। আত্মসমালোচনার পথ রুদ্ধ করে, মুক্তচিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে বিচ্ছিন্ন এক-একটা দ্বীপে পরিণত হয়েছে মুসলিম দেশগুলো। অথচ এসব মুসলিম সমাজে গত কয়েক দশক আগেও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার লোকের অভাব ছিল না। মাত্র ৩৮ বছর আগে ধর্মনিরপেক্ষ সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। অথচ সেই দেশটিকেই আজ ‘মডারেট মুসলিম’ পরিচয়ের জন্য লড়তে হচ্ছে ভেতরে-বাইরে। কোথায় কী বলব না বলব — এই বিষয়ে নিন্ত্রয়ণবোধ আমাদের নিজেদের মধ্যেই প্রখর। তবু অনিচ্ছাকৃত ভুল তো ঘটতেই পারে! কাটুর্নিস্ট আরিফের কথা তো ভুলে যাওয়ার কথা নয় আমাদের। ভোলার কথা নয় হুমায়ুন আজাদের সেই রক্তাক্ত চেহারা।

বর্তমানে তাই এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে : এখনকার মুসলিম সমাজ আদৌ মুক্তচিন্তাকে স্বীকার করে কি না? এমন সমাজে প্রকৃত প্রজ্ঞার দেখা পাওয়া সম্ভব কি না? প্রশ্ন তোলা হয়েছে, মুসলিম বিশ্বের এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি আর উঠে আসবে যারা নারী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী? যারা ঐতিহ্যিক ধ্যানধারণা লালন করেও আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করতে পারবেন?

Site Default

চট্টগ্রামে বসবাসরত। পেশা : লেখালেখি। জীবিকা : সাংবাদিকতা।

১১ comments

  1. স্নিগ্ধা - ২৬ অক্টোবর ২০০৯ (৬:০৩ অপরাহ্ণ)

    বর্তমানে তাই এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে : এখনকার মুসলিম সমাজ আদৌ মুক্তচিন্তাকে স্বীকার করে কি না? এমন সমাজে প্রকৃত প্রজ্ঞার দেখা পাওয়া সম্ভব কি না? প্রশ্ন তোলা হয়েছে, মুসলিম বিশ্বের এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি আর উঠে আসবে যারা নারী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী? যারা ঐতিহ্যিক ধ্যানধারণা লালন করেও আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করতে পারবেন।

    আহমেদ মুনির, আমার প্রশ্নটাকে দয়া করে শ্লেষ হিসেবে দেখবেন না – আমি সত্যিই জানতে চাই আপনার ওপরের প্রশ্নগুলো আপনি নিজেই বিশ্বাস করেন কিনা! অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি – ‘এখনকার মুসলিম সমাজ’ আদৌ ‘মুক্তচিন্তা’কে স্বীকার বা ধারন করে কিনা, এ ব্যাপারে এখনও কি আপনার চিন্তায় দ্বিধার কোন জায়গা আছে?

    এখনকার ইসলাম তো বোধহয় আগেকার সেই স্পিরিচুয়াল/আইডিওলজিকাল/জীবনাদর্শের ইসলাম নেই, এখন আমরা এমনকি বাড়ির ভেতরেও যে ইসলাম প্রয়াকটিস করি বহুলাংশেই সেটা ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’। রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত (shaped), আইডেনটিটি পলিটিক্স দ্বারা প্রভাবিত, রাজনৈতিক বলয় থেকে সামাজিক জীবনে একটু একটু করে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রবিষ্ট করিয়ে দেয়া এই ইসলাম কি আমাদের বাবা মাদের প্রজন্ম চিনতে পারেন?

    • রায়হান রশিদ - ২৬ অক্টোবর ২০০৯ (৯:০৯ অপরাহ্ণ)

      মুনির, একই প্রশ্ন কিন্তু আমারও। একটু কি অবস্থানটা স্পষ্ট করা সম্ভব?

      • আহমেদ মুনির - ২৬ অক্টোবর ২০০৯ (১০:৩২ অপরাহ্ণ)

        রায়হান

        আমি কী কোনো অস্পষ্টতার জন্ম দিয়েছি? ঠিক বুঝলাম ন।আমি মুসলিম সমাজে মুক্ত চিন্তা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন তুলেছি। এখানে আমার বিশ্বাস নিয়ে ঠিক কি জানতে চাস স্পষ্ট করলে ভালো হয়।

  2. votto kamal - ২৬ অক্টোবর ২০০৯ (৬:০৮ অপরাহ্ণ)

    খুবই গুরুত্ববহ, সময়োপযোগী একটা লেখা। লেখককে ধন্যবাদ। সত্যিকার ভাবেই আজকে বাংলাদেশী মুসলমান যে বিষয়টার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তা হলো আত্মপরিচয়ের সংকট। অনেকগুলো বিষয় লেখক তার এই ছোটলেখাটায় স্থান দিয়েছেন। শুধু একটা ব্যপার নিয়ে বলতে চাই। মুসলিম সাহিত্য সমাজ। আব্দুল ওদুদ, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেন, প্রফেসর মনসুর উদ্দিন, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ, ড. এনামুল হক, আব্দুল হক প্রমুখের অসাধারণ মনন ও চেতনা সমৃদ্ধ রচনাসমূহ যেন আজকে আমরা মুসলমান বলে পরিত্যাগ করতে পারলে বাঁচি। এসব লেখকেদের লেখা যেমন মৌলিক তেমনি গভীর। বাঙলা সাহিত্য ও ইসলাম সম্পর্কে অনেক গুরুত্ববহ দিক নিশানা আছে। কিন্তু কি এক অদৃশ্য কারসাজিতে যেন আমরা তাদেরকে এড়িয়ে চলি। এটাকি এই জন্য যে নিজেদের অজান্তে আমরাকি এখনো কলকাতার সাহিত্যেই চর্চা করে যাচ্ছি। কলকাতার দাদাদের চোখ দিয়ে এদেশীয় সাহিত্যকে দেখছি। প্রথমত পুবদেশের লোক তার ওপর মুসলমান এরা আবার কী লিখবে? সবতো অই কলকাতায় এই ভাব-এ মত্ত বুদ্ধিজীবীতেই তো ভরা এদেশীয় সাহিত্য মজলিস। একটা উদাহরণ দেয়া যাক, এদেশের সৃজনশীল লেখকদের লেখা ছাপানোর মতো কোনো ভাল পত্রিকা নাই অথচ পত্রিকার কিন্তু কমতি নাই। কি দৈনিক কি ছোটকাগজ। সবার স্বপ্ন তাদের কাগজে পশ্চিমবঙ্গের লেখকরাই লিখবে। হীনমন্যতা আর কাকে লিখবে।

    • মাসুদ করিম - ২৭ অক্টোবর ২০০৯ (৭:২৬ অপরাহ্ণ)

      প্রগতি শুরু হয় নিজের মধ্যে, তেমন পত্রিকা বের করতে নিজেই চেষ্টা করুন। আর যদি এমন হয় যে শুরু করেছেন, আমরা জানি না, তাহলে আমাদের জানান। শুধু কলকাতার দাদাদের পৃষ্টপোষকতা হচ্ছে – এ কথা বললে তো হবে না, নিজেদের তো তেমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যেন কলকাতার দাদারাও আমাদের কথা বলেন। সে সুযোগ এখন সমান সমান আছে, কিন্তু আমাদের নিজেদের কাজ করার চেয়ে ‘তুমি উত্তম তাই বলিয়া আমি অধম হইব না কেন’ এই মানসিকতায় আরো অধঃপতন ঘটছে, খালি কলকাতার দাদাগিরিতে গা পোড়াচ্ছি, নিজেরা নিজেদের তৈরি করছি না। আপনি যদি হন সে মানুষ যিনি আমাদের দেশের সৃজনশীলতাকে প্রচার করবেন, তাহলে এখনিই অভিন্দন।

  3. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৬ অক্টোবর ২০০৯ (৯:৪৯ অপরাহ্ণ)

    মুসলিম সমাজের মুক্তচিন্তার বিষয়ে আহমেদ মুনির কতিপয় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এসব নিশ্চয়ই খুব দরকারি বিষয়। তাকে ধন্যবাদ।
    তবে কিছু কথা বলার শুরুতেই বলতে হয়, তার লেখাটি আরও বিস্তৃত, ব্যাখ্যামূলক হতে পারত। মুসলিম সমাজের মুক্তচিন্তার বিষয়টা ১৯২৬ সাল-এর ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ থেকে একেবারে সমকালে আসাটা কি যুক্তিযুক্ত হলো? ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ছিল একটি সংগঠন। এরা নিশ্চয়ই গোটা মুসলিম সমাজকে রিপ্রেজেন্ট করে না। হুমকি-ধামকি তারাও কি কম পেয়েছেন? এটা ঠিক এসময়ে সাম্রাজ্যবাদ আর কর্পোরেট পুঁজিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে পাল্টা নানাবিধ জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের বিস্তৃতি হচ্ছে। তবে আরব সাম্রাজ্য আর সাম্রাজ্রবাদের সাথে গাঁটছড়া বাধার নেশা থেকে কখনো আমাদের রাষ্ট্রীয় শাসনপ্রক্রিয়া মুক্ত ছিল? মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে জনমানসের ভিতর ধর্মনিরপেক্ষতার যে আযোজন-উচ্ছ্বাস আমরা দেখেছিলাম, তা কি রাষ্ট্রব্যবস্থা কর্তৃক লালিত হয়েছিল? না হয়নি।
    পরবর্তীতে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমে ক্রমে স্যেকুলার অবস্থানের বদলে মুসলিম আধিপথ্যের দিকেই চলে গেল। আর এখনতো লা ইলাহাকে তজবি জপের আকারে প্রচার না-করলে ক্ষমতার স্বাদই নেয়া যাবে বলে মনে হয় না!
    কথা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা কামনা করা শুধুমাত্র আশার বিষয় নয়, এটা এক ধরনের লড়াই-সংগ্রামও বটে। এখানে মুসলিম সমাজ মুক্তচিন্তার বিষয়টা স্বীকার করে কি-না শুধুমাত্র এ নিয়ে বসে থাকার বিষয় হতে পারে কি?

  4. মাসুদ করিম - ২৭ অক্টোবর ২০০৯ (৭:০৭ অপরাহ্ণ)

    আগে জানতে হবে আমরা কী চাই, যদি এই হয় যে আমরা চিন্তামুক্ত হতে চাই, তাহলে সব ধর্মেই সেটা সম্ভব, এবং ধর্মের কাজও তাই — মানুষকে চিন্তামুক্ত করা। আর যদি আমরা মুক্তচিন্তা চাই, তাহলে ধর্মটা ছাড়তে হবে, ধর্মহীন হতে হবে। আবুল ফজলদের উত্তরণে কেন আমরা ফিরব? তারা তাদের প্রগতি সাধন করে গেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি কুপিত না হয়েও সুরাহীন জীবন কাটিয়ে গেছেন। আমাদের যুগে প্রগতি চাইলে শুধু সুরাহীন জীবন দিয়ে হবে না, ধর্মহীন জীবনও লাগবে।
    পুনশ্চ : সুরা কোরানের সুরা অর্থে, সুরাপায়ীর সুরা অর্থে নয়; সে অর্থ আবুল ফজল সুরাহীন ছিলেন কি না জানি না, তবে আমরা সে অর্থে মোটেই সুরাহীন হতে চাই না।

  5. মোহাম্মদ মুনিম - ৩১ অক্টোবর ২০০৯ (১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ)

    Wikipedia তে দেখলাম সাদ উদ্দিন এব্রাহিম বর্তমানে মুক্ত এবং হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত জেলে ছিলেন, ২০০৮ সালে তাঁর নামে আবার মামলা হওয়াতে তিনি মিশর ত্যাগ করেন। ২০০৫ সালে তাঁর একটি সাক্ষাতকারের লিঙ্ক এখানে।

  6. মুয়িন পার্ভেজ - ৩১ অক্টোবর ২০০৯ (৪:১৬ অপরাহ্ণ)

    আহমেদ মুনির

    বর্তমানে তাই এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে : এখনকার মুসলিম সমাজ আদৌ মুক্তচিন্তাকে স্বীকার করে কি না? এমন সমাজে প্রকৃত প্রজ্ঞার দেখা পাওয়া সম্ভব কি না? প্রশ্ন তোলা হয়েছে, মুসলিম বিশ্বের এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি আর উঠে আসবে যারা নারী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী? যারা ঐতিহ্যিক ধ্যানধারণা লালন করেও আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করতে পারবেন?

    শুধু ইসলাম নয়, কোনো ধর্মেই মুক্তচিন্তাকে উৎসাহিত করা হয়নি কখনও, তাই ধর্ম অক্ষরে অক্ষরে পালন ক’রে কেউ মুক্ত বিহঙ্গ হতে পারে না। এটুকু বরং সম্ভব যে আমরা ইসলামের নামে নানা ধরনের ‘পরিশোধিত’ এমনকী স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থা দেখতে থাকব যুগে যুগে — কামাল আতাতুর্কের ইসলাম বা মাহাথিরের ইসলাম বা আহমেদিনেজাদের ইসলাম ইত্যাদি। সমাজভেদেও ইসলামের চেহারা একরকম নয় (বাংলাদেশেও কি ‘মুসলিম সমাজ’-এর মুখচ্ছবি বর্ণনিরপেক্ষ?), ফলে শুধু ‘মুসলিম সমাজ’ বললেই সমাজটিকে সম্পূর্ণত ধরা যায় না।

    আপনার লেখার প্রান্তিক প্রশ্নাবলি একটু স্ববিরোধ তৈরি করে : ‘মুসলিম বিশ্বের’ যে- ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ উঠে আসবে, তা কী ক’রে আবার ‘আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’ হতে পারে — বিষয়টি বোধগম্য নয়। কোনো প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র কি ‘নারী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী’ হতে পারে? যদি মোহাম্মদি ইসলামে সম্ভব না হয়, তাহলে ‘পরিশোধিত’ বা ‘পরিমার্জিত’ ইসলামের নামেই বা কেন আনতে হবে বৈষম্যহীন ‘আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থা?

  7. মুয়িন পার্ভেজ - ৩১ অক্টোবর ২০০৯ (৫:০৭ অপরাহ্ণ)

    স্নিগ্ধা লিখেছেন :

    আহমেদ মুনির, আমার প্রশ্নটাকে দয়া করে শ্লেষ হিসেবে দেখবেন না – আমি সত্যিই জানতে চাই আপনার ওপরের প্রশ্নগুলো আপনি নিজেই বিশ্বাস করেন কিনা! অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি – ‘এখনকার মুসলিম সমাজ’ আদৌ ‘মুক্তচিন্তা’কে স্বীকার বা ধারন করে কিনা, এ ব্যাপারে এখনও কি আপনার চিন্তায় দ্বিধার কোন জায়গা আছে?

    রায়হান রশিদ লিখেছেন :

    মুনির, একই প্রশ্ন কিন্তু আমারও। একটু কি অবস্থানটা স্পষ্ট করা সম্ভব?

    প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে লেখককে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতেই পারে, কিন্তু আহমেদ মুনির-উত্থাপিত প্রশ্নগুলো তিনি নিজেই বিশ্বাস করেন কি না — এই প্রশ্ন বর্তমান লেখায় অবান্তর ব’লে মনে হয়েছে। মুনির লিখেছেন :

    টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান ও ইরাক দখলের কারণে এক ধরনের আত্মসচেতনতা তৈরি হয়েছে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যে। অন্যায় এই যুদ্ধের বিরোধিতা করতে গিয়ে পশ্চাৎপদ সংস্কার ও মূল্যবোধ এরা নিজের অজান্তেই আবারও পুনরুজ্জীবিত করেছেন। নিপীড়নের লক্ষ্যে পরিণত হওয়ার কারণেই হয়তো নিজের দিকে তাকাতেই ভুলে গেছেন মুসলমান দেশগুলোর শিক্ষিত লোকজন। আত্মসমালোচনার পথ রুদ্ধ করে, মুক্তচিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে বিচ্ছিন্ন এক-একটা দ্বীপে পরিণত হয়েছে মুসলিম দেশগুলো।

    মুনির-কথিত ‘মুসলমান দেশগুলোর শিক্ষিত লোকজন’ কথাটির মধ্যে সাধারণীকরণের প্রয়াস রয়েছে। যা হোক, এর প্রেক্ষিতেই মুনিরের অন্তিম প্রশ্নাবলি বা সংশয়। এগুলো ধ’রে নতুন চিন্তাসূত্র তৈরি হতে পারে, হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু মুনির একাই কেন প্রশ্নবিদ্ধ হবেন? বিষয়টি নৈর্ব্যক্তিক, তাই প্রশ্ন ব্যক্তিগত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

  8. মাসুদ করিম - ১ জুলাই ২০১৩ (১০:২৮ পূর্বাহ্ণ)

    আবুল ফজলের জন্মদিনে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার তাকে উপমহাদেশের ঐতিহ্যগতভাবে দৃঢ়মূল ‘liberal islamism’এর অনুসারী বলছে — এখন এই ‘উদার ইসলামবাদ’টা কী? এটা কি এমন কিছুর শুরু যার থেকে আমরা পরে ‘উদার জঙ্গিবাদ’এর মতো কিছু শুনব?

    He completed his Master’s degree in Bangla Language and Literature from Calcutta University in 1940. Fazal initially began his career as an Imam before embarking as an academic. In 1941 he joined Krishnanagar College as a lecturer of Bangla. In 1943 he moved to Chittagong College from where he retired as a Professor in 1956. In 1973 he was appointed Vice-Chancellor of Chittagong University. In 1975 he joined the advisory council of the Government of Bangladesh as member in-charge of education and culture, and served in that position till 1977*.

    Fazal was a fearless and socially committed writer whose works reflect patriotism, secularism, and humanism. He was considered the conscience of the nation in his time. Though primarily a writer, Fazal participated in and led almost all intellectual and civil movements against the Pakistani autocratic regime. At the advent of the Bangladesh liberation movement, Fazal became a truly national figure guiding the progressive forces with courage and high morale.**

    Fazal imbibed a liberal mode of thinking, non-communal and secular, but at the same time followed a tradition of liberal Islamism that took deeper roots in the subcontinent.

    * তিনি যে জিয়া সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন সেটা সরাসরি লিখতে কী অসুবিধা?
    ** মুক্তিযুদ্ধের আবির্ভাবকালে তিনি আসলেই কি জাতীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রগতিশীলদের সাহস ও নৈতিকশক্তির দিশারী ছিলেন?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.