এ বছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হেয়ার্টা ম্যুলারের একটি বিখ্যাত উপন্যাস 'সবুজ কুলের দেশ'। গ্রন্থটি জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে 'দ্য ল্যান্ড অব গ্রিন প্লাম্‌স্' নামে। ম্যুলারের এই উপন্যাস নানা কারণেই সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। [...]

এ বছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হেয়ার্টা ম্যুলারের একটি বিখ্যাত উপন্যাস সবুজ কুলের দেশ। গ্রন্থটি জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে দ্য ল্যান্ড অব গ্রিন প্লাম্‌স্ নামে। ম্যুলারের এই উপন্যাস নানা কারণেই সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর এই উপন্যাসের পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া লিখেছিলেন ল্যারি উল্ফ। উল্ফের সেই নাতিদীর্ঘ সমালোচনার সারাংশ থেকে ম্যুলারের সাহিত্যকীর্তি সম্পর্কে একটা সহজ ধারণা আমরা পেতে পারি।
Herta_Mueller

হেয়ার্টা ম্যুলারের এই উপন্যাসটির পটভূমি রচিত হয়েছে রুমানিয়ার বিগত কমিউনিস্ট শাসক নিকোলাই চসেস্কুর শাসনামলে। গ্রামাঞ্চল থেকে আসা দরিদ্র ছাত্রী লোলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসের কক্ষ থেকেই এর কাহিনীর সূত্রপাত। একটি উইমেন ইউনিভার্সিটির রুশ ভাষার ছাত্রী লোলা এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। লোলা এবং হোস্টেলে তার সহপাঠী রুমমেটরা বালিশের নিচে সাজসজ্জার সরঞ্জাম রাখে অতি গোপনে। চোখ কালো করার মাশকারা লাগিয়ে গোপনে রূপচর্চা করে তারা।

লোলার নগরজীবনটা শুরু হয় দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে। শৈশব গ্রামে অতিবাহিত হয়েছে তার। নগরজীবনের জন্য নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুতও করে তোলা হয়নি। তার আগেই তাকে এসে পড়তে হয় দুঃস্বপ্নের নগরীতে। এখানে এসেই মর্মান্তিক যৌন নিপীড়নের শিকার হয় সে। এ ঘটনায় কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায় না। বরং তাকে বহিষ্কার করা হয় কমিউনিস্ট পার্টি থেকে।

পুরো উপন্যাসটি বয়ান করা হয়েছে লোলারই এক রুমমেটের মুখ দিয়ে। কমিউনিস্ট পার্টি হতে বহিষ্কৃত হবার পর লোলার ওপর নজরদারি চলছিল। সন্দেহের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল সে। যার পরিণামে নিজের মাশকারার শিশি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়েছিল সে। লোলার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাবার পর তার রুমমমেট বিছানা উল্টাতে গিয়ে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখতে পায়। সে দেখে বিছানার ঠিক মাঝখানে সেঁটে আছে একটা শূকরের কান। কোনোভাবেই ছাড়ানো যাচ্ছে না কানটাকে। যেন আঠা দিয়ে কেউ লাগিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি বুঝতে পারে কানটি এখানেই থাকবে। অন্তত তাদের পাহারা দেওয়ার স্বার্থে। রুমানিয়ার গোপন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সীমাহীন অত্যাচার এভাবেই শূকরের কানের ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেছেন হেয়ার্টা ম্যুলার।

সবুজ কুলের দেশ সম্পর্কে এককথায় বলতে গেলে একে নিপীড়িতের কবিতা বলাই শ্রেয়। এই কবিতার মধ্য দিয়ে রুমানিয়ার কমিউনিস্ট জমানার আধ্যাত্মিক ও জাগতিক অবস্থার করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। জীবন সেখানে কেমন নিষ্ঠুর ও কুৎসিত ছিল তা অনুধাবন করানোই ছিল লেখকের লক্ষ্য। বইটি রুমানিয়ার লেখা হলেও প্রকাশিত হয় জার্মানি থেকে। রুমানিয়ার সংখ্যালঘু জার্মান জনগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন ম্যুলার। ১৯৮৭ সালে রুমানিয়া ছেড়ে তিনি পাকাপাকিভাবে চলে যান জার্মানিতে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ম্যুলার বলেন,

আমার মায়ের ভাষা ছিল জার্মান। রুমানিয়ায় বাস করে জার্মান ভাষায় যখন তিনি কথা বলতেন তখন তাঁর ভাষা থেকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার অবসাদ এসে আমাকে ঘিরে ধরত। তখন আমার মনে পড়ে যেত প্রাগে বসবাস করা কাফকার কথা। তিনিও তো একই বাস্তবতার মানুষ ছিলেন।

হেয়ার্টা ম্যুলাররা ছিলেন জার্মান। হিটলারের জার্মান বাহিনী রুমানিয়ায় অনুপ্রবেশের পর একটা কালো ইতিহাসের চক্রে প্রবেশ করে তাঁদের পরিবার। ম্যুলার বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন হিটলারের এসএস বাহিনীর একজন সদস্য।’ এই ইতিহাস সারাজীবন তাড়া করে ফিরেছিল হেয়ার্টা ম্যুলারকে। তাঁর সবুজ কুলের দেশ উপন্যাসের নারী চরিত্রটিতেও এমন বাস্তবতা উপস্থিত। অতীতে তার পরিবারের সদস্যদের হিটলারের প্রতি সমর্থন এখনো তাড়িয়ে ফেরে মেয়েটিকে। তাই উপন্যাসের মেয়েটি হেয়ার্টার মতোই যুদ্ধে-বেঁচে-যাওয়া ইহুদি মেয়েদের দিকে তাকাতে ভয় পায়। কারণ ইতিহাসের এক লজ্জা সে বহন করছে। তাই রাস্তায় হাঁটতে থাকা কোনো সাদা-স্কার্ফ-পরা ইহুদি মেয়ে দেখলেই কুঁকড়ে যেতে হয়। এই চোখ দিয়ে কী করে তাকানো সম্ভব কোনো ইহুদি নারীর দিকে! বস্তুত বিংশ শতাব্দীর পূর্ব ইউরোপে ক্ষমতার হাত বদল, যুদ্ধ আর হত্যার রাজনীতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে কয়েকটি প্রজন্ম। হেয়ার্টা ম্যুলারও তেমনি এক প্রজন্মের নারী। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র লোলা ও বয়ানকারী তার বান্ধবী এই উন্মাদ-জগৎকে অস্বীকার করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু হেয়ার্টা নিজে তা কখনো করার কথা ভাবেননি। নিজের অন্তর্গত শক্তিই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইতিহাসের যুগসন্ধির এই নারী সাহিত্যিক পৃথিবীবাসীর জন্য আরো নতুন সব সাহিত্য সৃষ্টি করে যাবেন এটাই আশা করেন তাঁর পাঠকরা।

Site Default

চট্টগ্রামে বসবাসরত। পেশা : লেখালেখি। জীবিকা : সাংবাদিকতা।

৩ comments

  1. আহমেদ মুনির - ৯ অক্টোবর ২০০৯ (৮:৩১ অপরাহ্ণ)

    বিডিনিউজ-এ প্রকাশিত দুটি প্রাসঙ্গিক লেখা :

    ১. নিজের একটি বই নিয়ে হেয়ার্টা ম্যুলার
    ২. হেয়ার্টা ম্যুলার-এর গল্প ‘অন্ত্যেষ্টির বয়ান’

  2. অবিশ্রুত - ১২ অক্টোবর ২০০৯ (৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ)

    কেউ লিখছেন হার্টা, কেউ লিখছেন হেয়ার্টা,- তো যেটাই হোক না কেন, আমি তাঁর নাম নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে কখনোই শুনিনি। বার্লিন প্রাচীর ভাঙনের ত্রিশ বছর (১৯৮৯-২০০৯) পূর্তি উদযাপনের সঙ্গে কি এই পুরস্কারপ্রাপ্তির কোনও সম্পর্ক আছে?
    বইটির কাহিনীকে অবশ্য ইন্টারেস্টিং-ই মনে হচ্ছে। ধরুন, রূপচর্চা,- পুজিবাদী সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে একে আমরা একেকজন কীভাবে দেখি? সেই রূপচর্চাকেই দেখছি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে ‘হস্তক্ষেপে’র ‘শিকার’ হতে। সাজগোছ ছাড়াই সে ধর্ষণের শিকারও হচ্ছে, কাহিনী-সূত্রে এরকম মনে হচ্ছে। নারীর জন্যে সমাজতান্ত্রিক সমাজও নিরাপদ নয়, এই পর্যবেক্ষণ খুব সুস্পষ্ট।
    প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ধর্ষণ ইদানিং বেড়ে গেছে। নারী সংগঠনগুলি কিন্তু এ ব্যাপারে আর আগের মতো উচ্চকিত নন। একজন নারী নেত্রী দেখলাম,সাক্ষাৎকারে বলছেন, এগুলি রাজনৈতিক ধর্ষণ নয়। তারপরও আমরা প্রতিবাদ করছি। এই-এই কর্মসূচি পালন করছি।
    কী দারুণ ভাষ্য, যেন রাজনৈতিক ধর্ষণ না হলে বোঝা ও অপরাধ অনেকটা হালকা হয়ে যায়!
    এর বিপরীতে পার্টির একনায়কত্ব রুমানিয়ায় যে-রাজনৈতিক ধর্ষণের ও বহিষ্কারেরর মধ্যে দিয়ে তা চাপা দেয়ার (এই উপন্যাসের কাহিনী-সূত্র অনুযায়ী) সংস্কৃতি চালু করেছিল, তাতে নজরদারীর প্রক্রিয়া এত সর্বব্যপ্ত হয়েছিল কেমন করে, তা কি উপন্যাসটায় তুলে আনা হয়েছে? না কি ব্যক্তির নিরিখ থেকেই যাবতীয় ঘটনাবলী বিবেচনা করা হয়েছে? ব্যক্তির অভিজ্ঞতা সর্বজনীন হয়ে ওঠার শর্তগুলি কি তেমন স্পষ্ট এতে?
    কারও বইটি পড়া থাকলে জানানোর জন্যে অনুরোধ করছি।
    আহমেদ মুনীরকে ধন্যবাদ, ম্যুলারের একটি বইয়ের সঙ্গে খানিকটা পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে।

  3. হাসিব - ১৪ অক্টোবর ২০০৯ (৫:১৩ অপরাহ্ণ)

    সঠিক উচ্চারণ “হ্যারটা ম্যুলার” ।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.