বিজয় দিবস ২০২৪: ভাবনা-দূর্ভাবনা-চাওয়া

আজকের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট এর পূর্ববর্তী ৫২টি বিজয় দিবস থেকে ভিন্ন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার মাস আগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়, রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে শুরু হয় একটা রিসেট বাটন প্রেস করার নিরলস প্রচেষ্টা। ধ্বংসপ্রায় মুক্তিযুদ্ধের বহু ভাস্কর্য এবং স্মৃতিচিহ্ন, যার বিবরণ ৯ ডিসেম্বরের সমকাল পত্রিকায় প্রতিবেদন থেকে খুবই পরিষ্কার। মুজিবনগরের স্মৃতিস্তম্ভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বর, অসংখ্য উদাহরণের মাত্র দুটি।

প্রথমেই বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ৩০ লাখ শহীদ ও ৪ লাখ মা-বোনকে, যাদের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। শ্রদ্ধা জানাই অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, যারা সমাজের বিভিন্ন স্তরে, নিজ-নিজ অবস্থান থেকে, যার যা আছে, তাই নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখেছিলেন। সব সেক্টর কমান্ডারকে জানাই আমার শ্রদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুদীর্ঘ ২৩/২৪ বছরের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফসল। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের নির্বাচন, ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ (Epic Liberation War) ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে দেশ হানাদার মুক্ত হয়, ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ পটভুমিতে রয়েছে ধারাবাহিক গণসম্পৃক্ত আন্দোলন। বিভিন্ন পর্যায়ে অগ্রপথিকের ভূমিকায় ছিলেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। একজন তরুন নেতা হিসেবে সব আন্দোলনেই সরব উপস্থিতি ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের। বিশেষত ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তাঁর ভূমিকা ছিলো সর্বাধিক সুস্পষ্ট এবং তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার অসন্দিগ্ধু প্রতিভূ। তাঁর অবর্তমানে স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস অত্যন্ত প্রতিকুল সময়ে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান। তাঁদের সবার প্রতি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা।

আজকের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট এর পূর্ববর্তী ৫২টি বিজয় দিবস থেকে ভিন্ন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার মাস আগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়, রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে শুরু হয় একটা রিসেট বাটন প্রেস করার নিরলস প্রচেষ্টা। ধ্বংসপ্রায় মুক্তিযুদ্ধের বহু ভাস্কর্য এবং স্মৃতিচিহ্ন, যার বিবরণ ৯ ডিসেম্বরের সমকাল পত্রিকায় প্রতিবেদন থেকে খুবই পরিষ্কার। মুজিবনগরের স্মৃতিস্তম্ভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বর, অসংখ্য উদাহরণের মাত্র দুটি।

বিজয় দিবসের সরকারী ব্যানারে ২০২৪ জুলাই গণঅভুত্থানে নিহত আবু সাঈদের ছবি সাঁটানো কতটা শোভন, কতটা প্রাসঙ্গিক? আবু সাঈদ কতটা শ্রদ্ধা পেলেন। বিজয় মহিমা ও গৌরবকে ছোট করতে কেন এই ব্যর্থ প্রয়াস? এসব করে কি একাত্তরকে মুছে ফেলা যাবে?

আর একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়—স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি বিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর এবং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার পর তার উপর  ইউরিনেট করা।

প্রসঙ্গত, ভারতে আজ যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, তারা মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে’র উত্তরসূরী, তাই বলে তারা গান্ধীকে দেশে-বিদেশে কোথাও অসম্মান করেনি। তেমনিভাবে বিল ক্লিনটন নিক্সনের মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁর আমলের অসামান্য অর্জনের  জন্য শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। ওয়াটার গেইট  scandal এ আবদ্ধ রাখেননি। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্রটাই এরকম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান   যাঁর কালজয়ী ৭-ই মার্চের ভাষণ আজ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, তাঁকে মুছে ফেলার প্রাণান্ত চেষ্টা। এই মুছে ফেলার চেষ্টা করে কি সত্যিই তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে? সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সম্পর্কে যে ডকুমেন্টেশন আছে, সেগুলো কে মুছবে?

দুর্নীতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে আমাদের বহু অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, এবং হয়েছে-ও তাই বহু বছর ধরে। একটা প্রশ্ন: দুর্নীতি কী? নীতির অভাব, নীতি বা নিয়ম বহির্ভূত পন্থায় কোনো কিছু অর্জন। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, তার সংবিধান, সংবিধান বহির্ভূত পথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল (Usurpation of State Power)। তারপরও কি সততার অভাবের প্রমাণের দরকার হয়? বিচারের ভার পাঠকের উপর দিলাম।

একটা সাম্প্রতিক সমস্যা, যা সীমান্তের দুপাশে ঝড় তুলেছে: মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সেরকম কিছুই ঘটছে না বা ঘটেনি, সবই কি একটি বিদেশী চক্রের সঙ্ঘবদ্ধ অপপ্রচার, যেমনটি ছিলো একজন তারকা সম্পাদকের বয়ানের প্রতিপাদ্য বিষয়? এটাই যদি হয়, তাহলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা কেন, কেনইবা সুইডেনের পার্লামেন্টে এ বিষয়টির অবতারণা? আসলে কোথাও কি আমরা কোনো রকম আত্মতুষ্টিতে ভুগছি? ১০ ডিসেম্বর ড. ইউনূসের প্রেস সচিব স্বীকার করলেন যে, সংখ্যালঘু সংক্রান্ত ৮৮ মামলায় ৭০ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ৫ আগস্ট থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এ সকল অপরাধ ঘটেছে। সুতরাং, এখানে দেখা যাচ্ছে বহির্বিশ্বে যা আলোচনা চলছে, তা কিছুটা হলেও স্বীকৃতি পেল। তাহলে Culture of Denial  কতটা কার্যকর? EU Ambassador  Michael Miller এবং EU দেশসমূহের কূটনীতিকরা ড. ইউনূসের সাথে বৈঠকে আইনের শাসন, মানবাধিকার, বিশেষতঃ সংখ্যালঘু সংক্রান্ত বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। আরও জানা যায় যে, এক্ষেত্রে তারা ২৮ দেশ থেকে এলেও, তাঁদের একই সুর এটি জানানো হয় পরিষ্কারভাবে।

 

কিছু চাওয়া

১. যথাসম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টার বক্তব্য রহস্য ঘেরা। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার তাড়াতাড়ি নির্বাচনে অনুষ্ঠানের কোন ইচ্ছা বর্তমান সরকারের নেই। যতদিন ইচ্ছা বা যতদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব সেটাই তাদের অভিলাষ এবং লক্ষ্য।

২. যতদিন অনির্বাচিত গণম্যান্ডেট বিহীন সরকার ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন বৈদেশিক বিনিয়োগ, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম; অর্থনীতির নিম্নগামীতা বাংলাদেশের মানুষের জন্য সীমাহীন দুর্গতি বয়ে আনবে।

৩. একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, যেখানে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।

৪. আইনের শাসন, mob rule  নয়।  mob rule আইনের শাসনের প্রধান অন্তরায়।

৫. সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে জুলাই-আগস্ট এবং ৫ আগস্ট পরবর্তী সব হত্যার বিচার। কোন প্রকার Indemnity  গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

৬.  মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-চিহ্ন এবং মেট্রোরেলসহ বহু রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্টকারী সব অপরাধের যথাযথ বিচার করতে হবে।

 

পরিশেষে, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা আমার পরিচয় থেকে কয়েকটি লাইন, যা আমাদের ইতিহাস এবং সংগ্রামকে ধারণ করে।

 

 

আমার পরিচয়

-সৈয়দ শামসুল হক

                        …

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে

আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে

এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে

শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?

তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই

সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।

পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-

কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।

শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;

অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;

একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;

আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান?

যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবর রহমান;

তারই ইতিহাস প্রেরনায় আমি বাংলায় পথ চলি-

চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।

  • এম.এ.ডি.পি

    বাংলাদেশের বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন। বর্তমানে অবসরে। দেশ নিয়ে ভাবেন। এখনকার নিপীড়নমূলক দমবন্ধ করা পরিস্থিতির আলোকে আপাতত ছদ্মনামে লিখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন।

    View all posts
সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

0 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.