আশংকা, গুজব, কানাকানি এবং সন্দেহের রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে বাংলাদেশ। যেখানেই চোখ রাখবেন, চারদিক ফিস ফিস। গুন গুন। চাপা আওয়াজ। কিসের যেন একটা অজানা শংকা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমার প্রিয় দেশটির মানুষগুলোকে। প্রচন্ড ঝড় শুরু হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে প্রকৃতি যেমন স্তব্ধ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি স্তব্ধ হয়ে আছে দেশটি। এক বন্ধু বলল, চারিদিকে এমন অস্বস্থি ও অসন্তোষের পরিবেশ সে আর কখন ও দেখেনি। সে বলল, জানি না কখন কি হয়…।
নির্বাচন নিয়েই এই গুঞ্জন চলছে। গুঞ্জন তখনিই বেশী হয়, যখন মানুষ সহজে কোন তথ্য জানতে পারে না। কারন এই সরকারের ভাবভংগীতে বোঝা যাচ্ছে না, তারা ঠিক কি চাইছে। এদের কিছু বাঁধা ধরা শব্দমালা যেমন ; আস্থার পরিবেশ তৈরী করা, গুনগত রাজনৈতিক উত্তরন ঘটানো, সমন্বয়সাধন করা, একযোগে কাজ করা ও সংস্কার জোরদার করা ইত্যাদি রীতিমত নাটুকে হয়ে ঊঠেছে। এদের কোনটা আসল কথা এবং কোনটা মুখের কথা বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। রীতিমত রহস্যজনক আচরন শুরু করেছেন তারা জাতির সাথে। ঊদ্বেগ বাড়ছে প্রতিমুহুর্তে, প্রতিদিনে।
আমার যতদুর মনে হয়, জনাব ফকরুদ্দিন সাহেব, এই নির্বাচনের তারিখই ঘোষনা করতে চাননি। এক বছরেরও বেশী টানা দাবীর মুখে তিনি তারিখ ঘোষনা করেছেন। কিন্ত জরুরী অবস্থামুক্ত পরিবেশে নির্বাচন হবে, এই প্রতিজ্ঞা তিনি করেননি। ইতিমধ্যে কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। এটা ছিল তাদের একটা টেষ্ট কেস। কারন, এর পরে পরেই, বর্তমান সরকার গলা ফাটিয়ে প্রচার দিচ্ছে যে, দেখ, জরুরী আইনের মধ্যেই শান্তিপূর্ন নির্বাচন সম্ভব। ফলে জরুরী আইনের আওতায় সংসদ নির্বাচন হলে কি অসুবিধা, সেটা তাদের উর্বর মাথায় প্রবেশ করছে না।
এই প্রসংগে দু’একটি কথা বলা প্রাসংগিক হতে পারে। প্রথমতঃ এই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে যে, মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ সব কিছুই নানা ভাবে হয়েছে। জরুরী আইনের অনেক বিধান লংঘিত হয়েছে। কিন্ত সরকার কোন রা করে নি। অনেকেই মনে করেন, সরকার নির্বাচন দিয়ে উদাহরন সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, ফলে তারা এখানে জরুরী আইন ভঙ্গ হলেও তাকে মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সরকারের ভাষ্য হল, লোকাল বডির ইলেকশন তো দল নিরপেক্ষ নির্বাচন। ফলে এই যুক্তির দোহাই দিয়ে সে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। কোন একশানে যায় নি। ইতিমধ্যে নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। সমান তালে রটণা ও রটে যাচ্ছে। এ দু’টোর কোন যোগ সূত্র আছে কি না তাও অনেকে খতিয়ে দেখছে।
প্রথমে দু’নেত্রীর আইনজীবিকে দিয়ে একটা চেষ্টা করানো হল, তাদের দু’জনকে এক সাথে বসানোর। বলা হচ্ছিল, সংলাপ হবে তাদের মধ্যে। দেশের মানুষ কিন্ত সত্যিই খুশি হতো যদি সে রকম কিছু হতো। যদিও তা হল না আর। কিন্ত প্রশ্নগুলো ছিল যে, কোন এজেণ্ডার ভিত্তিতে তাঁরা বসবেন। কি নিষ্পত্তি করার জন্য বসবেন। এর কোন সদুত্তর আমরা জানতে পারিনি সরকারের কাছ থেকে। এর কারন সম্ভবত; জবাবদিহিতা যখন কোন সরকারের থাকে না, তখন তারা জনগনের প্রশ্নের উত্তর দেন না বা এসব কেয়ার করেন না।
এরপর সংলাপের পুরোনো নাটক আবার শুরু হল। এবার এই সংলাপ কখনও গোপনে, কিংবা প্রকাশ্যে। সবাই দেখছে সংলাপ হচ্ছে পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনে এবং খবর শুনছে যে, সংলাপ চলছে এবং আরো চলবে। দুঃখের ব্যাপার হল, কি বিষয় নিয়ে ঠিক এই সংলাপ আয়োজন, তা আমরা কেউই জানতে পারছিনা। তথ্য অধিকার আইন হওয়ার পর তথ্য জানার অধিকার আরো কমে গেল বলেই মনে হয়, দুর্ভাগা এই দেশটিতে!
রেজিষ্ট্রেশণ করার জন্য মাত্র একদিন আছে বাকী। বিএনপি মাত্র ফরম নিয়েছে। আওয়ামী লীগ ফরম জমা দিলেও আইন অনুযায়ী অনেক অসংগতি তাদের আছে বলে খবর বেরিয়েছে। দেশের মোট ভোটারের শতকরা ৮৫-৯০ শতাংশ ভোট যারা পান, নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। সামরিক বাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তা যিনি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন তিনি বলছেন, বল এখন রাজনৈতিক দলের কোর্টে এবং এখন তারাই ঠিক করবে তারা কি করবে। সাধারন মানুষের প্রশ্ন হল, কোন ধরনের গেম খেলার জন্য নির্বাচন কমিশন কি গঠিত হয়েছিল? মনে পড়ে যায় ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদার কথা, যিনি ২২ জানুয়ারীর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহন প্রশ্নে বলেছিলেন, তারা অংশ না নিলেও ইলেকশন হয়ে যাবে। ঐ কমিশনারের কথা শুনে অনেকে মনে করছেন তারা নিজেরাও সরকারের সাথে একজোট হয়ে একটা খেলায় নেমেছেন। কখনো বল নিজেদের কোর্টে রাখেন সুবিধামত সময়ে অন্যদের কোর্টে পাঠান। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে এই ধরনের ভয়ংকর খেলার পরিনতি কি, তা ঐ কমিশনার সাহেব এখন ও আঁচ করতে পারছেন না।
বর্তমান গনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-২০০৮ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গনতান্ত্রিক সংস্কারের কাজগুলো করতে গেলে, যেমন তৃণমূল পর্যায়ে কাউন্সিল সম্পন্ন করা, নেতৃত্ব রদবদল, পুরোণো কমিটি ভেঙ্গে নতুন কমিটি গঠ্ন এবং স্থানীয় পর্যায়ে যেখানে যেখানে নেতৃত্বের কোন্দল রয়েছে সেগুলো দেখভাল করে সংগঠণের নতুন সদস্য সংগ্রহকরন ইত্যাদি আরো অনেক টেকনিক্যাল কাজ করতে গেলে একটা রাজনৈতিক দলের যে পরিমান সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করতে হয়, এবং তা এই ৬০ দিনের মধ্যে কোন রাজনৈতিক দল করতে পারবে এটা কেবল বিশ্বাস করবেন রাজনৈতিক কান্ডজ্ঞাণ বিবর্জিত কোন সরকার ও কোন নির্বাচন কমিশন। ফলে এভাবে আসলে কোন সংস্কার কাজ হতে পারে, তাও আবার একটা জরুরী অবস্থার মধ্যে, এটা ঊপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শোনা যায়নি এর আগে। ফলে, কাজীর গরু কেতাবে থাকবে কিন্ত গোয়ালে থাকবে না, এটাই হতে যাচ্ছে।
যা হোক, রটণার কথা বলছিলাম। আগামী ১৮ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন হবে, নাকি, গনতন্ত্র নির্বাসনের নতুন কোন পরিখা খনন করা হবে, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না, দেশের মানুষ। অনেকের মতে, এই সরকারের এই মুহুর্তের কয়েকটি এজেন্ডা আছে যার বাস্তবায়নের আশ্বাস না পেলে, নির্বাচন ঝুলে থাকতে পারে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে, সরকারের হিতাকাংখীরা অনেক ইংগিত দিয়েছেন। এই সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ইংগিত দিয়েছেন। ইংগিত দিয়েছেন জরুরী আইনের মধ্যেই জন্ম লাভ করা কয়েকটি ইচরে পাকা শিশু রাজনৈতিক দল। অনেকে মনে করেন, এরা ছোট মুখে বড় বড় কথা বলছেন। যেমন, তারা বলছেনঃ
১। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে।
২। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বাতিল বা সংশোধন করতে হবে।
৩। গুরুতর দুর্নীতির মামলাগুলো নির্বাচনের আগেই নিষ্পত্তি করতে হবে।
এ ছাড়া, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠণের কথাও তারা বলছেন। মনে হয়, এই দাবীগুলোর মর্মার্থ অনেক গভীরে। বাংলাদেশের মাটির নীচের সম্পদের দিকে যাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে, বাংলাদেশের সস্তা কিন্ত দক্ষ শ্রমের বাজারের দিকে শকুন দৃষ্টি যাদের পড়েছে এবং বাংলাদেশে যারা দক্ষিন এশিয়ার একটা সামরিক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা নির্মানের স্বপ্ন দেখেন সেই বিদেশি শক্তিগুলো এখন অনেক সক্রিয় এদেশে। বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে তারা নিরন্তর। এদেরই লোকজন এখন ক্ষমতায় আছে। তারা চায় পার্লামেণ্ট ক্ষমতাহীন হোক। জনগন রাজণীতি বিমুখ হোক। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং খোলামনে নিজের মত প্রকাশের স্বাধী্নতা ইত্যাদি না থাকুক। ভয় এবং আতংকের শাসন থাকুক। নির্বাচন হলেও যাতে জনগনের কাছে ক্ষমতা না থাকে এজন্য একটা শৃঙ্খলিত পার্লামেণ্ট জরুরী হয়ে পড়েছে। সেটাই সবচেয়ে ভাল অপশণ তাদের জন্য। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে কি জলপাই শাসনের দিকে যাবে দেশ? নাকি জনগন নিজেই নিজের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে নেবে।
