আমাদের দেশের প্রতিটি টেলিফোন এবং মোবাইলের ইনকামিং ও আউটগোয়িং কলে এখন থেকে সরকার কান পাতার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ২৩ আগষ্ট ২০০৮ থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকার চাইলে যে কোন নাগরিকের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থেকে শুরু করে সবকিছু শুনতে ও রেকর্ড করে রাখতে পারবে। এখানে দেখুন। এটি কেউ দ্বিমত করবে না যে, এই সিদ্ধান্ত আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সরাসরি লংঘন। অনুচ্ছেদ-৪৩।
পতিত চারদলীয় জোটের দুঃশাসনামলে ২০০৫ এর ডিসেম্বরে বর্তমান রাষ্ট্রপতির হাত দিয়ে এ সংক্রান্ত একটি অর্ডিন্যান্স পাস হয়। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে ঐ অর্ডিন্যান্সকে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে (অনেকটা গায়ের জোরের মত আর কি!) আইনে পরিনত করা হয়। এর প্রতিবাদে সারা দেশে ব্যাপক নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। দেশের সোশিও-পলিটিক্যাল গ্রুপ থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রত্যেকেই জোর আপত্তি জানাতে থাকে। অবশেষে, বিষয়টি হাইকোর্টে গড়ায়। আমাদের দেশের কিছু বিবেকবান মানুষ জনগনের পক্ষে ও জনগনের স্বার্থে এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রীট আবেদন করেন। একই বছরের মে মাসে রীটের প্রাথমিক শুনানী (মোশন) শেষে মহামান্য হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ‘ঐ আইন কেন সংবিধানের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী হবে না’ তা জানতে চেয়ে রুল নিশি জারী করেন। আজো সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। আর বর্তমানে জরুরী আইনের কারনে হাইকোর্ট তা শুনানী করতে পারছে না। এখানে দেখুন।
দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান স্বৈর-সরকারের আইন উপদেষ্টা জনাব এ এফ হাসান আরিফ তখন এই কালো আইনের বিরুদ্ধে তার ক্লায়েন্টের পক্ষে হাইকোর্টে লড়েছিলেন। আজ তার মন্ত্রনালয়ের হাত ধরে এই বর্বর সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে। পরিস্থিতির সু্যোগে। কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেষ্ট বলে একটা কথা ছিল। এখনো আছে বলে জানি। অন্ততঃপক্ষে moral এবং ethical গ্রাউন্ডে তিনি এ বিষয়ে ব্যক্তিগত আপত্তি দিতে পারতেন। চরিত্রের এতটুকু দৃঢ়তা তিনি দেখিয়েছেন তেমন কোন খবর এখনো পাইনি।
কোন গুরুতর অপরাধ দমন বা নিয়ন্ত্রন করার জন্য সুনির্দ্দিষ্ট কোন তথ্য ও অভিযোগের ভিত্তিতে কোন ব্যক্তি বা বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর উপর এ ধরনের নজরদারী করা যায়। যদিও তা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের আইন আছে। যা শুধু সন্দেহভাজন গ্রুপ বা ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যায়।
আমাদের দেশে যেখানে তদন্তের প্রয়োজনে, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থা সাধারন আইন অনুযায়ী আলামত হিসেবে ফোন কল সহ সকল ধরনের ডাটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চাইতে পারেন সেখানে পুরো জাতির ব্যক্তিগত ও একান্ত যোগাযোগের স্বাধীনতার উপর এই বর্বর হস্তক্ষেপ কেন হচ্ছে এবং সবার টেলিফোনে কান পাতার সাথে সন্ত্রাস দমনের সংযোগ কোথায় আমরা বুঝতে পারছি না। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ এ ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানাভাব চাইলে দূর করতে পারেন।
গনতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত ঐকমত্য ও প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচীর মাধ্যমে এ ধরনের যে কোন সামাজিক ব্যাধির মোকাবেলা করতে হয়। আমার বিশ্বাস, অনেকেই একমত হবেন যে, যেখানে এই সরকার নিজেই একটা ব্যাধি সে তো কোন রোগ সারাতে পারে না, বরং বিস্তার ঘটাতে পারে। বেশিদূর যেতে হবে না, পাকিস্তানের সামরিক শাসনের পর্যায়গুলো দেখলেই বোঝা যায় কিভাবে সামরিক বাহিনী সেখানে গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দশকের পর দশক জুড়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সেখানে জংলী শাসন চালিয়ে মানুষের মনকে পংগু-অসাড় করে দেয়া হয়েছে। ফলে, একই পন্থা নেয়ার কারনে সাধুবেশী এই interim সরকারের কোন কোন কার্যকলাপে শয়তানী চেহারা ভেসে উঠছে, এটা এখন আর লুকোনো যাচ্ছে না। কারা এদের মূল মদদদাতা তাও জনগন দেখছে। অসহ্য চোখে।
সরকার যে ভাবে এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে তাতে মনে হয় দেশ সুদ্ধ মানুষকেই এরা সন্দেহ করছে। যে কারনে তারা জরুরী আইন প্রত্যাহার করতে চায় না। মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে চায় না। যদি মৌলিক অধিকার মানুষ ফিরে পায় নিশ্চিত বলা যায়, অন্তত পক্ষে ক্ষমতার সীমালংঘনের দায় থেকে এই উপদেষ্টা পরিষদের কেউই নিস্তার পাবেন বলে মনে হয় না। মোহ মুক্তি ঘটছে মানুষের। আপনাদের ভন্ডামী ধরা পড়ে যাচ্ছে। দেশ সুদ্ধ মানুষ আপনাদেরই উল্টা সন্দেহ করতে শুরু করেছে। সুতরাং সাধু সাবধান!
