২৮ জুলাই ২০০৮; সাধারণ একটি দিন। ওইদিন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। সেই মানববন্ধনে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ আলী আমান, যিনি সম্প্রতি নিগৃহীত হন মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার জামাতিদের সমাবেশে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে। আরও ছিলেন ড. আনোয়ার হোসেন, যাকে ১১ জানুয়ারিতে ক্ষমতাদখলকারী সেনাবাহিনীর সদস্যরা ‘আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নই’ বলে আশ্বস্ত করে নির্যাতনের নিকৃষ্টতম স্থান ব্ল্যাকহোলে নিয়ে গিয়েছিল।
মানববন্ধন হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ আলী আনাম ও ড. আনোয়ার হোসেন তাতে যোগ দিয়েছিলেন, এসবও সাধারণ ঘটনা। কিন্তু এইসব সাধারণ ঘটনা ও সাধারণ দিনটি অনন্য হয়ে ওঠে আর এক ঘটনার সূত্রে। এর কিছুদিন আগে ড. আনোয়ার হোসেনের অফিসে ক্যুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে একটি চিঠি এসে পৌঁছে। চিঠিটি ছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের দুর্নীতি আর অনিয়ম নিয়ে। চিঠিটি পাঠিয়েছেন বেনামী একজন। তাতে ওই দুর্নীতি আর অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে আবেদন করা হয়েছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রধান বরাবর। একইসঙ্গে এর অনুলিপি পাঠানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে এবং ডিজিএফআই-য়ের দপ্তরে। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতেও অনুলিপি পাঠানোর উল্লেখ রয়েছে আবেদনটিতে। সেনাপরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কথাবার্তা ও তৎপরতা হয়তো এই ব্যক্তির মনে আলোড়ন তুলেছিল। তাই তিনি চোখের সামনে একটি বড় ধরনের দুর্নীতি দেখতে পেয়ে আর চুপ থাকতে পারেননি। তবে পুরোপুরি ভরসাও পাননি, তাই কেবল সরকারকে জানিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি, একইসঙ্গে তা অবগত করেছেন প্রথম আলো পত্রিকাকে। কিন্তু তারপরও বোধকরি তার সংশয় কাটেনি, আস্থার সংকট রয়েই গেছে, তাই একটি অনুলিপি পাঠিয়েছিলেন ড. আনোয়ার হোসেনকে।
মানববন্ধনের সমাবেশে সাহসের আর এক প্রতিকৃতি মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ আলী আমানসহ আরও অনেকের সামনে আনোয়ার হোসেন সবাইকে এই চিঠির কথা জানান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সামরিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কথা। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নাসির হোসেনের নেতৃত্বে সেখানে মেজর তরিকুল, মেজর কুদ্দুস, ক্যাপ্টেন আরিফ, ক্যাপ্টেন মঈন আর ক্যাপ্টেন দেলোয়ার গড়ে তুলেছেন চাঁদাবাজির রাজত্ব। ব্যবসায়ী, ইম্পোর্টার, স্টক হোল্ডার এবং চট্টগ্রামের সিএনএফ এজেন্টদের কাছ থেকে এরা চাঁদা হিসেবে এর মধ্যেই হাতিয়ে নিয়েছে ১৫ কোটি টাকা।
এর পাশাপাশি আরও একটি ঘটনা মনে পড়ছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে পাঠানো হয়। এখবর জানতে পেরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী বাংলাদেশিরা। কিন্তু সেই ক্ষোভের মুখেও গেল সপ্তাহে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর নিয়োগ চূড়ান্ত করেছেন বাংলাদেশ সরকার। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মিশনগুলিতে পেশাদারি কূটনীতিক নিয়োগের বদলে আবারও রাজনৈতিক কারণে প্রেষণে কূটনীতিক নিয়োগের ধারা চালু হতে চলেছে। এইভাবে দেখা যাচ্ছে, ১১ জানুয়ারির পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী পুনরায় একরকম প্রকাশ্যেই বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
পৃথিবীতে এমন কয়টি দেশ আছে, যেখানে সেনাবাহিনী শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে তার আগে ‘দেশপ্রেমিক’ বিশেষণ জুড়ে দিতে হয়? এমন কয়টি দেশ আছে, যেখানে এই মনস্তাত্বিক ধারণা তৈরি করার চেষ্টা চলে যে দেশটির জনগণ, রাজনীতিক বা অন্য কোনও স্তরের মানুষই দেশপ্রেমিক নয়, দেশপ্রেমিক কেবল সেখানকার সেনাবাহিনী? বোধকরি বাংলাদেশই একমাত্র সে-ধরনের দেশ। আর সে দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাল হলো এই যে, চামে চামে তারাও চাঁদাবাজি করে এবং সেই চাঁদাবাজি করার জন্যেই তাদের কয়েক বছর পর ‘রাজনীতিকরা দুর্নীতিবাজ’ শোর তুলে ক্ষমতা কব্জা করতে হয়। আর সেনাবাহিনীর এই হাল হওয়ার পেছনে যেমন জিয়াউর রহমানের অবদান রয়েছে, তেমনি অবদান রয়েছে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের। তারা সামরিক শাসনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন, সামরিকতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনখাতের সঙ্গে যুক্ত করে ঠেলে দিয়েছেন সশস্ত্র দুর্নীতির দিকে।
দুই.
২৮ জুলাইয়ের মতো আর একটি দিন ২৮ আগস্ট। এদিনটিও বাংলাদেশে বিশেষ একটি দিন হয়ে উঠেছে আর একটি কারণে। এইদিনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত জেল হত্যা মামলা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও চিহ্নিত সব আসামীকে অব্যাহতি দেয়; অথচ ঠিক একই দিনে সেখানকার একটি সাব-জেলে বসে কয়েক ঘন্টা ধরে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন খালেদা জিয়া, মুজাহিদ আর খোন্দকার। ব্যাপারটি কি কাকতালীয়? না পরিকল্পিত? যেটাই হোক না কেন, এই ট্র্যাজেডি আর কমেডির সহাবস্থানই বলে দিচ্ছে দেশটির ভবিষ্যত রাজনীতি কেমন হবে।
কেবল জেলহত্যা মামলা নয়, বাংলাদেশের অনেক মামলার অবস্থাই এখন এরকম। কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে উচ্চ আদালতে জামিনে মুক্তির ঝড় বয়ে গেছে। আমরা সেখানে দেখেছি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে একের পর এক দানব বের হয়ে আসতে। মাঝখানে অনেকদিন এসব দানবদের কারাগারে রাখার নামে কাউকে কাউকে আলাদা বাসভবন তৈরি করে, কাউকে কাউকে চিকিৎসার নামে হাসপাতালের জৌলুসময় কক্ষে, কাউকে কাউকে কারাগারেই দুধকলা দিয়ে রাখা হয়েছিল। তাদের দানবিক চেহারা এতই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল জনগণের সামনে যে সেই চেহারাকে সার্জারি করে মানবিক চেহারা দেয়ার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে বুর্জোয়া রাজনীতিকরা যখন ন্যুনতম গণতান্ত্রিক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক শর্ত প্রতিষ্ঠার নামে বরং দলবাজির মাধ্যমে দানবিক হয়ে ওঠে, তখন তাদের মানবিক চেহারা দেয়ার মহান দায়িত্ব পালন করার কাজটি পালন করতে এগিয়ে আসে সে দেশের সামরিক বাহিনী। কেননা সামরিক বাহিনীই হলো এসব দেশের বুর্জোয়া রাজনীতির সবচেয়ে সংঘটিত প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষক বাহিনী। দানব যখন দেখে যে তার দানবিক রূপ দেখতে দেখতে জনগণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দ্রুত তারা বিকল্পপথে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে পারে, তখন তারা নিজেরাই বিকল্প তৈরির নামে নানা ভড়ং তৈরি করতে থাকে। এই বিকল্পগুলির সর্বশেষ পন্থাটি হলো দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় সাময়িক সময়ের জন্যে সামরিক বাহিনীকে নিয়ে আসা। আর সামরিক বাহিনীও এ জন্যে তৈরি হয়েই থাকে, তারা যথারীতি এগিয়ে আসে এবং বলে, গণতন্ত্র একটি বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। আমরা সব কিছু ঠিকঠাক করে আবার জায়গামতো ফিরে যাব। তারপর ঈদের আগে বাস, ফেরি কিংবা রেলকাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে যেভাবে নির্বিচারে লাঠিচার্জ করা হয়, ঠিক তেমনি ভাবে তারা কিছুদিন রাজনীতিকদের নির্বিচারে দুর্নীতিবাজ, মতলববাজ, দেশের শত্রু ইত্যাদি বলে জনগণের মনের ক্ষোভ প্রশমিত করে এবং শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, আসল ঘটনা হলো ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’।
একটি দেশে একটি সংবিধান থাকে। রাজনীতিকদের দেশ শাসন করার কথা সেই সংবিধান অনুযায়ী। রাজনীতিকরা যখন সংবিধান লংঘন করেন কিংবা করতে উদ্যত হন, তখন সংবিধান রক্ষার জন্যে নিয়ে এগিয়ে আসার দায়িত্ব জনগণ সর্বাগ্রে কাদের হাতে অর্পন করে থাকে? এককথায়, বিচার বিভাগের ওপর। কিন্তু খুব অস্বস্তি নিয়েও এ প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কি কখনও এ দায়িত্ব পালন করেছে? ১৯৭৫ সালে যখন সামরিক শাসন জারি করা হলো তখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার জন্যে আমরা দেখেছি একজন বিচারপতিকে কালো ছাতার কাপড় গায়ে চাপিয়ে কোমরে বেল্ট পরে এগিয়ে আসতে। একই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আরও কয়েকজন বিচারপতি। আর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন তো এতই নিষ্ঠুর নিম্নমানের সাধারণ মানুষ যে নিচের প্রধান বিচারপতির পদ ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজনীতিকদের বাধ্য করেছেন সংবিধান সংশোধন করতে! প্রধান বিচারপতিরাও যে দুর্নীতিবাজ হয়ে থাকেন যে দৃষ্টান্তও রেখে গেছেন জোট সরকারের এক প্রধান বিচারপতি। বিচারপতিরাও যে কত নিকৃষ্ট দুর্নীতি করতে পারে তার দৃষ্টান্তও তৈরি করেছেন এক বিচারপতি (ওরফে প্রাক্তন এক উপদেষ্টা)। দেশে যতবার সংবিধান স্থগিত হয়েছে, যতবার একের পর এক অবৈধ অধ্যাদেশ জারি হয়েছে ততবারই আমরা দেখেছি, বিচার বিভাগকে আহ্লাদিত চিত্তে সেগুলির বৈধতা দেয়ার জন্যে এগিয়ে আসতে। কখনওই তারা বেঁকে বসেনি, বলেনি, সংবিধানকে এভাবে কাটাছেঁড়া করা অন্যায়।
অনেকে বলতে পারেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল না। কিন্তু পরাধীন থেকেও কি কেউ উচ্চকণ্ঠ হতে পারে না? বিদ্রোহী হতে পারে না? এরকম দৃষ্টান্ত তো ইতিহাসে অজস্র রয়েছে। আর বিচার বিভাগের স্বাধীন রূপও তো আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে। জেলহত্যা মামলার রায়ের অবস্থাই বলে দিচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাধীন বিচার বিভাগ কেমন আছে। বিচার বিভাগের এই স্বাধীনতার ঠেলায় তারেক রহমান একদিনে একদিনে পাঁচটি মামলায় জামিন পেয়েছেন। এবং বিষয়টি দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে বুঝতে পেরে সরকারপক্ষ পুনরায় আপিল করে জনগণের সামনে নিজের একটা ‘সুফি সুফি ভাব’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই জানেন, জুন ২০০৮-এ উইলটন পার্ক কনফারেন্স হয়েছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে। এ কনফারেন্সের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ও উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা। তারপর জুলাই ২০০৮ থেকে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা থেকে পরিষ্কার যে, দুদক ও টিআইবি-র কথিত দুর্নীতিবিরোধীরা যাই বলুন না কেন, দুদকের ওপর বাংলাদেশের মুখচেনা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাষায় বলতে গেলে, রাজনীতির শেষ অঙ্ক শুরু হয়েছে সেখানে। সাকা চৌধুরী মুক্তি পাওয়াতে তাকে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছেন পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী,- বোধকরি এ থেকেই টের পাওয়া যায় কেমন হচ্ছে রাজনীতির সেই শেষ অঙ্ক!
তিন.
শেয়ালের লেজ কাটা গেলেও যেমন তার ডাক শুনলেই বোঝা যায়, আসলে সে কী, ঠিক তেমনি ১১ জানুয়ারির পর সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সুশীল সমাজকে সামনে রেখে যা-ই করুক না কেন, বোঝাই যাচ্ছিল শেষ পর্যন্ত আসলে কী ঘটবে। বোঝাই যাচ্ছিল, সামরিকতন্ত্র যতই সুশীলদের ময়ুরপুচ্ছ লাগাক না কেন, শেষ পর্যন্ত আবারও নিদারুণ এক গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে নিপতিত হবে জনগণ। এতদিনে এসে তাই দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান লিখছেন, বর্তমানে যে এমন একটি পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তার কারণ এই-যে, সামরিক বাহিনী আর সুশীল সমাজের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন কারণে সুশীল সমাজ আর সামরিক বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, তাই তারা পিছু সরে আসছে। প্রশ্ন, হলো পৃথিবীর কোথায় এমন সুশীল সমাজ আছে, যারা এইভাবে সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়? বাংলাদেশের সুশীল সমাজ নিজেদের বিকশিত করার জন্যে এনজিও-নির্ভরতার যে-দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা তাদের জনগণ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং তারা জনগণ থেকে ছিটকে পড়েছেন। এবং বোঝা যাচ্ছে, এখন সুশীল সমাজ আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়ে বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক দুরবস্থার জন্যে কেবল সেনাবাহিনীর ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এটি মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্যে কেবল সেখানকার সামরিক বাহিনীই নয়, সুশীল সমাজও সমান দায়ী।
একটি দেশ গণতান্ত্রিক হলেও সেখানে অনেক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকতে পারে। যেমন, ভারতে অনেক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক পশ্চাতপদতা থাকার পরও দেশটি একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট, তারা গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে সমার্থক মনে করেন। এবং সে জন্যে তারা সবসময় হরতাল, মিছিল ইত্যাদির বিরুদ্ধে মারমুখো ভূমিকা দেখিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের দোদুল্যমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী সুশীল সমাজের সস্তা কথাবার্তায় খুব আশান্বিত হয়ে উঠেছিল এবং অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্র ও জনমুখী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। এ প্রসঙ্গে আহমদ ছফার পুরনো কথাটিই আবার বলতে হয়, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে দেশ স্বাধীন হতো না, আর এখন যা বলছেন, তা শুনলে দেশ গড়া যাবে না।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান তাঁর এই আলোচনাটি লিখেছেন বাংলাদেশের ট্রান্সকম মিডিয়া থেকে প্রকাশিত ইংরেজি মাসিক পত্রিকা ফোরাম-এর চলতি সংখ্যাতে। সেখানে তিনি বলেছেন, ১১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারের ভেতরে-বাইরে যা ঘটছে তা থেকে দুটি জিনিস শেখবার রয়েছে। একটি হলো, সংস্কারের জন্যে সরকারের ভেতরে ও বাইরে উভয় স্থান থেকেই সহযোগীর প্রয়োজন রয়েছে এবং তা ওপর থেকে আমলতান্ত্রিক কিংবা টেকনোক্র্যাটিকভাবে চাপিয়ে দিলে চলবে না বরং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় করতে হবে। দ্বিতীয় শিক্ষাটি হলো, শুধু ব্যক্তি নয়, সংস্কারের জন্যে প্রয়োজন ব্যবস্থার পরিবর্তন।
খুবই ন্যায্য ও সঙ্গত কথাবার্তা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই শিক্ষা নেবার জন্যে বাংলাদেশের সুশীলদের কী প্রয়োজন ছিল সেনানিয়ন্ত্রিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠার? কী প্রয়োজন ছিল কোটি কোটি মানুষকে বাক-স্বাধীনতাহীন অবস্থায় রাখবার? ইতিহাস থেকে বহু আগেই তো এ দুটি শিক্ষা মানুষ অর্জন করেছে। ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি যে দুই সমকোণ, এটি কি নতুন করে আবার গবেষণা করে প্রমাণ করার প্রয়োজন রয়েছে?
ট্র্যাজেডি হলো, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী বুদ্ধিজীবী সুশীলদের ওপরেই বেশি আস্থা রাখে। কিন্তু এই সুশীল বুদ্ধিজীবীদের যতটুকুও বা সততা ও প্রগতিশীলতা ছিল ১১ জানুয়ারির মধ্যে দিয়ে তা পুরোপুরি খসে পড়েছে। এই দু বছরে সুশীল সমাজ একেবারে প্রত্যক্ষ প্রমাণ রেখেছে, মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে, জাতিকে পথ দেখানোর ক্ষেত্রে তারা আসলে একেবারেই অনুপযুক্ত। তাদের কথা শুনলে সত্যিই দেশ চলবে না এবং তারা কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন।
বাংলাদেশে ১১ জানুয়ারিকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে সেখানকার বেশ কিছু মিডিয়া। এইসব মিডিয়ার কোনও কোনওটি এখন আবার প্রশ্নবিদ্ধ তাদের প্রতিষ্ঠা ও উত্থান নিয়ে। বাংলাদেশের মিডিয়াতে কারা বিনিয়োগ করছে তা নিয়ে বেশ কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটে। আর বাংলাদেশে সেই রিপোর্ট প্রকাশ করায় আদালতে মামলা হয়েছে জোটপন্থী একটি সংবাদপত্রকে। মিডিয়ার এসব নগ্ন বিরোধ বাংলাদেশের জনগণকেও নানাভাবে বিভ্রান্ত করছে। এসব মিডিয়ার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে ‘গোপাল বড় ভালো ছেলে’ জাতীয় একটি সুশীল সমাজ এবং পরিবর্ধিত তরুণ সুশীল সমাজও গড়ে উঠেছে, যারা সুশীল রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রচার করে চলেছেন; কোটি কোটি টাকার মুনাফা কামাচ্ছে এইসব কোম্পানিগুলো, তারপর সেরা রাধুনি, সেরা লেখক, সেরা তারকা কিংবা সেরা গায়ক-গায়িকা বা নতুন মুখ ইত্যাদির অনুসন্ধান ও নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বোকা বাক্সের সামনে বসে থাকা ব্যাপক মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কব্জা করে ফেলেছে এরা। পুরস্কারের মোহগ্রস্ত তরুণ প্রজন্ম ও তাদের অভিভাবকদের কল্যাণে তাদের সমস্ত অন্যায়ই জায়েজ হয়ে যাচ্ছে। কবি সুকান্ত লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি…’। কিন্তু এখন আঠারো বছরের তরুণরা যাতে প্রতিবাদী চোখ তুলবার বদলে লোলুপ চোখ তুলে তাকাতে শেখে তারই আয়োজন চলছে সেখানকার কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছে বিকিয়ে যাওয়া সুশীলদের তত্ত্বাবধানে।
এই সুশীলদের একটি অংশ গত সপ্তাহে লন্ডন এসেছিলেন। আবহাওয়া পরিবর্তনসংক্রান্ত ‘ফোকাস বাংলাদেশ’ নামের একটি সম্মেলনে যোগ দেয়াই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। মাত্র একদিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসেছিলেন অর্থ উপদেষ্টা মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষর সহকারী রাজা দেবাশীস রায়সহ ৩৯ জনের বিরাট একটি দল। এই বিরাট দলের খরচ যোগাতে হয়েছে সরকারকেই। মাত্র একদিনের সম্মেলনে এত বড় দল আসার প্রয়োজন কি সেটা একটি বড় প্রশ্ন। তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, একটি অরাজনৈতিক, অনির্বাচিত সরকার এ ধরণের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী সম্মেলন করার অধিকার কতটুকু রাখেন। কিন্তু এই প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করার মতো সুশীলের সংকট পড়েনি। তাই সরকারি এ-দলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্যে পাওয়া গেছে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে। অংশগ্রহণের জন্যে পাওয়া গেছে পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাতকে এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বুদ্ধিজীবী প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে! এদের মধ্যে একজন আবার আলোকিত মানুষ গড়ার কাজ করেন, যদিও র্যাবের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেন। যে-মানুষটি আলোকিত মানুষ গড়ার কথা বলেন, সে মানুষটি র্যাবের হত্যাকাণ্ডকে কীভাবে সমর্থন করেন! এমন আলোকিত মানুষ আছেন বলেই বাংলাদেশের অবস্থা এখন এমন।
চার.
বাংলাদেশে ২০০৬-এর শুরুর দিকে সেনাপতি মইন উদ্দিন আহমেদকে বলতে শোনা গিয়েছিল, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই, তারা শুধু লাইনচ্যুত ট্রেনটিকে লাইনে তুলে দিতে এ সরকারকে সাহায্য করছেন। অনেকেই তার এ কথা বিশ্বাস করেছিলেন! সেনাপতির এ-কথা মানলে এটাও মানতে হয়, যে-সব ঘটনা ঘটছে তার সবই ওই লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তুলে দেয়ার প্রক্রিয়াগত ও প্রক্রিয়াজাত মাত্র।
কিন্তু লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তোলার জন্যে বাংলাদেশের সেনাপতি ও বিচারপতিরা যা করে চলেছেন কিংবা অতীতেও তারা যা করেছেন, তা থেকে কি আমরা একটা প্রশ্ন তুলতে পারি? আমরা কি জানতে চাইতে পারি, লাইনচ্যুত সেনাপতি আর বিচারপতিদের লাইনে তুলবে কে? তাদের বিচার করবে কে? আদৌ কি সম্ভব এইসব লাইনচ্যুত সেনাপতি, বিচারপতি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের লাইনে টেনে তোলা?
১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮
অবিশ্রুত
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৩ comments
অলকেশ - ২৭ অক্টোবর ২০০৮ (১২:২৪ পূর্বাহ্ণ)
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন তথ্য জানলাম এই লিখাটি পড়ে। সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন অবিশ্রুত। কোন এক সময়, আবার এই দরকারী আলোচনায় প্রবেশের ইচ্ছা রইল।
অবিশ্রুত - ৩১ অক্টোবর ২০০৮ (১০:৪৪ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ, এ লেখার আলোচনার স্বার্থে নয়, আমাদের দেশ-সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্বার্থেই এসব নিয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে উঠেছে। আপনার আলোচনা বা আলাদা লেখার প্রত্যাশা করছি।
ইনসিডেন্টাল ব্লগার - ২৭ অক্টোবর ২০০৮ (১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
লেখককে ধন্যবাদ। এ বিষয়ে এ লেখাটিও সম্ভবত প্রাসঙ্গিক : Of Generals and Judges
অবিশ্রুত - ৩১ অক্টোবর ২০০৮ (১০:৪১ অপরাহ্ণ)
সম্ভবত নয়, নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক। এর একটি বাংলা সংস্করণ বোধকরি অনেককে স্বস্তি দেবে। ব্যবস্থা করা যায় কি?
ইনসিডেন্টাল ব্লগার - ১ নভেম্বর ২০০৮ (১১:৪৩ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ অবিশ্রুত। আমার পোস্টটি বেশ কিছুদিন আগের, এতদিনে আদালত পাড়ার অবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, পরিমানগত অর্থে হলেও। তবে সময় করে চেষ্টা করবো একটা বাংলা সংস্করণ বের করার। আপনার লেখাটির পরিসর বরং অনেক বেশী সাম্প্রতিক এবং বিস্তৃত। আমার ভাল লেগেছে। এমন লেখা আরো চাই।
আপনার প্রোফাইল পরিচিতিটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, এ শুধু ছদ্মনামে লেখার সেই দিনগুলোর স্মরণেই নয়, আমরা যেন সেই দিনগুলোই আবার পার করছি।
নীড় সন্ধানী - ২৭ অক্টোবর ২০০৮ (৯:১৪ পূর্বাহ্ণ)
পুরো লেখা জুড়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যেভাবে সবাইকে তিনহাত নিলেন মনে হলো বাংলাদেশে আস্থা রাখার একজনও অবশিষ্ট নেই। মানুষ হিসেবে নির্ভূল কেউই ভুলত্রুটির উর্ধ্বে না। কিন্তু যেভাবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন, আবদুল্লাহ আবু সাঈদ সহ সবাইকে ধোলাই করলেন তাতে আমি কৌতুক বোধ করছি।
দেশের মানুষগুলোর প্রতি আরেকটু পজিটিভ হওয়া যায় না? আমরাতো আস্থাহীনতার সংকটে আছি অনেকদিন ধরেই। কিন্তু যে কয়েকজনের উপর আস্থা অবশিষ্ট ছিল আপনি তাদেরকেও তুলোধুনো শুরু করলেন। এত অবিশ্বাস নিয়ে দেশে বাস করবেন কী করে। সারাক্ষন তো মনোঃকষ্টে থাকতে হবে।
লেখার বেশীরভাগ অংশজুড়ে তথ্যের চেয়ে আবেগ ও তত্ত্বের প্রাধান্য বেশী বলে আমি ওসব নিয়ে অর্থহীন তর্কে যাচ্ছি না। ওরকম গরম তত্ত্বকথা যৌবনেই বিশেষতঃ ১৮+ বয়সেই মানায় বেশী। কিন্তু বয়সকালে যখন বাস্তবতার মুখোমুখি হবেন তখন দেখবেন এসব তত্ত্বের কোন অস্তিত্ব নেই সেখানে। প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় বাঁচতে হয় আমাদের।
এক জায়গায় নীচের লাইনগুলো চোখে পড়লো। এখানে কিছু বলি।
পুরোপুরি ভিত্তিহীন একটা বক্তব্য। হলুদ সাংবাদিকের রিপোর্টের মতো লাগলো। আমি দীর্ঘকাল আমদানী-রপ্তানী বানিজ্যের সাথে সরাসরি কাজ করি। তাই এখানে দুর্নীতি কোথায় কোথায় হয়, তা প্রত্যক্ষভাবেই জানার সুযোগ আছে আমার। সত্যি বলতে কি প্রতিদিনকার কাজে সেনাবাহিনীর দুর্নীতির আভাষ পাইনি। তবে কেউ কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্নীতি করতে পারে। সবাই তো আর ফেরেশতা নয়। কিন্তু এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে সেনাবাহিনী বন্দরে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এটা সম্ভবতঃ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। গনতান্ত্রিক আমলে একটা জাহাজের যেখানে ১২ দিন লাগতো চট্টগ্রাম বন্দরে এই সরকারের আমলে তা নেমে আসে ২ দিনে। কাস্টমসের দুর্নীতি হয়রানি বন্ধ করার জন্য পুরো সিষ্টেমকে অটোমেশানের মধ্যে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। কাস্টমসের বাড়া ভাতে ছাই দিচ্ছে বলে দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাগন অসন্তুষ্ট। তাদের কেউ বেনামীতে এরকম চিঠি দিতে পারে।
তবে সেনাবাহিনীর যেখানে যেখানে দুর্নীতিগুলো হয় তার উপর কোন তথ্য দেখলাম না। ফলে মনে হলো লেখকের কাছে সেনাবাহিনীর বাস্তব দুর্নীতির কোন খবর নেই। আমার কাছে কিছু আছে। পরে অন্য পোস্টে লেখার আশা রাখি। আমি সেনাবাহিনীর ভালো অংশের সন্ধান যেমন পেয়েছি, তেমনি খারাপ অংশেরও। তাই ঢালাওভাবে সবাইকে খারাপ বলাটাকে মেনে নিতে পারি না।
ধন্যবাদ আপনাকে।
অবিশ্রুত - ২৭ অক্টোবর ২০০৮ (৮:৪৭ অপরাহ্ণ)
ঠিকই বলেছেন, নীড়সন্ধানী, লেখাটিতে আবেগ হয়তো বেশি। কিন্তু চারপাশে যা ঘটছে, তাতে নিরাবেগী থাকার সুযোগই বা কোথায় বলুন!
আপনি কৌতুক বোধ করায় আমিও আনন্দবোধ করছি, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য আপনাকে হাসির খোরাক যোগাতে পেরেছি বলে। এ লেখায় যদি বেশি তথ্য থাকত তা হলে আপনি এই কৌতুক কি খুঁজে পেতেন?
যাই হোক, একটি ব্যাপার। আপনি যে কোটেশানটুকু দিয়েছেন, তা যদি আরও এক লাইন আগে থেকে দিতেন, তা হলে হলুদ সাংবাদিকতার দায়িত্বটা আমার কাঁধে বর্তাতো না।
হতে পারে, এই সূত্র ভুল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটি প্রকাশ্যে সমাবেশে বলা হয়েছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশে একটি স্পর্শকাতর সময় চলছে, যখন প্রকাশ্যে এ-জাতীয় অভিযোগ এনে কেউ অহেতুক ঝামেলা তৈরি করতে চাইবে না।
হ্যাঁ, এগুলিকে ব্যক্তিগত দুর্নীতিও বলা যায়। হতে পারে এই অভিযোগ অসন্তুষ্ট দুর্নীতিবাজদের কাজ। হয়তো আপনার দাবিই ঠিক, পুরোপুরি ভিত্তিহীন একটি বক্তব্য। কিন্তু সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল করাটা? এটিকে যদি বড় ধরনের পতন হিসেবে বিবেচনা করার মানসিকতা না থাকে, তা হলে অবশ্য এই লেখার মূল আবেগটি কারও কাছে খুব সামান্যই হওয়ার কথা।
সত্যি বলছি নীড়সন্ধানী, কোনও ব্যক্তিকে তুচ্ছ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু যারা সমাজের আইকন, তাদের দায়দায়িত্বও অনেক বেশি। এমনকি এই যে আমি বা আপনি এইখানে বাতচিত করছি, তারও একটা দায়দায়িত্ব আছে।
দেশের মানুষদের প্রতি অবশ্যই আমার শ্রদ্ধা আছে। এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলায়, রিকশাওয়ালা প্রচণ্ড গরমে রোজা রেখেও রিকশা চালায় আর মধ্যবিত্ত শিক্ষিত চাকরিজীবীরা রোজার দিনে অফিসটাইম পাল্টানোর জন্য, অধিকতর ছুটির জন্য ছুটোছুটি করে,- আমার পক্ষপাতিত্ব কার দিকে, আমার শ্রদ্ধার জায়গা ও আস্থার জায়গা কোনদিকে আশা করি বুঝবেন। আর শাহাবুদ্দিন কিন্তু আমারও আইকন হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ বা বিএনপি-র মতো রাজনৈতিক দলগুলি তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে বারবার সংবিধান বদল করেছে, তার জন্য যখন আমরা সমালোচনা করি,- তখন একজন ব্যক্তির জন্য সংবিধান বদল করার প্রসঙ্গ তোলাটা কি খুব অপ্রাসঙ্গিক?
এখন রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির কথাবার্তা বলাবলি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ কিন্তু শাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল এবং রাষ্ট্রপতি পদটির মর্যাদা বাড়িয়েছিল। আর শাহাবুদ্দিনও পর পর দু বার জননিরাপত্তা আইনের খসড়া ফেরত পাঠিয়ে রাষ্ট্রপতির গুরুত্ব বাড়িয়েছিলেন। ওই কারণে আওয়ামী লীগ জননিরাপত্তা আইন নিয়েও আর এগোয়নি। যতদূর জানি, তিনি তার নিজের ভাষণ নিজে চূড়ান্ত করতেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিসেব শেষ ভাষণটি তিনি ফেরত পাঠাননি, যা আসলে একটি দলীয় ভাষণের নামান্তর। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত একটি বিলও, যতদূর মনে পড়ছে, একবারও ফেরত পাঠাননি,- যে বিলটি নিয়ে শিক্ষাবিদদের আপত্তি ছিল। তাই ব্যক্তি শাহাবুদ্দিনের জীবনযাপন যত মুগ্ধকরই হোক, কেউ যদি আশাহত হন তা হলে তাকে নিয়ে আপনি কৌতুক বোধ করতেই পারেন… কিন্তু আশাবাদী হওয়ার কোনও জায়গা তৈরি হয় না আর যে আস্থা খেলা করে তা আসলে মরিচিকা ছাড়া কিছু নয়।
যাই হোক, আপনি কিন্তু আমার মূল প্রসঙ্গ বা রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিকতন্ত্রের প্রবেশ ও সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের অনুমোদন প্রসঙ্গে কিছুই বলেননি। অবশ্য আপনার ভাষ্য অনুযায়ী, এগুলো সবই তত্ত্ব এবং আপনার বয়স বাড়ছে, এসব ব্যাপার তাই আর বাস্তবসম্মত মনে হয় না।
আমি জননিরাপত্তা আইনকে সেসময় পছন্দ করিনি, এখন রেপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়নকেও পছন্দ করি না। তবে জননিরাপত্তা আইনকে অপছন্দ করা অনেকেই কিন্তু এখন ক্রসফায়ারকে পছন্দ করে। এবং সাফাই গায়।
বুঝতে পারছি আমি তত্ত্ব আর আবেগের জগতের লোক… আপনি তথ্য আর বাস্তবতার জগতের লোক।… এই বিশাল পার্থক্য যে কী করে ঘুচাই! যাই হোক, সেনাবাহিনীর ভালোমন্দ নিয়ে আপনার লেখা পড়ার আশায় রইলাম। বলা ভাল, আপনার ব্লগ পড়তে কিন্তু আমার খুব ভাল লাগে।
মনজুরাউল - ২৭ অক্টোবর ২০০৮ (৮:৫১ অপরাহ্ণ)
সাহসী লেখা। পরে আলোচনার আশা রইল। ‘নীড় সন্ধানী’র বক্তব্য’র সাথে সহমত হতে পারলাম না। তার “আমার কাছে কিছু আছে; পরে অন্য পোস্টে লেখার আশা রাখি”-র অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ উভয়কে।সকলকে।
অবিশ্রুত - ৩১ অক্টোবর ২০০৮ (১০:৩৯ অপরাহ্ণ)
আপনাকেও ধন্যবাদ পড়বার জন্যে। আপনার ভবিষ্যত আলোচনায় এ বিষয়ে সকলের ধারণা ও অবস্থান আরও শাণিত হবে বলেই মনে করি।
সৈকত আচার্য - ২৮ অক্টোবর ২০০৮ (১২:০১ পূর্বাহ্ণ)
নীড় সন্ধানী যে ভাবে ভাবেন, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই দেশের অনেক মানুষই আছেন যারা ঠিক একইভাবে ভাবতে অভ্যস্ত। এই দলে আছেন সাধারন খেটে খাওয়া গরিব মানুষ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত। আর আছেন উচ্চবিত্তদের একটা বড় অংশ। আমি আরো দেখেছি, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা টেকওভার করার শুরুর দিকে এই ধরনের যুক্তিগুলো অনেকের মুখে মুখে থাকে।
ভাবনার এই ট্রেন্ড নিয়ে তাই অনেকে সমালোচনা করলেও মনে রাখতে হবে, এই ধরনের যুক্তি পদ্ধতি আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। তাই সমাজের একটা অংশের মতামতের প্রতিফলন হিসেবেই যদি নীড় সন্ধানীর বক্তব্যকে দেখা হয়, এবং সেই ভাবে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে ব্যক্তির মত খন্ডনের জন্যই শুধু আলোচনা করা হবে না, বরং সেই সাথে অবিশ্রুত যে লাইন থেকে আলোচনা দাঁড় করাতে চান, সেই লাইনের সাথেও একটা দারুন তর্ক জমে উঠবে। এই তর্কটা দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কত জরুরী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমি মনে করি, অবিশ্রুত দেশের এই সংকট সন্ধিক্ষনে, একটা সিরিয়াস আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। এই আলোচনায় দেশের সমস্যার সমাধান হবে না, তবে সমস্যা তৈরী কিভাবে হয় তার একটা ধারনা অন্ততঃ গড়ে উঠবে । এই জন্য, পক্ষে বিপক্ষের যুক্তিগুলো ধৈর্য সহকারে শোনার এবং বোঝার অবকাশ আছে, এই আলোচনায়।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরী হয়েছে এদেশে। তার কারন আছে নিশ্চয়ই। কিন্ত এই রাজনীতি বন্ধ করা উচিত কি উচিত না, কিংবা, কোন রাজনৈতিক দলের সাথে এদের যুক্ত থাকা উচিত কি উচিত না, এই বিষয়ে এখন এমন এক সময় চলছে যে, এক কথায় হাঁ বা না উত্তর দিয়ে আলোচনা চালানো মুশকিল। কারন এই পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে, কয়েক দশক জুড়ে। ফলে, এই আলোচনাও জরুরী। কারন, দেখছি আমরা, এই দেশটা ভেঙ্গে পড়ছে সবার চোখের সামনে দিয়ে। ঠিক সেই টাইটানিক জাহাজের মত, দেখছি সবাই, কিন্ত কিছু করতে পারছি না সেইভাবে।
বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলায়, প্রয়াত হুমায়ন আজাদের প্রতিক্রিয়া চোখে পড়লো এই মুহুর্তে, তা হুবহু তুলে দিলামঃ
“সাহাবুদ্দীন আহমদের রাষ্ট্রপতি হওয়া উচিত হয় নি। হাসিনার কৃপায় রাষ্ট্রপতি হন। তিনি সচেতনভাবেই জানেন রাষ্ট্রপতির বিশেষ কোনো ক্ষমতা নেই, তিনি যা বলেন তা সরকারকে বিব্রত করে। তিনি নিজেকে যতোটা সৎ ভাবেন ততোটা থাকলে বিচারপতি হিসেবেই অবসর নেয়া উচিত ছিলো। তা হলে রাজনীতি সম্পর্কে তার চুড়ান্ত অজ্ঞতার প্রকাশ পেতো না। বঙ্গভবনে বসে এ ধরনের আজেবাজে অনেক কথা বলা যায়। তিনি জানেন না ছাত্ররাজনীতির কারনেই ভাষা আন্দোলন,স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি নষ্টের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এমনকি সাহাবুদ্দিন আহমদ নিজেও দায়ী। হাসিনা-খালেদা,গোলাম আযমরা যা করেছেন,তা ছাত্র রাজনীতির থেকে উতকৃষ্ট ন্য়। সাহাবুদ্দিন আহমদের উচিত বুঝে শুনে কথা বলা।”
{হুমায়ন আজাদের অগ্রন্থিত সাক্ষাতকারঃ একুশ আমাদের অঘোষিত স্বাধীনতা দিবস। প্রথম প্রকাশ ২০০৬। আগামী প্রকাশনী।(পৃঃ৮১)}
এই আলোচনা এগুতে থাকুক। দেখি, আমরা কোথায় গিয়ে মিলি।
অবিশ্রুত - ৩১ অক্টোবর ২০০৮ (১০:২৫ অপরাহ্ণ)
আপনি ঠিকই বলেছেন সৈকত আচার্য, ‘এই আলোচনায় দেশের সমস্যার সমাধান হবে না, তবে সমস্যা তৈরী কিভাবে হয় তার একটা ধারনা অন্ততঃ গড়ে উঠবে।’
কিন্তু এই আলোচনা কি সত্যিই বেশিদূর এগুবে? মনে হয় না। কেননা এরচেয়ে আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা অনেক ভালো। তাতে খুব নিরাপদে থাকা যায় আবার নিজের সুতীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তাও প্রকাশ করা যায়!
আপনার ওই পর্যবেক্ষণও সঠিক, দেশের অধিকাংশ মানুষ ওইরকম ভাবে। আরও একটু এগিয়ে বলতে চাই, অনেকেই মনে করেন, সামরিক শাসন ছাড়া বাংলাদেশকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারণার যে বিভ্রান্তি মানুষ অর্জন করেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। বরং সাম্রাজ্যবাদের ইন্ধনে উন্নয়নের ওই ধারণাকেই অনেকে সঠিক ভেবে থাকেন। গ্রামের বয়োবৃদ্ধরা এখনো বলেন, শাসন করে গেছেন আইয়ুব খান। ঝোঁপজঙ্গল সব সাফ হয়ে গেছে।
আইয়ুব খান জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যে মিথ্যা প্রুতিশ্রুতি দিতেন,- রাস্তাঘাট বানানোর কথা বলতেন, স্কুল-কলেজ বানানোর কথা বলতেন। রাজনীতিকরাও তা রপ্ত করেছেন। এই ভাবে আইয়ুবের সামরিক শাসনামলে পরিকল্পনাহীনভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ, নদী শাসন ইত্যাদির মাধ্যমে যে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়েছে, শিক্ষক ও শিক্ষার মান নিশ্চিত না করেই স্কুল-কলেজ নির্মাণের মাধ্যমে যে শিক্ষা বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়েছে, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন না দিয়ে দালালদের মাধ্যমে নিম্ন পর্যায় থেকে শাসনব্যবস্থা পত্তনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটেছে, প্রতিটি সামরিক শাসনামল তাকে পুনরায় তুলে এনেছে, লালন করেছে, বিকশিত করেছে। বুর্জোয়া রাজনীতিকরা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন, কেননা তাদের রক্ষার জন্যে একমাত্র শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটির নাম সামরিক বাহিনী,- তারাও চান না গণতন্ত্রচর্চা এতদূর পর্যন্ত বিকশিত হোক যে দুঃসময়ে তাদের রক্ষার জন্যে সামরিক বাহিনীর এগিয়ে আসার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ুক।
এত কিছুর পরও মানতেই হবে, যেটি অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সামরিক শাসনের চেয়েও সবচেয়ে নিকৃষ্ট গণতন্ত্র অনেক ভাল। এমনকি নিকৃষ্ট গণতন্ত্রেও খানিকটা কথা বলার সুযোগ থাকে,- যে কারণে তখন অন্তত বোঝা যায়, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কতটুকু অবনতি ঘটেছে। কিন্তু সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সামরিকতন্ত্রেও বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে নিয়ন্ত্রিত,- যে কারণে মনে হয় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। এবং খুব রুঢ় হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের যে-কোনও সামরিক শাসনের সময়ের চেয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো নিকৃষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর শাসনামলে দেশ অনেক এগিয়েছে।
অনেকে এ বক্তব্যে আপত্তি তুলতে পারেন। সেই আপত্তিকে নাকচ করার মতো কিছু যুক্তি ও পরিসংখ্যান (মানে তথ্য) আমি এজেডএম আবদুল আলীর একটি লেখা থেকে ধার করে এখানে তুলে ধরতে চাই।
তাঁর ওই আলোচনার ভিত্তি ছিল ইউএনডিপি-র বার্ষিক মানব উন্নয়ন সূচক। সেখানে এক কিলোমিটারকে মানব উন্নয়নের সূচক ধরে গবেষণাক্রমে দেখানো হয়েছে, 1975 সালের পর থেকে 28 বছরে পৃথিবীর 177টি দেশের কোনটি কতদূর এগিয়েছে। এই এক হাজার মিটারের সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নরওয়ে। তারা অতিক্রম করেছে 963 মিটার। অন্যদিকে, বাংলাদেশ তিন দশকে অতিক্রম করেছে 520 মিটার।
এখন দেখা যাক, রাজনৈতিক আমল বনাম সামরিক আমল,- কোন আমলে বাংলাদেশ কত মিটার অতিক্রম করেছে। জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আসেন, মানে সামরিক শাসক হন, তার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ অতিক্রম করেছিল 345 মিটার। তার মানে ‘হতভাগা’ শেখ মুজিবুর রহমানই তাঁর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি পথ অতিক্রম করানোর কাজটি সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তাঁর পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে নিয়ে অতিক্রম করেছিলেন মাত্র 19 মিটার। তারপর আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ তাঁর প্রথম পাঁচ বছরে অতিক্রম করেন 25 মিটার এবং পরবর্তী কয়েক বছরে অতিক্রম করেন 30 মিটার। তার মানে তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আর মাত্র 5 মিটার।
1991 সালে খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় এলেন, তখন বাংলাদেশ অতিক্রম করেছে 419 মিটার। তিনি যখন ক্ষমতা ছাড়লেন, তখন তিনি এগিয়েছিলেন 33 মিটার, মানে এরশাদের চেয়ে মাত্র 3 মিটার বেশি। তারপর হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের সূচক দাঁড়ায় আগের 452 থেকে 506। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশ এগিয়েছিল, আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতির পরও, 54 মিটার,- যা পূর্ববর্তী বিএনপি-র শাসনামলের চেয়ে 21 মিটার বেশি। তারপর আসে চারদলীয় জোটের শাসন। তখন দেশ এগোয় 520 মিটারে। তার মানে বাংলাদেশকে তারা এগিয়ে নেয় মাত্র 14 মিটার,- যা পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের শাসনামলের চেয়ে সাত মিটার কম।
আমি ইউএনডিপির পরিসংখ্যান এবং তার ব্যাখ্যাই ব্যবহার করলাম,- কেননা বেশির ভাগ মানুষই আবার এগুলির ওপরেই বেশি নির্ভর করেন।
এখন দেখুন সৈকত আচার্য, সামরিকতন্ত্র দেশকে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে, নাকি নিকৃষ্ট গণতন্ত্র (যদিও এ গণতন্ত্রকেও সমর্থন করি না? অনির্বাচিত সরকার দেশকে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে নাকি নির্বাচিত সরকার (যদিও আমি মনে করি না নির্বাচিত সরকার মানেই গণতান্ত্রিক সরকার)? ব্যাপার কি জানেন, ডাণ্ডা মেরে কয়েকদিন সমুদ্র বন্দরকে খুব ছিমছাম গোছগাছ দেখানো খুবই সম্ভব, কিন্তু সেটা কি ‘শৈবাল দীঘিরে কহে…’র মতোই শোনায় না?
মাসুদ করিম - ১ নভেম্বর ২০০৮ (৩:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
আসলে আমাদের মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। আমাদের হতে ইচ্ছে করে মালেশিয়া সিঙ্গাপুর, ওয়াজে পাকিস্তান ফিল্মে ভারত, যেতে ভালো লাগে অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা, আনতে ভালো লাগে ফেলে দেয়া নকল ছাপ্পড় মারা চাইনিজ মালামাল। তাই শুধু মনে হয় কোনো এক ভালো একনায়ক এসে দিনযাপন করুক আমাদের সাথে।আমরা বিভোর থাকব আমাদের নিয়ে তারা জরুরী জোরে জরুরী সব কাজ করবেন। আমরা শুধু ভাবি ব্যক্তি পারে, আমরা জনগণ হতে কেউ চাই না, আমরা একেকজন রাসপুটিন, রাজার মন্ত্রণাদাতা, যখন যে আসে তার গুণকীর্তনে আমাদের দিন যায়। আমরা ছিলাম ডোবায়, আছি ডোবায়, পরিণতি ডোবায়।আমরা তো চাই শুধু আমাদের চলে যাক, চলেই তো যাচ্ছে…
অলকেশ - ১ নভেম্বর ২০০৮ (৭:০৯ অপরাহ্ণ)
মাত্র দু’মাস আগে “Asian Human Rights Commission”একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে তারা বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসনে ব্যাপক সামরিকীকরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তারা কিছু তথ্য সন্নিবেশ করে দেখিয়েছিলেন, কি ভাবে বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসনে ইতিমধ্যেই ব্যাপক সামরিকীকরন সম্পন্ন হয়েছে, এবং রাষ্ট্রীয় লেভেলে কোন নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে, সামরিক কর্তৃপক্ষ কতটুকু প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা রাখে।
ঐ রিপোর্টের বিষয়গুলো হলঃ
১। সরকারী নির্দেশঃ যৌথ বাহিনীর কমান্ডিং অফিসারদের সাথে একযোগে কাজ করুন।
২। সব উপজেলায় ইতিমধ্যে সেনা মোতায়েন সম্পন্ন।
৩। যৌথবাহিনী আসলে সেনাবাহিনী ডমিনেটেট।
৪। সিভিল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ন কোন কোন পদে সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর কর্মকর্তারা আসীন আছেন তার একটি নমুনা তালিকা।
৫। সিভিল প্রশাসনে মেজর সাহেবদের দাপট বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলা প্রশাসকের মন্তব্য।
৬। অনেক ক্ষেত্রে বিচারিক আদালত নিয়ন্ত্রন করছে এখন সামরিক কর্তৃপক্ষ।
৭। পরিশেষে তাদের অবজারভেশনস হল, সামরিকীকরন করে কোন রাষ্ট্র জনগনকে মুক্তি দিতে পারেনি। গনতন্ত্রের মূল কাঠামো ভেঙ্গে যাবে,যদি এই পরিস্থিতি-এই ধারা, চলতে থাকে।
রিপোর্টটি এখানে দেখুন।