২৮ জুলাই ২০০৮; সাধারণ একটি দিন। ওইদিন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। সেই মানববন্ধনে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ আলী আমান, যিনি সম্প্রতি নিগৃহীত হন মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার জামাতিদের সমাবেশে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে। আরও ছিলেন ড. আনোয়ার হোসেন, যাকে ১১ জানুয়ারিতে ক্ষমতাদখলকারী সেনাবাহিনীর সদস্যরা ‘আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নই’ বলে আশ্বস্ত করে নির্যাতনের নিকৃষ্টতম স্থান ব্ল্যাকহোলে নিয়ে গিয়েছিল।
মানববন্ধন হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ আলী আনাম ও ড. আনোয়ার হোসেন তাতে যোগ দিয়েছিলেন, এসবও সাধারণ ঘটনা। কিন্তু এইসব সাধারণ ঘটনা ও সাধারণ দিনটি অনন্য হয়ে ওঠে আর এক ঘটনার সূত্রে। এর কিছুদিন আগে ড. আনোয়ার হোসেনের অফিসে ক্যুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে একটি চিঠি এসে পৌঁছে। চিঠিটি ছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের দুর্নীতি আর অনিয়ম নিয়ে। চিঠিটি পাঠিয়েছেন বেনামী একজন। তাতে ওই দুর্নীতি আর অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে আবেদন করা হয়েছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রধান বরাবর। একইসঙ্গে এর অনুলিপি পাঠানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে এবং ডিজিএফআই-য়ের দপ্তরে। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতেও অনুলিপি পাঠানোর উল্লেখ রয়েছে আবেদনটিতে। সেনাপরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কথাবার্তা ও তৎপরতা হয়তো এই ব্যক্তির মনে আলোড়ন তুলেছিল। তাই তিনি চোখের সামনে একটি বড় ধরনের দুর্নীতি দেখতে পেয়ে আর চুপ থাকতে পারেননি। তবে পুরোপুরি ভরসাও পাননি, তাই কেবল সরকারকে জানিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি, একইসঙ্গে তা অবগত করেছেন প্রথম আলো পত্রিকাকে। কিন্তু তারপরও বোধকরি তার সংশয় কাটেনি, আস্থার সংকট রয়েই গেছে, তাই একটি অনুলিপি পাঠিয়েছিলেন ড. আনোয়ার হোসেনকে।
মানববন্ধনের সমাবেশে সাহসের আর এক প্রতিকৃতি মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ আলী আমানসহ আরও অনেকের সামনে আনোয়ার হোসেন সবাইকে এই চিঠির কথা জানান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সামরিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কথা। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নাসির হোসেনের নেতৃত্বে সেখানে মেজর তরিকুল, মেজর কুদ্দুস, ক্যাপ্টেন আরিফ, ক্যাপ্টেন মঈন আর ক্যাপ্টেন দেলোয়ার গড়ে তুলেছেন চাঁদাবাজির রাজত্ব। ব্যবসায়ী, ইম্পোর্টার, স্টক হোল্ডার এবং চট্টগ্রামের সিএনএফ এজেন্টদের কাছ থেকে এরা চাঁদা হিসেবে এর মধ্যেই হাতিয়ে নিয়েছে ১৫ কোটি টাকা।
এর পাশাপাশি আরও একটি ঘটনা মনে পড়ছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে পাঠানো হয়। এখবর জানতে পেরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী বাংলাদেশিরা। কিন্তু সেই ক্ষোভের মুখেও গেল সপ্তাহে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর নিয়োগ চূড়ান্ত করেছেন বাংলাদেশ সরকার। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মিশনগুলিতে পেশাদারি কূটনীতিক নিয়োগের বদলে আবারও রাজনৈতিক কারণে প্রেষণে কূটনীতিক নিয়োগের ধারা চালু হতে চলেছে। এইভাবে দেখা যাচ্ছে, ১১ জানুয়ারির পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী পুনরায় একরকম প্রকাশ্যেই বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
পৃথিবীতে এমন কয়টি দেশ আছে, যেখানে সেনাবাহিনী শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে তার আগে ‘দেশপ্রেমিক’ বিশেষণ জুড়ে দিতে হয়? এমন কয়টি দেশ আছে, যেখানে এই মনস্তাত্বিক ধারণা তৈরি করার চেষ্টা চলে যে দেশটির জনগণ, রাজনীতিক বা অন্য কোনও স্তরের মানুষই দেশপ্রেমিক নয়, দেশপ্রেমিক কেবল সেখানকার সেনাবাহিনী? বোধকরি বাংলাদেশই একমাত্র সে-ধরনের দেশ। আর সে দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাল হলো এই যে, চামে চামে তারাও চাঁদাবাজি করে এবং সেই চাঁদাবাজি করার জন্যেই তাদের কয়েক বছর পর ‘রাজনীতিকরা দুর্নীতিবাজ’ শোর তুলে ক্ষমতা কব্জা করতে হয়। আর সেনাবাহিনীর এই হাল হওয়ার পেছনে যেমন জিয়াউর রহমানের অবদান রয়েছে, তেমনি অবদান রয়েছে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের। তারা সামরিক শাসনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন, সামরিকতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনখাতের সঙ্গে যুক্ত করে ঠেলে দিয়েছেন সশস্ত্র দুর্নীতির দিকে।
দুই.
২৮ জুলাইয়ের মতো আর একটি দিন ২৮ আগস্ট। এদিনটিও বাংলাদেশে বিশেষ একটি দিন হয়ে উঠেছে আর একটি কারণে। এইদিনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত জেল হত্যা মামলা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও চিহ্নিত সব আসামীকে অব্যাহতি দেয়; অথচ ঠিক একই দিনে সেখানকার একটি সাব-জেলে বসে কয়েক ঘন্টা ধরে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন খালেদা জিয়া, মুজাহিদ আর খোন্দকার। ব্যাপারটি কি কাকতালীয়? না পরিকল্পিত? যেটাই হোক না কেন, এই ট্র্যাজেডি আর কমেডির সহাবস্থানই বলে দিচ্ছে দেশটির ভবিষ্যত রাজনীতি কেমন হবে।
কেবল জেলহত্যা মামলা নয়, বাংলাদেশের অনেক মামলার অবস্থাই এখন এরকম। কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে উচ্চ আদালতে জামিনে মুক্তির ঝড় বয়ে গেছে। আমরা সেখানে দেখেছি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে একের পর এক দানব বের হয়ে আসতে। মাঝখানে অনেকদিন এসব দানবদের কারাগারে রাখার নামে কাউকে কাউকে আলাদা বাসভবন তৈরি করে, কাউকে কাউকে চিকিৎসার নামে হাসপাতালের জৌলুসময় কক্ষে, কাউকে কাউকে কারাগারেই দুধকলা দিয়ে রাখা হয়েছিল। তাদের দানবিক চেহারা এতই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল জনগণের সামনে যে সেই চেহারাকে সার্জারি করে মানবিক চেহারা দেয়ার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে বুর্জোয়া রাজনীতিকরা যখন ন্যুনতম গণতান্ত্রিক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক শর্ত প্রতিষ্ঠার নামে বরং দলবাজির মাধ্যমে দানবিক হয়ে ওঠে, তখন তাদের মানবিক চেহারা দেয়ার মহান দায়িত্ব পালন করার কাজটি পালন করতে এগিয়ে আসে সে দেশের সামরিক বাহিনী। কেননা সামরিক বাহিনীই হলো এসব দেশের বুর্জোয়া রাজনীতির সবচেয়ে সংঘটিত প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষক বাহিনী। দানব যখন দেখে যে তার দানবিক রূপ দেখতে দেখতে জনগণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দ্রুত তারা বিকল্পপথে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে পারে, তখন তারা নিজেরাই বিকল্প তৈরির নামে নানা ভড়ং তৈরি করতে থাকে। এই বিকল্পগুলির সর্বশেষ পন্থাটি হলো দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় সাময়িক সময়ের জন্যে সামরিক বাহিনীকে নিয়ে আসা। আর সামরিক বাহিনীও এ জন্যে তৈরি হয়েই থাকে, তারা যথারীতি এগিয়ে আসে এবং বলে, গণতন্ত্র একটি বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। আমরা সব কিছু ঠিকঠাক করে আবার জায়গামতো ফিরে যাব। তারপর ঈদের আগে বাস, ফেরি কিংবা রেলকাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে যেভাবে নির্বিচারে লাঠিচার্জ করা হয়, ঠিক তেমনি ভাবে তারা কিছুদিন রাজনীতিকদের নির্বিচারে দুর্নীতিবাজ, মতলববাজ, দেশের শত্রু ইত্যাদি বলে জনগণের মনের ক্ষোভ প্রশমিত করে এবং শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, আসল ঘটনা হলো ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’।
একটি দেশে একটি সংবিধান থাকে। রাজনীতিকদের দেশ শাসন করার কথা সেই সংবিধান অনুযায়ী। রাজনীতিকরা যখন সংবিধান লংঘন করেন কিংবা করতে উদ্যত হন, তখন সংবিধান রক্ষার জন্যে নিয়ে এগিয়ে আসার দায়িত্ব জনগণ সর্বাগ্রে কাদের হাতে অর্পন করে থাকে? এককথায়, বিচার বিভাগের ওপর। কিন্তু খুব অস্বস্তি নিয়েও এ প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কি কখনও এ দায়িত্ব পালন করেছে? ১৯৭৫ সালে যখন সামরিক শাসন জারি করা হলো তখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার জন্যে আমরা দেখেছি একজন বিচারপতিকে কালো ছাতার কাপড় গায়ে চাপিয়ে কোমরে বেল্ট পরে এগিয়ে আসতে। একই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আরও কয়েকজন বিচারপতি। আর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন তো এতই নিষ্ঠুর নিম্নমানের সাধারণ মানুষ যে নিচের প্রধান বিচারপতির পদ ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজনীতিকদের বাধ্য করেছেন সংবিধান সংশোধন করতে! প্রধান বিচারপতিরাও যে দুর্নীতিবাজ হয়ে থাকেন যে দৃষ্টান্তও রেখে গেছেন জোট সরকারের এক প্রধান বিচারপতি। বিচারপতিরাও যে কত নিকৃষ্ট দুর্নীতি করতে পারে তার দৃষ্টান্তও তৈরি করেছেন এক বিচারপতি (ওরফে প্রাক্তন এক উপদেষ্টা)। দেশে যতবার সংবিধান স্থগিত হয়েছে, যতবার একের পর এক অবৈধ অধ্যাদেশ জারি হয়েছে ততবারই আমরা দেখেছি, বিচার বিভাগকে আহ্লাদিত চিত্তে সেগুলির বৈধতা দেয়ার জন্যে এগিয়ে আসতে। কখনওই তারা বেঁকে বসেনি, বলেনি, সংবিধানকে এভাবে কাটাছেঁড়া করা অন্যায়।
অনেকে বলতে পারেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল না। কিন্তু পরাধীন থেকেও কি কেউ উচ্চকণ্ঠ হতে পারে না? বিদ্রোহী হতে পারে না? এরকম দৃষ্টান্ত তো ইতিহাসে অজস্র রয়েছে। আর বিচার বিভাগের স্বাধীন রূপও তো আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে। জেলহত্যা মামলার রায়ের অবস্থাই বলে দিচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাধীন বিচার বিভাগ কেমন আছে। বিচার বিভাগের এই স্বাধীনতার ঠেলায় তারেক রহমান একদিনে একদিনে পাঁচটি মামলায় জামিন পেয়েছেন। এবং বিষয়টি দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে বুঝতে পেরে সরকারপক্ষ পুনরায় আপিল করে জনগণের সামনে নিজের একটা ‘সুফি সুফি ভাব’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই জানেন, জুন ২০০৮-এ উইলটন পার্ক কনফারেন্স হয়েছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে। এ কনফারেন্সের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ও উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা। তারপর জুলাই ২০০৮ থেকে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা থেকে পরিষ্কার যে, দুদক ও টিআইবি-র কথিত দুর্নীতিবিরোধীরা যাই বলুন না কেন, দুদকের ওপর বাংলাদেশের মুখচেনা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাষায় বলতে গেলে, রাজনীতির শেষ অঙ্ক শুরু হয়েছে সেখানে। সাকা চৌধুরী মুক্তি পাওয়াতে তাকে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছেন পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী,- বোধকরি এ থেকেই টের পাওয়া যায় কেমন হচ্ছে রাজনীতির সেই শেষ অঙ্ক!
তিন.
শেয়ালের লেজ কাটা গেলেও যেমন তার ডাক শুনলেই বোঝা যায়, আসলে সে কী, ঠিক তেমনি ১১ জানুয়ারির পর সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সুশীল সমাজকে সামনে রেখে যা-ই করুক না কেন, বোঝাই যাচ্ছিল শেষ পর্যন্ত আসলে কী ঘটবে। বোঝাই যাচ্ছিল, সামরিকতন্ত্র যতই সুশীলদের ময়ুরপুচ্ছ লাগাক না কেন, শেষ পর্যন্ত আবারও নিদারুণ এক গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে নিপতিত হবে জনগণ। এতদিনে এসে তাই দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান লিখছেন, বর্তমানে যে এমন একটি পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তার কারণ এই-যে, সামরিক বাহিনী আর সুশীল সমাজের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন কারণে সুশীল সমাজ আর সামরিক বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, তাই তারা পিছু সরে আসছে। প্রশ্ন, হলো পৃথিবীর কোথায় এমন সুশীল সমাজ আছে, যারা এইভাবে সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়? বাংলাদেশের সুশীল সমাজ নিজেদের বিকশিত করার জন্যে এনজিও-নির্ভরতার যে-দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা তাদের জনগণ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং তারা জনগণ থেকে ছিটকে পড়েছেন। এবং বোঝা যাচ্ছে, এখন সুশীল সমাজ আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়ে বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক দুরবস্থার জন্যে কেবল সেনাবাহিনীর ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এটি মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্যে কেবল সেখানকার সামরিক বাহিনীই নয়, সুশীল সমাজও সমান দায়ী।
একটি দেশ গণতান্ত্রিক হলেও সেখানে অনেক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকতে পারে। যেমন, ভারতে অনেক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক পশ্চাতপদতা থাকার পরও দেশটি একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট, তারা গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে সমার্থক মনে করেন। এবং সে জন্যে তারা সবসময় হরতাল, মিছিল ইত্যাদির বিরুদ্ধে মারমুখো ভূমিকা দেখিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের দোদুল্যমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী সুশীল সমাজের সস্তা কথাবার্তায় খুব আশান্বিত হয়ে উঠেছিল এবং অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্র ও জনমুখী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। এ প্রসঙ্গে আহমদ ছফার পুরনো কথাটিই আবার বলতে হয়, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে দেশ স্বাধীন হতো না, আর এখন যা বলছেন, তা শুনলে দেশ গড়া যাবে না।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান তাঁর এই আলোচনাটি লিখেছেন বাংলাদেশের ট্রান্সকম মিডিয়া থেকে প্রকাশিত ইংরেজি মাসিক পত্রিকা ফোরাম-এর চলতি সংখ্যাতে। সেখানে তিনি বলেছেন, ১১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারের ভেতরে-বাইরে যা ঘটছে তা থেকে দুটি জিনিস শেখবার রয়েছে। একটি হলো, সংস্কারের জন্যে সরকারের ভেতরে ও বাইরে উভয় স্থান থেকেই সহযোগীর প্রয়োজন রয়েছে এবং তা ওপর থেকে আমলতান্ত্রিক কিংবা টেকনোক্র্যাটিকভাবে চাপিয়ে দিলে চলবে না বরং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় করতে হবে। দ্বিতীয় শিক্ষাটি হলো, শুধু ব্যক্তি নয়, সংস্কারের জন্যে প্রয়োজন ব্যবস্থার পরিবর্তন।
খুবই ন্যায্য ও সঙ্গত কথাবার্তা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই শিক্ষা নেবার জন্যে বাংলাদেশের সুশীলদের কী প্রয়োজন ছিল সেনানিয়ন্ত্রিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠার? কী প্রয়োজন ছিল কোটি কোটি মানুষকে বাক-স্বাধীনতাহীন অবস্থায় রাখবার? ইতিহাস থেকে বহু আগেই তো এ দুটি শিক্ষা মানুষ অর্জন করেছে। ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি যে দুই সমকোণ, এটি কি নতুন করে আবার গবেষণা করে প্রমাণ করার প্রয়োজন রয়েছে?
ট্র্যাজেডি হলো, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী বুদ্ধিজীবী সুশীলদের ওপরেই বেশি আস্থা রাখে। কিন্তু এই সুশীল বুদ্ধিজীবীদের যতটুকুও বা সততা ও প্রগতিশীলতা ছিল ১১ জানুয়ারির মধ্যে দিয়ে তা পুরোপুরি খসে পড়েছে। এই দু বছরে সুশীল সমাজ একেবারে প্রত্যক্ষ প্রমাণ রেখেছে, মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে, জাতিকে পথ দেখানোর ক্ষেত্রে তারা আসলে একেবারেই অনুপযুক্ত। তাদের কথা শুনলে সত্যিই দেশ চলবে না এবং তারা কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন।
বাংলাদেশে ১১ জানুয়ারিকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে সেখানকার বেশ কিছু মিডিয়া। এইসব মিডিয়ার কোনও কোনওটি এখন আবার প্রশ্নবিদ্ধ তাদের প্রতিষ্ঠা ও উত্থান নিয়ে। বাংলাদেশের মিডিয়াতে কারা বিনিয়োগ করছে তা নিয়ে বেশ কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটে। আর বাংলাদেশে সেই রিপোর্ট প্রকাশ করায় আদালতে মামলা হয়েছে জোটপন্থী একটি সংবাদপত্রকে। মিডিয়ার এসব নগ্ন বিরোধ বাংলাদেশের জনগণকেও নানাভাবে বিভ্রান্ত করছে। এসব মিডিয়ার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে ‘গোপাল বড় ভালো ছেলে’ জাতীয় একটি সুশীল সমাজ এবং পরিবর্ধিত তরুণ সুশীল সমাজও গড়ে উঠেছে, যারা সুশীল রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রচার করে চলেছেন; কোটি কোটি টাকার মুনাফা কামাচ্ছে এইসব কোম্পানিগুলো, তারপর সেরা রাধুনি, সেরা লেখক, সেরা তারকা কিংবা সেরা গায়ক-গায়িকা বা নতুন মুখ ইত্যাদির অনুসন্ধান ও নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বোকা বাক্সের সামনে বসে থাকা ব্যাপক মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কব্জা করে ফেলেছে এরা। পুরস্কারের মোহগ্রস্ত তরুণ প্রজন্ম ও তাদের অভিভাবকদের কল্যাণে তাদের সমস্ত অন্যায়ই জায়েজ হয়ে যাচ্ছে। কবি সুকান্ত লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি…’। কিন্তু এখন আঠারো বছরের তরুণরা যাতে প্রতিবাদী চোখ তুলবার বদলে লোলুপ চোখ তুলে তাকাতে শেখে তারই আয়োজন চলছে সেখানকার কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছে বিকিয়ে যাওয়া সুশীলদের তত্ত্বাবধানে।
এই সুশীলদের একটি অংশ গত সপ্তাহে লন্ডন এসেছিলেন। আবহাওয়া পরিবর্তনসংক্রান্ত ‘ফোকাস বাংলাদেশ’ নামের একটি সম্মেলনে যোগ দেয়াই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। মাত্র একদিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসেছিলেন অর্থ উপদেষ্টা মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষর সহকারী রাজা দেবাশীস রায়সহ ৩৯ জনের বিরাট একটি দল। এই বিরাট দলের খরচ যোগাতে হয়েছে সরকারকেই। মাত্র একদিনের সম্মেলনে এত বড় দল আসার প্রয়োজন কি সেটা একটি বড় প্রশ্ন। তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, একটি অরাজনৈতিক, অনির্বাচিত সরকার এ ধরণের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী সম্মেলন করার অধিকার কতটুকু রাখেন। কিন্তু এই প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করার মতো সুশীলের সংকট পড়েনি। তাই সরকারি এ-দলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্যে পাওয়া গেছে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে। অংশগ্রহণের জন্যে পাওয়া গেছে পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাতকে এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বুদ্ধিজীবী প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে! এদের মধ্যে একজন আবার আলোকিত মানুষ গড়ার কাজ করেন, যদিও র্যাবের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেন। যে-মানুষটি আলোকিত মানুষ গড়ার কথা বলেন, সে মানুষটি র্যাবের হত্যাকাণ্ডকে কীভাবে সমর্থন করেন! এমন আলোকিত মানুষ আছেন বলেই বাংলাদেশের অবস্থা এখন এমন।
চার.
বাংলাদেশে ২০০৬-এর শুরুর দিকে সেনাপতি মইন উদ্দিন আহমেদকে বলতে শোনা গিয়েছিল, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই, তারা শুধু লাইনচ্যুত ট্রেনটিকে লাইনে তুলে দিতে এ সরকারকে সাহায্য করছেন। অনেকেই তার এ কথা বিশ্বাস করেছিলেন! সেনাপতির এ-কথা মানলে এটাও মানতে হয়, যে-সব ঘটনা ঘটছে তার সবই ওই লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তুলে দেয়ার প্রক্রিয়াগত ও প্রক্রিয়াজাত মাত্র।
কিন্তু লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তোলার জন্যে বাংলাদেশের সেনাপতি ও বিচারপতিরা যা করে চলেছেন কিংবা অতীতেও তারা যা করেছেন, তা থেকে কি আমরা একটা প্রশ্ন তুলতে পারি? আমরা কি জানতে চাইতে পারি, লাইনচ্যুত সেনাপতি আর বিচারপতিদের লাইনে তুলবে কে? তাদের বিচার করবে কে? আদৌ কি সম্ভব এইসব লাইনচ্যুত সেনাপতি, বিচারপতি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের লাইনে টেনে তোলা?
১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে… কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
![wpdiscuz](https://muktangon.blog/wp-content/plugins/wpdiscuz/assets/img/plugin-icon/icon_info.png)