অবশেষে আমরা ধন্য হলাম, ধন্য হলো বাঙালি জাতি- কারণ কর্নেল তাহের মার্কসিস্ট হলেও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শ্রদ্ধা করেন তাকে। তবে যত শ্রদ্ধাই থাক, তাহেরের গোপন বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করা হলে তার কিছু যায় আসে না- অকপটে তিনি বলেছেন আদালতের কাছে। যে-মানুষটিকে শ্রদ্ধা করেন, তার মৃত্যুকে মওদুদ আহমদ আসলে তা হলে কী চোখে দেখেন? আমরা জানতাম, মানুষ মানুষকে যান্ত্রিকভাবে শ্রদ্ধা করে না, মানুষ তো রক্ত ও মাংসের, তার শ্রদ্ধার সঙ্গে তাই আবেগও জড়িয়ে থাকে, সেই আবেগের তোড়ে মানুষ নিজের অবস্থানও আচানক পাল্টে ফেলে, যেমন দেখেছি আমরা সোমেন চন্দের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর একেবারেই বিপরীত ধারার সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে আবেগদীপ্ত কবিতা লিখে ফেলতে- কিন্তু অনুভূতিশূন্যভাবেও যে কাউকে শ্রদ্ধা করা যায়, মওদুদ আমাদের সেই অনুশীলন দিয়েছেন কয়েকদিন আগে আদালতে দাঁড়িয়ে।
মওদুদ আহমদ জানেন এবং বলেও থাকেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকলে আইনের শাসন না থাকলে কোনও রাষ্ট্র বা সমাজই এগিয়ে যেতে পারে না। এই বিবৃতির অনিবার্য সম্প্রসারিত ভাষ্য হলো, বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা শ্রদ্ধা বা অশ্রদ্ধার ওপর নির্ভর করে না। বিচার বিভাগ ও আইনকে তুচ্ছ করে তাহেরকে গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে দাঁড় করিয়ে আইনের শাসনকে উপহাস করার কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন কুখ্যাত সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান। তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মধ্যে দিয়ে সেই উপহাসকে তিনি উন্নীত করেন অশ্লীল অট্টহাসির পর্যায়ে। পরে এই কুখ্যাত মানুষটি নির্বাচন দিয়েছেন, সামরিক শাসন তুলে নিয়েছেন, কিন্তু এসবই করেছেন সামরিকতন্ত্রের তত্বাবধানে সমমনোভাবাপণ্ন শ্রেণি-অংশটিকে গুছিয়ে নিয়ে, ওই শ্রেণি-অংশের উপযোগী রাজনৈতিক দল গঠনের পরে। জিয়াউর রহমানের স্তাবকেরা তাকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হিসেবে প্রচার করে, মওদুদও সেই স্তাবকদের একজন- কিন্তু যে-কুখ্যাত মানুষটি গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে কর্নের তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার নামে হত্যা করেছিলেন, হত্যা করেছিলেন আরও অনেক সামরিক কর্মকর্তাও সাধারণ সৈনিকদের, তার পক্ষে গণতান্ত্রিক হওয়া কতটুকু সম্্ভব? ব্যারিস্টার মওদুদ কি জানেন না, বোঝেন না, কর্নেল তাহেরের বিচারকার্যকে অবৈধ ঘোষণা করা হলে জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক আবরণও খুলে পড়বে নতুন করে? আর মানুষ দেখবে, হিংস্র, কুৎসিত ও বীভৎস সেই একনায়ককে- যার নির্দেশে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে কারাগারের অভ্যন্তরে, যার সময়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে গুলি চালিয়ে মানুষজনকে হত্যা করা হয়েছে, যাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জেনারেল ইন দ্য লেবেরিন্থ-এর কুখ্যাত সেই সেনাশাসকের মতো গায়ে বেসামরিক শাসনের পোশাক চড়ানোর পরও একটির পর একটি সামরিক অভ্যুত্থান দমন করার মধ্যে দিয়ে। জিয়াউর রহমানের জীবন ও বেঁচে থাকাটা নির্ভর করছিল কতটা শৈল্পিক নিষ্ঠুরতা ও গোপনীয়তার সঙ্গে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানকে দমন করতে পারবেন, তার ওপরে। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি শৈল্পিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। এই মৃত্যু যত অনাকাঙ্ক্ষিত ও যত নিষ্ঠুরই হোক না কেন, তাকে অন্তত শহীদান বলা যায় না। কিন্তু কুখ্যাত শাসক জিয়াউর রহমানের অনুসারীরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর গোয়েবলসীয় কায়দায় তাকে শহীদ বলতে বলতে শহীদ শব্দটিকে জিয়াউর রহমানের নামাংশে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন নিষ্ঠুর সময় আসে যখন এমন সব নারকীয় ঘটনা ঘটে যে অনেক শব্দের অর্থ পাল্টে যায়- যেমন, রাজাকার, আলবদর ইত্যাদি শব্দের অর্থ পাল্টে গেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে, যেমন মীর জাফর শব্দের অর্থ পাল্টে গেছে ভারতবর্ষের ইতিহাসে, যেমন রাসপুটিন শব্দটি মানবস্বভাবের একটি বিশেষ ধরণনির্দেশক হয়ে উঠেছে বিশ্বমনস্তত্বের ইতিহাসে। শহীদ শব্দটির এই অপব্যবহার অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতের বাংলা অভিধান ত্যক্তবিরক্ত হয়ে এর শব্দার্থ করবে ‘সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত কুখ্যাত সামরিক জান্তা।’
এ হেন এক কুখ্যাত সামরিক জান্তার অনুসারী ব্যারিস্টার মওদুদ, যিনি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দুর্নীতির দায় থেকে বাঁচার জন্যে ধন্য করেছিলেন আর এক কুখ্যাত ও কুলাঙ্গার সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিপরিষদকে, যে-পাত্রে রাখা যায় সেই পাত্রেরই আকার ধারণ করা ছাড়াও তার বিশেষ আরেকটি গুণ হলো, দশ-দশটি বই লিখেছেন তিনি। আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিক বই-ই পড়েন না, বই লেখা তো অনেক দূরের ব্যাপার। ইদানিং গণমাধ্যম প্রসারিত হওয়ায় তাদের তাই উপকারই হয়েছে। তারা প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙেই সংবাদপত্রে কিংবা টিভিতে অন্য কোনও নেতার খবর ও ছবি দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তারপর ঘরে বসেই রিপোর্টারদের ডেকে পাঠিয়ে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে থাকেন। আর রিপোর্টারদেরও বিষয়বস্তুর অভাব, আবার অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে গেলে খাটুনি অনেক, অতএব তারাও এরকম সব ফাঙ্গাসপড়া রাজনীতিকদের উত্তেজিত করে তুলে উত্তেজক সব কথাবার্তা ছাপিয়ে বা প্রচার করে আলোচনার পাদপ্রদীপে আসার চেষ্টা চালান। কিন্তু রিপোর্টারদের কি সাধ্যি আছে যে ব্যারিস্টার মওদুদকে কেবল বলা-কওয়াতেই সীমিত রাখবেন? তিনি হলেন ব্লেড- ব্লেড দুদিকেই কাটে- মওদুদ রিপোর্টারদের সামনেও বলতে পারেন, কাগজেকলমেও লিখতে পারেন। তাঁর লেখা সেরকমই একটি বই হলো ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলাপমেন্ট। তাহের হত্যা মামলার শুনানীর সময় আদালতে ঠাঁই পেয়েছে সে-বই, কেননা তাতে তিনি লিখেছেন, জিয়াউর রহমান তাঁর কাছে বলেছিলেন, পাকিস্তানফেরতা সামরিক কর্মকর্তাদের চাপে নাকি জিয়াউর রহমান তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমানের অতীত ইতিহাস অবশ্য বলে, পাকিস্তানঘেঁষা বিবিধ চাপের মধ্যে থাকতেই ভালোবাসতেন তিনি। সানন্দেই এরকম বিভিন্ন চাপ সহ্য করতেন তিনি। উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তার ‘চাপে’ অকুতোভয় জিয়াউর রহমান ২৫ মার্চ রাতে সোয়াত থেকে পাকিস্তান থেকে আসা সামরিক সরঞ্জাম নামানোর জন্যে রওনা হয়েছিলেন, তারপর ভাগ্যের ফেরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও সেনাপতি ওসমানীকে বার বার ক্রুদ্ধ করে তুলেছেন নানা কাজের মধ্যে দিয়ে, তিন-তিনবার ওসমানী বহিষ্ড়্গারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে। মুক্তিযুদ্ধ জিয়াউর রহমানের সামনে পাকিস্তানি চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিরাট এক সুযোগ এনে দিয়েছিল, কিন্তু জিয়াউর রহমানের পাকিস্তানি মন তাতে সায় দেয়নি। এক মুহূর্তের জন্যেও জিয়ার পাকিস্তানি মন শান্তি পায়নি একাত্তর থেকে পচাত্তর অবধি- তার অতৃপ্ত পাকিস্তানি মন প্রথম শান্তি পায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরে, দ্বিতীয় দফায় শান্তি পায় ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোরে।
ব্যারিস্টার মওদুদ তাহেরের প্রশংসা করেছেন, আবার তারপরই বলেছেন, ‘কর্নেল তাহেরের বিচার বৈধ বা অবৈধ যাই হোক, একটি ট্রাইবুøনাল গঠন করে তার বিচার হয়েছিল। অন্যদিকে সিরাজ সিকদারকে কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছিল।’ তার মানে, মওদুদ কি বোঝাতে চান, ট্রাইবুøনাল গঠন করে বিচার করলেই সব বৈধ হয়ে যায়? বাংলাদেশে আইনসঙ্গতভাবে, গণতান্ত্রিক উপায়ে গঠিত এবং জনগণের রায়ে নির্বাচিত সংসদ থেকে অনুমোদিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের পরও সেটিকে ‘রাজনৈতিকউদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ‘আইনবহির্ভূত’ ইত্যাদি বাক্যবাণে জর্জরিত করছেন মওদুদ আর তার যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক সঙ্গীরা। ভাড়াটে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, যে-অধ্যাদেশের আওতায় বিচার করা হবে, তা আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়। এরকম সব কর্মকাণ্ডের বাজনাদার ব্যারিস্টার মওদুদ কোন মুখে বলেন, ‘বৈধ বা অবৈধ যাই হোক, একটি ট্রাইবুøনাল গঠন করে তার বিচার হয়েছিল’?
আর সিরাজ সিকদার! তার নামও কি মানায় মওদুদের মুখে?
সিরাজ সিকদারের জন্যে এটি একটি বিরাট দুভার্গ্যই বটে- তিনি এখন বস্তাপঁচা ডানপন্থী রাজনীতিকদের পথিকৃৎ উদাহরণ। প্রতি বছর তার জন্মমৃত্যু দিবসগুলিতে ডানপন্থীরা যত মায়াকান্না আর আস্ফালনই দেখাক না কেন, সেসবের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে বিপ্লব ঘটানো নয় এমনকি সিরাজ সিকদার হত্যার বিচার করাও নয়। বিএনপির নেতা তারেক রহমান তার পিতা জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যেমন মনে করেন, ‘তার হত্যাকাণ্ডের বিচার হলে কি দেশের উন্নয়ন ঘটবে? তা হলে হয়তো এ বিচার করা যেতো।’, সিরাজ সিকদার হত্যার বিচার সম্পর্কে বিএনপি যে এর চেয়ে উন্নত কোনও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবেন না, তা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, এরশাদপতনের পর আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার প্রচুর তৈলসহযোগে কল্কে পাওয়ার এবং শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন মজহার এই চেষ্টার অংশ হিসেবে। এই মুহূর্তে সাক্ষাৎকারটি হাতের কাছে নেই বলে উদ্ধৃতি দিতে পারছি না-তবে ওই সাক্ষাৎকারটিতে কি হাসিনা কি মজহার উভয়েই আলোচনা করেছিলেন সিরাজ সিকদার হত্যার ঘটনাটিকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এরকম ঘটনা ঘটানো সম্ভব ছিল কি না ইত্যাদি নিয়ে।
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যুদ্ধপরবর্তীকালে একটি রাষ্ট্র-সমাজকে যে-সব আদর্শ ও বাস্তবতার সংঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তার উদাহরণ সেসব রাজনৈতিক হত্যা। উদাহরণ রাজনৈতিক অদূরদর্শিতারও এবং অবশ্যই এখনও আমাদের অনেকের পরিবারকে সেসব হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি শোকাচ্ছন্ন করে রেখেছে। আওয়ামী লীগ সরকার এসব হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে মুক্ত নয়, যেমন মুক্ত নয় বিরোধী প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলিও। মওদুদ আহমদরা এমনভাবে কথা বলেন যে মনে হয়, আমরা সেসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলি ভুলে গেছি; মওদুদ আহমদরা এমনভাবে কথা বলেন যে মনে হয়, ওইসব হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে পরবর্তী শাসনামলগুলির হত্যাকাণ্ডগুলিকেও বৈধ করা যায়! বাস্তবতা হলো, হত্যাকাণ্ডগুলির বিচার নয়, বরং সেগুলি নিয়ে রাজনীতি করতেই তারা ভালোবাসেন, ভালোবাসেন জল ঘোলা করতে। যেমন, ব্যারিস্টার মওদুদ আদালতকে বলেছেন, পত্রিকাগুলি তার কথা ঠিকভাবে লেখেনি, আদালতকে তিনি অনুরোধ করেছেন পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু আদালত তাকে লিখিত আবেদন করার আহ্বান জানাতেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, বলেছেন, চিন্তা করে দেখবেন। সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ড নিয়েও মওদুদ আহমদ যাই বলুন না কেন, মামলা করার আগে অনন্ত চিন্তারাজ্যে নিমগ্ন হয়ে যাবেন।
মওদুদ আহমদরা যাই মনে করুন না কেন, গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাহেরসহ তার অপরাপর সঙ্গীদের বিচার বৈধ ছিল কি না- হাইকোর্টের এই বিচারপ্রক্রিয়া মানুষের সামনে জিয়াউর রহমানের মুখোশটিও খুলে ফেলবে। তাহেরের মতো মহাপ্রাণ আবারও জেগে উঠবে। প্রমাণিত হবে, জিয়াউর রহমান একটি কুখ্যাত, দুর্গন্ধযুক্ত নেংটি ইঁদুর ছাড়া আর কিছু নন। কুখ্যাত নেংটি ইঁদুররা গোপনে, গৃহের সকল মানুষের অনুপস্থিতির সুযোগে গৃহের সবকিছু কেটেকুটে তছনছ করে, সারা ঘরে তোষক-বালিশের তুলো ছড়ায়। জিয়াউর রহমানও তাই করেছিলেন তার শাসনামলে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের ছদ্দাবরণে-একদলীয় বাকশাল থেকে বহুদলীয় শাসনের নামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একনায়কতান্ত্রিকতার জগত, সেখানে তিনি ইচ্ছেমতো কাটাকাটি করেছেন গণতন্ত্রকে, খাল কেটে কুমীর এনেছেন, নদীশাসন করেছেন, রাস্তার গাছপালা কেটে সৌন্দর্য ও পরিবেশ দুটোই নষ্ট করেছেন, যাত্রীচলাচলের সুবিধার নামে মিনিবাস এনে যাত্রীপরিবহনের বারোটা বাজিয়েছেন, নদী থামিয়ে সড়ক নির্মাণ করে রেলপথকে ধ্বংস করেছেন, শিক্ষা ও সংস্ড়্গৃতিতে ধর্মান্ধতা ঢুকিয়েছেন, ভোগ্যপণ্যের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে চেয়েছেন মানুষের সূক্ষ্ন-সুরুচিকর আনন্দ অন্বেষণের প্রচেষ্টাকে। মানুষের জীবনকে সস্তা করে তুলেছেন তিনি। ১৯৭৫ আগেও মানুষের জীবন সস্তা ছিল, কিন্তু এত আদর্শহীন ছিল না। তিনি মানুষকে আদর্শহীন করে রেখে গেছেন। আদর্শহীন সেই প্রজন্ম এখন আমাদের সামনে, যাদের পথিকৃৎ তারেক ও কোকো।
তাহের, সত্য বটে, অতীতের বিষয়- কিন্তু সত্যিই কি নিছক অতীত? এই দেশে, যেখানে মেরুদণ্ডহীন রাজনীতিকদের কারণে বার বার সামরিক শাসন এসেছে, যেখানে আস্তানা গেড়েছে স্বৈরতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রকারী ও স্বপ্নবাজ দুর্বৃত্তরা, তাহেরের মতো মেরুদণ্ড উচু করে দাড়ানো মানুষ, জনগণগামী মানুষ, স্বাপ্নিক এক মানুষ কি সেখানে কখনো অতীত হতে পারে? তা ছাড়া সময় আমাদের অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করায়, কেননা রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতির দুষ্টচক্র না চাইলেও ইতিহাস ও সময় সবসময়েই চায় অতীতকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে, প্রাপ্য সম্মান দিতে। তাই আবারও আমরা মুখোমুখি হয়েছি সেই ভয়াবহ অতীতের, যে-অতীতে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছিল এক দেশপ্রেমিককে। কুখ্যাত জিয়াউর রহমান এ রাষ্ট্রকে কী স্বৈরতন্ত্র, অপশাসন, গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রহীনতার পঙ্কিলে নিমজ্জিত করে রেখে গেছেন, দেশপ্রেমিক তাহেরের উদ্ভাসন জগতের সামনে সেই ভয়াবহ সত্য তুলে ধরবে।
অবিশ্রুত
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৮ comments
সৈকত আচার্য - ২৯ জানুয়ারি ২০১১ (১১:০৩ পূর্বাহ্ণ)
অবিশ্রুত লিখছেনঃ
এই সত্যগুলো আজকের দিনে জানা থাকা দরকার আমাদের। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন জিয়াউর রহমান (দেখুনঃ পঞ্চম সংশোধনী মামলা) এবং তার অদ্ভুত কায়দায় গড়ে তোলা রাজনৈতিক দল যেখানে হতাশ চৈনিক পথ ভ্রষ্ট বাম থেকে শুরু করে উগ্রডান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চেতনা বিরোধীরা ঠাঁই নিয়েছিলেন। ‘৭৫ এর পর থেকে এই শক্তি একে একে সংবিধান, রাষ্ট্র ক্ষমতা এবং তার খোল নলচে সব কিছু পাল্টানোর ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠে। একটি অভূতপূর্ব স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা একটি জাতির অসাম্প্রদায়িকতার মূল চেতনার ভিত্তি ধরে নাড়া দেন জিয়াউর রহমান, মোশতাক গং এবং উগ্র ধর্মীয়গোষ্টীগুলো যাদের শিরোমণি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামাত সহ রাজাকার আলবদর শকুন চক্র। ঘাতক গোলাম আজমকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করা থেকে শুরু করে পাকিস্তান পন্থা এবং উগ্র ডান পন্থাকে রাজনীতির মাঠে দুধ কলা দিয়ে পুষেছেন জিয়াউর রহমান। ফলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ধারায় চালিত করা এই ব্যক্তিটির মুখোশ উন্মোচন হওয়া খুব জরুরী।
নির্ভীক কর্নেল তাহেরের প্রতিটি শিরায়-ধমনীতে ছিল চে গুয়েভারার মত স্বপ্ন দেখার বিপ্লবী সাহস এবং স্পর্ধা। মৃত্যুকে ভগতসিংহ, এবং সূর্যসেনরা যেভাবে আলিংগন করার দুঃসাহসিক স্পর্ধা দেখিয়েছেন কর্নেল তাহের ছিলেন এদেশে তাদেরই একজন অত্যন্ত যোগ্য উত্তরসূরী যিনি ভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছিলেন মাত্র। দেশ কালে এরা ভিন্ন কিন্ত চিন্তায় এক এবং সম্পূর্ন অভিন্ন। উদ্দেশ্য এদের সব কালেই এক। এরা সম্পূর্ন ভিন্ন ধাতুতে গড়া ক্ষণজণ্মা মহাপ্রান। তাহের দেশের প্রতি ভালোবাসার অন্য রকম টানে সামরিক পোশাক গায়ে চড়িয়েছিলেন। চাকরীর প্রয়োজনে নয় কিন্ত। তাহেরের বুকে ছিল দেশের জন্য সমাজের জন্য এমন এক ভালোবাসা, যার খুব বেশী তুলনা ছিল না। একজন দরিদ্র মওদুদ তাহের বিষয়ক আলোচনায় অতি নিম্নশ্রনীর একজন কীট, তাহের বেঁচে থাকলে এই মওদুদদের দেখার দুর্ভাগ্য হয়তো জাতির হতো না। তাহেররা বেঁচে নেই বলেই হয়তো নর্দমার এই কীটেরা সবখানেই জায়গায় অজায়গায় বারবণিতার মতো আসন পাতেন এবং সব বিষয়েই কিছু একটা বলতে ভালোবাসেন এবং কখনো কখনো ভুল ভাবে সম্মানিত হয়ে যান। মেধাহীন-মেরুদণ্ডহীন কিছু মানুষের কাছে।
তাহেরের জীবনের বিশেষ ঘটনা বহুল অংশগুলো নিয়ে তাঁরই অনুজের অসাধারন একটি লেখা এটি…।
এই লেখাটি পড়ার আহবান রইলো সবার প্রতি।
মাসুদ করিম - ২৯ জানুয়ারি ২০১১ (৪:২৬ অপরাহ্ণ)
সূর্যসেনের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে তাহেরের নাম চিরদিনের জন্য মুদ্রিত হয়ে গেছে। অসফল হলেও তারা মহান হৃদয়ের মানুষ, তারা মৃত্যুঞ্জয়ী, লাখ লাখ সফল মানুষের চেয়ে এই অসফলরাই আমাদের হৃদয়ে আলোর জোগান দেয়।
আর সফল নেংটি ইঁদুরদের (জিয়া, এরশাদ) কথা তো লেখক বলেছেনই। আর এই নেংটি ইঁদুরেরও চেলা যারা — তারা যতই বই লিখুন আর আইনবিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেদের জাহির করুন না কেন, ওই তাদের চেম্বারে যারা পরবর্তীতে বসবে তারা ওদের মনে রাখবে কি না আমার সন্দেহ আছে।
মাসুদ করিম - ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (১:৩৪ অপরাহ্ণ)
এটা ঠিক মন্তব্য নয় মিসরের ৩০ বছরের ধিক্কৃত স্বৈরাচারী সরকারের বর্তমান গণবিক্ষোভ দমনের ন্যাক্কারজনক কার্যকলাপে মওদুদ বিষয়ক একটা ঘটনা মনে পড়ল — একে টীকা বলা যেতে পারে। ১৯৯০ সালের ০২ ডিসেম্বর বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে মওদুদ বলেছিলেন
অবশ্য এর একদিন পরই ০৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চাপে এরশাদ উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদকে সরিয়ে দিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। আর তারপর এই সাহাবুদ্দিন আহমেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেই এরশাদ পদত্যাগ করেন।
জানি না, মিসরের গণতন্ত্রের আকাঙক্ষায় কী ঘটবে। এর মধ্যে মুবারক এরশাদের মতোই আরেক বিশ্ববেহায়ায় পরিণত হয়েছেন। এবং সেথানে মওদুদের ভূমিকায় উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে আছেন আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দা ওমর সুলাইমান। আমরা তার মওদুদের মত পরিণতি আশা করি এবং মিশরের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সাফল্য কামনা করে একজন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে মুবারকের ক্ষমতা হস্তান্তর কামনা করি। আর সেসাথে এটাও বলতে চাই এরশাদ-মুবারকদের পাশাপাশি সমান ঘৃণায় যেন মওদুদ-সুলাইমানদের নাম উচ্চারিত হয়।
অবিশ্রুত - ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (৩:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
ত্রিশ বছর ধরে অপেক্ষা করছিলেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ-তাহেরের গোপন বিচার একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধ, একদিন নিশ্চয়ই এ অপরাধের বিচার হবে-এই প্রত্যাশা নিয়ে। বলেছেন তিনি, জিয়া একক সিদ্ধান্তে এই রাষ্ট্রীয় অপরাধ সংঘটিত করে, যা তাকে জানিয়েছেন জিয়ার ঘনিষ্ট দুই কর্মকর্তা :
তাহেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, এ তথ্য নতুন নয়। নতুন করে যা ঘটছে, তা হলো,দেশের আদালতে বিষয়টি উঠে এসেছে-যে বিচার গোপনে হয়েছিল, এবার আদালতই দেখাবে, সেই গোপনীয়তার যৌক্তিকতা কোথায় ছিল, আদৌ ছিল কি না, কেন গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস মিথ্যার থাকে না,যে-সব মিথ্যার ওপর ভর করে জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছে, তার সবই একে একে ধ্বসে পড়বে।
রেজাউল করিম সুমন - ২৩ মার্চ ২০১১ (৭:০৮ পূর্বাহ্ণ)
কর্নেল তাহেরের প্রহসনমূলক গোপন বিচার অবৈধ : হাইকোর্টের রায়
তাহেরের গোপন বিচার অবৈধ
প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১১
মোহাম্মদ মুনিম - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অংশ (সপ্তম খন্ড) হিসাবে প্রকাশিত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অসংখ্য সরকারী বিজ্ঞপ্তি, সামরিক ঘোষণাতে মেজর জিয়ার নাম একটিবারের জন্যও আসেনি। মেজর জিয়ার বহুল আলোচিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা যা শুনে নাকি সারা দেশ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই স্বাধীনতার ঘোষণা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে একবিন্দুও বিচলিত করলো না, ব্যাপারটা খানিকটা অবাক করার মতই। চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক এক প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জিয়াউর রহমানের বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ করার পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে, সেটা হচ্ছে অসংখ্য নিরস্ত্র অবাঙ্গালী হত্যা। অবাংগালী নারীদের নিয়ে হারেম খোলার কথাও সেই মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করেছেন। আমোদ ফুর্তির শেষে এই নারীদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এক নারীর কয়েক মাসের সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়ার কথাও সেই মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করেছেন। সেই মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেছেন যে জিয়ার পক্ষের সৈনিকেরা ৭১ এ তাদের ‘দুরাবস্থা’র জন্য প্রায়শঃ ছাত্রদের দায়ী করতো।
নিজেকে ক্ষমতায় রাখার জন্য তুচ্ছ কারণে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা ছাড়াও জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে irreversible ভাবে দুষিত করেছেন। দেশের রাজনীতিতে ইসলাম ঢুকিয়েছেন, রাজাকারদের দেশে এনেছেন, ছাত্ররাজনীতিতে দুর্নীতি ঢুকিয়েছেন। আজকের বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক তরুণ যুবকের কাছে রাজনীতি মানে টুঙ্গিপাড়ার কোন কিশোরের ১২ বছর বয়সে মিছিলে জোগদান নয়, কর্মচারীদের দাবী আদায়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে বহিষ্কৃত হওয়া নয়, রাজনীতি মানে হচ্ছে ‘দেশ গড়া’। সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে করতে ফাঁকতালে ক্ষমতা নিয়ে রাজনীতিবিদদের জেলে পুরে ফেলে, খাল কেটে বা পাবলিক কে আলু খাওয়া শিখানোটাই আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে আসল রাজনীতি।
সায়েম চৌধুরী - ৪ মার্চ ২০১১ (১০:১৩ অপরাহ্ণ)
কর্ণেল তাহের আজও আমাদের বিপ্লবের স্বপ্ন দেখায়। বাংলাদেশের অনেক তরুণ তাহেরের অসম্পূর্ণ বিপ্লব সফল করতে বদ্ধপরিকর।
মাসুদ করিম - ১০ এপ্রিল ২০১১ (৬:৪৯ অপরাহ্ণ)
বিস্তারিত পড়ুন : মির্জা ফখরুলের মন্তব্য অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য: পিটার কাস্টার।