'হলোকস্ট'-এর প্রত্যাবর্তন

গাজায় ইসরাইলিদের শিশুহত্যা ২০০৯ একজন শিশু যখন তাকিয়ে তাকিয়ে আরেকটি শিশুর মৃতদেহ দেখতে থাকে, মৃত শিশুর চোখেমুখে বিপণ্ন বিস্ময় নিয়ে বেঁচে থাকার সামান্যতম চিহ্ন খুঁজতে থাকে এবং একইসঙ্গে নিজেও অপেক্ষা করতে থাকে মৃত্যুর জন্যে, তখন এই পৃথিবীর জীবিত পরিণত মানুষ হিসেবে আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? [...]

গাজায় ইসরাইলিদের শিশুহত্যা ২০০৯

গাজায় ইসরাইলিদের শিশুহত্যা ২০০৯

একজন শিশু যখন তাকিয়ে তাকিয়ে আরেকটি শিশুর মৃতদেহ দেখতে থাকে, মৃত শিশুর চোখেমুখে বিপণ্ন বিস্ময় নিয়ে বেঁচে থাকার সামান্যতম চিহ্ন খুঁজতে থাকে এবং একইসঙ্গে নিজেও অপেক্ষা করতে থাকে মৃত্যুর জন্যে, তখন এই পৃথিবীর জীবিত পরিণত মানুষ হিসেবে আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? জীবন মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বটে, কিন্তু সেই জীবনের মূল্য কি এতই বেশি যে শিশুদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু সহ্য করেও আমাদের এই জীবনকে বয়ে বেড়াতে হবে?

গত দুই সপ্তাহ ধরে কেবল প্যালেস্টাইনীরা নয়, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিয়ে কেউ আক্ষরিকভাবে কেউ মানসিকভাবে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। প্যালেস্টাইনে এখন যুদ্ধ নয়,- চলছে গণহত্যা এবং এই একতরফা গণহত্যা পরিচালনা করছে ইসরাইল। গত ১৫ দিনে সেখানে ৮২০ জনকে হত্যা হয়েছে, যার মধ্যে তিনশ জনই শিশু আর শ’খানেক নারী। মৃত্যুকে সেখানে সহজলভ্য করে তোলা হয়েছে, বন্ধ সেখানে খাদ্যসরবরাহ। আহত মানুষ, তাদের রক্ত ও আর্তচিৎকারে ভরে উঠেছে হাসপাতালগুলো, কিন্তু চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই। কেননা বছরের পর বছর ধরে ইসরাইল যেভাবে গাজাকে অবরোধ করে রেখেছে তাতে অনেক আগেই হাসপাতালগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে, সেখানে ওষুধের সরবরাহ ওষুধ নেই, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, ডাক্তাররা কোনওমতে টিকে আছেন জীবন বাজি রেখে, আবার কোনও কোনও হাসপাতালে ডাক্তারও নেই।

জিম্বাবুয়েতে যদি এরকম ঘটনা ঘটত, তা হলে ব্রিটেনসহ পশ্চিমা সব মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ত, আলোচনার ঝড় উঠত, বিরাট এক মানবিক সংকটকে ঠেকানোর জন্যে তৎপর হয়ে উঠতেন কথিত সভ্য বিবেকমান মানুষেরা। জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতিকে আমরা খাটো করে দেখছি না; তারপরও বলতে হয়, প্যালেস্টাইন জিম্বাবুয়ে নয়, তাই ব্রিটেনের নীতিনির্ধারকদের তত মাথাব্যথা নেই। হ্যাঁ, কিছুটা মাথাব্যথা আছে বটে। আর আছে বলেই গত ১০ জানুয়ারি যখন ব্রিটেনের হাইড পার্কে সমবেত হয়েছিলেন প্রতিবাদীরা, প্যালেস্টাইনি পতাকার সমুদ্র হয়ে উঠেছিল স্পিকার্স কর্নার তখন সেই প্রতিবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করেছিলেন ব্রিটেনের সরকার। প্রতিবাদকারীদের মিছিল যখন কেনসিংটন গার্ডেনের দিকে রওনা হয়েছিল, তখন তা যাতে ইসরাইলি দূতাবাসের ধারে কাছে যেতে না পারে, সেজন্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। তাই প্রতিবাদকারীরাও বাধ্য হয়ে হাতে তুলে নিয়েছিল মুনতাজারের জুতা, সংঘাত শুরু হয়েছিল পুলিশের সঙ্গে। পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে এ ঘটনায়, কিন্তু একজন কমান্ডার গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, গ্রেফতারের সংখ্যা ৪০-এ গিয়ে ঠেকতে পারে। তার মানে আরও অনেককে খুঁজছে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করবার জন্যে। প্রায় এক লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিল সেদিন বিক্ষোভ করতে, কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ তাদের ভাষ্যে এই সংখ্যাকে নামিয়ে এনেছে মাত্র বিশ হাজারে। কেননা কিছুটা হলেও মাথাব্যথা রয়েছে তাদের। ১০ জানুয়ারির ওই হাজার হাজার প্রতিবাদকারীদের মধ্যে কেবল ব্রায়ান ইনো আর অ্যানি লেনোক্সই ছিলেন না, ছিলেন তারিক আলী, ছিলেন সাংবাদিক লরেন বুথ,- যিনি তার বোনের স্বামী টনি ব্লেয়ারের যুদ্ধবিরতির পরামর্শের তীব্র সমালোচনা করে বলছিলেন, এর মধ্যে দিয়ে প্যালেস্টাইনিদের মন্থর এক যন্ত্রণাকর মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেয়া হবে।

এইদিন কেবল লন্ডনেই নয়, গাজায় নির্বিচার হত্যার প্রতিবাদে প্যারিসে বিক্ষোভ করেছে ৩০ হাজার মানুষ, লিওনে বিক্ষোভ করেছে ১০ হাজার মানুষ, বার্লিনে করেছে সাড়ে আট হাজার মানুষ। জার্মানির আরেক শহর ডুইসবার্গেও বিক্ষোভ করেছে ১০ হাজার মানুষ। আর অসলোতেও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে পুলিশের। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে ছুড়েছে ঢিল, বোতল আর আতশবাজি; পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দিকে ছুড়েছে কাঁদানে গ্যাস।

এমনকি ইসরাইলের বিবেকসম্পন্ন সাধারণ মানুষও উদ্বিগ্ন এই গণহত্যা নিয়ে। শুরু থেকেই প্রতিবাদ করে আসছে তারা। ১০ জানুয়ারি রাতে তেলআবিবে কয়েক হাজার ইসরাইলি বিক্ষোভ করে তেল আবিবের কেন্দ্রস্থলে দ্য সেন্ট্রাল কমান্ড অব দ্য ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস অ্যান্ড দ্য মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স হাকিরা-র সামনে। এটি ছিল ইসরাইলকে যারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় না এমন সব ইসরাইলিদের গত তিন সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় প্রতিবাদ সমাবেশ। প্রথম সমাবেশটি তারা করেছিল গাজায় ইসরাইলের প্রথম বিমান হামলা হওয়ার পরেই। তাতে অংশ নিয়েছিল মাত্র কয়েকশ প্রতিবাদকারী। কিন্তু দিন যত বাড়ছে, প্রতিবাদকারীও বাড়ছে; দ্বিতীয় প্রতিবাদের সময় রাস্তায় নেমে আসে দুই হাজারের বেশি মানুষ। এই বিক্ষোভের আয়োজন করে পিস নাউ। সংযুক্ত প্যালেস্টাইনি-ইসরাইলি বেসরকারি সংগঠন অলটারনেটিভ ইনফরমেশন সেন্টার সকলের প্রতি আহ্বান রেখেছিল ১০ জানুয়ারিকে গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে একটি ব্যাপক বৈশ্বিক সমাবেশের দিন করে তোলার। সেই আহ্বানে সারা দিয়ে ইসরাইলে বিক্ষোভের উদ্যোগ নেয় শান্তি আন্দোলনকারী সংগঠন গুস শালোম। এ বিক্ষোভে যোগদানকারী পিস নাউ-এর ইউসেফ ডৌয়েক ইন্টার প্রেস সার্ভিসের কাছে বলেছেন, ‘জনমতকে প্রভাবিত করার জন্যে আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব তা আমরা করে চলেছি। যদিও আমি জানি আমাদের এই কাজের প্রভাব খুবই সামান্য। কেননা এমন একটি দেশে আমরা বসবাস করছি, যেখানে গণমাধ্যম রাজনৈতিক কনসেনসাসকে ঢেলে সাজাতে আগ্রহী নয়। একই সময়ে আমাদের বারতার রাজনৈতিক উপস্থাপনটিও বাস্তবে বিরাজ করছে না। নিদেনপক্ষে, এই পর্যায়ে সবাইকে যুদ্ধকে সমর্থন করার মতো দেশপ্রেম তাড়িয়ে ফিরছে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, এই অবস্থার শীঘ্রই পরিবর্তন ঘটবে। জনগণের সমর্থন ভেঙে পড়বে ঠিক আগের সব যুদ্ধাবস্থার মতোই।’ ইসরাইলের বামপন্থী সংগঠন মেরেজ-এর নেতা ইডো গাইডেওন বলেছেন, ‘আমাদের সবাইকেই অনুভব করতে হবে যে হলোকাস্ট যেমন ইসরাইলিদের জাতীয় আত্মার অংশ, নাকবাও তেমনি প্যালেস্টাইনিদের জাতীয় আত্মার আত্মার অংশ। এখন আমাদের সময় এসেছে বরং আমাদের এই বেদনা নিয়ে কথা বলবার।’ (১৯৪৮ সালে ইসরাইল নামের রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার সময় প্যালেস্টাইনে গ্রামের পর গ্রামে, শহরের পর শহরে যে গণহত্যা ও বসতিউচ্ছেদ পর্ব চলে তা ইতিহাসে নাকবা নামে অভিহিত।) । ইসরাইলে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন দূতাবাসগুলির কূটনীতিকদের বরাবর চিঠি লিখেছেন ৫০০ ইসরাইলি, যাদের অনেকেই শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী; বলেছেন তারা দ্রুত এই অবস্থার নিরসনকল্পে উদ্যোগ নিতে, বলেছেন জাতিবিদ্বেষবিরোধী সংগ্রামকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে। বলেছেন তারা, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার বয়কট কার্যকর হয়েছিল, কিন্তু ইসরাইলকে তদারকি করা হচ্ছে কিডস গ্লোভস দিয়ে… এই আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’

সত্যিকার অর্থেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রকারান্তরে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে ইসরাইলকে। প্রথমে ইয়াসির আরাফাতকে সুপরিকল্পিতভাবে চিকিৎসার নামে হত্যা করা হয়েছে এবং এখন হামাস দমনের নামে ইসরাইল চেষ্টা করছে গোটা প্যালেস্টাইনের ওপর নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার। যতদিন আরাফাত জীবিত ছিলেন, ততদিন আরববিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্যালেস্টাইনের মুক্তিসংগ্রামকে হৃদয় থেকে সমর্থন করেনি এ কারণে যে, প্যালেস্টাইন হবে আরববিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্র। আর এখন তারা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে থাকতে চাইছে এই ভয়ে যে, হামাসের নেতৃত্বে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রটি হবে পশ্চিমাশক্তি বিরোধী জঙ্গি মুসলিম রাষ্ট্র। এই পরিস্থিতি তুলে ধরছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে আরব বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির আন্তঃসম্পর্কের একটি ধরণ, যা নতুন কোনও জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রচণ্ড ভীত। জুলাই ২০০৫ সালে বিভিন্ন প্যালেস্টাইনি গ্রুপগুলি ইসরাইলকে অবরোধ ও বর্জন করার মতো বৈশ্বিক আন্দোলনের দিকে মনযোগী হয়েছিল। তারা আহ্বান রেখেছিল, অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেমন গোটা বিশ্ব বৃহৎ এক অবরোধ গড়ে তুলে সেখানে জাতিগত বিদ্বেষ ও সহিংসতার অবসান ঘটিয়েছিল, ইসরাইলের বিরুদ্ধেও সেরকম বৈশ্বিক অবরোধ গড়ে তোলা হোক। কিন্তু এই উদ্যোগকে নানাভাবে পর্যুদস্ত করা হয় এবং ইসরাইল অচিরেই গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। ২০০৬ সালের পর থেকে ইসরাইল গাজায় তার বসতিএলাকাকে বাড়িয়ে চলেছে, লেবাননের বিরুদ্ধে আগ্রাসী যুদ্ধে শামিল হয়েছে এবং জঘন্য অবরোধের মধ্যে দিয়ে গাজাবাসীর জীবনযাপনকে বিপণ্ন করে তুলেছে। বাড়িঘর ভেঙে দেয়া হচ্ছে গাজাতে, জোর করে উচ্ছেদ করা হচ্ছে সাধারণ অধিবাসীকে, বাধ্য করা হচ্ছে কালার-কোডেড আইডি এবং ট্রাভেল পারমিট ব্যবহার করতে, সেটলার-অনলি রোড ব্যবহার করতে। দক্ষিণ আফ্রিকার একজন খ্যাতনামা রাজনীতিক রনি কারসিল বলেছেন, পশ্চিম গাজায় তিনি ২০০৭ সালে পৃথককরণের যে-স্থাপত্য দেখতে পেয়েছেন তা জাতিবিদ্বেষের চেয়েও অনির্দিষ্টরকম খারাপতম কিছু। কিন্তু এর জন্যে ইসরাইলকে কোনও শাস্তি পেতে হয়নি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে বছর বছর তিন বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, সমরাস্ত্রও দিচ্ছে উদার হাতে। ইসরাইল হলো ল্যাটিন আমেরিকার বাইরের প্রথম রাষ্ট্র যেটি মারকোসার-এর (আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে এবং প্যারাগুয়ের অর্থনৈতিক সংস্থা) সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে ২০০৭ সালে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইসরাইলের নতুন এক বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে, যার ফলে ইসরাইল এখন তাদের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ইউরোপে দ্বিগুণ পরিমাণ সরবরাহ করছে। আর গত আট ডিসেম্বর, গাজায় ইসরাইল হামলা শুরু করার ২১ দিন আগে ইউরোপিয় মন্ত্রীরা ইইউ-ইসরাইল অ্যাসোসিয়েশন এগ্রিমেন্টকে পরিবর্ধন করেছেন।

এইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলি ইসরাইলকে যেভাবে এখনও পৃষ্ঠপোষকতা করছে, তাতে ইসরাইল বরং প্রতিদিন আরও ভয়ানক এক দানব হয়ে উঠছে। গাজা উপত্যকায় গত দুই বছরের অবরোধের মাধ্যমে ইসরাইল নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ, তেল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে বঞ্চিত করেছে ১.৫ মিলিয়ন মানুষকে। তারপরও ইসরাইলের গায়ে হাত বুলানো বন্ধ করেনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো রাষ্ট্রগুলো। এই পৃষ্ঠপোষকতার পথ যাতে পরিষ্কার থাকে সেজন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্র তো গণমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণ করছে; কোনও ক্যাবল বা স্যাটেলাইট সরবরাহকই সেখানে ইংরেজি ভাষার আল-জাজিরা চ্যানেলটি প্রদর্শন করে না, কেননা এ ব্যাপারে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং কোনও কোনও স্যাটেলাইট সরবরাহক নিজেরাই এ মাধ্যমটিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে হুমকি বলে মনে করেন। যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার বিজয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন, সেখানে পরিবর্তনের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে চিৎকার করছিলেন, সারা বিশ্বের সেইসব মানুষও এখন হতভম্ব; কেননা বারাক ওবামা এখনও রাষ্ট্রক্ষমতা নেননি এই অজুহাতে বুশ প্রশাসনের ইসরাইল নীতি সম্পর্কে উদ্যোগ নেয়া দূরে থাকা, মন্তব্য করতেও খোলাখুলি আপত্তি জানিয়েছেন। এমনকি বিবিসি-র মতো আপাত-জনপ্রিয় গণমাধ্যমটির সংবাদ বা আলোচনাতেও ইসরাইলের এই নৃশংস গণহত্যাকে উল্লেখ করা হয় অনেক নরম করে ইসরাইলের ‘মিলিটারি ক্যাম্পেইন’ হিসেবে। সাধে কী জর্জ গ্যালাওয়ে বিবিসি-র শব্দ-সম্প্রসারণ করেছিলেন ‘বুশ-ব্লেয়ার ক্যাম্পেইন’ হিসেবে!

ইসরাইল রাষ্ট্রটি এখন পৃথিবীর একটি অন্যতম বাস্তবতা, কিন্তু ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় রাষ্ট্রগুলির কর্ণধাররা এ-কথাটি বুঝতে নারাজ যে প্যালেস্টাইন তার চেয়েও বড় বাস্তবতা। যে-কারণে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রই ধর্মজ রাজনীতিমুক্ত হওয়া প্রয়োজন, সব রাষ্ট্রকাঠামোই ধর্ম থেকে মুক্ত থাকা প্রয়োজন, ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপিয় রাষ্ট্রগুলি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তার বিপরীত কার্যকারণগত অবস্থান থেকে। এই দ্বৈততা ইসরাইল ও তার মিত্র দেশগুলির জন্যে যে সংকট তৈরি করেছে, তারা তা কাটিয়ে উঠতে চাইছে নিজের নিরাপত্তা সৃষ্টির নামে প্যালেস্টাইনকে অবলুপ্ত করার অপচেষ্টা চালিয়ে। কিন্তু বর্বরতার মধ্যে দিয়ে কখনও নিরাপত্তা সৃষ্টি করা যায় না, গণহত্যার মধ্যে দিয়ে কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না, কাজেই ইসরাইলও এভাবে নিরাপত্তাব্যুহ গড়ে তুলতে পারবে না। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র কত বড় দানব হয়ে উঠতে পারে ইসরাইল তার সবচেয়ে উদাহরণ।

ইসরাইল যে গাজায় এই গণহত্যা শুরু করার মধ্যে দিয়ে আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতার সংকটে পড়েছে, লেবানন থেকে রকেট নিক্ষেপের ঘটনায় তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্কট এখন স্পষ্টতই আরও বিস্তারিত হতে চলেছে। আর এই সঙ্কট থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে উদ্ধার করা সম্ভব কেবল ইসরাইলকে এই একতরফা গণহত্যা ও দখলদারিত্ব থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে। এবং সে কাজটিও তেমন কঠিন নয়। কেননা ইসরাইল মূলত বাণিজ্যনির্ভর এক রাষ্ট্র এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যদি ইসরাইলকে ঘিরে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অবরোধ তৈরি করে, এসব ক্ষেত্রে তাদের বর্জন করে, তা হলে দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও কম সময়েএই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। হুগো শ্যাভেজ ভেনিজুয়েলা থেকে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছেন,- যা থেকে বিশ্বের আর সব রাষ্ট্রের শিক্ষা নেয়া উচিত।

অথচ সাম্প্রতিক এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দায়ভার চাপানোর অপচেষ্টা চলছে প্যালেস্টাইনের ওপরেই,- যদিও এই কয়েকদিন আগে সিএনএন-ও তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, হামাস নয় বরং মাসদুয়েক আগে ইসরাইলই রকেট হামলা চালিয়েছিল এবং তারপর থেকে তা অব্যাহত রেখেছে। এই হামলায় ইসরাইল ব্যবহার করছে বেআইনি রাসায়নিক হাতিয়ার ফসফরাস গ্যাস, পুড়িয়ে ফেলছে মানুষের হাড়গোড়কে। গাজায় কর্মরত নরওয়েজিয়ান ট্রিয়েগ মেডিক্যাল টিমের সদস্য ড. ম্যাডস গিলবার্ট প্রমাণ হাজির করেছেন, যাতে দেখা যাচ্ছে ইসরাইল এ হামলায় ব্যবহার করছে ডেনস ইনার্ট মেটাল এক্সপ্লোসিভ (ডিআইএমই),- যা টুকরো টুকরো করে ফেলে আঘাতপ্রাপ্ত মানুষটিকে আর ক্যান্সার ছড়িয়ে দেয় আশপাশের বেঁচে যাওয়া মানুষদের শরীরে।

কারা অস্ত্রের যোগান দেয় এই ইসরাইলকে? কারা জাতিসংঘের বৈঠকে বসে ফালতু সব যুক্তি টেনে সমর্থন করে এই ইসরাইলকে? আমাদের সবই জানা আছে। গাজাতে যে-নৃশংস গণহত্যা চলছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্য কিছুতেই এর দায় এড়াতে পারে না। বরং দিন যত যাচ্ছে এদের দায়ভার আরও বাড়ছে, কেননা হাতের ‘কিডস গ্লোভস’টি খুলে ইসরাইলের গায়ে সামান্যতম আচড় বসাতেও রাজি নয় এইসব দেশ। তাই যেসব গুলি গিয়ে প্যালেস্টাইনিদের গায়ে লাগছে, প্রতিটি গুলির সঙ্গে আসলে লেখা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাম, যুক্তরাজ্যের নাম, জাতিসংঘের নাম। এমনকি এই মুহূর্তে যে-মানুষটি এই গণহত্যার বিরোধিতা না করে নীরবতা পালন করছে, তার নামও লেখা রয়েছে ওই গুলির গায়ে, রকেটের গায়ে, বোমার গায়ে। ইসরাইল রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এখন বেছে বেছে কেবল শিশুদেরই হত্যা করছে, নারীদেরই হত্যা করছে,- কেননা তাদের মনে হচ্ছে এর মধ্যে দিয়ে প্যালেস্টাইনি বিস্তার রোধ করা যাবে; কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে তারা আসলে জন্ম দিয়ে চলেছে গভীর এক জাতিবিদ্বেষবোধের।

তারপরও আমরা চাই না, ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটির শিশুদের জীবনেও একই পরিণতি নেমে আসুক। আমরা চাই না তাদের রক্তমাখা লাশ নিয়ে তাদের মা-বাবাকে কাঁদতে হোক কিংবা এরকম গুলি ও বোমার শব্দে প্রতি মুহূর্তে তারা আতঙ্কিত হোক আর নির্ঘুম রাত যাপন করুক। আমরা শুধু একথাই বলব, ইসরাইলে এখন যারা শিশু, তারা বড় হোক, বেড়ে উঠুক শুভবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে। কিন্তু এই শুভবোধসম্পন্ন শিশুরা যখন অতীতের দিকে তাকিয়ে এই গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, ইসরাইলের আজকের নীতিনির্ধারকরা তখন কী জবাব দেবেন? সেই যে কবিতা আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের,- ‘অপমানে হতে হবে তাহাদের সমান’, সেই যে পৃথিবীতে এক দেশ আছে জার্মান নামের, যে এখনও বয়ে চলেছে হলোকাস্টের অপরাধণ্ড ইসরাইলকেও বয়ে বেড়াতে হবে তেমনি এই শিশুহত্যা, গণহত্যার অপরাধ, নাকবার অপরাধ, নতুন এক হলোকাস্টের অপরাধ। কিন্তু অসংখ্য মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্যালেস্টাইন ঠিকই উঠে দাঁড়াবে, ঠিকই জীবন জয়ের গান গেয়ে উঠবে।

আমরা এই রক্তরঞ্জিত শিশুদের সামনে রেখে, রক্তজমাট বাধা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে দাত চেপে রক্ত ফুটিয়ে কান্না থামাতে থামাতে অপেক্ষা করছি সেই কান্না ও হাসি মাখা, আনন্দ ও বেদনায় ভাসা দিনটির জন্যে। সেদিন অবশ্যই আসবে, সেদিন আর বেশি দূরে নয়।

১২ জানুয়ারি ২০০৯

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

9 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
9
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.