তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি…

এক কথায় বলতে গেলে, বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। নির্বাচন কমিশন শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন, একটি তুলনামূলক স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে পেরেছেন, কালো টাকার দৌরাত্ম্যকে সামাল দেয়ার জন্যে কিছু কিছু উদ্যোগও নিয়েছেন। নির্বাচনের যারা পর্যবেক্ষক ছিলেন, তারা এ নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্ত বলে মন্তব্য করেছেন। নির্বাচনের পরদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে বিরুপ করলেও পরে মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে তাদের অভিযোগ যা-ই হোক না কেন, তারা মনে করেন যে একটি অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে নির্বাচিত সরকার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এও জানিয়েছেন, ‘বড়ভাইয়ের (আওয়ামী লীগ) উচিত, ছোটভাইকে (বিএনপি) দেখা। একটি দল বিজয় অর্জন করেছে, অন্যদের কাছে যাওয়ার দায়িত্ব তার (ইত্তেফাক, ৩ জানুয়ারি ২০০৯)।’

আবার নির্বাচনের আগে স্বৈরাচারী এরশাদকেও বার বার বলতে শোনা গেছে, ‘ভাইবোনে মিলে দেশটিকে ঢেলে সাজাবো!’ অতএব বলা যায়, এ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আমরা সরকারি কিংবা বিরোধী বিভিন্ন দলগুলির আত্মীয়তার মাধুর্যও উপভোগ করছি।

এদিকে নির্বাচনের পরপরই, গত চারদিনে পাঠকমহলে সংবাদের জন্যে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য পত্রিকাগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ইত্তেফাকেই নির্বাচনোত্তর সংঘাতের যত খবর ছাপা হয়েছে তা জোড়া দিলে সংবাদপত্রের দু’ পৃষ্ঠাতেও আটানো সম্ভব হবে না। এমনকি আমরা এ-ও জানতে পেরেছি, ফেনীতে জয়নাল হাজারীর সুযোগ্য ক্যাডাররা এখন মিছিল করছেন ও শ্লোগান দিচ্ছেন, ‌শেখ হাসিনা হাসছে, জয়নাল হাজারী আসছে।’

জনগণ এইসব নতুন করে সহ্য করছে। ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে। কেননা, আওয়ামী লীগকে ঘিরে তাদের একধরণের প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছে। সেই প্রত্যাশা এতই আকাশচুম্বী যে তারা স্বৈরাচারের প্রতিভূ জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের মহাজোট গঠনও মেনে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি হয়তো তারা আস্থাশীল নয়, কিন্তু নির্ভরশীল হওয়ার মতো উপাদান তারা দলটির মধ্যে খুজেঁ পেয়েছে। তাই এদের প্রার্থীদের ঘিরে তাদের মধ্যে প্রত্যাশাবোধের জন্ম হয়েছে।

কিন্তু এত প্রত্যাশার ভিত্তি কোথায়?

বোধকরি, প্রথমত ব্যাপক নারী ভোটার। গত পাঁচ বছর ধরে এই নারীরা সরাসরি দ্রব্যমূল্যের আঁচ অনুভব করেছে। গার্মেন্টস শ্রমিকসহ নিম্নপেশাভুক্ত দরিদ্র নারী থেকে শুরু করে কর্মজীবী মধ্যবিত্ত ব্যাপকসংখ্যক নারী তো বটেই এমনকি গৃহিনী নারীরাও এখন বাজার থেকে কেনাকাটার সঙ্গে আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। সন্তান ও পরিবার সদস্যদের করুণ মুখ প্রতিক্ষণ তাড়িয়ে ফেরে তাদের। উনুনের তাপ আর দ্রব্যমূল্যের তাপ মিলেমিশে নারীদের বিরুপ করেছে চারদলীয় জোটের প্রতি। আগেও নারী ধর্ষণ ছিল, কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের পর চারদলীয় জোটের কল্যাণে নারী ধর্ষণ ও যৌননিপীড়ন রাজনৈতিক নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এটিও বিরুপতার অন্যতম আর একটি প্রধান কারণ।

বিপরীতে আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সালের সময়কালে নারী ধর্ষণ একটি অন্যতম মারাত্মক অপরাধপ্রবণতা হলেও নারীরা ক্ষমতায়নের সুফল অনুভব করেছে। ব্যক্তিতথ্যায়নের ক্ষেত্রে মায়ের নামের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে নারী প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং এভাবে ক্ষমতায়নের স্থানিক ভিত্তির সূচনা করা হয়েছে। এসব নারীর জন্যে আর্থিক সঙ্গতি তৈরি করতে পারেনি বটে, কিন্তু তার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের দুয়ার খুলে দিয়েছে। গ্রামীণ নারীরা নতুন করে উপলব্ধি করেছেন, সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা হলো বাক-স্বাধীনতা ও অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা যা থেকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এবং এইসব অধিকার মৌলবাদসম্পৃক্ত একটি শাসনামলে কখনও যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এসব কারণে বেশির ভাগ নারী ভোটার চার দলের প্রতি বিমুখ হয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, ভোটারদের মধ্যে গ্রামীণ মানুষ ও কৃষকের আধিক্য। ১৯৭৭ সালের দিকে বিএনপির গ্রামীণ ভিত্তি গড়ে তোলার জন্যে এগিয়ে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন অপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা, যারা বয়োজ্যেষ্ঠদের কারণে গ্রামীণ ক্ষমতার বলয়ে স্থান করে নিতে পারছিলো না, অথচ কৃষি ও সমবায় প্রক্রিয়ায় লুটপাটের মধ্যে দিয়ে অর্থ সঞ্চয়নের ফলে ক্ষমতা অনুশীলনের উপযোগী হয়ে উঠেছিল। যুব উন্নয়ন কমপ্লেক্স করে জিয়াউর রহমান এদের এবং এদের উত্তরপ্রজন্মের ক্ষমতা ও নষ্টামীর ক্ষুধা মেটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এখন গ্রামগুলি নগর ও বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার পরও বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। বিএনপির নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়াতে ব্যবসায়ী শ্রেণির অবস্থান এতই সুস্পষ্ট যে, তা কখনও গ্রামীণ ও কৃষক সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়নি। ফলে গ্রামের বিভাজিত ক্ষমতার বলয়ে সাধারণ মানুষরা দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের দিকে। এই সাধারণ মানুষরা সুশীল সমাজের মতো গবেষণা ও সংলাপ করতে পারে না বটে, কিন্তু কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা বিভিন্ন নীতির ব্যবহারিক চাপটি প্রাত্যহিক জীবনে অনুভব করেছে এবং কোন আমলের উদ্যোগগুলি বেশি সহনীয় সেটিও টের পেয়েছে।

তৃতীয়ত, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তরুণ ভোটার (ভোটারদের ৩১ শতাংশ)। মুক্তিযুদ্ধ থেকে বেশ দূর সময়ের এই তরুণরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঙ্গতকারণেই অনেক বেশি নির্মোহ এবং খানিকটা ব্যক্তিগত আবেগবিযুক্তও বটে; প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের আবেগ থেকে নয়, বরং যুক্তি দিয়ে তারা খতিয়ে দেখেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিকৃতির প্রচেষ্টা, দেখেছে যুদ্ধাপরাধীদের উন্মত্ত উল্লাস, দেখেছে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সবচেয়ে সাহসী মানুষদের কোণঠাসা অবস্থা। তারা এই সাহসী মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চেয়েছে। এই তরুণদের বেশির ভাগই গ্রাম ও মফস্বলের, এখনও তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ও অঙ্গণের পুরানো সাহসী মুখগুলিই অনুপ্রাণিত করে থাকে, এখনও তারা কর্পোরেটশক্তির কল্যাণে বেড়ে ওঠা উঠতি সুশীল তরুণ সমাজের মতো কর্পোরেটমুখগুলিকে, এনজিওঘেঁষা পণ্ডিতদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব মনে করে না। তাই এবারের নির্বাচনে সুজন, জাগরী এমনকি টিআইবি-ও রাজনীতিকদের প্রতি তরুণ সমাজকে আস্থাহীন করার জন্যে যত প্রচেষ্টাই চালাক না কেন, না- না- করার জন্যে উজ্জীবিত করার যত প্রচেষ্টাই চালাক না কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক তরুণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতিই তাদের পক্ষপাত ব্যক্ত করেছে।

যে রাজনৈতিক দলটির প্রতি ভোটাররা তাদের নির্ভরতা (আবারও বলি, আস্থা নয় নির্ভরতা) প্রকাশ করেছে, সে রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগ। আর যে জনপ্রতিনিধিদের তারা নির্বাচিত করেছে তাদের অন্তত ৯২ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগে সব মিলিয়ে তিনশ’র বেশি মামলা রয়েছে। সুজনের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচিত নতুন সাংসদের ৪৪ শতাংশই কোটিপতি। মোট ১২৮ জন কোটিপতি এবার সংসদটিকে দাবড়ে বেড়াবেন, যাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৯২ জন, জাতীয় পার্টির ১৪ জন, বিএনপির ১৯ জন, জামায়াতে ইসলামীর একজন, বিজেপির একজন আর স্বতন্ত্র একজন। নির্বাচন কমিশনের কাছে দেয়া তথ্য অনুযায়ী এদের মধ্যে ২১ জনের আবার ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে।

কোটিপতিরা মোট সাংসদসংখ্যার ৫০ শতাংশ দখল করতে ব্যর্থ হলেও ব্যবসায়ীরা ব্যর্থ হননি তাতে। সাংসদদের ৫৬.৫২ শতাংশ ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১২১ জন, বিএনপির ২০ জন, জাতীয় পার্টির ১৯ জন এবং অন্যান্য দলের ৯ জন। তার মানে আকাঙ্ক্ষা এদের ওই কোটিপতি হওয়া, আরও বড় ব্যবসায়ী হওয়া। এরকম এক বিন্যাসের মধ্যে থেকে আওয়ামী লীগ কিভাবে বাংলাদেশের ব্যাপক কৃষক শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ করবে, নারীদের ক্ষমতায়ন করবে, তরুণদের আশার পথ দেখাবে তা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন।

তা হলে, বলব কি, ভোটাররা ভুল করেছেন? না, তারা তাদের সবচেয়ে ভাল বিকল্পই বেছে নিয়েছেন। তারা এটিও বিবেচনায় নিয়েছেন, কেবল স্বৈরাচার নয়, মহাজোটে কতিপয় বামদলও আছে, তাদের সাংগঠনিক ব্যাপ্তি তত বড় নয় বটে, কিন্তু তাদের অতীত অনেক পরিস্কার, তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ ভবিষ্যতের দায়বোধটুকুও। তারা চিন্তা করেছেন, সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগকে অনেক চাপের মুখে রাখা যাবে, কেননা গণতন্ত্রের ট্রেনে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি পথ অতিক্রম করতে আগ্রহী ও সক্ষম। মূলত বুর্জোয়া শ্রেণির দল হলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বশ্রেণির প্রবেশাধিকার আছে, তাই আওয়ামী লীগের ওপর যত বেশি চাপ-দল থেকে চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব, বিএনপির ওপর সেরকমভাবে চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। তারা এই সুযোগটি গ্রহণ করেছেন।

আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই এই বিশাল ভোটারগোষ্ঠীকে সঙ্গে রাখতে চায়, তা হলে তাকে অন্তত পাঁচটি কাজ করতে হবে :

প্রথমত, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙক্ষলা পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখতে হবে। এর আগের শাসনামলে আওয়ামী লীগ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও আইনশৃঙক্ষলা পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে আবারও ১০ টাকা কেজি দরে মানুষকে চাল খাওয়ানোর অঙ্গীকার করেছে; জনগণ খুব ভালো করেই জানে কেবল কাগুজে বাঘই এমন হুংকার ছাড়তে পারে, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আওয়ামী লীগ যদি অন্তত এক-তৃতীয়াংশও কমিয়ে আনতে পারে, তা হলেই সাধারণ মানুষ তার পাশে থাকবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগকে তাদের পুরানো গডফাদার ও সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে যেমন, তেমনি সম্ভাব্য নতুন গডফাদার ও সন্ত্রাসীদের সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে হবে। যেমন, একজন পুরানো মন্ত্রীর তরুণ এক সাংসদ এবার উত্তরাঞ্চলের একটি আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন,- আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) এই নবীন সাংসদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডী থানা থেকে গ্রেফতারকৃত আসামীকে বের করে নির্যাতন করার অভিযোগ অনেকেরই জানা আছে। এমনকি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনও তাঁর এক ভাষণে কারও নাম উল্লেখ না করে এই ঘটনা সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এরা যদি আবারও ‘আমি কি হনু রে’ ভাব দেখাতে শুরু করে তা হলে আওয়ামী লীগ সরকার ডুববে।

দ্বিতীয়ত, তেল-গ্যাস-খনিজসহ দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ প্রশ্নে ইতিবাচক পরিচয় দিতে হবে এবং এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্রনীতিও ঢেলে সাজাতে হবে।

তৃতীয়ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক,- প্রতিটি বাজেটে ও নীতিনির্ধারণে এই সত্যের প্রকাশ ঘটাতে হবে।

চতুর্থত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির বাহ্যিক প্রকৃতি যাই হোক না কেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একমুখী করতে হবে, এ দুই পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক ও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে এবং তথ্যপ্রযুক্তিকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে।

পঞ্চমত, আওয়ামী লীগ সরকারকে বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। ইতিমধ্যেই একটি অপপ্রচার শুরু হয়ে গেছে যে, বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগ দেশকে বিভক্ত করছে। প্রকৃত সত্য হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময়েই আমাদের সামনে এ অঙ্গীকারগুলি ছিল এবং এগুলি আওয়ামী লীগের চলতি নির্বাচনী অঙ্গীকারও বটে। আর এগুলি বাস্তবায়নের জন্যেই এবার মানুষ আওয়ামী লীগকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। কাজেই যথেষ্ট পরিপক্কতার সঙ্গে আওয়ামী লীগকে এ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথম চারটি পদক্ষেপ যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে শুরু করতে পারলে পঞ্চম পদক্ষেপটির দিকে এগিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে অনেক সহজ হবে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ এইসব পদক্ষেপের দিকে কতটুকু এগিয়ে যাবে, সেটিই একটি বড় প্রশ্ন। যে-সংসদ কোটিপতি এবং কোটিপতি হতে ইচ্ছুক লাখপতিদের আস্তানা, সেই সংসদ যদি কার্যকর হয়, তা হলে সাধারণ জনগণের আকাঙক্ষা বাস্তবায়িত হোক বা না হোক, উচ্চবিত্ত ও কর্পোরেটবাদীদের লক্ষ্য অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে এবং সেটিই বোধকরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সুশীল সমাজের প্রত্যাশা! এই প্রত্যাশার সঙ্গে সাধারণ জনতার বিভেদ ও ফাটল কতটুকু স্পষ্ট হয়ে উঠবে, ভবিষ্যতই সে প্রশ্নের জবাব দেবে।

২০০১ সালে চারদলীয় জোট যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হন, তখন ড. ইউনূস বলেছিলেন, এবারের সরকারকে উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিতে আর কোনও বেগ পেতে হবে না। কেননা তাদের রয়েছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, যা তাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করবে। আমরা দেখেছি, সত্যিই বিএনপি বা জামাতীদের কোনও কাজে কোনও বেগ পেতে হয়নি, কিন্তু যা তারা করেছে তা ড. ইউনূসের কাছে উন্নয়ন মনে হতে পারে, জনগণের কাছে সেরকম মনে হয়নি। কোনও কোনও পর্যবেক্ষক শুরু থেকেই বলছেন, এ নির্বাচনে কোন দল আসবে সেটি বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার হলো, কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এজেন্ডাগুলি কোন দল পূরণ করতে পারবেন। প্রথমে অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিলেন, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়েই এগিয়ে যেতে। নির্বাচনের দিন মতিউর রহমানকে আমরা লিখতে দেখেছি, ”প্রথম এক বছরে আমরা দেখলাম, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। ফলে রাজনীতির গতিবিধি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারেননি। এটি মূলত বেসামরিক নেতৃত্বের বাইরে (সশস্ত্র বাহিনীকে) ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এখানেও অনেক ভুল হয়ে গেছে, বড় ধরনের ভুল। এতে সমস্যা বেড়েছে। দুই নেত্রীকে শুধু বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া নয়, নতুন দল গঠন, দল ভাঙাভাঙির চেষ্টা প্রভৃতি কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস বেড়েছে। পরে এ ভুল শোধরাতে গিয়ে ওই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গেই কারাগারের ভেতরে-বাইরে দীর্ঘ আলোচনা ও সমঝোতা করতে হয়েছে। এ সমঝোতা করতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনাবাহিনীকে অনেক বেশি নমনীয় হতে হয়েছে (আরেকটি সুযোগ, আরেকটি সম্ভাবনা/ প্রথম আলো, ২৯ wW‡m¤^i ২০০৮)।” তার মানে সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার প্রতিনিধিরা এখন বলতে চাইছেন, দুই নেত্রীকে বিয়োগ করার ও নতুন রাজনৈতিক দল দাঁড় করানোর তত্ত্ব বা উদ্যোগ তাদের নয়, বরং শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর এবং এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা সুশীলদের ও সেনাবাহিনীকে অনেক বেশি নমনীয় হতে হয়েছে! তার মানে, শেখ হাসিনা বা খালেদার বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছিলেন, কেবল তারাই মামলা প্রত্যাহার করছেন না, সুশীলরাও আবার নতুন কোনও বদমতলবে নমঃ নমঃ ভাব দেখাতে শুরু করেছে। অথচ নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগ পর্যন্তও এরা প্রত্যাশা করেছে একটি ঝুলন্ত সংসদের, যাতে তারা অনায়াসে আগামী পাঁচ বছর সরকারের মাথার ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারে, নিজেদের এজেন্ডাগুলি অনায়াসে বাস্তবায়ন করতে পারে!

এই সামরিক, সুশীল ও কর্পোরেট চাপ-দলগুলি, আওয়ামী লীগের ভেতরের পুরানো অবাঞ্ছিত কার্যকারণগুলি সরকারের ওপর কোন ধরনের চাপ তৈরি করতে থাকবে এবং আওয়ামী লীগ তাতে কীভাবে সাড়া দেবে সেটাই এখন আমাদের দেখার বিষয়। জনগণ তার পতাকা বইবার ভর আওয়ামী লীগকে দিয়েছে বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পতাকা বইবার শক্তি জনগণের কাছ থেকে নেবে কি না, সেটিই এখন আমাদের দেখার বিষয়।

কাজেই উদ্দীপ্ত জনগণের এখনও রাজপথ ছাড়ার সময় আসেনি। সংসদ কার্যকর হলে, রাজনীতি ও অর্থনীতি গতিশীল হলে ‘চুইয়ে পড়া তত্ত্ব’ অনুযায়ী তাদের পাতেও কিছু কিছু সুফল আসবে বৈকি। কিন্তু জনগণ যদি পাহারাদারের দায়িত্ব থেকে সরে আসে, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংগঠনিক চাপ-দলের মাধ্যমে তাদের আকাঙ্ক্ষিত দাবিগুলি পূরণের জন্যে বার বার চাপ দিতে না থাকে তা হলে অতীতেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। হয়তো তা ২০০১-পরবর্তী সময়ের চেয়ে অনেক সুললিত হবে, সাংস্কৃতিকভাবে পরিমার্জিত হবে কিন্তু এক কথায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা অপূরিতই থেকে যাবে।

৪ জানুয়ারি ২০০৯

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

২ comments

  1. সৈকত আচার্য - ৬ জানুয়ারি ২০০৯ (১১:৫৯ অপরাহ্ণ)

    অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু সাবধানবাণী এই লেখায় উঠে এসেছে। প্রগতিশীল চিন্তার ধারক অনেক সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী এবং কিছু বামপন্থী দল যাঁরা দেশের মঙ্গলের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম-সাধনা করে যাচ্ছেন, কিন্ত আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের নির্বাচনের এই বিজয়কে কিভাবে দেখতে হবে, তা বুঝতে পারছেন না কিংবা কিভাবে React করতে হবে তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত আছেন, তাঁদের জন্য এই লেখাটি চিন্তার খোরাক জোগাবে। বাস্তবতার নিরিখে কিভাবে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে হয়, এবং একটি জোট বা দলের চিন্তার মানুষ না হয়েও কিভাবে সেই দলের পজিটিভ বিষয়গুলো নৈর্ব্যক্তিকভাবে সামনে নিয়ে এসে দেশের অগ্রগতির সাথে মিলিয়ে, প্রশংসা ও সংশয় দুটোই সমান তালে আলোচনায় এনে, ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে কিভাবে আমাদের ভাবতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে রাজপথের আন্দোলনের আশাবাদও জাগিয়ে রাখতে হবে, তা মনে করিয়ে দেয়ার একটি নির্দেশনামূলক লেখা এটি। যেমন শেষের দিকে এসে লেখক স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন :

    কাজেই উদ্দীপ্ত জনগণের এখনও রাজপথ ছাড়ার সময় আসেনি। সংসদ কার্যকর হলে, রাজনীতি ও অর্থনীতি গতিশীল হলে ‘চুইয়ে পড়া তত্ত্ব’ অনুযায়ী তাদের পাতেও কিছু কিছু সুফল আসবে বৈকি। কিন্তু জনগণ যদি পাহারাদারের দায়িত্ব থেকে সরে আসে, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংগঠনিক চাপ-দলের মাধ্যমে তাদের আকাঙ্ক্ষিত দাবিগুলি পূরণের জন্যে বার বার চাপ দিতে না থাকে তা হলে অতীতেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

    লেখককে অনেক ধন্যবাদ, চমৎকার এই বিশ্লেষণী লেখার জন্য।

    • অবিশ্রুত - ১০ জানুয়ারি ২০০৯ (১:১০ পূর্বাহ্ণ)

      নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সব বামদলের প্রতিক্রিয়া জানার ভাগ্য হয়নি, তবে বাসদ নেতা খালেকুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে জনগণের পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা উঠে এসেছে, কিন্তু নির্বাচনে কালো টাকার দৌরাত্ম্য কিংবা অন্যান্য নেতিবাচক দিক বন্ধ হয়নি।
      আমার মনে হয়, প্রায় সব বামদলই এ ধরনের গৎবাধা প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করবেন। তবে বাসদ এবং সিপিবি-র দিক থেকে একটি ইতিবাচক ব্যাপার হলো, তারা আলাদা ভোট ব্যাংক তৈরির প্রতি মনযোগী হয়েছে এবং এটি বামদের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়। বছরের পর বছর ধরে বামরা অনেক আন্দোলন করছে, কিন্তু ভোটের সময় এসে তাদের মনে হয়েছে বুর্জোয়া সংগঠনের চেয়েও অন্য কোনও বড় শত্রু, যেমন সামরিক স্বৈরাচার, রয়েছে এবং সম্মিলিতভাবে তাকে রুখতে হবে। এই করে বামরা বাংলাদেশে কখনো তাদের আলাদা ভোট ব্যাংক তৈরির প্রতি মনযোগী হয়নি। এর জন্যে তাদের এখন উপহাস শুনতে হয়, বামদের ভোট কয়টি আছে! এর বিপরীতে, ভারতের বাম সংগঠনগুলোকে দেখুন, সেখানে ভোটবিরোধী বামদল যেমন আছে, তেমনি প্রথম থেকেই ভোটব্যাংককে গুরুত্ব দিচ্ছে এমন বামদলও আছে; এবং এর সুফল হলো এই যে বামরা কোনও কোনও রাজ্যে সরকার গঠনও করে।
      বামদলগুলোও আমার মনে হয়, বাংলাদেশে ছায়া-সরকার গঠন করতে পারে এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে পরিবীক্ষণ করতে পারে। এতে সরকারের অনেক সমস্যা বুঝতে যেমন তাদের সুবিধা হবে, তেমনি জনগণের চাপ-দলের ভূমিকায়ও তারা অগ্রণী দায়িত্ব পালন করতে পারবে এবং জনগণের মনে বিকল্প কিছু আস্থা জাগিয়ে তুলতে পারবে।
      আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না করতেই কোনও কোনও নেতা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘আমরা ১০ টাকা সের চাল খাওয়াতে চাইনি, এগুলি অপপ্রচার।’ আমরা জানি, ১০ টাকা সের চাল আর কেউ খাওয়াতে পারবে না, কিন্তু আওয়ামী লীগ যে তার প্রতিশ্রুতির সীমাবদ্ধতা মূল্যায়ন করে জনগণের সামনে তার বাস্তব দিকগুলি তুলে ধরার বদলে প্রতিশ্রুতিকেই অস্বীকার করতে পারে, এটি তারই এক অশুভ আলামত।
      তবে ইতিবাচক দিক হলো, মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেই কৃষি ও কৃষকদের স্বার্থবাহী একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যদিও এ সিদ্ধান্ত কীভাবে কার্যকর হবে তার বিস্তারিত কোনও কিছুই আমরা এখনও জানতে পারিনি। কিন্তু কৃষিজ্বালানীতে ভর্তূকি দেয়ার ঘোষণা সত্যিই ইতিবাচক। তবে আগেই ঘোষিত একটি বাজেটের আওতায় এরকম ভর্তুকি কতটুকু ছিল, সরকার নতুন করে কতটুকু বাড়ালেন তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। দিলীপ বড়ুয়া ঘোষণা দিয়েছেন, এখন সারই কৃষকের পিছে দৌড়াবে; খুশির খবর, সার যে মৃত্তিকার স্বাস্থ্যে কী ভঙ্গুরতা তৈরি করে তা আমাদের জানা আছে, তারপরও আমরা প্রত্যাশা করছি, তার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক, তার কথা সত্যি হোক।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.