বুক বেধে তুই দাঁড়া দেখি

বাংলাদেশে ভাস্কর্য ভাঙতে শুরু করেছে ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। তারা তাদের এই ভাঙনের কাজে সাধারণ মানুষকেও টেনে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে ধর্মীয় বয়ান দিয়ে। ভাস্কর্য ধর্মবিরোধী ব্যাপার,- একবাক্যে বলতে গেলে এটি তাদের মূল যুক্তি এবং নিছক আক্ষরিকভাবে বলতে গেলে, এই যুক্তি সঠিক। কিন্তু মানবজাতিকে যারা যুগে যুগে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁরা ঈশ্বরপ্রেরিতই হন আর সামাজিক সংগঠক, রাজনীতিক, বৈজ্ঞানিক কিংবা শিল্পী-সাহিত্যিক যে-ই হন, তাঁদের অভিজ্ঞতা আমাদের এ কথাই বলে, ইতিহাস ও আদর্শকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে সমাজের বিকাশ সম্ভব নয়। তার জন্যে প্রয়োজন হয় যথোপযুক্ত বিশ্লেষণ পদ্ধতির [...]

বাংলাদেশে ভাস্কর্য ভাঙতে শুরু করেছে ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। তারা তাদের এই ভাঙনের কাজে সাধারণ মানুষকেও টেনে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে ধর্মীয় বয়ান দিয়ে।

ভাস্কর্য ধর্মবিরোধী ব্যাপার,- একবাক্যে বলতে গেলে এটি তাদের মূল যুক্তি এবং নিছক আক্ষরিকভাবে বলতে গেলে, এই যুক্তি সঠিক। কিন্তু মানবজাতিকে যারা যুগে যুগে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁরা ঈশ্বরপ্রেরিতই হন আর সামাজিক সংগঠক, রাজনীতিক, বৈজ্ঞানিক কিংবা শিল্পী-সাহিত্যিক যে-ই হন, তাঁদের অভিজ্ঞতা আমাদের এ কথাই বলে,  ইতিহাস ও আদর্শকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে সমাজের বিকাশ সম্ভব নয়। তার জন্যে প্রয়োজন হয় যথোপযুক্ত বিশ্লেষণ পদ্ধতির। মৌলবাদীদের (তা ধর্মীয়ই হোক আর রাজনৈতিকই নয়) আমরা মৌলবাদী বলি কেন? বলি, এই কারণে যে এরা সব কিছুকেই আক্ষরিক অর্থে বিবেচনা করার পক্ষপাতি। ইতিহাস, ভূগোল ও রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতা থেকে শুরু করে সময়ের পরিবর্তন কোনওটিকেই এরা বিকাশের ধারা ও যুক্তির আওতায় নিতে চায় না। তাই এরা সময়ের সত্যকে হারিয়ে ফেলে, সত্যের উদ্বোধন ঘটাতে ব্যর্থ হয় এবং উটপাখির মতো মুখ গুঁজে থাকে অতীতের বদ্ধ কাঠামোতে।

ইসলাম ধর্মের উত্থানপর্বে মূর্তি-বিরোধিতা খুব সুস্পষ্ট। কেননা, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) একটি নিরাবয়ব ও একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচার করেছিলেন। মূর্তি-পূজা এই একেশ্বরবাদিতা ও নিরাকারবাদিতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করেছিল। কিন্তু কালক্রমে মূর্তি তৈরির বিষয়টি আর ধর্মচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেনি, বরং তা ধর্মসাধনার পরিধিকে অতিক্রম করে শিল্পভাবনা ও শিল্পসৃষ্টির ধারাকেই বড় করে দেখেছে। এইভাবে মূর্তিপূজা থেকে, মূর্তি তৈরির পর্ব থেকে ভাস্কর্য চর্চা এবং ভাস্কর্য তৈরিও প্রক্রিয়াও আলাদা হয়ে পড়েছে। কিন্তু অনেকেই আছেন, যারা এই সহজ ঐতিহাসিক সত্যকে গ্রহণ করতে পারেন না। তাদের কাছে ভাস্কর্যের ঐতিহ্যিক প্রেরণা ও আবেদন এবং এর সঙ্গে শিল্পের যোগ খুবই তুচ্ছ মনে হয়। তারা মনে করেন, এর মধ্যে দিয়ে আসলে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে।

কিন্তু ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের প্রতি মমত্ব, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা আর ঈশ্বরের জন্যে নৈবেদ্যর মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। এই প্রসঙ্গে টেনে আনা যায় হযরত মোহাম্মদের প্রথম জীবনীকার আরবের ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাকের বইটির কথা। অনেক আগের লেখা তাঁর বই ‘দ্য লাইফ অব মোহাম্মদ’-এ তিনি কাবা শরীফ থেকে ৩৬০টি মূর্তি সরিয়ে নেয়ার সময়ের একটি বর্ণনাও তুলে ধরেছেন। তাতে লেখা হয়েছে, মূর্তি অপসারণ এমনকি দেয়ালের সব ফ্রেসকো মুছে ফেলার নির্দেশ দিলেও হঠাৎ নবীজীর চোখ নিবদ্ধ হয় কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভের ওপরে, যেখানে বাইজেনটাইন পর্বে আঁকা মা মেরির একটি ছবি ছিল। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সেটির ওপর হাত রেখে বলেছিলেন, তোমরা এটিকে নষ্ট কর না।

শুধু তাঁর জীবদ্দশাতেই নয়, ৬৮৩ সাল পর্যন্ত ওই ছবিটি কাবা শরীফে বহাল ছিল।

আমরা জানি, এসব প্রসঙ্গ খুবই স্পর্শকাতর। এ নিয়ে আলোচনা করার মতো স্থিরতা, ঔদার্য ও সংযম অনেকেরই নেই। সহনশীলতাও অনেকের নেই। তাই সত্য জানার পরও অনেকে ঝামেলা এড়াতে এসব ইতিহাস তুলতে চান না, বলতেও যান না। কিন্তু এইভাবে ‘ঝামেলা এড়ানোর’ চেষ্টা নিরীহ ও সৎ মানুষরা যতই করুক, এমন অনেক সময় আসে যখন গোটা মানুষ জাতিকেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয়। পুরানো সত্য উদ্ঘাটন করতে হয় পৃথিবী ও মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সহজাত প্রবণতা থেকেই মানুষ এসব করে থাকে এবং এমন নয় যে এ কাজটি কেবল মহৎ মানুষরা করেন, সৃষ্টিশীল মানুষরাই করেন। সত্য অন্বেষণের প্রবণতা প্রতিটি মানুষেরই একটি সহজাত প্রবণতা। তাই সঠিক পরিচর্যায় এমনকি সবচেয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষটিও খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন।

সৌদি আরবে যারা যান, তারা জানেন, খেলনা পুতুল সেখানে সহজলভ্য খুব। অনেকে এটিকে আধুনিক যুগের ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু মুহাম্মদ আলী আল সাবুনির ‘রওযাইউল বয়ান’ বইটির দ্বিতীয় খণ্ড তাদের এ ধারণা অনেকটা দূর করতে পারে। সেখানে লেখক লিখছেন, ‘নয় বছর বয়সে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর সহধর্মিনী হওয়ার পরও হযরত আয়েশা (রাঃ) মাঝেমধ্যে পুতুল খেলতেন। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) তাতে বাধা দেননি, বরং মাঝেমধ্যে মজা করেছেন এবং কৌতূহলও দেখিয়েছেন।’

যারা সত্যমনের অধিকারী, যারা সুপথে থাকতে চান ও মানুষকে সুপথে রাখতে চান, তারা সবাই জানেন, প্রকৃতি ও মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম ও প্রবণতার ওপর অহেতুক হস্তক্ষেপ করলে তাতে প্রকৃতি বিগড়ে যায়, মানুষ আরও অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ভাস্কর্য ভাঙার দলগুলিও বোধকরি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কেননা স্বাভাবিক বয়সে তাদের অস্বাভাবিক সব শিক্ষা দেয়া হয়েছে। মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালবাসার ও সত্য কথা বলার শিক্ষা দেয়ার আগেই তাদের মনে আক্ষরিক সব ধর্মের বাণী ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর পরিণত করা হয়েছে রাজনৈতিক ক্রীড়নকে। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে গোটা দেশবাসীকে।

পোশাককে খাবার খাইয়ে কবি শেখ শাদী মানুষ যাচাই ও অতিথি-অভ্যর্থনার প্রচলিত রীতিকে লজ্জা দিয়েছিলেন,- এই কবি অনেক নাত লিখেছেন, যেগুলি বাংলাদেশেও অহরহ পাঠ করা হয়। এবং যারা ঢাকার বলাকা ভাস্কর্য ভাঙলেন, রাউফুন বসুনিয়াদের প্রতিকৃতিতে কালো কালি মেখে দিলেন, বিমানবন্দরের সামনে থেকে ‘অচিন পাখি’ টেনেহিঁচড়ে নামালেন, নিশ্চয়ই তারাও তা পাঠ করে থাকেন মাঝেমধ্যে। আমাদের বিশ্বাস, এটিও এরা জানেন, শেখ শাদীর কবরের সামনেই রয়েছে তাঁর একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য। যে সাদ্দাম হোসেনকে নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের এত আবেগ, সেই সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্যও কি ছিল না ইরাক দেশে? এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের সময় সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার পর সেখানে যা গড়ে তোলা হয়েছে তাও এক ভাস্কর্য,- মা-বাবা ও সন্তানের ২৩ ফুট উঁচু এক ভাস্কর্য। ইরাক দেশের বাগদাদ শহরে এখনও কি নেই বাদশাহ শাহরিয়ার ও বেগম শাহেরজাদ-এর ভাস্কর্য?

ইরাক-ইরানকে যারা গুরুত্ব দিতে চান না, তাদেরকে আমরা নিয়ে যেতে পারি খোদ সৌদী আরবেই। সেখানে জেদ্দার হামরায় যেতে না যেতেই চোখজোড়া আটকে যাবে উটের এক ভাস্কর্যে। প্রশ্ন হলো, যারা ভাস্কর্য ভাঙার জন্যে আটঘাট বেধে নেমেছেন, তারা কি এসব জানেন না? নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু তারপরও তারা যে এত কিছু করছেন, তার কারণ, তারা চান, আক্ষরিক অর্থে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার নামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে। তাদের কাছে তাই ধর্ম কখনও ব্যক্তিপর্যায়ের বিষয় নয়, আত্মপ্রশান্তি অর্জনের বিষয় নয়, তার স্ববিশ্বাসের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে গভীর আত্মিক সংযোগের বিষয় নয়; বরং বার বার তা এসব কিছুকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে স্পর্শ করতে চায়।

অনেকে অবশ্য বিষয়টিকে পিছিয়ে পড়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অঘটন বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু বিষয়টিকে অত তুচ্ছ ভাবে নিলে অনেক সত্যই আমাদের খতিয়ে দেখা হবে না। বলাকা ভাস্কর্য ভাঙার এ কাজটি করেছে উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়িনাত। এ ভাস্কর্য ভাঙার আগে তারা ভেঙে ফেলেছে ঢাকা মতিঝিলের পূবালী ব্যাংকের সামনে ঢাকা চেম্বারের অর্থায়নে নির্মিতব্য নতুন এক ভাস্কর্যের নামফলক। তা ছাড়াও ভেঙেছে শাহবাগে কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি ম্যুরাল। অনেকেরই স্মরণে আছে বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই আল বাইয়িনাতের অফিস পরিদর্শন করেছিলেন! বিশ্বব্যাপী যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গান গেয়ে বেড়ায়, সেই যুক্তরাষ্ট্রই আবার এদের অফিসে অফিসে ধর্ণা দেয়। কেননা এরা ‘হাকিম হয়ে হুকুম করে পুলিশ হয়ে ধরে।’ এই পরিদর্শনের কিছুদিন পরে আল বাইয়িনাত যে কাজটি করেছে, বাংলাদেশে সেই কাজটি অনেক আগেই করতে চেয়েছিল ইসলামী ছাত্র শিবির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের উদ্যোগে যখন (মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান ভিপি-জিএস থাকাকালীন অবস্থায়) ‘অপরাজেয় বাংলা’ সৃষ্টির কাজ শুরু হয়, তখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের পক্ষ থেকে ‘মূর্তি-স্থাপনের’ প্রতিবাদে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে নেমেছিল ইসলামী ছাত্র শিবির। অনেক আগের সংবাদপত্র ঘাটলেই দেখা যাবে সেই ছবি,- রোকেয়া হলের ছাত্রীরা ধরে মারপিট করছে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে আসা দু’জন শিবির কর্মীকে।

সেই আশির দশকে, যখন বাংলাদেশে এত শিক্ষার বিস্তার হয়নি, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ঘটেনি, তখন এ ধরনের কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্যে রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ওইটুকু ক্ষোভই যথেষ্ট ছিল। আর এতদিন পরে একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশের সমগ্র প্রগতিশীল শক্তিকে তারস্বরে চিৎকার করতে হচ্ছে ভাস্কর্য ভাঙা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশে এখন ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের এত বেশি সংগঠিত করে তুলেছে যে তারা ভাস্কর্যকে ধর্মবিরোধিতার অজুহাত তুলে ভাঙতে পারে। মূলধারার ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী অবশ্য এ ব্যাপারে এখনও প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেনি। কিন্তু এই ভাঙাভাঙির গড় রাজনৈতিক ফল তাদের গোলাতেই উঠবে। বাংলাদেশের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও সকল দাবিদাওয়াভিত্তিক আন্দোলন সংগঠন করার ক্ষেত্রে বাম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা মুখ্য ভূমিকা রাখলেও আন্দোলনের ফসল যেমন গিয়ে শেষ পর্যন্ত ওঠে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-র গোলাঘরে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশে যে-যেমন ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই করুন না কেন, যত জঙ্গিই সাজুন না কেন, তার ফসল ওঠে জামায়াতের গোলাঘরে।

এই অবস্থা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আরও দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকরা সামাজিক সংঘবদ্ধতা হারাচ্ছেন। কেননা তারা আর সামাজিক উদ্যোগগুলির মধ্যে সক্রিয় নন। আবার প্রগতিশীলদের যে অংশটি তারুণ্যে রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হয়ে এখন ব্যর্থতার অনুভবে পীড়িত, তারা ব্যর্থতাকে পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার জন্যে মনোনিবেশ করেছেন বিভিন্ন নাগরিক আলোচনা সভা, সংলাপ ও প্রশিক্ষণের গতানুগতিক চক্রগুলিতে। এসবের অনেকটাই এনজিও দোষে দুষ্ট। এবং কে না জানে, এনজিও-র অনুপ্রবেশের ফলে বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ মরতে বসেছে এবং মানুষ এসবের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুফল খুঁজতে শুরু করেছেন। ওদিকে মধ্যবিত্তদের পরিধি এখন বাংলাদেশে অনেক বিস্তৃত, এবং গ্রামাঞ্চল অবধি প্রসারিত। যতদিন পর্যন্ত মধ্যবিত্ত একটি উত্থানপর্বের মধ্যে ছিল, ততদিন উৎপাদনশীল শ্রেণিগুলির সঙ্গে এর যোগ ছিল এবং তাই এদের সামাজিক সিদ্ধান্ত, ঘোষণা ও আন্দোলনগুলির সামাজিক সংঘবদ্ধতা ছিল। উৎপাদনশীল কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে নতুন শিক্ষিত শ্রেণির সম্পর্কচ্ছেদ পর্ব এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ার শুরু ষাটের দশকেই। খুব সহজ, সরল উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তান-পর্বের ‘তালাশ’ ছায়াছবির কথা। রিকশাওয়ালা-বাবার সঙ্গে শিক্ষিত চাকরিজীবী সন্তানের যে-দূরত্ব সৃষ্টি হতে শুরু করে, সে-দূরত্বকে হত্যা করার যাবতীয় সাংস্কৃতিক আয়োজন বাংলা চলচ্চিত্র মাধ্যমে যতই করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা বিফলে গেছে। যদিও এর সাংস্কৃতিক অপভ্রংশ হিসেবে শহরের কোনও কোনও রিকশাওয়ালাকে দেখা যায়, কোনও ছাত্রীকে আরোহী করে প্রেম ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়ে ধনী-গরিবের বিভেদ ঘোচানোর স্বপ্নাচ্ছন্নতায় আক্রান্ত হতে। কিন্তু শিক্ষিত প্রজন্মের বড় একটি অংশ এখন শহরেই থিতু হতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে এবং আমলাতন্ত্রর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সোপানগুলিতে রক্তসম্পর্কের আবেগ ভেতরে-ভেতরে অনেকটাই নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে।

এর পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে শিক্ষার উপাদান হিসেবে কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী, অবৈজ্ঞানিকতাও প্রচারের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা পাচ্ছে। ফলে মাদ্রাসার ছাত্রদের চেয়ে বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই অনেক বেশি সহিংসতার পরিচয় দিচ্ছেন বাংলাদেশের মৌলবাদীদের অঘটনগুলিতে। এর ফল হিসেবে, ভাস্কর্য ভাঙার যে প্রবণতা এখন প্রকাশ্য রুপ নিয়েছে, তা এক সুযোগও এনে দিয়েছে বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের সামনে। গোটা জনগোষ্ঠী নয়, বরং জনগোষ্ঠীর একটি বিভ্রান্ত অংশই যে এই সহিংস ধর্মোন্মত্ত কাজটি করছে, তা যত্নের সঙ্গে তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের যুক্তির অসারতাগুলি তুলে ধরারও এক সুবর্ণ সুযোগ এটি। মুক্তচিন্তা পরিচর্যার আন্দোলনকে একেবারে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ারও এক ঐতিহাসিক সুযোগ এটি। বাংলাদেশের ভাস্কর্যগুলি মূলত ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য; তাই এইসব ঐতিহ্যিক ঐতিহাসিক বিষয়গুলির চেতনা আবার ঝালাই করারও এক সংঘবদ্ধ সুযোগ এটি।
এবং সবাই জানেন, এরকম সুযোগ সব সময় আসে না। এ সুযোগ যত দ্রুত কাজে লাগানো যাবে, আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজও তত বেশি কলুষমুক্ত হবে, প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে।

৫ ডিসেম্বর ২০০৮

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

২ comments

  1. সৈকত আচার্য - ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ (১২:১৬ পূর্বাহ্ণ)

    গোটা জনগোষ্ঠী নয়, বরং জনগোষ্ঠীর একটি বিভ্রান্ত অংশই যে এই সহিংস ধর্মোন্মত্ত কাজটি করছে, তা যত্নের সঙ্গে তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের যুক্তির অসারতাগুলি তুলে ধরারও এক সুবর্ণ সুযোগ এটি। মুক্তচিন্তা পরিচর্যার আন্দোলনকে একেবারে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ারও এক ঐতিহাসিক সুযোগ এটি। বাংলাদেশের ভাস্কর্যগুলি মূলত ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য; তাই এইসব ঐতিহ্যিক ঐতিহাসিক বিষয়গুলির চেতনা আবার ঝালাই করারও এক সংঘবদ্ধ সুযোগ এটি।

    প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলি এভাবে ভাবতে পারতো, ভাবাটাই উচিত ছিলো। কিন্ত তথাকথিত আসন্ন সেই ইলেকশনে মাথা ঢুকিয়ে বসে আছে জাদরেল বামপন্থী থেকে শুরু করে লিবারেল সকল গণতন্ত্রী। এদের মাথায় ইলেকশন ঢুকেছে, এদের দেখার ও বোঝার ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে এবং এরা বোধ হয় বুঝতে অক্ষম, কখনও কখনও মানবিক মূল্যবোধগুলোর পূনর্জাগরনের নিমিত্তে সামাজিক শক্তিগুলোর নতুন বিন্যাস-সমাবেশ ঘটাতে হয়, মানুষকে ডাক দিতে হয় সংগ্রামের পথে শামিল হতে। এই অপশক্তির উত্থানকে ঠেকাতে গেলে নির্বাচনের রাস্তায় মুক্তি মিলবে না। নির্বাচনের পথ এখন আত্মঘাতের পথ রচনা করবে মাত্র। আমার মতে, রাজপথের আন্দোলনের কর্মসূচী ছাড়া প্রগতিশীল শক্তিগুলির ঐক্যবদ্ধতার কোন সুয়োগ নাই। অবিশ্রুতকে সাধুবাদ জানাই, এই বিশ্লেষনধর্মী লেখাটার জন্য।

    • অবিশ্রুত - ১৭ ডিসেম্বর ২০০৮ (১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ)

      বিষয়টি নিশ্চয়ই রাজনৈতিক, কিন্তু রাজপথের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে জোটবদ্ধতার শক্তি পাওয়া গেলেও বিজ্ঞানমনস্কতা ও শিল্পবোধ কতটুকু অর্জন ও তৈরি করা যাবে? এটি মনে হয় আরও এক গভীরতর সংগ্রাম। আরও স্থিরতা আর ধৈর্যও বোধহয় প্রয়োজন হয় এতে। এবং কখনও কখনও, বলাই বাহুল্য, একা-একাই দাঁড়িয়ে যেতে হয় ডামাডোলের মধ্যে, উজানস্রোতে। অবশ্য, যেমনটি আপনি বলেছেন, সামাজিক শক্তিগুলির নতুন বিন্যাস, তারও দরকার হয় এই স্রোত ধরে রাখবার জন্যে। ধন্যবাদ আপনাকে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.