বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন মিডিয়া বিগত কয়েক বছরের আপ্রাণ চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে কুশল বিনিময়ের আয়োজন করতে পেরেছেন। অবশ্য এই আয়োজনের মূল কৃতিত্ব ঠিক সুশীল সমাজ ও মিডিয়াকে দেয়া যায় না। বলতে গেলে, গত আঠারো বছর থেকে আমরা দেখে আসছি, পৃথিবীর একটি বিশেষ দেশে, একটি বিশেষ বাহিনীর বিশেষ একটি দিনে বিশেষ একটি ঘটনা ঘটে; আর সেই বিশেষ ঘটনাটি হলো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সশস্ত্র দিবসে সেনাকুঞ্জে দেশটির দুই রাজনৈতিক নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া পাশাপাশি বসেন, কখনও কথা বলেন, কখনও আবার কথা বলেন না। কথা যখন বলেন না তখন তারা সামনের দিকে এত মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকেন যে মনে হয় শেক্সপিয়রের কোনও নাটক দেখতে বসেছেন। দু’এক বছর অবশ্য এই ঘটনার ব্যতিক্রম ঘটেছে, কেউ হয়তো বিশেষ কোনও কারণে ওই অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি, কারও যাবার পথে হয়তো বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে; কিন্তু সেগুলো উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। শক্তি অনেক কিছুর ধাত্রী হিসেবে কাজ করে থাকে; শক্তিমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার এই কুশলবিনিময়ের ধাত্রী হিসেবে কাজ করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
নিশ্চয়ই এটি একটি বড় ঘটনা, আর তা কেবল সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার সাফল্যের অর্থে নয়, রাজনৈতিক অর্থেও।ক্ষমতা নেয়ার প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন; উদ্দেশ্যটি হলো, যে-দলই আগামী জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সরকার গঠন করুন না কেন, তাকে সুনির্দিষ্ট কিছু ইস্যু বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বিরোধী দল সে-ক্ষেত্রে তেমন কোনও তীব্র বাগড়া বসাতে পারবে না। আর এই ইস্যু বাস্তবায়নের কাজটি যাতে আরও নিপূণভাবে করা যায়, সেজন্যে তারা জাতীয় সরকার প্রসঙ্গটিকেও বার বার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। ২০০১ সালের আগে একই উদ্দেশ্য (দলনির্বিশেষে সুনির্দিষ্ট কর্পোরেট স্বার্থ বাস্তবায়ন) নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রীয়-স্বার্থের তথা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের প্রতিনিধি জিমি কার্টার। কিন্তু ওই নির্বাচনের পর নির্বাচিত চারদলীয় সরকারের পক্ষে একমাত্র আদমজী পাটকলকে বিক্রি করার কাজটি ছাড়া আর কোনও বড় কর্পোরেট স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এবার তাই আরও আটঘাট বেধে নেমেছে কর্পোরেট শক্তি। প্রায় দুই বছর ধরে তারা প্রধান রাজনৈতিক দলদুটিকে এ-উদ্দেশ্যে ঘোলাজলে হাবুডুবু খাইয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এবং দরকার হলে ভবিষ্যতে অন্য কোনও ফর্মে আরও অনেকদিন দেবেন। কিন্তু কর্পোরেটস্বার্থে যা কিছু করার দরকার তা তারা নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই করবেন।
অতএব অনেকের কাছে আশাব্যঞ্জক বলে মনে হতে পারে; কিন্তু দুই নেত্রীর এই কুশলবিনিময় কিংবা ভবিষ্যতের কোনও সংলাপও ১১ জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থা জারি করে লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তোলার মতো একটি বড় প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। সুশীল সমাজ এমনকি সামরিকপ্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এমনভাবে উপস্থাপন করে চলেছেন যেন তারা নিতান্তই ব্যক্তি এবং তাদের দল তাদের ব্যক্তিগত দল। কিন্তু দল ও জনগণের ওপর এই দুই রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত যত প্রভাবই থাকুক, চূড়ান্ত অর্থে তারা পরিবারের নয়, নিজের নয়, বরং দলেরই প্রতিনিধি, আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে শ্রেণিপ্রতিনিধি। দু’একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি-হাসিনার অথবা ব্যক্তি-খালেদার অস্তিত্বের যত প্রতিফলনই ঘটুক, রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের পরিবারকে যত শক্তিমানই মনে হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা দলের আকাঙ্ক্ষার কাছে তাদের শ্রেণির আকাঙ্ক্ষার কাছে নিজেদের সমর্পন করতে বাধ্য। সংস্কারপন্থীদের ওপর খালেদা জিয়া যত ক্ষিপ্তই হোন না কেন, তারেক রহমানকে তাঁকে সাময়িকভাবে দলের বাইরে রাখতে হয়েছে, রাজনীতি থেকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। অন্যদিকে মান্না-আখতার-সুলতানদের ওপর শেখ হাসিনা যত তাফালিংই দেখান না কেন, প্রেসিডিয়ামের আমু, সুরঞ্জিত, তোফায়েল, রাজ্জাককে তাকে সহাস্যেই মনোনয়ন দিতে হয়েছে।
হাসিনা ও খালেদা যদি কেবল পরিবারতন্ত্রেরই প্রতিনিধি হতেন, তা হলে ১১ জানুয়ারির পর তাদের বিসর্জনে পাঠানো বা বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়া সত্যিই কোনও কঠিন ঘটনা ছিল না। আর কে-না জানে, বাংলাদেশের দু’চারটে মিডিয়া তাদের এই আকাঙ্ক্ষার কথা বার বার বিভিন্নভাবে, কখনও মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে, কখনও পাঠকদের কাছ থেকে চিঠি বা টেলি-মত আদায় করে, কখনও গৃহপালিত কলামিস্টদের মাধ্যমে বার বার প্রকাশ করেছেন এবং জনগণকে সেই মতে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণির নীতিনির্ধারকরা জানেন- এর ফলে যা হতো,- তা হলো সামরিকতন্ত্র ও জনগণ আবারও মুখোমুখি হতো, কিন্তু সে-ক্ষেত্রে সামরিকতন্ত্রকে প্রয়োজনে কফিন থেকে টেনে তোলার জন্যে বা জনগণের প্রত্যক্ষ বিক্ষোভ থেকে আড়াল দেয়ার জন্যে কোনও হাসিনা বা খালেদাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। আশির দশক ও নব্বই দশকের আন্দোলনকারীদের নিশ্চয়ই মনে আছে, এরশাদের পতন ঘটার ডিসেম্বর ১৯৯০-এ এই শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়াই বেতার ও দূরদর্শনে ভাষণ দিয়ে জনগণকে বার বার ‘উশৃঙ্খল’ না হওয়ার জন্যে কীভাবে অনুরোধ করছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, একজন বামনেতাও তাদের সেই কোরাসে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন। এতদিন যে-জনগণের যে-আচরণকে তাদের ‘বিশৃঙ্খল’ মনে হয়নি, হঠাৎ করে সেদিন একই আচরণ তাদের কাছে ‘বিশৃঙ্খল’ হয়ে উঠেছিল, কেননা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা যত আন্দোলনই করুন না কেন, সামরিকতন্ত্রকে তারা তাদের দুর্দিনের উদ্ধারকর্তা হিসেবে জানেন বলেই তারা চাননি সামরিক শাসনের কোনও প্রতিনিধি আঘাত পাক এবং তাদের শেষভিতটিও ধ্বসে পড়ুক। ফল হয় এই, সাড়ম্বরে এরশাদ ৩৫টি আসন নিয়ে তাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় সঙ্গ দিতে থাকেন। অতএব এটি পরিস্কার, বুর্জোয়া শ্রেণি কখনও এরকম (এবং এরকমভাবে) নেতা হারানোর ঝুঁকি নেবে না, যার ফলে অন্য কোনও শ্রেণির নতুন কোনও নেতা উঠে আসারও ঝুঁকি রয়েছে। এবং এবারও, মানে ১১ জানুয়ারি ২০০৬-এর পরও, রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করে নতুন বুর্জোয়া নেতা তৈরির পরীক্ষানিরীক্ষার কাজটি কত ঝুঁকিপূর্ণ তা মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় তারা। ফলাফল এই,- খালেদা ও হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে এবং সুশীল প্রতিনিধি ও মিডিয়ার মাধ্যমেই তারা ফিরে এসেছেন। এবং এটিও সত্য, যেভাবেই হোক না কেন, বাংলাদেশে আগামী মাসেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। নানা কারণেই সেটি প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সামনে রেখে শাসনের ছড়ি ঘোরানো সামরিক বাহিনীর ওপর সমাজের অপেক্ষাকৃত আন্দোলনপ্রবণ পেশা ও শ্রেণির মানুষগুলির বিরূপ মনোভাব সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠার আগেই সামরিক বাহিনীকে রঙ্গমঞ্চের বাইরে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন,- যাতে অদূর ভবিষ্যতে তাদের আবার ‘তরতাজা দাওয়াই’ হিসেবে কাজে লাগানো যায়। আর ধিকৃত গণশত্রু হয়ে ওঠার আগে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও নিষ্কৃতি দেয়া প্রয়োজন। এতদিন তারা সামরিক বাহিনীর ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, সামরিকতন্ত্র তার প্রতিদান দিচ্ছে যথেষ্ট নিন্দিত হওয়ার আগেই তাদের বিদায় দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
কিন্তু বাস্তবত ২৭ কিংবা ২৯ ডিসেম্বর, যে-তারিখই বলি না কেন, বাংলাদেশে যে-নির্বাচন হতে চলেছে দেশের জন্যে তা আরও প্রচণ্ড সংকট নিয়ে আসবে। কেননা এই নির্বাচন কেবল কর্পোরেটস্বার্থ সংরক্ষণের নির্বাচন নয়, একইসঙ্গে এ-নির্বাচনের মাধ্যমে সমন্বয় ঘটতে চলেছে প্রচলিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মবাদী রাজনীতি ও সামরিকতন্ত্রের। এবং এর মধ্যে দিয়ে রাজনীতির চেহারা কখনোই উজ্জ্বল হতে পারে না।
বরং এর ফলে রাজনীতির চেহারা যে কত অমসৃন হয়ে উঠবে, তার একটি আগাম চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি পতিত স্বৈরতন্ত্রের প্রতিনিধি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নানা আস্ফালনের মধ্যে দিয়ে। এরশাদ স্পষ্টকণ্ঠেই ঘোষণা দিয়েছেন, ২০০৭-এ অনুষ্ঠিতব্য ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মহাজোট গঠনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার অলিখিত চুক্তি হয়েছিল, তাকে রাষ্ট্রপতি বানানো হবে। এবং এবারও তিনি জোটে যেতে চান একই শর্তে। বিএনপির আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকেও নাকি তার সঙ্গে একইরকম শর্তসাপেক্ষে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন, কিন্তু বিএনপি বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, এরশাদকেই রাষ্ট্রপতি বানানো হবে। এর মধ্যে সুধাসদনে শেখ হাসিনা ও এরশাদের মধ্যে মুখোমুখি বৈঠকও হয়েছে।
পাশাপাশি ছোট হলেও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর : ‘এই ১৩ নভেম্বরে ঢাকা জজ আদালতের নবীন আইনজীবী মোহাম্মদ লিটন মিয়া, মোঃ সাফায়াৎ হোসেন রাজিব ও শিক্ষানবিস আইনজীবী রাজিব আহমেদ বাদী হয়ে জামাতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, তার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ ৩৬ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করার এবং জাতীয় নির্বাচন থেকে তাদেরকে বিরত রাখার জন্য ঢাকার জেলা জজ আদালতে একটি মামলা করেছেন।’ কিন্তু এই সংবাদে, খুব গুরুত্ব দিয়েই বলতে হচ্ছে, উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই,- কেননা, এ মামলাটি করা হয়েছে দুর্বল যুক্তিপ্রমাণের মামলা দায়েরের মাধ্যমে অভিযুক্তদের অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে। রাজাকার-আলবদর-আলশামস ও শান্তিবাহিনীসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন, তাদের পক্ষ থেকে কেউ এ মামলা করেননি,- এ মামলাটি করেছে যুদ্ধাপরাধী পক্ষই।
অনেকেই আছেন, শুরু থেকেই বলে আসছেন সামরিক বাহিনীর প্রধান মইন উদ্দিন আহমদ মুখে যাই বলুন না কেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম প্রকল্প হলো যুদ্ধাপরাধীর বিচার নয়, বরং যুদ্ধাপরাধীর পুনর্বাসন। এ ক্ষেত্রে আদালতের চেয়ে উত্তম পুনর্বাসনকারী আর কী-ইবা হতে পারে? তারা তাদের সাজানো বিচার বিভাগের মাধ্যমে এখন সেই কাজটিই করতে চলেছেন : যুদ্ধাপরাধীদের হালাল করে দিয়ে যাচ্ছেন। এ কথা কে না জানে, দীর্ঘ ৩৭ বছর পরে যুদ্ধাপরাধী বিচারের কাজটি নিশ্চিত হতে পারে একমাত্র বিশেষ আদালতের মাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন, এমনকি সাম্প্রতিকতম যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্যেও বিশেষ আদালত গঠন করা হয়ে থাকে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার একদিকে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ আন্দোলনকে উৎসাহিত করছেন এবং এই বিচারের জন্যে বিশেষ আদালত গঠনের ক্ষেত্রে নিজেদের আইনী অক্ষমতা দেখাচ্ছেন, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধী পক্ষকে আদালতে পাঠিয়ে দুর্বল যুক্তির মামলা নিষ্পত্তির মধ্যে দিয়ে তাদের কেতাদুরস্ত আইনীপন্থায় হালাল করে নিতে চাইছেন!
এরকমভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, আসলে এইসব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সামরিকতন্ত্রকে সমন্বিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এবং যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামাত সকলেই এই প্রক্রিয়ার অংশীদার; এই প্রক্রিয়ার অংশীদার বাংলাদেশের সুশীল সমাজ এবং বেশ কিছু মিডিয়া।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এত কিছুর পরও কেন একটি (এবং এই) নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে হাইকোর্টের একটি রায় সবাইকে ভেবে দেখার অনুরোধ করব। হয়তো অনেকেরই চোখে পড়েছে ওই খবর : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০১-এ বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা যুদ্ধে বাংলাদেশের জল ও আকাশসীমা এবং বিমানবন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। দেশের সব প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদ তখন বৈঠকও করেছিল। আর আমাদের বিভিন্ন ‘বুড়ো শালিক’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের ওই সিদ্ধান্তে সম্মতি দিতে একটুও দ্বিধা করেননি। ভেবে দেখুন, স্বাধীনতার পর কতগুলো মাথা উঁচু করা দেশপ্রেমিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেয়েছে বাংলাদেশ! কিন্তু ওই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তখন অ্যাডভোকেট মো. রুহুল কুদ্দুস হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন। ২০০১-এর ২১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি হামিদুল হকের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চ বাংলাদেশের আকাশ ও জলসীমা এবং বিমানবন্দর আফগানিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে ব্যবহারের অনুমতি প্রদানকে কেন কর্তৃত্বহীন ঘোষণা করা হবে না মর্মে রুল জারি করেছিলেন। দীর্ঘ সাত বছর ২৬ দিন পর গত ১৭ নভেম্বর হাইকোর্ট এই রুল খারিজ করে দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ওই সময় দেশে যুদ্ধাবস্থা ছিল না এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীও বাংলাদেশের আকাশ, জলসীমা ও বিমানবন্দর ব্যবহার করেনি। তবে হাইকোর্ট একই সঙ্গে তাদের দশ দফা পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘বিশেষ আইনগত কারণ ছাড়া সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। তার কারণ একমাত্র জাতীয় সংসদই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। সংসদই সকল নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রাখে। কারণ সাংসদরা নির্বাচিত হন জনগণের ভোটে সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে। প্রজাতন্ত্রের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার তাই একমাত্র জাতীয় সংসদের। তবে রাষ্ট্রে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে কিনা তা নির্ধারণ করবে নির্বাহী বিভাগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংসদকে। আর এ-কারণে প্রয়োজনে সংসদের মেয়াদ বাড়াতে হবে। নির্বাচনজনিত কারণে সংসদের অনুপস্থিতিতে যদি যুদ্ধ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি ভেঙে যাওয়া সংসদ আহ্বান করতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।
এটি একটি সামান্য উদাহরণ, যা বলে দিচ্ছে কেন অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলির জন্যেও একটি নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর কেনই বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিকতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলগুলোর জন্যেও এখন নির্বাচন খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সত্য কেবল এটুকুই নয়। সত্যের আরেক দিকটি হলো, একটি নির্বাচিত সরকার থাকলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যারা করেন, সমাজ বদলের আন্দোলন যারা করেন, তাদেরও সুবিধা হয়। কেননা তখন সাংবিধানিকসূত্রে পাওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকারগুলি তারা প্রয়োগ করতে পারেন। সেজন্যেই বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমগুলির বরাত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হরতালবিরোধী অপপ্রচার চালানো হচ্ছে এবং বিশেষ দুইটি বড় দলের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে এই গণতান্ত্রিক পন্থাটিকে অকার্যকর ও হত্যার চেষ্টা চালানো হচ্ছে,- যাতে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার এলেও গণমানুষ তার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের চূড়ান্ত পন্থাটি প্রয়োগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। নির্বাচিত সরকার যেহেতু রাখতেই হবে, সেহেতু তারা চান গণতান্ত্রিক অধিকারের চোখ-নাক-দাত-হাত-পা-মুখ সবকিছু কেটে ফেলতে, যাতে ওই নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে নির্বিবাদে অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়ন করা যায়, যাতে গণতান্ত্রিক শক্তি সেসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আইনসিদ্ধ, সংবিধানসিদ্ধ গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করতে না পারে। হরতাল যদি সংবিধানসিদ্ধ না হয় তা হলে গুলি চালানো যত সহজ, সংবিধানসিদ্ধ হলে তো তত সহজ নয়! সংবিধানকে রাবার স্ট্যাম্প বানানোর জন্যে আজ এরশাদের মতো বিশ্ববেহায়াও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কাছে।
অথচ গোটা আশি ও নব্বইয়ের দশক জুড়ে বাংলাদেশে যে-তরুণরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছে এমনকি যারা ঘরে বসে শুধুই লেখাপড়া করেছে তাদেরও প্রত্যাশা ছিল সামরিকতন্ত্র ও ধর্মতান্ত্রিক রাজনীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের দিকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। যে কৃষক ও শ্রমিকরা তখন সংঘবদ্ধ হচ্ছিল তাদেরও স্বপ্ন ছিল তাই। এইসব তরুণ-শ্রমিক-কৃষকদের কাছে এরশাদ একটি স্পর্শকাতর কিন্তু কেবলই ঘৃণার প্রতিকৃতি। কেননা সামরিকতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে চেয়েছিলেন তিনি, চেয়েছিলেন সাংবিধানিক বৈধতা দিতে এবং ওই কাজে অনেকদূর এগিয়েও গিয়েছিলেন। মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিয়ে ছাত্রহত্যা করতে তিনি কুণ্ঠিত হননি, কুণ্ঠিত হননি চোরাগোপ্তা হত্যাকাণ্ড ঘটাতে, এমনকি জনসভায় পুলিশি হামলা চালিয়ে লাশের পর লাশ ফেলতেও ইতস্তত করেননি। সেদিন যে-ছাত্রটি তার সহযোদ্ধার লাশ কাঁধে বহন করেছে, আজ কোনখানে সান্তনা পাবে সে? আজ যখন সেই এরশাদের সঙ্গে তখনকার আন্দোলনকারী জোটের নেতা শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া তাদের কথিত গণতন্ত্র বাস্তবায়নের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনায় বসেন, আজ যখন সেই এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনী মহাজোট গড়তে রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুদের মতো নেতারা মৌন সম্মতি দেন, তখন তারা কি একবারও চিন্তা করেন, তাদের নিজেদের রক্তে গড়ে তোলা সাহসী সন্তানদেরই তারা হত্যা করতে বসেছেন, অস্বীকার ও অবজ্ঞা করতে চলেছেন? তারা কি একবারও চিন্তা করেন, ১৯৮৭ সালের পর আবারও নূর হোসেনকে হত্যা করতে চলেছেন? পার্থক্য এটুকুই যে, এবার আর এরশাদ একা নন, এবার নূর হোসেনকে হত্যা করা হচ্ছে সম্মিলিতভাবে!
এই সাহসের মুখগুলিকে সংঘবদ্ধ করে তারা কী-ইনা করতে পারতেন! তার বদলে গত দেড়যুগে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে হারাতে হারাতেও তাদের সেই নিষ্পাপ স্বপ্নের এখনও যে-টুকুও বা বেঁচে আছে, সে-টুকুকেও হত্যা করার মিশন নিয়েছেন তারা। কামরুল হাসান তখন ছবি এঁকেছিলেন, ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’। আজ বেঁচে থাকলে তাঁকে কোন ছবি আঁকতে হতো?
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার হাত মেলানোর ফলে তাই কোনও কিছু মেলেনি এবং মিলবেও না। বরং তাঁরা সামরিকতন্ত্র-ধর্মতন্ত্র-বুর্জোয়াতন্ত্রের মিঁশেলে ভয়াবহ এক রাষ্ট্রিক বিপত্তি ডেকে আনছেন। আর তিননং ছাগশাবকের মতো এই দৃশ্য দেখে হাততালি দিচ্ছেন বাংলাদেশের কোনও কোনও মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের কেউ কেউ।
জয়নাল, সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়া, শাহজাহান সিরাজ, তাজুল, নূর হোসেনদের সৌভাগ্য,- তারা আজ বেঁচে নেই। একাত্তরের শহীদদের সৌভাগ্য তারা তখন শহীদ হয়েছিলেন। সঠিক সময়ে শহীদ হওয়া বা মৃত্যুবরণ করতে পারাও মানুষের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মানুষের জীবনের মূল্য ও স্বাদ এত বেশি নয় যে, প্রতি পদে পদে মিথ্যার সঙ্গে সমঝোতা করে, অন্যায়কে ন্যায্যতা দিয়ে কোনওরকমে বেঁচে থাকতে হবে।
আমাদের লজ্জা হলো, আমরা এখন সেইভাবে বেঁচে থাকার স্বাদ পাওয়ার জন্যেই যেন মরিয়া হয়ে উঠেছি!
২৩ নভেম্বর ২০০৮
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে… কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!