ব্রিটেনের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন অর্থনৈতিক ধসের হাত থেকে ব্যাংকগুলিকে উদ্ধার করার জন্যে ৫০০ বিলিয়ন পাউন্ডের যে-উদ্ধারপ্রকল্প ঘোষণা করেছেন, সেইন্ট জেমস পার্কের কাছে অবস্থানরত ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের কর্মকর্তারা তার নাম দিয়েছেন ‘বালতি বেইলআউট’! এই নাম দেয়ার পেছনে ছোটখাটো এক ঘটনা কাজ করেছে। চ্যান্সেলর অ্যালেস্টেয়ার ডার্লিং এবং তার আরও প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা এক ম্যারাথন বৈঠকে বসেছিলেন মঙ্গলবার। আর ওই বৈঠকের ফাঁকে রাত সাড়ে নয়টার দিকে তাঁরা তাদের মূল্যবান সময়ের খানিকক্ষণ ব্যয় করেছিলেন দক্ষিণ লন্ডনের কেনিংটনের গান্ধী’স ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের টেকওয়ে কারী উদরস্থ করতে। এই গান্ধী’স-এর ভারী সুনাম। এর ওয়েবসাইট খুলে কাস্টমারস ফিডব্যাক সেকশনে পাওয়া যায় জন মেজর, গর্ডন ব্রাউন, জ্যাক স্ট্র, জন রেইড, প্যাডি এ্যাসডাউন, এ্যালিস্টেয়ার ডার্লিং প্রমুখের পরিতৃপ্ত প্রশংসা। ট্রেজারী বিল্ডিং-এর দ্বিতীয় তলায় বসে সরকারি কর্মকর্তারা সেদিন চিকেন তন্দুরী উদরস্থ করলেও কাছেই এক রুমে বসে থাকা আটটি ব্যাংক ও বিল্ডিং সোসাইটির কর্মর্কতাদের ভাগ্য অত সুমধুর ছিল না। কাছেই একটি রুমে বসে বিস্কুট আর চা পান করেই নিজেদের ধন্য মনে করেছেন তারা। আর এইভাবে ঘটনাটি মানুষের মুখ থেকে ইতিহাসের পাতায় পরিচিতি পেতে চলেছে ‘দ্য গ্রেট বালতি বেইলআউট’ নামে।
এই ‘বালতি বেইলআউট’ প্যাকেজের আওতায় ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সুদের হার কমিয়ে এনেছে পাঁচ থেকে চার দশমিক পাঁচ শতাংশে। প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের পক্ষ থেকে যে ৫০০ বিলিয়ন পাউন্ড দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন পাউন্ডই সরকারকে গুণতে হবে সম্পূর্ণ নতুন করে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ অর্থও যথেষ্ট নয়। তবে যত পাউন্ডই লাগুক না কেন, সব পাউন্ডই আদায় করা হবে এদেশের জনগণের কাছ থেকে। মানে আমার আপনার মতো মানুষের ওপর নানা রকম কর বসিয়ে। সাধারণ ব্রিটেনবাসীর ৫০০ বিলিয়ন পাউন্ড কয়েকটি ব্যাংক উদ্ধারের জন্যে ব্যয় করা যে কত বড় ঘটনা তা আরও কিছু কথা না বললে বোঝা যাবে না। যেমন, ৫০০ বিলিয়ন পাউন্ডের মানে হলো ৫০০ হাজার মিলিয়ন পাউন্ড, যা ব্রিটেনের জাতীয় আয়ের এক-তৃতীয়াংশ এবং গত বছর ব্রাউন সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, পেনসন, রাস্তাঘাট, নীতিপ্রণয়ন, কারাগারসহ জনখাতের সবকিছুর পেছনে যে-অর্থ ব্যয় করেছিলেন (৫৮৯ বিলিয়ন পাউন্ড) তা থেকে একটু কম!
গর্ডন ঘোষিত এই ৫০০ বিলিয়ন পাউন্ডের মধ্যে থেকে প্রায় ৫০ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যবহার করা হবে ‘ইনজেক্ট ক্যাপিটাল’ হিসেবে, অর্থাৎ এখানকার প্রধান প্রধান ব্যাংকগুলির শেয়ার কেনার কাজে। আর আরও ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করা হবে ক্যাশ ব্যাংকগুলিতে লোন গ্যারান্টি হিসেবে। প্রায় ২০০ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করা হবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের স্পেশ্যাল লিকুইডিটি স্কিম-এ। এবং এর পাশাপাশি চলবে সুদের হার কমানোর খেলা। এই সুদের হার এত বেশি কমে আসতে পারে, যা কেউ চিন্তাও করতে পারবেন না।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জনগণের আমানত যাতে নষ্ট না হয় সে জন্যেই ব্যাংকগুলিকে এ ভাবে উদ্ধার করা হচ্ছে। কিন্তু এখানেও লক্ষ্য করার ব্যাপার, পাবলিক অথরিটি আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলিকে এ সংকট থেকে রক্ষার ব্যাপারে সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই। আইসল্যান্ডে যে অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, তা থেকে পাবলিক অথরিটিকে উদ্ধার করার জন্যে ডার্লিং তৎপর নন। মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডনসহ আটটি লন্ডন কাউন্সিলের আইসল্যান্ডিক ব্যাংকগুলোয় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি অর্থ জমা রয়েছে। লক্ষ্য করার মতো ঘটনা হলো, চ্যান্সেলর ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয়রক্ষার গ্যারান্টি দিচ্ছেন, কিন্তু পাবলিক অথরিটিগুলির ক্ষতিপূরণের কোনও প্রতিশ্রুতির ধারে কাছে যাচ্ছেন না। লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সের টনি ট্রাভার্সের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘পাবলিক অথরিটিসমূহ বেসরকারি ব্যাংকগুলির ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের অধিকারী।’ কিন্তু একজন ব্যক্তি মন্দাভাবের ভয়ে ব্যাংক থেকে পাউন্ড তুলে নেয়ার অধিকার রাখলেও পাবলিক অথরিটিকে সে অধিকার দিতে নারাজ সরকার। আবার ক্ষতিপূরণও দিতে নারাজ।
কিন্তু এত করেও কী উদ্ধার পাওয়া যাবে? হ্যাঁ, সাময়িকভাবে হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষমেষ কী হবে কেউই বলতে পারেন না। সাময়িকভাবে দেখা যাচ্ছে, ব্রিটেনের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর খাবারের দোকান ওয়েট্রেস-এর বেচাকেনা কমে গেছে, কিন্তু বাড়ছে মার্কস এ্যান্ড স্পেন্সারের খাবারের বাজার। এর অর্থ এই নয়, ওয়েট্রেসের জনপ্রিয়তা কমেছে বা মার্কস এ্যান্ড স্পেন্সারের কদর বেড়েছে। আসল কথা হলো, মার্কস এ্যান্ড স্পেন্সারের খাবার ভালো লাগুক বা না লাগুক, মধ্যবিত্ত তার আগের জায়গা থেকে সরে এসেছেন, ঢু মারছেন কম খরচের খাবারের দোকানে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শুধু তৈরি খাবারের দোকানেই নয়, বাঙালি-ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলিতেও মন্দাভাব দেখা দেবে। প্রথমে হয়তো মনে হবে, রেস্টুরেন্টগুলি চাঙ্গা হয়ে উঠছে। কিন্তু অচিরেই বোঝা যাবে আসলে তা নয়। এসবের পাশাপাশি তখন আরও কিছু উপসর্গ দেখা দেবে বাঙালি-ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলির ক্ষেত্রে। খাদ্যমান ও পরিবেশ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা বাড়বে, কর্মীদের বৈধতা আছে কি না তা যাচাইয়ের অভিযান বাড়বে। এইভাবে সাময়িকপর্ব পাড়ি দেয়ার পর দেখা যাবে, মন্দাভাব প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন অথবা জন মেজরদের প্রিয় গান্ধী’স-কে স্পর্শ করতে না পারলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার অথবা চিত্রনায়িকা ঐশ্বরিয়ার প্রিয় রেডফোর্ডকে স্পর্শ করতে না পারলেও মধ্যবিত্তদের উপযোগী বাঙালি-ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলিকে মন্দাভাবের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
কিন্তু কাদের জন্যে আজকে এমন অবস্থা? কারা ব্রিটেনবাসীকে ঠেলে দিয়েছে এই বিপর্যয়ের মধ্যে? পুঁজিবাদের সাধারণ নিয়মে এ পরিস্থিতি বার বার তৈরি হয়, বার বার ফিরে আসে। অথচ সেই পুঁজিবাদের জন্যেই সাফাই গেয়ে বেড়াই আমরা সবাই! পুঁজি নিয়ে এই নষ্টামীর খেলা যারা খেলেছেন তারা তো কেবল একটি নাম নন, তারা একটি পুরো ব্যবস্থার প্রতিনিধি, একটি সুগঠিত চক্র। যেমন, ব্যাংকগুলির মন্দাভাবের হালচাল বর্ণনা করতে গিয়ে ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলোয় অনেকের নাম উঠে এসেছে, মিলিয়ন মিলিয়ন বেতন দিয়ে পোষা হয়েছে এদের। অতএব বলা চলে, মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড এদের পিছনে ব্যয় করা হয়েছে এবং তা এই মন্দাভাব ডেকে আনবার জন্যে। যেমন এইচএসবিসি-র সিইও মাইকেল গঘেগান; তাকে গত বছর বেতন দেয়া হয়েছে ৩.৫৪ মিলিয়ন পাউন্ড, যার মধ্যে ২.৫৪ মিলিয়নই দেয়া হয়েছে বোনাস আকারে। এইচবিওএস-এর সিইও এ্যান্ডি হর্নবিকে গত বছর বেতন দেয়া হয়েছে ১.৯৩ মিলিয়ন, যার মধ্যে বোনাস আকারে দেয়া হয়েছে এক মিলিয়ন। লয়েডস-এর সিইও এরিক ড্যানিয়েলসকে গত বছর বেতন দেয়া হয়েছে ২.৭৬ মিলিয়ন, যার মধ্যে বোনাস আকারে দেয়া হয়েছে ১.৮ মিলিয়ন। আরবিএস-এর সিইও ফ্রেড গুডউইনকে বেতন দেয়া হয়েছে চার মিলিয়ন, যার মধ্যে বোনাসের পরিমাণ ২.৮৬ মিলিয়ন। আর বার্কলেস-এর সিইও জন ভারলে পেয়েছেন গত বছর ২.৩৮ মিলিয়ন পাউন্ড, যার মধ্যে ১.৪ মিলিয়ন পাউন্ড নিয়েছেন বোনাসরূপে। বোনাস নিতে নিতে এরা ফর্সা করে ফেলেছেন গ্রাহকদের একাউন্ট!
সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে, ব্যাংকগুলিকে নয়, এরকম সব মানুষগুলিকে উদ্ধার করার জন্যেই এখন কি যুক্তরাষ্ট্রে কি যুক্তরাজ্যে উদ্ধারপ্রকল্প হাতে নিতে হচ্ছে সরকারকে। আর সেজন্যে মাশুল গুণতে হচ্ছে সাধারণ সব মানুষদের! এবং পুঁজিবাদ বার বার এই কাজটিই করে। ১৯৩০ সালের মহামন্দা থেকে বের হয়ে আসার জন্যে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাকে অবলম্বন করতে হয়েছিল তাকে এবং সেই কল্যাণ রাষ্ট্রকে বাজারজাত করা আরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিকে টেক্কা দেবার প্রয়োজনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট নতুন বিশ্বপরিস্থিতিতে বিশ্বঅর্থনীতিকে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ৪৪টি মিত্র দেশের ৭৩০ জন প্রতিনিধি অনেক দেনদরবার করে গড়ে তোলে ব্রেটন উডস সিস্টেম, যার প্রতিকৃতি হলো আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। ১৯৪৪ সালে নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উড্স-এর মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেলে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত মনিটারি এ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিল এসব দেশ। তারপর ১৯৪৫ সাল থেকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক সারা পৃথিবী জুড়ে ব্রেটন উডস সিস্টেম বিস্তারের মাধ্যমে পুঁজিবাদকে সচল করার অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু কোরামিন স্যালাইন দিয়ে রোগীকে কিছুদিন টেকানো যায়, যদিও শেষমেষ পুরানো অবস্থাই ফিরে আসে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়, ১৯৭১ সালে পরিস্কার হয়ে যায়, আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে যে-ব্যবস্থার বিস্তৃতি ঘটানোর প্রচেষ্টা চলেছিল, তা সফল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তারপরও সেই পুরানো ব্যবস্থা ও পদ্ধতি নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকে,- যার ফল এখন হাতেনাতে পাচ্ছি আমরা সবাই। নোয়াম চমস্কি এই পরিস্থিতির ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, প্রকৃতার্থে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গণতন্ত্র অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। ল্যারী বারটেলস-এর নিরীক্ষাকে অবলম্বন করে তিনি দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আসলে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা নয়, চলছে একদলীয় ব্যবস্থা, যে দলটি মূল ব্যবসায়ী দল এবং এ দলের দুটি অংশের একটি কনজারভেটিভ, আরেকটি ডেমোক্র্যাটিক। এবং এটি সকলের মনে রাখা ভালো, আপাতদৃষ্টিতে তাদের মধ্যে যত দূরত্বই দেখা যাক না কেন, স্বদেশ ও বিশ্বের অর্থনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে হেন কাজ নেই, যা তারা করবে না। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলির মূল দায়িত্ব একটাই,- সংকটগ্রস্থ ও অধঃপতিত পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে বার বার টেনে তোলা।
অনেক বছর আগে মোটর সাইকেলে করে ল্যাটিন আমেরিকা ঘুরে দেখতে বেরিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার দু’জন নিরীহ ডাক্তার। এদের একজনকে আমরা সবাই এখন চিনি; তিনি চে গুয়েভারা। তখনও তিনি বিপ্লবী হয়ে ওঠেননি। ‘একই যাত্রায় দুই ফল’ বলে একটি কথা আছে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। চে-র সঙ্গী ডাক্তার একটি নিরাপদ জীবনের জন্যে থিতু হয়েছিলেন, কিন্তু চে বিপ্লবের পথে রওনা হয়েছিলেন। কী ভাবে এই ঘটনাটি ঘটেছিল? চে গুয়েভারার ডায়েরীর ভাষায়, সেটি ছিল তার জীবনের একটি শীতার্ততম রাত। পাশাপাশি সেটি ছিল তার মানবপ্রজাতির বেঁচে থাকার সংগ্রামের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠার একটি নিবিড়তম রাত। পেরুর এক অসহায় ভবিষ্যতহীন দম্পতির সঙ্গে ওই রাতে তাঁর পরিচয় হয় সামান্য উষ্ণ আগুনের কুণ্ডলীর পাশে। এই রাত চে-র জীবনকে বদলে দেয়, তিনি ঘুরে দাঁড়ান জীবনের পথে, যে জীবনের পথ কেবল একজন ব্যক্তির জীবনের পথ নয়, মানবপ্রজাতির সকলের হাসিমুখে এগিয়ে যাওয়ার পথ। যে ৫৯ জন মানুষ কিউবার ভাগ্য পাল্টে দেয়, চে গুয়েভারা ছিলেন তাদের দলের মানুষ। কিন্তু কেবল কিউবায় নয়, গোটা ল্যাটিন আমেরিকায় বিপ্লব সম্পন্ন স্বপ্ন নিয়ে তিনি আবারও নেমে আসেন ক্ষমতার কাঠামো থেকে সাধারণ জনতার কাতারে। বলিভিয়ার জঙ্গলে আহত অবস্থায় ১৯৬৭ সালে বন্দি করা হয় তাঁকে। তাঁর সঙ্গে ছিল একটি গণিতের বই আর পাবলো নেরুদার কবিতার বই। বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি রেনে ব্যারিয়েন্তো তাকে নির্দেশ দেন হত্যা করার, যদিও বলিভিয়ার প্রচলিত আইনে কাউকে মৃত্যুদ- দেয়া বা হত্যা করা যায় না। সিআইএ-র এজেন্ট ফেলিক্স রড্রিগেজ তাই বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট মারিও তেরানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন চে-কে এমনভাবে হত্যা করার, যাতে লোকজন মনে করে সৈনিকদের সঙ্গে গুলি বিনিময়ের সময় মারা গেছেন তিনি; ঠিক যেভাবে এখন বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষদের। হত্যার ছয়দিনের মাথায় ১৫ অক্টোর চে-র কাটা হাত পাঠানো হয় ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কাছে এবং ক্যাস্ট্রো নিশ্চিত হন, সত্যিই হত্যা করা হয়েছে চে-কে। কিউবায় এবং পৃথিবীর দেশে দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। গত ৯ অক্টোবর ছিল সেই চে গুয়েভারার মৃত্যুর দিন,- যে চে-র মৃত্যু আমাদের বার বার অপরাধী করে দেয়।
এখন যখন সারা বিশ্বে আবারও এক ভয়াবহতম অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, যে মন্দাভাবের পথ ধরে অচিরেই ক্ষুধা ও মৃত্যু নেমে আসবে, হয়তো আমরাও হারিয়ে যাব, তখন চে গুয়েভারার সেই শীতার্ত রাতটির কথা খুব করে মনে পড়ছে। আমরা কি বুঝতে পারছি না, আমাদের ওপর নেমে আসছে ভয়াবহ এক নিকষ কালো রাত? আমরা কি এবারও এই উপলব্ধি মেনে নিতে ব্যর্থ হবো যে, পুঁজিবাদ মানুষকে কোনওভাবেই মুক্তি দিতে পারে না? পুঁজিবাদ আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে বন্দি করে রাখে এক জুয়া খেলার ভেতর? এইভাবে সে নিজে বাঁচে, আমাদের হত্যা করে, এইভাবে সে তার প্রতিনিধিদের রক্ষা করে, আমাদের হত্যা করে।
আমরা কি এবারও ব্যর্থ হবো জীবনের পথে ঘুরে দাঁড়াতে?
অবিশ্রুত
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!