প্রশাসন যন্ত্র সেই পুরোনো ব্যক্তিরাই চালান। বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তারাই। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য ছিলেন সচেষ্ট, তিনি আজ আরও উচ্চপদে সমাসীন। যে পুলিশ অফিসার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে সোপর্দ করেছেন পাকিস্তানীদের হাতে, তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাতদিন খেটে তৈরি করেছে রাজাকার বাহিনী তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চাকুরী দিয়ে দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেননি তিনিই আজ তরুণদের শিক্ষা দেয়ার গুরু দায়িত্ব বহন করেছেন। পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর, তিনিই এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরি করেন। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানীদের হয়ে প্রচারণায় মত্ত ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর-এর পর তারাই ভোল পাল্টে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন।

১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব

(পূর্ব প্রকাশিতের পর…)

গৌহাটি সামরিক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি কক্ষ। জীবন শঙ্কা এখনও কাটেনি। এর মধ্যে আহত হওয়ার চারদিনের মাথায় ১৮ নভেম্বর, ১৯৭১ তারিখে রণক্ষেত্রে ছেড়ে আসা তার প্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তাহের একটি পত্রের ডিকটেশন দেন। আমি তার কথা শুনে তা লিখি। তার কিছু অংশ,

“কামালপুরে কিছুক্ষণের জন্য যা দেখেছি তা অপূর্ব। তোমরা সম্মুখ যুদ্ধেও যে রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছ তা যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। কামালপুরের যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ও অনন্য রণকৌশলের স্বাক্ষর। তোমরা নিয়মিত বাহিনীকেও হারিয়ে দিয়েছে। যতোদিন না আবার আমি তোমাদের মধ্যে ফিরে আসি, আশা করি সংগ্রাম চালিয়ে যাবে সাফল্যের সাথে। . . . তোমরা যুদ্ধ করছো জনসাধারণের জন্য। বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, জনগণকে অভাব, দুঃখ, অশিক্ষা থেকে মুক্ত করা এ যুদ্ধের লক্ষ্য। তোমাদের আচরণের মধ্য দিয়ে যেন জনসাধারণের মধ্যে সেই লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলার অগনিত কৃষক যারা দেশের সর্বপ্রধান শ্রেনী তাদের মুক্তির জন্য এ যুদ্ধ। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনগণকে মুক্তির আলো দেখাও, তাদেরকে শিক্ষিত করো, যেন স্বাধীন বাংলাকে তারা একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। যখনই তোমরা কারো বাড়ীতে আশ্রয় নাও, তোমাদের উচিত তাদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করা। এ কাজ তোমাদের কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম করবে এবং তারা পরিস্কার বুঝতে পারবে তোমরা কাদের জন্য যুদ্ধ করছো। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ জুলুম করে, মেয়েদের সম্ভ্রম নষ্ট করে, তবে তাদের জনসাধারণের দ্বারা বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে দ্বিধা করবে না। . . . তোমরা তরুণ। তোমরা একটি পবিত্র ইচ্ছা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে নেমেছো। বাংলাদেশ তোমাদের জন্য গর্বিত। মনে রাখবে, বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব তোমাদের। জয় বাংলা। মেজর আবু তাহের”।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্রের দশম খণ্ডে সশস্ত্র সংগ্রাম (২) এ সন্নিবেশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাহেরের সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে ধরবো:

“সামরিক দিক থেকে ময়মনসিংহের চাইতে টাঙ্গাইল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই ময়মনসিংহ পাশে রেখে কামালপুর থেকে শেরপুর-জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা পৌঁছানো বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করলাম। রংপুর এবং বগুড়া ৭ নং সেক্টরের অধীনে থাকলেও যোগাযোগের সুবিধার জন্য ঐ সেক্টরের অনেক অপারেশন আমার নেতৃত্বেই হয়েছে। আগস্ট মাসেই টাঙ্গাইলে যুদ্ধরত কাদের সিদ্দিকী আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং আমার সেক্টরের অধীনে আমার কমান্ডে থাকেন। ময়মনসিংহ-এর ভালুকা এলাকাতে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক মেজর আফসার মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড গঠন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকেই বীরত্বের সাথে অপারেশন চালাতে থাকেন। তার দেশপ্রেম, সাহস ও কর্মনিষ্ঠা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। আমার আওতায় রৌমারী থানা বরাবরের জন্য মুক্ত ছিল। এখানে একটি মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি এবং ট্রেনিং দেয়া শুরু করি। নভেম্বর মাস পর্যন্ত সকলের হাতে অস্ত্র দেয়া না গেলেও দশ হাজারের মত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েছিল। এই থানাতে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশও দিয়েছিলাম। আমার হেড কোয়ার্টারে কেবল গরীব কৃষকদের নিয়ে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫০ জন কৃষক নিয়ে কাজ শুরু করি । কৃষক সৈনিকেরা পরবর্তীতে যুদ্ধের ময়দানে যে-কোনো সামরিক প্রশিক্ষিত সৈনিকের চাইতে অধিক দক্ষতা প্রদর্শন করেছিল। তার কারণ বোধহয় এসব কৃষকের অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানিদের দ্বারা অত্যাচারিত। আর তাই তাদের বুকে জ্বলছিল প্রতিশোধ গ্রহণের আগুন। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চল আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আমি চিন্তা করলাম যদি মূল লক্ষ্য হিসেবে কামালপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল এবং ঢাকাকে বেছে নেই, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ময়মনসিংহ-এর পতন হবে। তাই এই টার্গেটকে সামনে রেখেই আমার সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রাখি। নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে আমি আশাবাদী হলাম। ভারতীয় বাহিনীও আমাদের তৎপরতা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। এই সময়ই মুক্তিবাহিনীর একটি অংশকে নিয়মিত বাহিনীর পর্যায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভাবনা অনুযায়ী নিয়মিত বাহিনীর একটি ব্রিগেড গঠনের অনুমতি চেয়ে সেনা দফতরে একটি আবেদন পাঠালাম। সেনাবাহিনী প্রধান (কর্নেল ওসমানী) আমার আবেদন প্রত্যাখান করলেন। অথচ এই সময় গেরিলা বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনীতে রূপান্তরিত করার উপযুক্ত সময় এসেছিল। বাংলাদেশের সামরিক যুদ্ধকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:

প্রথম স্তরঃ সশস্ত্র গণ অভ্যুত্থান – যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল – মার্চ ও এপ্রিল।
দ্বিতীয় স্তরঃ গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি – মে, জুন ও জুলাই।
তৃতীয় স্তরঃ গেরিলা যুদ্ধ – ডিসেম্বর পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। আমাদের গেরিলা বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনীতে নিয়ে যাবার যে পর্যায় এসেছিল, তা কাছে লাগানো হয়নি”।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাহেরের ভাবনার আরও কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখপত্র ‘গ্রেনেড’-এ প্রকাশিত তাহেরের ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে’ প্রবন্ধে। তিনি লিখিছেন,

“পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১১নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে একটা জিনিস দেখে বারবার অবাক হয়েছি। দেখেছি প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মত হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য নির্বাচিত না হতে পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে গেছে। তারপর ইউথ ক্যাম্পে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। মহেন্দ্রগজ্ঞ, মাইনকারচর, ডালু ও অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় ওরা আমাকে ঘিরে ধরেছ। সবারই এক প্রশ্ন – আর কতদিন অপেক্ষা করবে। একজন সৈনিক হিসেবে আমি বুঝতে পারি কখন মানুষ ভয়াবহ যুদ্ধকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। রিক্রুটিং সেন্টারে লাইন দেখে আমি বুঝেছি, এ যোদ্ধারা জয়ী হবেই। কারণ পৃথিবীতে এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেয়ার দৃষ্টান্ত আর নেই। গনচীন থেকে শুরু করে ইন্দোচীনের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মত দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। ভিয়েতনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির সঙ্গে। রাজনৈতিক সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলার তরুণরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শোর্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই”।

তিনি আরো লিখেন,

“২৬ মার্চ থেকে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয় তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ২৫ মার্চের বর্বর আক্রমণ যদি পাকসেনার না চালাতো, তবে এ স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হতে আরো দেরী হতো বলেই আমার ধারণা। এ প্রতিরোধ সশস্ত্র হলেও সাথে সাথে তা মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়নি। এদেশের জনগণের সামরিক অতীত ইতিহাস না থাকাতে এই প্রাথমিক অবস্থায় জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার আকাক্সক্ষা সত্বেও সাথে সাথে তা পারেনি। তবে সামরিক ঐতিহ্যহীনতার এই অভাব জনগণ কয়েকমাসেই সাহসিকতার সাথে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পেরেছিল। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে অল্পসংখ্যক বাঙ্গালি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর (পরে বিডিআর) ও পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ এই নিয়মিত বাহিনীগুলোকে তাদের শেখা যুদ্ধের চিরাচরিত প্রথা ছেড়ে গেরিলা যুদ্ধে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করেছিল। আর সে সময় অর্থাৎ জুন মাসে এদেশে গেরিলা যুদ্ধের সূচনা হয়। মুক্তিফৌজ গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন অঞ্চলে। জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধ একটা রূপ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছড়িয়ে পড়তে থাকে গ্রামে। আগষ্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয় আর সেপ্টেম্বরে তা জোরদার হয়ে ওঠে। এই কৃতিত্ব অর্জনের পর আমি মনে করেছিলাম, আমরা হয়তো মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এমন একটা দৃষ্টান্ত রাখতে পারবো যা নাকি এশিয়ার মুক্তিকামী জাতিসমূহকে জাতীয় মুক্তির প্রেরণা যোগাবে। . . . মুক্তিযোদ্ধারা প্রমাণ করেছিল, যুদ্ধের অতীত ইতিহাস না থাকা সত্বেও একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা ঘায়েল করতে পারে। গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় উপাদান ‘জনগণের আস্থা’ মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল। এটাকে বজায় রেখে রাজনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তখন তাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য”।

এরপর তাহের বলেছেন কিভাবে এবং কেন মুক্তিযোদ্ধারা সে নেতৃত্ব নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি লিখেন,

“এ যুদ্ধ ছিল উপনিবেশিক পাকিস্তানীদের সাথে জনগণের যুদ্ধ। জনগন তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করেছে। শুধু যুদ্ধ করলেই জনগণের সাথে সংযুক্ত হওয়া যায় না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জনগণের সাথে সংযুক্ত হতে হয়। এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ, জনগণের যুদ্ধ। যুদ্ধ যেমন জনগণের জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিকতা, প্রশাসন ইত্যাদিও তার জীবনের অঙ্গ। তাই তখন ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের বলতাম, কৃষকের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে তার খাসী আর মুরগী খেয়ে গেরিলাযুদ্ধ হয় না । . . . যদি কোন কৃষকের গোয়ালে রাত কাটাও, সকালে গোবরটা পরিষ্কার কর। যেদিন অপারেশন না থাকে, তোমার আশ্রয়দাতাকে একটা ‘ডীপ ট্রেঞ্চ লেট্রিন’ তৈরি করে দিও। তাদের সাথে ধান কাট, ক্ষেত নিড়াও। এগুলো হলো জনগণের সাথে সংযুক্ত হবার পদ্ধতি। এগুলো রপ্ত করা, শিক্ষা দেয়া ও প্রয়োগ করার দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতাদের, যারা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটকে এ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে। প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক শিক্ষকের, যারা গেরিলা যুদ্ধের অভিধানে রাজনৈতিক উপদেষ্টা নামে পরিচিত। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটাকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে গণ্য করলো। এ সময়ে আমি আমার সেক্টরে রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য কিছুসংখ্যক সচেতন শিক্ষককে ‘অপারেশন অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ করি। এতে বিশেষ সুফল পাওয়া গিয়েছিল।
সমগ্র বাংলাদেশে গেরিলারা কোন একক কমান্ডের অধীন ছিল না। বস্তুত: সামরিক নেতৃত্বে ছিল কেন্দ্রিকতার অভাব আর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল সামরিক ব্যুৎপত্তির অভাব। সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একদিকে ছিল দুর্বল, অপরদিকে অসমন্বিত। সামরিক নেতৃত্বের রাজনীতিকরণ মোটেও হয়নি”।

একই প্রবন্ধে তাহের বলেন,

“মুক্তিযুদ্ধে সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশে মানুষের মধ্যে আসে দেশ গড়ার উদ্যম ও উদ্দীপনার জোয়ার। তা আমি দেখিছি বাংলার মানুষের মধ্যে। কিন্তু যে ষড়যন্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পঙ্গু করে দিয়েছে, সেই ষড়যন্ত্র দেশ গড়ার উদ্যমকে ব্যর্থ করে দিল। অপরদিকে জনগণ এজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করলো, কারণ মুক্তিযোদ্ধারা এনেছে সামরিক বিজয়। জনগণ তাদের নেতৃত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা নেতৃত্ব হারিয়েও জনগণের মনে নেতৃত্বের আসনে বসে আছে। সেজন্য তারা তাদের সমস্ত দুর্গতির জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করলো, কারণ তারাই ছিল জনগণের বিপদের বন্ধু, নিজস্ব লোক, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নেতৃত্বের আইনানুগ উত্তরাধিকারী। বাংলার দুর্ভাগ্য, আইনানুগ উত্তরাধিকারীর বদলে সর্বস্তরের নেতৃত্ব এসেছে তাদেরই হাতে যারা প্রাক বিপ্লব যুগে ছিলেন ক্ষমতার উৎস। প্রশাসন যন্ত্র সেই পুরোনো ব্যক্তিরাই চালান। বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তারাই। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য ছিলেন সচেষ্ট, তিনি আজ আরও উচ্চপদে সমাসীন। যে পুলিশ অফিসার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে সোপর্দ করেছেন পাকিস্তানীদের হাতে, তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাতদিন খেটে তৈরি করেছে রাজাকার বাহিনী তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চাকুরী দিয়ে দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেননি তিনিই আজ তরুণদের শিক্ষা দেয়ার গুরু দায়িত্ব বহন করেছেন। পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর, তিনিই এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরি করেন। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানীদের হয়ে প্রচারণায় মত্ত ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর-এর পর তারাই ভোল পাল্টে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যেক দেশে স্থাপন করা হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধকে যারা সাহায্য করেনি তারা স্থান পেয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়েছে যাতে তারা বিপ্লবী জনতার অংশ হতে পারে। নিতান্তই পরিতাপের বিষয়, যাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থেকে আত্মশুদ্ধি করার কথা, সকলের অগোচরে তারা সর্বস্তরে নেতৃত্বের আসন দখল করে বসেছে”।

এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে তাহেরের স্বপ্ন ও ভাবনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হল। প্রচলিত যুদ্ধের সাথে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক পার্থক্য, মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ও সৈনিক নয়, জনগণই যে মূল শক্তি ও ভরসা, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক চরিত্র, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্ব, সমরনেতাদের রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জন, জনগণের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসেনাবাহিনী বিকাশের ধাপসমূহ তাহেরের নিজ লেখা থেকে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীর যে সকল দেশে সফল মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে যেমন চীন, ভিয়েৎনাম এবং কিউবা – সে সব দেশের বিপ্লবী নেতাদের চিন্তাধারা এবং অভিজ্ঞতার সাথে তাহেরের চিন্তার অপূর্ব মিল ও সায়ুজ্য দেখা যায়। এটা সম্ভব হয় দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক ভাবনার সচেতন অনুশীলন, বিপ্লবী স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়নে একাগ্রতা, প্রচণ্ড দেশপ্রেম এবং তার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠাবোধ না করা – এসব থেকে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে গুরুতর ভুলগুলো তাহেরের চোখে ধরা পড়েছে – বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে ভুল সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাগত প্রশিক্ষিত সেনা সদস্যদের প্রচলিত সেনাবাহিনীর নিয়মিত কাঠামোতে বেধে ফেলা এবং তার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নতুন যোগ দেয়া হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা – এসব যে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার পথে কত বড় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল তা আমরা দেখবো। অন্যদিকে যখন সঠিক সময় উপস্থিত হলো, অর্থাৎ ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বর পরবর্তী সময়, যখন গেরিলা যুদ্ধ ও তার সংগঠন বিকশিত হয়ে উঠেছে এবং নিয়মিত বাহিনীতে তাকে রূপ দেয়া প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, তখন তা করা হোল না। এর ফলে লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধা যারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে তাদের কোন নিয়মিত সামরিক কাঠামোর মধ্যে আনা হলো না। ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ জনগণের সেনাবাহিনী বা পিপলস আর্মি গড়ে তোলার কাজে তাদের কোন অংশগ্রহণ থাকলো না। দেশে নতুন সেনাবাহিনী হলো সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আদলে গড়া গণ-বিচ্ছিন্ন ব্যারাক আর্মি। আর মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেলে দেয়া হোল এক অনিশ্চিত দিক-ভ্রান্ত উদ্দেশ্যহীন জীবনের দিকে। এর ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সোনার বাংলা অর্জনের পথে যে কত মারাত্মক অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী সামরিক কাঠামো যে বাংলাদেশের গনতান্ত্রিক সমাজ অর্জনে, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় এবং সর্বপোরি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কি সমূহ বিপদ ডেকে আনতে যাচ্ছে, কর্নেল তাহের তা উপলব্ধী করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নবগঠিত সেনাবাহিনীতে তার স্বল্পকালীন চাকুরী জীবনে।

ভারতের পুণা সামরিক অর্থোপেডিক হাসপাতালে নকল পা সংযোজিত করার পর ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে তাহের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়ার্টারে প্রথম এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দু’মাস পরে তাঁকে কুমিল্লায় ৪৪তম ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
আমরা আবার ফিরে যাব ঢাকা কারাগারে গোপন প্রহসন বিচারে তাহেরের জবানবন্দীতে। তিনি বলেন,

“আমাদের আশা ছিল একটা সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর বাংলাদেশের, যে দেশে দুর্নীতি ও মানুষে মানুষে শোষণের কোন সুযোগ থাকবে না। সাধারণ মানুষের সাথে দেশরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্ক হবে আন্তরিক। এই সেনাবাহিনী হবে আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তা জনগণের মাথার বোঝা হবে না। এই আশা এই স্বপ্ন নিয়েই আমাদের জাতি বারবার এতো কঠোর সংগ্রামে নেমেছে। এই আশায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে আমাদের আদর্শ ও মূল্যবোধ। কিন্তু তা হয়নি। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই অধ:পতনের ধারা শুরু হয়ে যায়। . . . এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল পদে যোগ দিয়ে আমি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হই। তখন এ কাজ ছিল দুঃসাধ্য। আমি অবৈধ অর্থ-বিত্ত আদায়ের দায়ে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত এবং আরো কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেই। আমার আহ্বান ছিল অফিসার কর্তৃক অবৈধ উপায়ে অর্জিত যে-কোনো সম্পদ ফেরত দিতে হবে। কেবল তখনই তারা বুক ফুলিয়ে সাহসের সাথে খাঁটি সৈনিকের মত দাঁড়াতে পারবে। আমি কখনই এই নীতির প্রশ্নে অপোষ করিনি। . . . কুমিল্লা ব্রিগেডের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আমার অধীন অফিসারদের নির্দেশ দেই অবৈধ উপায়ে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তার সব ফিরিয়ে দিতে হবে। এরা আমার নির্দেশ পালন করেছিল। আমি সবসময় মানুষের ভাল দিকটি জাগিয়ে তুলতে চেয়েছি, মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নেয়াকে আমি ঘৃণা করেছি এবং এড়িয়ে চলেছি”।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেনা অফিসারদের উপঢৌকন নেয়ার একটি ঘটনার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করি। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের এক বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসের ২৬ স্টাফ রোডের কর্নেল তাহেরের বাংলোর বসবার ঘরে আমরা তাহের ভাই-এর সাথে বসে ছিলাম। তার অল্প কিছুদিন আগে চিকিৎসা শেষে তিনি ভারত থেকে ফিরেছেন। প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধারা আসে তাঁর সাথে দেখা করতে। সেই বিকেলে ১১নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান যিনি তাহের আহত হওয়ার পর সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন – তাহেরের সাথে দেখা করতে এলেন। তাহের তাকে দেখে খুব খুশী হলেন। কিছু কুশল বিনিময়ের পর হামিদুল্লাহ বললেন, “স্যার আমি আপনার জন্য একটি উপহার সংগ্রহ করে রেখেছিলাম, সে’টি আজ নিয়ে এসেছি”। তাহেরের চেহারায় বিস্ময়। কী উপহার তার অধীন এই কমান্ডার নিয়ে এসেছে? হামিদুল্লাহ গর্বিতভাবে বললেন, “স্যার আদমজী যে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ীটি ব্যবহার করতেন, সে’টি আপনার জন্য এনেছি”। আমরা বুঝতে পারলাম বিপদ ঘটে গেছে। তাহেরের চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করলো। তিনি তাঁর হাতের ওয়াকিং ষ্টিকটি উঠিয়ে সেই মুহুর্তে হামিদুল্লাহকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। ‘ইয়েস স্যার’ বলে তিনি অতি দ্রুত নিঃস্ক্রান্ত হলেন।

তাহেরের জবানবন্দীতে আবার ফিরে আসি। তাহের বলছেন,

“স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং ঢাকা ও কুমিল্লা সেনানিবাসে অর্জিত অভিজ্ঞতা আমাকে উৎপাদন বিচ্ছিন্ন স্থায়ী সেনাবাহিনীকে একটি বিপ্লবী গণবাহিনীতে পরিণত করতে উদ্বুদ্ধ করে। আমার সৈনিক জীবনে লক্ষ্য করেছি উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে স্থায়ী সেনাবাহিনী জাতীয় অর্থনীতির উপর কত বড় বোঝা হিসেবে কাজ করে। এ ধরণের সেনাবাহিনী সমাজ প্রগতির পথে এক বিরাট বাঁধা। জাতীয় উৎপাদনে এদের কোন অবদানই থাকে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে নিষ্ঠা, আনুগত্য ও ত্যাগের মনোভাব লক্ষ্য করেছিলাম, তাতে স্বাধীনতা উত্তরকালে একটা উৎপাদনমুখী বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করা অসম্ভব বলে আমার মনে হয়নি। সামরিক বাহিনীর অনেকেই এটা জানেন যে, আমি কুমিল্লা ব্রিগেডকে একটি ‘গণবাহিনী’র মতো করে তুলতে চেষ্টা করেছিলাম। মুক্তিসংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী সেনাদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে আমি সব সময় চেষ্টা করেছি। আমার সামরিক সংগঠনের মূলনীতি ছিল ‘উৎপাদনশীল সেনাবাহিনী’। এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের অফিসার ও সৈনিকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শ্রমিক-কৃষকের সাথে উৎপাদনে অংশ নেয়। আমরা নিজেরা জমিতে হাল ধরেছি, নিজেদের খাবার উৎপাদন করে নিয়েছি। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে গ্রামের মানুষের বাড়ীতে গিয়েছি। এটাই ছিল স্বনির্ভর হওয়ার একমাত্র পথ”।

কুমিল্লা সেনানিবাসে তাহের কর্তৃক নতুন ধরনের সেনাবাহিনী গড়ে তোলার এই সময়ে বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তিনি তাহেরকে সেখানে ডেকে পাঠান তার পায়ের উন্নত চিকিৎসা করাতে। তাহের বুঝতে পেরেছিলেন, কুমিল্লায় তাঁর কর্মকাণ্ডের ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাহের বঙ্গবন্ধুকে জানান তার চিকিৎসায় যে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হবে তা যেন নির্মীয়মান পঙ্গু হাসপাতালে দেয়া হয়। বিপুল সংখ্যক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা তখন চিকিৎসাধীন ছিল। আরও একটি কারণে তাহের তখন দেশ ছেড়ে যাওয়াকে সমীচীন মনে করেননি। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানকালে দেশে একটি সামরিক ক্যুদেতার প্রচেষ্টা হয়। তাহের তার তীব্র বিরোধীতা করেন। তিনি ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তন করলে তাকে এ বিষয়ে অবহিত করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হলো না। বরং তাহেরকে সক্রিয় অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলো। তাহেরকে বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠান। তিনি তাকে বলেছিলেন, “তুমি আমাদের জাতীয় বীর। সেনাবাহিনীতে হাতে গোনা সৎ অফিসারদের মধ্যে একজন। এজন্যই ‘ডাইরেক্টর ডিফেন্স পারচেজ’ (ডিডিপি) পদে তোমাকে নিয়োগ দিয়েছি। দেশ এতে উপকৃত হবে”। তাহের বিনয়ের সাথে তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করলেন এবং সেনাবাহিনীকে পাকিস্তানী আদলে রেখে দেয়ার বিপদ সম্পর্কে পূনরায় তাঁকে বোঝাতে চাইলেন। এর আগে সেনাবাহিনীর কাঠামো সম্পর্কে তার সার্বিক পরিকল্পনা তাহের বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে ছিলেন।

তাহের শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করলেন। ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করা লেখা তাহেরের পদত্যাগ পত্রটি নানা কারণে তাৎপর্যমন্ডিত। তার কিছু অংশ:

“আমি চিন্তা করেছিলাম বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবজনক সেনাবাহিনী গড়ে তুলবো। আমি ছাউনিতে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীতে কাজ করেছি এবং আমি বুঝতে পারি একটি অনুন্নত দেশের জন্য এই ব্যারাক আর্মি কতটুকু বিপজ্জনক হতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই বলেই তারা এমন স্বেচ্ছাচারী শাসন চালিয়েছিল, বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এবং সর্বশেষে দেশটিকে ধবংস করে ফেলে। আমি উৎপাদনশীল গণমুখী সেনাবাহিনী – যা দেশের প্রগতির জন্য অত্যন্ত কার্যকরী সংগঠন হিসেবে কাজ করবে – গড়ে তোলার ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ এবং আরও কিছু উচ্চ পদস্থ অফিসার আমার এই ধারণার ব্যাপারে কোন উৎসাহ বা সহযোগিতা প্রদান করেননি। এই মৌলিক বিষয়ে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফের সাথে আমি মতৈক্যে পৌঁছুতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চাইতেন চিকিৎসার জন্য যাতে আমি বিদেশে যাই। যখন আমি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম, তখন জানতে পারি যে মন্ত্রীসভার জনৈক সদস্যসহ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার প্রধানমন্ত্রীর দেশে অনুপস্থিতিরি সুযোগে ক্ষমতাদখলের ষড়যন্ত্র করছে। সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন। আমি তখন ভাবলাম প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরা পর্যন্ত আমার বিদেশে গমন স্থগিত রাখা উচিত।

কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হলো না উপরন্তু সেনা বাহিনীর চীফ অব স্টাফ আমাকে ৪৪ নং ব্রিগেডের কমান্ড ত্যাগ করে ডিডিপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেন। আমি অনুভব করছি ষড়যন্ত্র এখনও চলছে এবং আরও অনেকে এর সাথে জড়িত রয়েছে। এ ধরনের ক্ষমতাদখল হচ্ছে সামগ্রিকভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্খার বিরুদ্ধে। এবং এটাকে রুখতে হবে। যদি ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে সেনাবাহিনীর যে সুনাম রয়েছে তা নষ্ট হবে এবং সেনাবাহিনীতে আমার আর কাজ করা সম্ভব হবে না।

আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম একজন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে নয় বরং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আমি এ’টাকে আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করি। জনগণের স্বার্থই আমার কাছে সর্বোচ্চ। আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই। যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিল। আমি তাদের বলবো কি ধরনের বিপদ তাদের দিকে আসছে।

আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকবো।

আপনার একান্ত বাধ্যগত,
লে: কর্নেল এম. এ. তাহের
কমান্ডার, ৪৪ ব্রিগেড
কুমিল্লা সেনানিবাস
তারিখ: ২২শে সেপ্টেমর, ১৯৭২

জেনারেল হেড কোয়ার্টারে এডজুটেন্ট জেনারেল পদে তাহেরের দায়িত্ব পালন কালে মেজর জলিলের বিচারের জন্য সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক পাকিস্তানীদের কাছ থেকে দখল করা অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন মেজর জলিল। একজন সেক্টর কমান্ডারের গ্রেপ্তার তখন সেনাবাহিনী এবং জনমনে আলোড়ন তুলেছিল।

তাহের ছিলেন ট্রাইব্যনালের চেয়ারম্যান। সরকার মেজর জলিলের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে খুলনা জেলে আটক সেখানকার প্রাক্তন ডিসি-কে নিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন পাকিস্তানীদের সহযোগী। সাক্ষীর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকার কথা জেনে কর্নেল তাহের তাকে আদালত কক্ষ থেকেই বের করে দেন। তাঁর যুক্তি ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার-এর বিরুদ্ধে কোন স্বাধীনতা-বিরোধীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিছুদিন বিচার চলার পর তাহেরের নেতৃত্বে সামরিক ট্রাইব্যুনাল মেজর জলিলকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ও মুক্ত ঘোষণা করে।

সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের পর কর্নেল তাহেরের সাথে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রায় সকল রাজনীতিবিদদের সাথে আলোচনা হয়। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন বদরুদ্দিন উমর, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবুল বাশার, সিরাজ সিকদার, মঞ্জুরুল আহসান খান, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ। তাঁদের সকলের সাথে আলোচনার পর তাহের সিদ্ধান্ত নেন সিরাজুল আলম খান ও তাঁর সহযোগীদের রাজনৈতিক উদ্যোগের সাথে যোগ দেবেন। তাঁরা তাকে অবহিত করেছিলেন কিভাবে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে তারা স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে কাজ করে আসছিলেন। এছাড়া এই ধারার তরুণ প্রতিভাদীপ্ত নেতৃবৃন্দ যারা ছাত্রলীগের র‌্যাডিক্যাল অংশটির প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং ১৯৬৯ ও ’৭০-এর স্বাধিকার আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদেরকেই তাহের সামনের দিনগুলোতে সমাজবদলের লড়াইয়ে সবচাইতে সম্ভাবনাময় শক্তি ভেবেছিলেন।

১৯৭২-এর ৩১ অক্টোবর পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে জাসদ আত্মপ্রকাশ করে। সেখানে জনতার উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়, দলের সহ-সভাপতির নাম পরে জানানো হবে এবং সে নাম শুনলে তারা খুশী হবেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই তা করা হয়। তাহের ছিলেন সেই সহ-সভাপতি। তাহেরকে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে নতুন গণবাহিনীর সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়। আরও স্থীর হয় তাহের সাময়িক কালের জন্য কোন বেসামরিক কাজে নিয়োজিত থাকবেন। সে অনুযায়ী তাহের প্রথমে সী-ট্রাক ইউনিটের পরিচালক ও পরে ড্রেজার সংস্থার পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর সানন্দ অনুমতি ছিল এসব নিয়োগে।

সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে জাসদ-এর তরুণ নেতৃত্ব শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের শ্লোগান নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়। প্রখ্যাত বাম অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহামন সে সময় লিখেন, ‘বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’। নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে তিনি দেখান প্রাক স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব থেকেই কৃষিতে ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা ধাপে ধাপে কিভাবে অর্থনীতির মূল নিয়ামকে পরিণত হচ্ছিল এবং বাংলাদেশ পরবর্তী সে সময়ে প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রূপ পেয়েছে। যেহেতু কৃষি সে সময়ে অর্থনীতির মূল অংশ এবং কৃষিতে আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাই প্রধান বলে বাংলাদেশের অধিকাংশ বাম রাজনৈতিক দলগুলো মনে করতো, তাই কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে ড. আখলাকুর রহমানের বিশ্লেষণ সচেতন মহলে আলোড়ন তোলে।

সিরাজুল আলম খান এবং জাসদ নেতৃবৃন্দ ড. আখলাকুর রহমানের কৃষি অর্থনীতি তত্ত্বকে গ্রহণ করেছিলেন। যুক্তির ধারাটি ছিল এমন – যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি মূল খাত এবং সেখানেই ধনতন্ত্র মূল অর্থনৈতিক নিয়ামকে পরিণত হয়েছে, তাই সিদ্ধান্ত টানা যায় যে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি ধনতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করেছে। অবস্থিত বাম চিন্তাধারার বক্তব্য – বাংলাদেশের অর্থনীতি আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা সাম্রাজ্যবাদী – এর বিপরীতে জাসদ তার বক্তব্য বলিষ্ঠ ভাবেই উত্থাপন করে। অর্থনীতির এই ভিত্তির উপর জাসদ বাংলাদেশের বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক বলে নির্ধারণ করে। জাসদ-এর এই রাজনীতিক দর্শনের আরও একটি কারণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালেই সিরাজুল আলম খান ভারতের বাম রাজনৈতিক দল “সোশ্যালিষ্ট ইউনিটি সেন্টার”-এর প্রধান তাত্ত্বিক শিবদাস ঘোষের চিন্তা-ভাবনার সাথে পরিচিত হন। শিবদাস-এর বিশ্লেষণ ছিল ভারতে বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন নিশ্চয়ই সিরাজুল আলম খানকে প্রভাবিত করে থাকবে।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধনের মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজে রয়ে যাওয়া সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ এবং দূর্বল জাতীয় রাষ্ট্রের উপর সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী বহি:শক্তির প্রভাবের অবসান ঘটবে বলে জাসদ নেতৃবৃন্দ মনে করতেন। এভাবেই ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি যেভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের থিসিস অনুযায়ী তাদের রণনীতি নির্ধারণ করেছিল, তেমনি জাসদও বাংলাদেশে ক্ষমতা দখলের রণনীতি হিসেবে মূলত: শহর-ভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানমূলক রণনীতি গ্রহণ করে। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশের প্রচলিত বাম চিন্তা – গ্রামাঞ্চলে প্রলম্বিত গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করা এবং শহর ঘেরাও করা – তার সাথে জাসদের রণনীতি ছিল পৃথক। আগেই বলেছি কর্নেল আবু তাহের জাসদ-এর সমাজ বিশ্লেষণ ও ক্ষমতা দখলের রণনীতির সাথে একমত হয়েছিলেন এবং সেভাবেই তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্তব্য ঠিক করেছিলেন। জাসদে সকল শ্রেণীর মানুষের সম্মিলন ঘটেছিল। সে অর্থে জাসদ ছিল আওয়ামীলীগ বা ন্যাপের মতই একটি গণতান্ত্রিক দল। তবে লক্ষ্য হিসেবে সমাজবিপ্লব ও শ্রেণী সংগ্রাম নির্ধারণ করায় জাসদ-এর উদ্দ্যেশ ছিল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাসদ সংগঠনের অভ্যন্তরে বিপ্লবী পার্টির ভ্রুণ তৈরি করা। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে সচেতন চেষ্টাও ছিল। নিয়মিত পাঠচক্রের মাধ্যমে বিপ্লবী সাহিত্য অধ্যয়ন এবং দলের সবচেয়ে অগ্রবর্তী এবং নিবেদিত প্রাণ কর্মিদের নিয়ে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার কাজও জাসদ শুরু করে। ১৯৭৪ সালে সে লক্ষ্যে গঠিত হয় ‘কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি’। ১৩ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে কর্নেল তাহেরও ছিলেন একজন সদস্য।

রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে একটি সফল গণঅভ্যুত্থান সংগঠনের জন্য জাসদ আন্দোলন-সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করে। রাজনীতি হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানকে গ্রহণ করায় অবস্থিত রাষ্ট্র কাঠামোর অভ্যন্তরেই জাসদ সমান্তরাল ভাবে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করে। অন্যান্য বাম সংগঠনের মত গণ-বিচ্ছিন্ন গোপন রাজনীতি ও পৃথক গোপন সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলতে চায়নি জাসদ। বরং উন্মুক্ত রাজনীতির সকল সুযোগ কাজে লাগাতে চেয়েছে তারা। এমনকি শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যে তাত্ত্বিক সম্ভাবনা বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হতো সে পথে অগ্রসর হওয়ার দ্বারও জাসদ উন্মুক্ত রাখে। তাই একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালুর পূর্ব পর্যন্ত জাসদ পৃথক সশস্ত্র গণবাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়নি। বাকশাল প্রবর্তিত হওয়ার ফলে আইনি উন্মুক্ত রাজনীতির সকল পথ যখন রুদ্ধ হয়ে পড়ে তখনই কেবল জাসদ নেতৃত্ব রাষ্ট্র সংগঠনের বাইরেও রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিপ্লবী গণবাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। শহর-ভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধের জন্য সংগঠন গড়ে তোলা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর কাজ শুরু হয়। আগেই বলেছি কর্নেল তাহেরের উপর এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।

সার্বিক ভাবে গণবাহিনী কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে কর্নেল তাহেরের ওপর। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ১৯৬৯ সালে তাহের যেমন চরম ঝুঁকি নিয়েও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছিলেন, তেমনি এবারে স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজ বদলের লড়াই চালাতে অবস্থিত রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে ও বাইরে বিপ্লবী গণবাহিনী গড়ে তোলার কঠিন বিপজ্জনক দায়িত্ব তিনি কাঁধে নিলেন।

(চলবে)

১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব

মো. আনোয়ার হোসেন

অধ্যাপক, প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনুজ, শহীদ কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)।

৫ comments

  1. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (পঞ্চম ও শেষ পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  2. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (প্রথম পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  3. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (তৃতীয় পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  4. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৪ নভেম্বর ২০১০ (৯:২৯ অপরাহ্ণ)

    খুবই দরকারি আয়োজন এটি।

  5. অবিশ্রুত - ২১ ডিসেম্বর ২০১০ (৩:৩৮ পূর্বাহ্ণ)

    এক.
    তাহেরের জবানবন্দিতে বলা হয়েছে :

    যখন আমি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম, তখন জানতে পারি যে মন্ত্রীসভার জনৈক সদস্যসহ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার প্রধানমন্ত্রীর দেশে অনুপস্থিতিরি সুযোগে ক্ষমতাদখলের ষড়যন্ত্র করছে। সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন। আমি তখন ভাবলাম প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরা পর্যন্ত আমার বিদেশে গমন স্থগিত রাখা উচিত।

    কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হলো না উপরন্তু সেনা বাহিনীর চীফ অব স্টাফ আমাকে ৪৪ নং ব্রিগেডের কমান্ড ত্যাগ করে ডিডিপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেন। আমি অনুভব করছি ষড়যন্ত্র এখনও চলছে এবং আরও অনেকে এর সাথে জড়িত রয়েছে। এ ধরনের ক্ষমতাদখল হচ্ছে সামগ্রিকভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্খার বিরুদ্ধে। এবং এটাকে রুখতে হবে।

    গত ১৯৮০ সাল থেকে আমি জানার চেষ্টা করছি, কারা এই সামরিক ক্যুদেতার প্রচেষ্টা করেছিলেন। কেননা, এই ভাষ্য যদি সত্য হয়, তা হলে এটিই ছিল বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা। কারও কি ধারণা আছে, কোন কোন সামরিক কর্মকর্তা এই প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিংবা কোন সামরিক অফিসার এর উদ্যোক্তা ছিলেন?
    এটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাহের এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে যে-কোনও ভাবেই হোক না কেন, জানতে পেরেছিলেন। তার মানে কি তাকেও এই ক্যু-এর উদ্যোগের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল?
    দুই.
    মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামরিক ও গেরিলা নেতৃত্ব সম্পর্কে তাহেরের এ কথাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ :

    সমগ্র বাংলাদেশে গেরিলারা কোন একক কমান্ডের অধীন ছিল না। বস্তুত: সামরিক নেতৃত্বে ছিল কেন্দ্রিকতার অভাব আর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল সামরিক ব্যুৎপত্তির অভাব। সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একদিকে ছিল দুর্বল, অপরদিকে অসমন্বিত। সামরিক নেতৃত্বের রাজনীতিকরণ মোটেও হয়নি।

    এগুলি দুর্বল ও অসমন্বিত ছিল বলেই মুজিব বাহিনী আলাদাভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, প্রবাসী সরকারের বাইরে আলাদা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছিল শেখ মণির নেতৃত্বে। আর সামরিক নেতৃত্বের রাজনীতিকরণ না হওয়ার কারণে সামরিক শাসনসমেত দানবের মতো বেরিয়ে এসেছেন জিয়াউর রহমান।
    তিন.
    আনোয়ার হোসেন লিখেছেন :

    মুক্তিযুদ্ধকালেই সিরাজুল আলম খান ভারতের বাম রাজনৈতিক দল “সোশ্যালিষ্ট ইউনিটি সেন্টার”-এর প্রধান তাত্ত্বিক শিবদাস ঘোষের চিন্তা-ভাবনার সাথে পরিচিত হন। শিবদাস-এর বিশ্লেষণ ছিল ভারতে বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন নিশ্চয়ই সিরাজুল আলম খানকে প্রভাবিত করে থাকবে।

    শিবদাস ঘোষের রাজনৈতিক চিন্তা অন্তত সিরাজুল আলম খানকে তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি। করলে, ১৯৮০ সালে জাসদ বিভক্তির সময় তিনি হয়তো বাসদের সঙ্গেই থাকতেন। জাসদের কর্মীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় সচিত্র চিকা মারতো : বঙ্গভবন থেকে বেরুলেন গাই/ তার যে বাছুর মান্না ভাই/ এসইউসি-র নাতজামাই/ বলেন নতুন পাট্টি চাই।
    তবে সিরাজুল আলম খান শিবদাস ঘোষের সঙ্গে কীভাবে পরিচিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কোন ধরণের কথা হতো, তা জানার ইচ্ছে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ-ব্যাপারে এসইউসি-র অবস্থানই বা কী ছিল? কারও জানা আছে কি?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.