কাফকা, দীপায়ন এবং আমি : প্রসঙ্গ সংখ্যালঘুত্ব

লেখক, যদি তিনি হন চিন্তায় অগ্রগামী, অপ্রথানুগ, তাহলে নিশ্চিতই তিনি পড়ে যান সংখ্যালঘুদের দলে। এ তো লেখকের স্বনির্মিত এক ভাগ্যনিয়তি। মানসিক সংখ্যালঘুত্ব তাঁকে কোনো এক সময়ে পরিণত করে ফেলতে পারে নিঃসঙ্গ এককে। তিনি তখন স্বয়ম্ভূ কিন্তু নিঃসঙ্গ। এমন প্রাপ্তি এবং প্রাপ্তির অভিশাপ একই সঙ্গে বহন করার ভাগ্য লেখক ছাড়া আর কারো হয় বলে আমাদের জানা নেই।

মানসিক সংখ্যালঘুত্ব নয়, আজ আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে জাজ্জ্বল্যমান জাতিগত ও সামাজিক সংখ্যালঘুত্বের সমস্যা। আজ নয়, বহুদিন থেকেই। সেই যেদিন আইয়ুব খানের মার্শাল প্ল্যানে তার মাশরেকি পাকিস্তানের নাগরিকদের বিদ্যুৎ দেবার মানসে পাহাড়ের মানচিত্র পরিবর্তন করে নির্মিত হলো জলাধার, তলিয়ে গেল পঞ্চাশ সহস্রাধিক আদিবাসীর বসতবাড়ি-জুমক্ষেত, থমকে গেল নিজেদের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক জীবনধারা, সেদিন থেকেই এদেশের সংখ্যাগুরু বাঙালির সাথে আদিবাসীদের মানসিক দূরত্ব বেড়েই চলেছে।

কথা শুরু হয়েছিল লেখকদের মাননিক-মানসিক সংখ্যালঘুত্ব নিয়ে। লেখকদের মধ্যে আবার কাফকার চাইতে অসহায় সংখ্যালঘু আর কে ছিলেন? জন্ম প্রাগে। কিন্তু নিজের পরিবার জার্মানভাষী। মনে রাখা দরকার সেই সময় প্রাগে জার্মানভাষীর সংখ্যা হাতে-গোনা বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। সেই হাতে-গোনা জার্মান পরিবারের মধ্যেও আবার সংখ্যালঘু ছিল কাফকার পরিবার। কেননা জার্মানরা অধিকাংশ খ্রিস্টান হলেও কাফকার পরিবার ছিল ইহুদি। শারীরিক বর্বরতা তাঁকে কতখানি সইতে হয়েছে তা না জানলেও তাঁকে যে স্বল্পায়ু জীবনের পদে পদে এজন্য মানসিক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়েছে সে তথ্য সকলেরই জানা।

আমার ভাবনাতে কখনোই একথা আসেনি যে দীপায়ন বা তাঁর সহকর্মীরা আমার থেকে ভিন্ন কিছু। আমাদের কাছে এটুকু জানাই যথেষ্ট যে দীপায়ন ‘মাওরুম’ সম্পাদনা করেন। তিনি সংস্কৃতিকর্মী। প্রগতিশীলতা এবং সুরুচির আন্দোলনে প্রথম সারির সৈনিক। এই পর্যন্ত জানাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যথেষ্ট তাঁকে আত্মীয় ভাবতে পারা। আত্মীয়, কেননা সত্যিকারের সংস্কৃতিকর্মী তো পৃথিবীর সবার জন্য নিজের বুক মেলে রাখেন। তাঁদের বুক তাই পৃথিবীর মতোই বিশাল এবং ক্ষতবিক্ষত। সেই বুকের আহ্বান অস্বীকার করতে পারি, নিজেকে এতটা সংবেদনাহীন এখনো ভেবে উঠতে পারিনি।

কাফকা সংখ্যালঘু। দীপায়ন সংখ্যালঘু। আর আমি?

আমিও সংখ্যালঘু।

হ্যাঁ, আমিও সংখ্যালঘু। যদিও জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ে যে জাতিসত্তা বা ধর্মের মানুষ এই ভূখণ্ডে সংখ্যায়-শক্তিতে বেশি, রাষ্ট্রের ওপর যাদের কর্তৃত্ব, রাষ্ট্রযন্ত্রকে চরমতম বর্বরের মতো ব্যবহার করতে যে সম্প্রদায়ের একটি অংশ কখনোই দ্বিধায় ভোগে না, যারা জাতীয় ফুল-পাখি-মাছ-ফলের মতো জাতীয় ধর্মেরও পরিচয় দাঁড় করাতে চায়, আমার জন্ম সেই জাতি-ধর্মাবলম্বীদেরই ঘরে। তবুও আমি নিজেকে সংখ্যালঘুই ভাবি। কেননা আমি যে-দর্শনে বিশ্বাস করি, সেই দর্শনের তত্ত্বে বিশ্বাস ও চর্চাকারীর সংখ্যা আজ পৃথিবীর বিরল প্রাণী রক্ষার কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমি যে-ইহজাগতিকতায় বিশ্বাস করি, সেই ইহজাগতিকতা আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে পরিস্রুত হতে হতে আজ লক্ষ লক্ষ বছর পরে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। ক্ষমতাসীন শ্রেণীর অপকর্মের শিকারে পরিণত হয়ে রয়েছে পুরো জাতি। এতে যারা বিক্ষুব্ধ হয়, প্রতিকারে-প্রতিবাদে যাদের ফেটে পড়তে ইচ্ছা জাগে, প্রতিকারে নামার কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে যাদের কারো কারো অসহায় আত্মহননের ইচ্ছা জাগে, কিংবা ক্ষোভ প্রকাশের পথে আইনগত-সামাজিক-ধর্মীয় অসংখ্য বাধার পাহাড় দেখে যাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে ইচ্ছা করে, আমি তাদেরই একজন। আমি সংখ্যালঘু হতে হতে এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকি ছোটবেলার খেলার সাথীদের থেকে, পাঠশালার সহপাঠীদের কাছ থেকে, পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে, পাড়া-পড়শি থেকে, পেশাগত বান্ধবদের থেকে। কখনো কখনো চিন্তার দূরত্ব এতটাই বেড়ে যায় যে স্ত্রী-পুত্রকেও মনে হয় অনেক দূরের মানুষ। কাজেই আমিও খুব ভয়ংকর রকম সংখ্যালঘু। যেমনটি দীপায়নদের গ্রামে ও জনপদে ঘটে, সেই রকম হামলার ঘটনা আমার পরিবারের ওপর ঘটলেও দীপায়নের মতো দুই-চারজন ছাড়া আর কেউ যে বেদনা ও সহমর্মিতা বোধ করবে না সে ব্যাপারে আমি এখন থেকেই নিশ্চিত।

অথচ কী আশ্চর্য! মানুষের সাথে মানুষের সংযোগ স্থাপনের জন্যই নাকি আবিষ্কৃত হয়েছিল ভাষা, মানুষের সাথে মানুষের মিলন ঘটানোর জন্যই উদ্ভব ঘটেছিল ধর্মের, আর মানুষকে মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করতেই নাকি দানা বেধেছিল জাতীয়তাবাদী চেতনা। আর আজ ঘটছে ঠিক উল্টোটাই। আজ তাই ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্ম, ভাষার বিরুদ্ধে ভাষা। অমৃতের বৃক্ষে কেন বিষফল উৎপাদিত হচ্ছে তা আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

আজ এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে ধর্মীয় ও জাতিগত সাম্প্রদায়িকতা প্রাকৃতিক নয়, বরং শতভাগ ঐতিহাসিক। মানুষ কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে জন্ম নেয় না, তাকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে তৈরি করে তার সাম্প্রদায়িক পূর্বসূরিরা। আর এর সাথে কোনো পারলৌকিক মঙ্গলের যোগসূত্র নেই, আছে শুধু জাগতিক স্বার্থ। সেই স্বার্থ থেকেই আজ সংখ্যাগুরুর আস্ফালন আর সংখ্যালঘুর নিরাপত্তাহীনতা।

ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির পেছনেই ছিল শহরের একমাত্র ধোপাপাড়াটি। শহরের মানুষকে পরিপাটি ও সুন্দর পরিচ্ছন্ন করে রাখার কাজে নিয়োজিত তারা। তাদের মধ্যে টগর জ্যাঠার কথা খুব মনে পড়ে। পেশায় ধোপা, কিন্তু আদতে টগর দাস ছিলেন শিল্পী এবং ভাবুক। সত্য ও শান্তির খোঁজে ভেতরে ভেতরে সবসময় ছটফট করতেন। টগর দাস মুসলমান না হয়েও ফুরফুরার পীর সাহেবের ভক্ত ছিলেন। একবারই শুধু কয়েক মিনিটের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন পীর সাহেবের। পীর সাহেব নাকি টগর জ্যাঠাকে বলেছিলেন, তাঁর নিজের ও টগর দাসের মধ্যে যে অভিন্ন মিলটি রয়েছে, সেটি হচ্ছে বাস্তব জগতের সবচেয়ে বেদনাদায়ক মিল। তা হলো তাঁরা দুইজনই সংখ্যালঘু। একজন ভারতে সংখ্যালঘু, একজন বাংলাদেশে।

এটাই এখনকার বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতা ছেড়ে তো পালানোরও কোনো পথ নেই। কারণ পালিয়ে কাফকা, দীপায়ন বা আমি যতদূরেই যাই না কেন, এই বাস্তবতা দুঃস্বপ্ন হয়ে আমাদের পিছু নেবেই নেবে। তাই এই বাস্তবতাকে পাল্টানোর জন্য এর মুখোমুখি দাঁড়ানোই শ্রেয়। কী আয়ুধ নিয়ে আমরা দাঁড়াব দীপায়ন? ‘মাওরুম’ আর সুস্থ মানবিকতা নিয়ে। সেই সঙ্গে থাকতে পারে আহমদ শরীফের সেই অবিস্মরণীয় আত্মোপলব্ধি — ‘আমার সাহসের উৎস হচ্ছে আমার বৈষয়িক ক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতা।’

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

9 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
9
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.