আনাতোল ফ্রাঁসের মৃত্যুর কিছুদিন আগে শিকাগো টাইমস পাঠকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকদের সম্পর্কে তাঁদের মতামত দিতে। ফলাফলে দেখা যায় ১. শেক্সপীয়র ২. গ্যোতে ৩. আনাতোল ফ্রাঁস। আনাতোল ফ্রাঁস অসাধারন হিউমার সমৃদ্ধ ফরাসী লেখক। আমাদের দেশে তিনি কামু অথবা সাত্রের মত পরিচিত নন। ১৮৪৪ সালের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাহিত্যে বিশেষ করে উপন্যাসে দুই ধরনের স্কুল দেখা যায়। লিটারারি জারনালিজম আর লিটারারি মনাস্টিসিজম। তিনি এই শেষোক্ত স্কুলের লেখক। তিনি নিজেও বলতেন তিনি সমকালীনদের লেখা পড়তেন না সবসময় ক্লাসিকের দিকেই ছিল তার ঝোক। তাঁর লেখা সব বই প্রকাশের সাথে সাথেই ক্লাসিকের স্বীকৃতি পেয়েছে। আনাতোল ফ্রাঁসের আসল নাম Jacques Anatole Thibault. তিনি ঠাট্টার ছলে বলতেন আহা মূল নামটার উচ্চারণই ভুলে গেছি। ফ্রাঁস জন্মেছিলেন এক বইয়ের দোকানদারের ঘরে। সেকেন্ডারী স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি বইয়ের পোকা। পিতামাতা চেয়েছিলেন পাদ্রী হবেন কিন্তু ফ্রাঁস তার বিরুদ্ধে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঈনিড পড়তে গিয়ে সামান্যর জন্য বেঁচে যান বোমার আঘাত থেকে। অন্য কোনো কাজেই মন ছিলনা তার। ১৮৭৬ সালে সেনেট লাইব্রেরীতে একটা চাকরি পান। কাজ না করে বই পড়ার অপরাধে সেটাও হারালেন। পরের বছর বিয়ে করেন তার চাইতে বড়লোকের মেয়ে ভালেরি গুয়েরিনকে। বছর দেড়েক সংসার করলেন। মাদাম বুঝলেন স্বামী বস্তুটির মূলত কোনদিকে মনটন নাই কেবল ঐ বই পড়া ছাড়া। তিনি আবার খুব ব্যবসা বুদ্ধি রাখেন। ফলে গন্ডগোল আর বিচ্ছেদ। ফ্রাঁসের জীবনে মাদাম অরমানি দি কেলাভেত ছিলেন সৌভাগ্যের প্রতীক স্বরূপ। ফ্রাঁসের লেখক হয়ে উঠার পেছনে এই ভদ্রমহিলার অবদান স্বীকৃত। ফ্রাঁস আলসেমি করে লেখাটেকা শিকেয় তুলে রাখলে মহিলা বুঝিয়ে তাকে লেখার টেবিলে বসাতেন। মতবাদের দিক থেকে ফ্রাঁস সমাজতন্ত্রী থাকলেও রাজনীতি বিষয়ে চুপচাপ ছিলেন। ব্যঙ্গ, রসবোধ, গভীর বেদনা আর প্রজ্ঞা এই ছিল তার লেখার চরিত্র। আনাতোল ফ্রাঁসের আত্মজীবনী অন লাইফ এন্ড লিটারেচারে তিনি লেখেন বিশ্বাস করুন, আমি মনে করি লেখার চাইতে বাধাকপির চাষ করা ভাল। আর সত্যি যদি লিখতে চান তবে সমসাময়ীকদের লেখা পড়া ঠিক হবেনা। বলা ভাল এই মন্তব্যটি মারাত্মক কিন্তু সত্য। সমসাময়ীকদের লেখা বেশী পড়লে নিজের লেখার মান নেমে যেতে পারে। আজেবাজে লেখাও প্রচারগুণে মহান সাহিত্য হয়ে যায় আজকাল।
আরেক জায়গায় তিনি লেখেন সৌন্দয্যই শক্তি। তাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? নারী ফুল নদী জ্যোৎস্না ছেড়ে। যদি আমাকে সুন্দর আর সত্যের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে আমি সুন্দরকেই বেছে নেব কারণ সুন্দরই একমাত্র সত্য। আরেক জায়গায় লেখেন ইন্দ্রিয় চেতনা শিল্প চেতনার ভিত্তি। মহত শিল্পীদের প্রতিভার চার ভাগের তিন ভাগই ইন্দ্রিয় চেতনা। অনেকে বলে ইন্দ্রিয় চেতনা পাপ-কেন? ভার্জিন মেরী যিনি পাপ ছাড়াই জননী হয়েছিলেন। তবে দয়া করে আমাকে পিতৃত্ব ছাড়াই পাপ করতে দিন। এই রকম অনেক রসময় বাক্যে ভরপুর তার বইটি। তাঁর এ উপন্যাসটি আত্মজীবনীমুলক। মঁসিয়ে বোনার্ড অদ্ভুত রকমের একজন মানুষ। যিনি বইপত্র আর পুরানো পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে জীবন কাটান। তাঁর সংসার বলতে ঝি তেরেজা আর প্রিয় বিড়াল হামিলকার। একদিন মঁসিয়ে কোকোজ নামের একজন পান্ডুলিপি বিক্রেতা আসেন। তিনি কিছু আজেবাজে পান্ডুলিপি গছাতে চান বোনার্ডকে। বোনার্ড নেন না তবে লোকটার জন্য দু:খ পান। তেরেজাকে জিজ্ঞেস করেন কোথায় থাকে এই লোক জান? তেরেজা বলে এই দালানের চিলেকোঠায়। বৌটার বাচ্চা হবে। আরও একটা শিশুকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য লোকটাকে গালিগালাজ করতে করতে বোনার্ড উপরে কিছু খাবার দাবার পাঠিয়ে দেন। বোনার্ড তাঁর পুরনো পান্ডুলিপির তালিকা খুঁজতে খুঁজতে চর্তুদশ শতকের জ্যাক দ্য ভোরাজিনার-সন্ন্যাসীদের কাহিনীর সন্ধান পান। বইটির নাম গোল্ডেন লেজেন্ড। পান্ডুলিপিটা পাওয়ার জন্য তিনি পাগল হয়ে উঠলেন প্রায়। আট ন মাস পরে বোনার্ড যখন একটা পুরানো ভাস্কর্য ও বইয়ের দোকানে গেলেন তখন মাদাম কোকোজের সাথে তাঁর দেখা হয়। ততদিনে মঁসিয়ে কোকোজ মারা গেছেন। সেই গোল্ডেন লেজেন্ডের জন্য চিঠি লিখতে লিখতে একসময় বোনার্ড একটা চিঠি পান। নেপলস থেকে পান্ডুলিপির মালিক জানাচ্ছেন। ওটা আছে, তবে তিনি হাতছাড়া করবেন না। দেখতে অথবা কাজ করতে হলে ওখানে গিয়েই করতে হবে। ইতি এম এ পলিজি। মদ্য ব্যবসায়ী । সিসিলি। অতএব সিসিলি যেতেই হয়। কিন্তু তেরেজা রাজী না হলে? তেরেজা রাজি তবে সন্ধ্যা ছটার মধ্যে ফেরা চাই। কারণ আজ একটা বিশেষ খাবার সে বানাচ্ছে মঁসিয়ের জন্য। বেচারি জানে না সিসিলি কোথায়! কী করে যে জিনিসপত্র নিয়ে বোনার্ড সিসিলি গিয়ে পৌছান ভগবান মালুম। রেস্তেরাঁয় খেতে গিয়ে এক দম্পতির সাথে তাঁর পরিচয়। দিমিত্রি এবং মাদাম ত্রেপফ। রুশ দম্পতি, তাঁদের শখ জগতের তাবত দেশলাই বাক্স সংগ্রহ করা। কথায় কথায় মঁসিয়ে বোনার্ডের পারির ঠিকানা শুনে মাদাম ত্রেপফ স্তব্ধ হয়ে যান। কারন ইনিই হচ্ছেন সাবেক মাদাম কোকোজ। মাদাম কোকোজ বোনার্ডের বদান্যতার কথা ভুলেননি। এরপর পান্ডুলিপির মালিকের কাছে গিয়ে বোনার্ডের মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়, তিনি জানলেন পান্ডুলিপি ইতোমধ্যে পারিতে চলে গেছে। তিনি আবার পারি ফিরে আসেন। বোনার্ড নিলামখানায় এসে তাঁর সর্বস্ব বাজি রেখে নিলাম ডাকেন। কিন্তু পান্ডুলিপির মালিক নিজেই কার জন্য যেন সর্বোচ্চ নিলামে ডেকে নিলেন। বোনার্ড জানতে চান কে এই লোক। মালিক জানালেন নাম বলা বারণ। কিছুদিন পর বোনার্ডের জন্মদিনে তেরেজাকে একটা বাক্স নিয়ে ঢুকতে দেখে বোনার্ড জিজ্ঞেস করেন কি আছে ওখানে। বোনার্ড খুলে অবাক। একগাদা ফুলের মধ্যে সেই পান্ডুলিপিটা। এইভাবে কাহিনীটা এগোতে থাকে। ফ্রাঁস জীবিত থাকাকালীনই এই বইটা ক্লাসিক হিসাবে সম্মান লাভ করে। পরের ঘটনা আরো মর্মস্পর্শী। বোনার্ড এক বাড়ীতে বইয়ের ক্যাটালগ তৈরী করতে এসে একটি ভারী সুন্দর খুকীকে দেখে তাঁর ভেতর পিতৃস্নেহের হাহাকার টের পান। আহা ক্লেমেনতীন এতদিন তাঁর জীবনে থাকলে তাঁরও এতসুন্দর একটা মেয়ে থাকতে পারতো। পরে তিনি জানতে পান এ আসলে ক্লেমেনতীনেরই মেয়ে, দেখতে অবিকল তার মত। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মেয়েটার এখন কেউ নেই। তিনি স্কুলে আ
ইনগত ভাবে মেয়েটার ভার নেন। বোর্ডিং স্কুলের এক শিক্ষিকা বোনার্ডের প্রেমে পড়েন। কিন্তু বোনার্ড তাঁকে প্রত্যাখান করলেন। শিক্ষিকা ছোট্ট মেয়েটির উপর নির্যাতন বাড়িয়ে দেন। একদিন বোনার্ড স্কুল থেকে জেনকে নিয়ে আসেন। জেন বড় হয়। বোনার্ডের এক ছাত্রকে ভালবাসে জেন। ছাত্রটি আবার যৌতুক নেবেনা। বিয়ের দিন শোকে উদ্বেলিত বোনার্ড। কি দেবেন নিজের মেয়েকে। কি আছে তাঁর এই বিশাল বই আর পান্ডুলিপির ভুবন ছাড়া। সমগ্র জীবনের সঞ্চয়ের বিনিময়ে যা গড়ে তুলেছেন। বোনার্ড সিদ্ধান্ত নিলেন এই লাইব্রেরীটাই পুরো বিক্রি করে যা পাবেন তা তুলে দেবেন জেন আর তার বরের হাতে। কারণ ততদিনে অকৃতদার বোনার্ড বুঝে গেছেন পিতৃস্নেহের কাছে তাঁর সমগ্র জীবনের অর্জন অতি তুচ্ছ। অসাধারণ এই বইটি আপনাদেরও ভাল লাগবে আশা করি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৮ comments
অবিশ্রুত - ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৬:৩৫ অপরাহ্ণ)
টানা গদ্যে লেখা জাহেদ সরওয়ার-এর এই পাঠপ্রতিক্রিয়া পড়ে বইটি পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু একটি ব্যাপার বুঝতে পারছি না – তা হলো, এ বইটির নাম কি? সিলভেস্তা বোনারদের অপরাধ? অথবা তিনি যদি মূল ফরাসিতে পড়ে থাকেন, কিংবা ইংরেজিতে, সেটিরই বা নাম কি?
ফুটনোটে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিশেষ করে বইয়ের নাম, অনুবাদক ও প্রকাশনীর নাম দেয়া হয়, তা হলে বোধহয় আমাদের সবারই উপকার হয়।
একজন মানুষের মধ্যে পিতৃস্নেহ কিভাবে জেগে ওঠে, তারপর ক্রমশ বিস্তারিত হয়,- সত্যি পড়তে ইচ্ছে করছে এ বই।
রেজাউল করিম সুমন - ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৭:২৩ অপরাহ্ণ)
@ জাহেদ সরওয়ার
ধন্যবাদ চমৎকার এই বইটি নিয়ে লেখার জন্য।
@ অবিশ্রুত
বাংলা অনুবাদে বইটির নাম সিলভেস্তা বোনারদের অপরাধ। কলকাতা থেকে প্রকাশিত খুব বাজে প্রচ্ছদের একটি অনুবাদ একসময় কিনেছিলাম। প্রকাশনের নাম মনে পড়ছে না; বইটি খুঁজে পেলে দেখে জানাব। জাহেদ সরওয়ারের কাছে বইটি আছে নিশ্চয়ই।
ইংরেজি অনুবাদে The Crime of Sylvestre Bonnard-এর ই-টেক্সট প্রোজেক্ট গুটেনবার্গ-এর ওয়েব আর্কাইভ থেকে ডাউনলোড করা যাবে।
মোহাম্মদ মুনিম - ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৪:৩৩ পূর্বাহ্ণ)
আরেকটা কপি পেলাম এখানে (মুল বইটি স্ক্যান করা)। লেখককে অনেক ধন্যবাদ এই বইটির সন্ধান দেওয়ার জন্য।
জাহেদ সরওয়ার - ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৮:২০ অপরাহ্ণ)
স্বীকার করি এটা একেবারেই অগোছালো একটা লেখা। বইটা বহু বছর আগে পড়েছিলাম। কার অনুবাদ মনেও নাই। কলকাতার অনুবাদ। শুধু ভাললাগাটুকু জেগে আছে মনে। পড়তে পড়তে সেই সব ভেজা কান্নারুদ্ধ আবেগময় অভিজ্ঞতাটুকুকে জারিয়ে নেবার চেষ্টা। কিন্তু লেখাটাকে আমি মূলত বিস্তৃত ও আরো তথ্যবহুল করতে বসেছিলাম। লিখতে লিখতে চলে গেল বিদ্যুত কেমনে এটা পোষ্ট হয়ে গেল দেখে অবাক হচ্ছি।
মুক্তাঙ্গন - ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ)
@জাহেদ সরওয়ার
এমন অবশ্য হবার কথা না। কারণ, অথর-একাউন্টের মানেই হল স্বীয়-অনুমোদন এবং প্রকাশ। ড্রাফট হিসেবে সংরক্ষিত আপনার পোস্টটি তাহলে হয়তো কেউ ভুলবশত “প্রকাশ” করে ফেলেছেন। সে জন্য দুঃখিত। তবে চাইলে আপনি এখনো পোস্টটিতে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করে নিতে পারেন, তার জন্য লেখকদের প্রত্যেকেরই প্রয়োজনীয় একসেস রয়েছে।
জাহেদ সরওয়ার - ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (২:০৫ অপরাহ্ণ)
সমস্যা নাই। এখানেই বড় করতে হবে।
মাহাবুবুর রাহমান - ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (২:৪৫ অপরাহ্ণ)
সুন্দর একটি বইয়ের পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। লেখাটি আরও গুছিয়ে পুনঃ পোস্ট করার অনুরোধ রইল।
জাহেদ সরওয়ার - ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৩:৪৮ অপরাহ্ণ)
লেখাটি আপডেট করা হয়েছে।