নুট হামসুন ও 'গ্রোথ অব দি সয়েল' প্রসঙ্গে

পৃথিবীতে যে-ক'জন লেখক একেবারে মাটির কাছাকাছি, তাঁদের মধ্যে নুট হামসুন অন্যতম।

পৃথিবীতে যে-ক’জন লেখক একেবারে মাটির কাছাকাছি, তাঁদের মধ্যে নুট হামসুন অন্যতম। নুট হামসুনের এই উপন্যাসটি মহাকাব্যের লক্ষণাক্রান্ত। পড়তে পড়তে অবশ হয়ে যেতে হয়। নরওয়ের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের বর্ণনা পড়তে পড়তে প্রকৃতির ভেতর ডুবে যেতে হয়। এ-উপন্যাসের নায়ক আইজাক যেন আদম। এই বনাঞ্চলে সে-ই যেন প্রথম মানবসন্তান। এই অবারিত প্রকৃতির ভেতর সে গড়ে তুলতে চায় তার বাসস্থান। এই অনাবাদী জমিতে সত্যি সত্যি সে একটা ঘর বানায়। বাস করতে থাকে। ফসল হতে থাকে তার মাঠে। আর একদিন সে নিঃসঙ্গ হতে থাকে। তার ক্ষুধা এক নারীর । পথ দিয়ে যাবার সময় দু’-এক জনকে বলেছেও তার জন্য যেন একটা মেয়ে দেখে তারা। খুব সুখের জীবন তার। একদিন অপরাহ্ণে হাজির হয় এক আগন্তুক নারী। নাম তার ইঙ্গার। প্রথম দিকে বোঝা যায় না । পরে বোঝা যায় তার উপরের ঠোঁট চেরা। এ-কারণে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে জীবনে। ঠোঁট চেরার কারণে তার বিয়ে হয়নি এতদিন। রাতে তাকে গ্রহণ করে আইজাক। এভাবে তারা বাধা পড়ে যৌথজীবনে। ইঙ্গার কর্মঠ নারী। তারা গড়ে তোলে খামার। গরু-ছাগল নিয়ে একটা ভরান্ত পরিবার। আবাদী জায়গাটার একটা নামও দিয়ে দেয় তারা : সেলেনারা। তাদের কোল জুড়ে আসে ইলিসিমা আর সিভার্ট। আইজাক আর ইঙ্গার এখন দুই পুত্রসন্তানের জনকজননী।

তৃতীয় সন্তান পেটে । ইঙ্গারের একটাই ভয় — তার উপরের ঠোঁট চেরা। এখন ছেলে-মেয়ে হলে যদি তারও ঠোঁট চেরা হয়? ইঙ্গার নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে অঙ্গহীন জীবনের দুঃখযন্ত্রণা। এজন্য তার বিয়ে হয়নি। কাউকে ভালোবাসার সাহস হয়নি তার — যদি তার প্রেমিক তাকে ঘৃণা করে? তৃতীয়বারের মতো তার একটা মেয়ে হয় এবং তার উপরের ঠোঁট চেরা। প্রতিবেশীরা এল দেখতে। কী লজ্জা! সকলে চলে যেতে ইঙ্গার একটা ভীষণ কাণ্ড করে বসল। সে যেমন সারা জীবন ধরে উপহাস আর যন্ত্রণা পেয়েছে, তার মেয়ে যেন তা না পায়। মেয়েটাকে গলা টিপে হত্যা করে বনের ধারে পুঁতে রেখে আসে। এক নিষ্পাপ শিশুর নির্জন কবর। ওদিকে আইজাক ব্যস্ত থাকে খুব কাজে-কর্মে। কিন্ত এক প্রতিবেশিনী কবর থেকে মেয়েটার লাশ নিয়ে সদরে ইঙ্গারের বিরুদ্ধে মামলা টুকে দেয়। এতে আট বছরের সাজা হয়ে যায় ইঙ্গারের।

এভাবেই এগোতে থাকে এ-উপন্যাসের কাহিনী। শেষে জেলে ইঙ্গারের আরেকটা মেয়ে হয়। তারও ঠোঁট চেরা। কিন্ত এবারে ডাক্তার অপারেশন করে তার ঠোঁট ঠিক করে দেয়। এরপর আইজাকের জমিতে তামার খনি পাওয়া যায়। আইজাক জমি বিক্রি করে দেয়। এতে তার প্রচুর লাভ হয়। শেষে ইলিসিমা শহরে চলে যায়। সে সেখান থেকে আমেরিকা পাড়ি জমায়। আর সেভার্ট বাবার মতো চাষবাস করে থেকে যায় গ্রামে। কী আশ্চর্য সুন্দর এই সেলেনারা! এখানে আকাশ আর মৃত্তিকা অবারিত। সেভার্ট ভালোবেসে ফেলে এই অঞ্চলকে। কেবল চাষবাসে নয়, নগর সভ্যতারও বিকাশ ঘটেছে এ-এলাকায়। তামার খনি আবিষ্কারের সাথে সাথে আধুনিক বিজ্ঞান যে-বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাখছে, তাকেও অস্বীকার করার উপায় নাই। সভ্যতা যতই এগিয়ে আসুক, মানুষকে তো তবুও নতুন আবাদ করতে হয়। সমস্ত উপন্যাসে একটা অদ্ভুত মহাকাব্যিক আবহ ধরে রাখে পাঠককে।

নুট হামসুন ১৮৫৯ সালে ৪ আগস্ট অত্যন্ত দরিদ্র এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খুব কম বয়সে বাবা মারা যান। পরিবারে লেখাপড়ার তেমন কোনো চল ছিল না। হামসুন স্কুলশিক্ষাও তেমন কিছু পাননি। চাষ ছাড়াও আরেকটা কাজ তিনি শিখেছিলেন : জুতা তৈরি। যে-ওস্তাদের কাছে হামসুন কাজ শিখতেন, তাঁর কাছে অনেক বড় বড় লোক আসতেন। তাঁদের দেখে দেখে হামসুন অনেক বড় হবার স্বপ্ন দেখেন। তিনি বুঝলেন, বড় হতে হলে লেখাপড়া দরকার। হামসুন স্কুলের কিছু পাঠ্যসূচি জোগাড় করে পড়তে লাগলেন। হামসুন বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী ছিলেন। তিন বছরের কোর্স এক বছরে শেষ করলেন। একটা কেরানির চাকরিও জুটে যায়। পোষাল না, হলেন স্কুল মাস্টার। নিয়মিত পড়তে থাকেন। অবশ্য সাহিত্য। মাঝে মাঝে কবিতা লেখেন, পত্রিকায় পাঠান। দু’-একটা ছাপাও হয়। ইচ্ছে হল লেখক হবেন। ক্রিশ্চিনা শহরে এসে চেষ্টা করতে থাকেন। বহু কষ্টে জীবন ধারণ করেন। চলে গেলেন আমেরিকা। সেখানে বাগানের মজুর, মাছ ধরার জেলে, গমক্ষেতে, রাস্তা মেরামতের কুলি, কয়লা ভাঙার মজুর, ট্রামের কন্ট্রাকটরি ইত্যাদি কাজ করতে লাগলেন। কিন্ত সময় পেলেই বই খুলে বসেন। একদিন এমনি কাজের ফাঁকে গ্রিক নাটক পড়ছিলেন। কাজ ফাঁকি দেবার অভিযোগে চাকরি খতম।

আবার শুরু হল ক্ষুধার সাথে সংগ্রাম। অনাহার আর অর্ধাহার। একদিন না কি কুকুরের নাম করে কসাইয়ের কাছ থেকে একটা হাড় চেয়ে নেন। তাতে একটু মাংস লেগে আছে কি না। হাড়টা নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়েন। কামড় লাগান — উফ, কী বিচ্ছিরি গন্ধ! তাও সহি। এই হচ্ছেন নুট হামসুন। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান তিনি, লেখেন তাঁর সবচাইতে বিখ্যাত উপন্যাস হাঙ্গার। এই বই লিখতে গিয়ে না খেয়ে হামসুন একেবারে শুকিয়ে কাঠি। জরাজীর্ণ পোশাক। হামসুন পান্ণ্ডুলিপিটা নিয়ে পলিটিক্যাল পত্রিকার নামজাদা সম্পাদক এডওয়ার্ড ব্রাওসের সঙ্গে দেখা করেন। অভিজাত ও ঐশ্বর্যের গর্বে গর্বিত এই লোক। হামসুনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকান। সরাসরি অবশ্য বিদায় করলেন না। পাণ্ডুলিপিটা দয়া করে রাখলেন। তারপরে পড়ে অবাক। হাঙ্গার প্রকাশিত হতে থাকল। মাটির কাছাকাছি থাকা কবির প্রথম জয়যাত্রা শুরু।

নুট হামসুন নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ১৯২০ সালে। অনেক সমালোচকই তাঁর নাজি কানেকশন নিয়ে তাঁর উপর ক্ষ্যাপা, তবে সেটা আলাদা অধ্যায়। ১৯৫২ সালে এই মহান লেখক দেহত্যাগ করেন।

১ comment

  1. মাহতাব - ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১১:৩৯ অপরাহ্ণ)

    খুবই ভাল লাগল।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.