কনভেনশনাল পত্র-পত্রিকার সাথে “ব্লগ” (লিন্ক দেখুন) প্রকাশনার একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। “গণসাংবাদিকতা”-র (Citizen Journalism, এখানে দেখুন) একটি ধারা হিসেবে গত কয়েক বছর ধরেই সারা বিশ্বে ব্লগ নামের এই মাধ্যমটি লাভ করছে উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা। সত্যিকার অর্থেই সব ধরণের সেন্সরশিপ এবং বড় পুঁজির আধিপত্য থেকে মুক্ত এই আপাত নতুন মাধ্যমটি ‘সাংবাদিকতা’, ‘লেখক’, ‘পাঠক’, ‘তাদের মাঝে সম্পর্ক’ এসব বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমাদের চিরাচরিত ও সনাতন সব ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে দিচ্ছে। এতে পোস্ট লেখক যা লেখেন তাই শেষ কথা না; বরং কথার সূচনা বা সূত্রপাত মাত্র। এখানে লেখক আর তার মন্তব্যকারীরা সবাই মিলে তর্ক-বিতর্কের পর একটি সত্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেন, আলোচনার ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে। সে অর্থে বলা যেতে পারে, একটি ব্লগপোস্ট আসলে সবাই মিলে লেখেন, তাতে নাম যারই দেখাক। ব্যাপারটা আমার কাছে অন্তত এমনই মনে হয়েছে সবসময়।
পৃথিবীর দেশে দেশে আজ বিভিন্ন ধরণের ক্যাম্পেইন (মানবাধিকার, পরিবেশবাদী, রাজনৈতিক) ও গণসচেতনতা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ব্লগগুলো। যেমন ইরাকে এখন প্রকৃত অর্থে কী ঘটছে এবং তার প্রভাব কী পড়ছে জনজীবনে তা জানতে সাধারণ ইরাকিদের লেখা ব্লগগুলো পড়লে জীবনযাপনের যে নিবিড় অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা যায়, তা আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। সাউন্ড, বাইট, এডিটিং, আর মালিকস্বার্থের অধীন করপোরেট মিডিয়াতে তো নয়ই। পাঠক হিসেবে সেখানকার ব্লগ লেখকদের আমরা সরাসরি আমাদের মনের কথাটা, প্রশ্নটা পৌঁছেও দিতে পারছি। পারছি সংহতি কিংবা সহানুভূতির বার্তা পৌঁছে দিতে তাদের এমন সংকটের দিনে। সাম্প্রতিককালে, যতদূর শুনেছি মার্কিন সিনেটর বারাক ওবামার ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্সিয়াল নমিনেশন ক্যাম্পেইনে ব্লগ ছিল প্রধান অস্ত্রগুলোর একটি । আর গত দেড় বছরে বাংলাদেশের মিডিয়া যখন সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তখন দেশে বিদেশে কয়েক শত বাংলাদেশী ব্লগ ছিল বলেই সময় সময় আমরা জানতে এবং আলোচনা করতে পেরেছি বিভিন্ন বিষয় যা আর কোথাও বলা বা লেখা যাচ্ছিল না। এভাবে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন অসংখ্য ব্লগ লেখক, সময়ের প্রয়োজনেই। সুতরাং ব্লগ হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ আলোচনার স্পেসগুলো কেমন হবে তার একটি অগ্রিম নমুনা।
একেকজন একেক উদ্দেশ্যে ব্লগ লেখেন। আমার সবসময় মনে হয়েছে তার অন্যতম হলো চলমান কিছু বিতর্কের বিষয় যা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে তাকে নির্দিষ্ট আবদ্ধ গণ্ডির বাইরে টেনে এনে সকলের আলোকপাতের জন্য মুক্ত এক পরিবেশে উপস্থাপন করা। এ ধরণের আলোচনা, সমালোচনা কিংবা বিতর্ক ঠিক কীভাবে উপস্থাপন করা হলো তা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক নয়, তবে আবার মুখ্যও নয়। এ ধরণের আলোচনা যখন করা হয়, তখন তা হতে পারে যুক্তিনির্ভর, পরিশীলিত, ভারসাম্য রক্ষা করে। আবার তা হতে পারে কর্কশ এবং এমনকী কারো কারো মতে অন্যায্যও। কিন্তু এর সবই যে মুক্ত আলোচনার জরুরি উপাদান, তা বোধহয় অস্বীকার করার জো নেই।
মাধ্যমটির সম্ভাবনার যেমন শেষ নেই, তেমনি এর কিছু অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এর সাথে পত্র-পত্রিকায় ছাপানো সম্পাদকের অনুমোদননির্ভর লেখা কিংবা প্রবন্ধ ও অন্যান্য গবেষণা প্রকাশনার সাথে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন, আকার আকৃতি, উদ্ধৃতি পদ্ধতি ইত্যাদি। সে হিসেবে কোনো ব্লগ পোস্ট কীভাবে লেখা হয়েছে বা হয়নি কিংবা হওয়া উচিত সেসব টেকনিক্যাল এবং ফর্মাল বিষয়গুলো এখনো যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে উঠে আসেনি মূল ধারার আলোচনায়, প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো দূরের কথা। কারণ ব্লগ নামের এই আপাত নতুন মাধ্যমটি নিয়ে বিশ্বময় এখনো চলছে এর shape, size, form, content, style, methodology, বিষয়বস্তু ইত্যাদি নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট আর টানাপোড়েন। সেদিক থেকে বাংলা ব্লগ তো মাত্র তার আঁতুড়ঘর থেকে শৈশবে পদার্পণ করলো। এ বিষয়ে জানতে এই ব্লগসাইটটিরই অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলো একে একে খুলে দেখা যেতে পারে। বাংলা ব্লগের ক্রিস্টালাইজড একটা নিরেট আকার পেতে আরো কিছুটা সময় লাগতে পারে বলে সবাই মনে করছেন।
ব্লগ কালচারের এই মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতনতা না থাকলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে, স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, ব্লগ তো আর গবেষণা নিবন্ধ না। তাতে লেখা অনেক বক্তব্য কিংবা বিশ্লেষণের কোনো প্রতিষ্ঠিত মাপকাঠি বা মানদণ্ড নেই। এ নিয়ে কোথাও কোন ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে বলেও আমার অন্তত জানা নেই। তা যেদিন হবে, সেদিন হয়তো ব্লগ আর এত মুক্ত, স্বাধীন আর উদ্দীপনাকর থাকবে না!
সুতরাং আর কিছু না হোক, এ প্রকাশ-মাধ্যমটিকে অন্তত আয়ত্ত করা দরকার। পরিচিত হওয়া দরকার এতে অংশগ্রহণের কারিগরি দিকের পাশাপাশি এখানকার etiquette, কালচার আর গড়ে ওঠা প্রথাগুলোর সাথে। যাতে করে একে আমরা ব্যবহার করতে পারি strategic ভাবে — কোনো সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে, কিংবা কোনো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে, প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে।
এর সম্ভাবনা অনেক।
[এ বিষয়ে অন্যত্র প্রাসঙ্গিক লেখা: সুমন চৌধুরীর পোস্ট]
মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর বেশীরভাগের ভূমিকায় অনেকটা নিরাশ হয়েই লিখতে শুরু করেন “ইনসিডেন্টাল ব্লগার” ছদ্মনামে।