যে-কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে আমরা পড়েছি ছেলেবেলায়, তাঁদের মধ্যে তিনজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে : সিলেটি স্যার, জসিম স্যার ও অলিউল্লা স্যার। সিলেটি স্যারের পরে―বেশ বিরতি দিয়েই অবশ্য―এসেছিলেন জসিম স্যার এবং আরও কয়েকজনের পরে অলিউল্লা স্যার। জসিম স্যারের বাড়ি ছিল সন্দ্বীপ, অলিউল্লা স্যারের ফেনি। আর সিলেটি স্যার? জীবনকাহিনির মতো তাঁর 'সিলেটি স্যার' অভিধাও ছিল রহস্যময়! [...]

যে-কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে আমরা পড়েছি ছেলেবেলায়, তাঁদের মধ্যে তিনজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে : সিলেটি স্যার, জসিম স্যার ও অলিউল্লা স্যার। সিলেটি স্যারের পরে―বেশ বিরতি দিয়েই অবশ্য―এসেছিলেন জসিম স্যার এবং আরও কয়েকজনের পরে অলিউল্লা স্যার। জসিম স্যারের বাড়ি ছিল সন্দ্বীপ, অলিউল্লা স্যারের ফেনি। আর সিলেটি স্যার? জীবনকাহিনির মতো তাঁর 'সিলেটি স্যার' অভিধাও ছিল রহস্যময়! জসিম স্যার জিজ্ঞেস করলেন এক সকালে, 'আচ্ছা, তোমরা কালো কালিতে লাল লিখতে পারো?' এ কেমন প্রশ্ন―কালো কালিতে লাল! কোনও বুদ্ধি মাথায় না আসায় এবং ব্যাপারটা একরকম অলৌকিক বিবেচনা করে আমরা হার মানলাম। জসিম স্যার গম্ভীরভাবে খাতা টেনে নিয়ে কালো কালিতেই গোটা-গোটা অক্ষরে লিখলেন : 'লাল'। ও, এই ঘটনা তাহলে! চমৎকৃত হয়েছিলাম কিছুটা। আর এত দিন পরেও যে জসিম স্যারকে ভুলিনি, তা সেই কালো কালির টানেই! অলিউল্লা স্যার ছিলেন বেজায় বেরসিক মানুষ। তাঁর ঘুম ভাঙত সকালে নির্বিকারচিত্তে অগ্নিসংযোগ করতে করতে। বিড়ি খেতেন প্রচুর। তাঁর শার্টের হাতায় কি বিছানার চাদরে অসংখ্য বিড়িপোড়ার সাক্ষ্য আর ছাই ছড়িয়ে থাকত যত্রতত্র। খুঁটিনাটি নিয়ে ছেলেমানুষিও করতেন আমাদের সঙ্গে। তবে রসবোধ না থাকলেও তিনি কখনও মারধর করতেন না। ছিলেন পাটিগণিতের জাদুকর। সুদকষার প্যাঁচ খুলতে তাঁর দুমিনিটও লাগত না। কিন্তু মেধায়, রসিকতায়, হুল্লোড়পনায় সিলেটি স্যারের সমকক্ষ ছিলেন না কেউই। দীর্ঘকায়, উন্নতনাসা, শ্যামবর্ণ এ-শিক্ষকটিকে ঘিরে অনেক রূপকথার জোনাকি জ্বলত সে-সময়েও। তাঁর আসল নাম না কি রাজু, ধর্ম কী আজও জানা নেই। বাড়ি আদৌ সিলেট কি না সন্দেহ। 'কমিউনিস্টের লোক', না কি কোন ব্যাংকডাকাতি করে পালিয়েছেন সবান্ধবে, আত্মগোপন করে থাকেন নানা জায়গায় ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের রক্ষণশীল বাড়ির কর্তারা কখনও তাঁকে এ-বিষয়ে প্রশ্নাক্ত করেননি, বরং তাঁর বন্ধুরা মাঝেমধ্যে এলে আপ্যায়নাদির পর খোশগল্প করতেন। এমন নিষ্কলুষ প্রশ্রয়ের প্রচ্ছন্ন একটি কারণ ছিল হয়তো এই : জংলি গ্রামের উপান্তে আমাদের বড় বাড়ি। ঝিঁঝির আহাজারি ছাড়া কোনো সাড়াশব্দ থাকত না সারাবেলা। সিলেটি স্যারের আগমনের পরেই (১৯৮৫ সালের দিকে) রাতারাতি জমে উঠল ভূতের বাড়িটা। আর না কি তিনি ঘুমাতেন না রাতে, টহল দিতেন এদিক-সেদিক―যা হোক, চোরডাকাতেরা অন্তত সন্ত্রস্ত থাকবে! সন্ত্রস্ত থাকারই কথা, যা বাজখাঁই গলা! খুব ভোরে উঠে (না কি জেগেই থাকতেন?) বাড়ির চৌহদ্দিতে বার কয়েক চক্কর মেরে এসে ঢক-ঢক করে…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.