আমার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম শহরের ঈদগা-র মুন্সীপাড়ায়। ঊনআশি, আশি সাল। পুরো ঈদগা-ই তখন ছিল না-শহর না-গ্রাম। তখনও ঈদগা অঞ্চলের লোকজন নিউমার্কেটের দিকে এলে বলত : 'শহরৎ যাইর' (শহরে যাচ্ছি)। আজ কয়েকদিন হল মুন্সীপাড়াটা বুকের ভেতর জেগে উঠেছে। আহা কী ছিমছাম ছিল পাড়াটা। ধানক্ষেত, পুকুর, খেলার মাঠ। সকাল বেলা সবাই মিলে স্কুলে যাওয়া, দুপুরে স্কুলফেরত 'হাজার দিঘি'তে সাঁতার কাটা, বিকেলে রঙ্গিপাড়া বিলে ফুটবল খেলা। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে মেজবান খাওয়ার কথা। ঈদগা অঞ্চলে ধনী মানুষের মূল ব্যবসা ছিল পরিবহন আর পাহাড়তলি বাজারের সওদাগরি ব্যবসা। বেডফোর্ড কোম্পানির ট্রাক ছিল তাদের। নতুন ট্রাক কিনে বারো আউলিয়ার মাজার দর্শন এবং মেজবান দেওয়া ছিল নিয়ম। আর ছিল বিভিন্ন পীরের জন্ম বার্ষিকী এবং মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে মেজবান। মানুষ মারা গেলে চারদিনের দিন মাছ-ফাতেহা বা মেজবান। এ রকম নানান উপলক্ষের মেজবান। মেজবান খাবার সময়টাও ছিল অদ্ভুত। ফজরের নামাজ শেষে ভোরে, সকাল দশটায়, আসরের নামাজ শেষে বিকেল বেলায় এবং রাতে। আমি ও আমার বড় ভাই বাবার সাথে মেজবানে যেতাম পারিবারিকভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে। তবে বেশির ভাগ সময়ে মেজবান খেয়েছি আমি, আমার বড় ভাই আর বন্ধুরা মিলে বিনা নিমন্ত্রণে। মাঠে খেলছি, এ সময়ে হঠাৎ কোনো বন্ধু হয়তো খবর আনল : 'ওডা চল, কেরাইয়্যা-র (কেরামত আলীর) বাড়িৎ মেজ্জান চলের' (ওরে চল, কেরামত আলীর বাড়িতে মেজবান চলছে)। তৎক্ষণাৎ খেলা বন্ধ। বড় ভাই আদেশ করলেন : 'দোম্বি যা, ঘরে যাই নুন লই আয়, আন্ডা থিয়াইছি' (দৌড়ে যা, বাসায় গিয়ে লবণ নিয়ে আয়, আমরা অপেক্ষা করছি)। আদেশ মাত্রই পালন। বাসায় গিয়ে খবরের কাগজ অথবা স্কুলের খাতার পাতা ছিঁড়ে তাতে মুড়ে লবণ নিয়ে ফিরে আসা। তারপর 'কেরাইয়্যা'দের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা। মেজবান স্থলে লোকে লোকারণ্য। পুকুরে হাত ধুয়ে খেতে বসে পড়া মুখোমুখি এক লাইনে। এরকম কয়েক লাইন করে বসানো হতো মাটিতে। শুধুমাত্র মুরব্বি আর গণ্যমান্যদের জন্য ছিল চেয়ার-টেবিলে বসবার ব্যবস্থা। ছোটরা এবং সর্বসাধারণ মাটিতে। মুখোমুখি দু'জন বসায় মাঝখান বরাবর একটা প্যাসেজের মতন তৈরি হতো। সেই প্যাসেজ ধরে দুইজন লাই-এ করে মাটির সানকি নিয়ে আগে আগে যেত, আরেকজন লাই থেকে সানকি নিয়ে প্রত্যেকের সামনে রাখত। সানকি পাতার পর লাই-ভর্তি ভাত নিয়ে দুজন আগে আগে যেত, পেছন থেকে…
মাঠে খেলছি, এ সময়ে হঠাৎ কোনো বন্ধু হয়তো খবর আনল : 'ওডা চল, কেরাইয়্যা-র (কেরামত আলীর) বাড়িৎ মেজ্জান চলের' (ওরে চল, কেরামত আলীর বাড়িতে মেজবান চলছে)। তৎক্ষণাৎ খেলা বন্ধ। বড় ভাই আদেশ করলেন : 'দোম্বি যা, ঘরে যাই নুন লই আয়, আন্ডা থিয়াইছি' [...]