মহাশ্বেতা দেবীর চলে যাওয়ার সংবাদে কেন জানি প্রথমেই মনে হলো, ‘হাজার চুরাশির মা’-এর কথা... আবার পরক্ষণেই খালেদ চৌধুরীর আঁকা ওই বইয়ের প্রচ্ছদটি কেমন এক জলস্রোতে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল নবারুণের মুখ। [. . .]

মহাশ্বেতা দেবীর চলে যাওয়ার সংবাদে কেন জানি প্রথমেই মনে হলো ‘হাজার চুরাশির মা’-এর কথা... আবার পরক্ষণেই খালেদ চৌধুরীর আঁকা ওই বইয়ের প্রচ্ছদটি কেমন এক জলস্রোতে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল নবারুণের মুখ। নবারুণের মৃত্যুর পর কলকাতার কোনও এক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি, ‘আমাকে দুনিয়া হয়তো একজন নিষ্ঠুর মা হিসেবেই দেখবে।’ নিষ্ঠুরই কি? যাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ‘হাজার চুরাশির মা’ হিসেবে, তাঁকে কেন এই পৃথিবী দেখতে যাবে নিষ্ঠুর মা হিসেবে? নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এই ছোট্ট উপন্যাস আমাদের কেবল যে ওই আন্দোলনকেই নতুন করে চিনিয়েছিল, কেবল যে ওই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষগুলোর পরিবার-পরিজন আর কাছের মানুষের প্রতিপক্ষ-সময়কে অনুভব করিয়েছিল, তা তো নয় – আমরা মহাশ্বেতা দেবীকেও চিনেছিলাম নতুন করে। ইনি সেই মহাশ্বেতা নন যিনি কেবল আদিবাসীদের সঙ্গে নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ গেঁথে নিয়েছেন। ইনি সেই মানুষ – যিনি তাঁর সমসময়ের তারুণ্যের দীর্ঘ যাত্রা আর প্রলম্বিত রক্তপাতকেও নিজের কপালের টিপ করে তুলেছেন। তাই সেই দেবী যখন কোনও এক সময় লেখেন, ‘হাজার চুরাশির মা’র ‘ব্রতীর শৈশবচিত্র তো আমার ছেলে নবারুণেরই শৈশবচিত্র’ – তখন এই কথা থেকে উপন্যাসটি সম্পর্কেও চিন্তার নতুন দিগন্ত খুলে যায়। নবারুণও বিখ্যাত হয়েছিলেন, মার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল আন্তরিক, কিন্তু তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল আগেই। দুই বছর আগে এই জুলাই মাসেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। মহাশ্বেতাও চলে গেলেন প্রায় একই সময়ে। ঢাকাতে জন্ম – এই অর্থে ঢাকার মেয়ে তাঁকে আমরা বলতেই পারি। কিন্তু তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের – কেবল বাঙালির নন, কেবল ভারতের নন, সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন না – ‘যেথায় থাকে দীনের অধম, দীনের থেকে দীন, সেইখানেতে চরণ তোমার রাজে...।’ মহাশ্বেতার চরণ গিয়ে পৌঁছেছিল শবরের ঘরে, সাঁওতালের ঘরে – বঞ্চিত লাঞ্ছিত সকল আদিবাসীর ঘরে। এ বিশাল ভারতবর্ষের সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সঙ্গে চলতে চলতে তিনি বাঙালিত্বের যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে গেছেন, বাঙালিত্বের মনুষ্যত্ববোধকে যে পর্যায়ে উন্নীত করে গেছেন – তা হয়তো জাতিত্ববোধের ভারে ন্যুব্জ আমরা সারা জীবনেও বুঝতে পারব না। ‘ঝাঁসীর রাণী’ লিখতে গিয়ে নিজের জীবনের গতিপথও পাল্টে ফেলেছিলেন। ছোট্ট ছেলেকে বাবার কাছে রেখে সেই যে ঝাঁসী-গোয়ালিয়রে গিয়েছিলেন, তার পর ফিরলেও ঘর আর তাকে পারেনি বেঁধে রাখতে। ‘অরণ্যের অধিকার’-এর ভূমিকার কথা মনে পড়ছে;…

অন্য কোনো বেড়ালের সঙ্গে লড়াই করে সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল না জন্ম থেকেই অন্ধ ছিল তা আর জানার উপায় নেই। [...]

সম্ভবত আমি ছোটগল্প খুবই কম পড়েছি, এমনও হতে পারে আমার পড়া উপন্যাসের চেয়েও পড়া ছোটগল্পের সংখ্যা কম, অথবা এমনও হতে পারে – এটা মিথ, ব্যক্তিগত – যাতে পড়েও অস্বীকারের প্রবণতা বিশেষ প্রকট বিশেষ বস্তুরাশির উপর মানসিক অবজ্ঞাতির সাধারণ কারণে। এনিয়ে যখন তৃতীয় কি চতুর্থবার গল্পটি পড়লাম, বিশেষত লেখক মরে যাবার পরে, কোন লেখাটি পড়ব ভেবে যখন ‘অন্ধ বেড়াল’ পড়তে শুরু করেছি, তৃতীয় কি চতুর্থবার, তখন থেকেই ভাবছি ঠিক কেন এছোটগল্পটি পড়তে আমার ভাল লাগে – সেই প্রথম যখন পড়েছি আজ থেকে কয়েক বছর আগে আর এবার যখন পড়লাম ঠিক একই রকম লাগল, একই রকম দ্রুততায় পুরো গল্পটা ভুলে গেলাম, একই রকম আচ্ছন্নতায় উদ্বেগ জেগে রইল, একই রকম নিঃসঙ্গতার হানা হানা আক্রমণ থেকে থেকে অন্ধকারকে ঠেলে আরো অন্ধকারে নিয়ে গেল, আমি দূরেই থাকলাম, শুধু হোটেলটাকে মনে হল খুব চেনা, আমিও থাকতাম হয়তো – থেকেছি অনেক দিন, এপ্রসঙ্গ কোনোদিন আসতই না – তবে এটা কি ঠিক ছোটগল্প, বিশেষত ‘অন্ধ বেড়াল’-এর মতো ছোটগল্প সেরকম কিছুই প্রথম থেকেই করতে পারে, যা আমাকে পথের ধারে নিয়ে যায়, যেপথের ধারে উদ্বেগ দাঁড়িয়ে আছে শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হওয়ার দিকে প্রাণিত হচ্ছে, জলরাশি শুয়ে আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা আমি নিজেই পথের ধার হয়ে পড়ে আছি। সব ছোটগল্পের শুরুর মতোই এছোটগল্পেও আমার এপরিণতির দায় কার দিয়েই শুরু হয়েছে, পরিবেশটা ফুটে উঠেছে কিছুমাত্র দেরি না করেই, যা বোধের অতীত বা যা বোধেরই অধিগম্য সেসব একে একে আসতে শুরু করেছে , শুরু থেকেই শুরুটাকে জানিয়ে দেয়ার ক্লাসিক অবস্হানটাকে কোনো ছোটোগল্পই কোনো কালেই অস্বীকার করেনি, কোনো কালেই বলতে কোনো আধুনিক কালেই , যেহেতু ছোটগল্প ফিল্মের মতোই একটি আধুনিক প্রকাশ মাধ্যম, তাই খুব একুরেট, হতে চেয়েছে – হতে হয়েছে, এটা নিতান্তই এক ধরনের অনিশ্চিত নির্দিষ্টতা, বলতে গেলে – এজন্যই শিল্পের সৃষ্টি তার অস্তিত্ব, তাই শুরুতেই সেআবেশ কাজ করে রূপান্তরের মতো। অন্য কোনো বেড়ালের সঙ্গে লড়াই করে সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল না জন্ম থেকেই অন্ধ ছিল তা আর জানার উপায় নেই। সে শহরের বেড়াল নয়। নদীর ধারে মাছের আঁশটে গন্ধমাখা একটা ছোটো গঞ্জের বেড়াল। এরকম বেড়ালদের গল্পও অন্যরকম হয়। সে যে-হোটেলটায় থাকত তার মেঝেটা…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.