ছড়া নিয়ে গাঁটছড়া... ছড়া নিয়ে ছেলেমি করার ঝোঁকটা সম্ভবত ছড়ার জন্মেতিহাসের সাথেই সম্পর্কিত। কিন্তু এই ঝোঁকের মধ্যে যদি দায়বদ্ধতার কোনো ছোঁয়া না থাকে তাহলেই তা হয়ে ওঠে বিপর্যয়কর। কেমন বিপর্যয়? হতে পারে ছড়াকে তার আত্মপরিচয় থেকে হটিয়ে দেয়া বা অন্য কিছুকে ছড়া নামে প্রতিস্থাপিত করা! মানুষের ভিড়ে মানুষের মতো কতকগুলো হনুমান গরিলা ওরাংওটাং বা এ জাতীয় কিছু প্রাণী ছেড়ে দিয়ে এক কাতারে মানুষ বলে চালিয়ে দিলে যা হয়। মানুষের দুই পা দুই হাত থাকে, ওগুলোরও দুই পা দুই হাত। পায়ের উপর ভর করে এরা সবাই হাঁটে। মেরুদণ্ড কিছুটা কুঁজো করে হাঁটা মানুষের মধ্যেও রয়েছে। বিশেষ করে বার্ধক্য আক্রান্ত মানুষের জন্য। মাঝে মাঝে বাঁদরামি সুলভ আচরণ মানুষও করে। তাহলে কি মানুষ আর হনুমান গরিলা এক হয়ে গেলো! বিবেচনার বাহ্যিক দৃষ্টি ঝাপসা হলে দু’টোর মধ্যে তফাত ঘুঁচে যাওয়া বিচিত্র নয়। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রাণীগুলোর সংখ্যাধিক্য ঘটতে থাকলে এক সময়ে হনুমান গরিলাই যদি মানুষের পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে কি? তবুও হনুমান গরিলার দ্বারা মানুষের স্থান দখল করা সম্ভব নয়। পার্থক্যের ভুলে কিছুকাল দাপাদাপি করলেও ঠিকই এদের আসল পরিচয়গুলো বেরিয়ে আসে। কোন্ আসল পরিচয়? এটা হলো অন্তর্গত স্বভাব, আচরণের প্রকৃতি আর সৃজনশীল প্রণোদনায় মানুষের সাথে এদের মৌলিক ও ব্যাপক পার্থক্য। কিন্তু এখানেও কি সমস্যামুক্ত আমরা? কিসের নিরিখে নির্ধারণ করবো মানুষ আর গরিলার অন্তর্গত স্বভাবের ভিন্নতা, আচরণের প্রকৃতিগত বিভেদ বা সৃজনশীল প্রণোদনার পার্থক্য? সেই নির্ধারণসূত্রটা জানা হয়ে গেলে পার্থক্য নির্ণয় করা আর দুরূহ থাকে না। তাই প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে একটা হনুমান বা গরিলাকে মানুষের পূর্ণ আকৃতি দেয়া হলেও মানুষের স্থান দখল করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়, প্রকৃতিগতভাবেই। তেমনি ছড়া নিয়ে আমাদের জটিলতার শেষ নেই। ছড়া তো কোনো প্রাণী নয় যে গুঁতো দিলেই তার প্রকৃতিগত ভাষা বা স্বভাবসুলভ আচরণ দিয়ে নিজের ধাত বা পরিচয়টা জানিয়ে দেবে! ছড়া একটা শিল্প, অক্ষরের কারুকাজ, মূর্ত চেহারায় বিমূর্ত ব্যঞ্জনাধারী শব্দ বা শ্রুতিশিল্প। কবিতা, পদ্য, গান, পুঁথি, পাঁচালি এসবও তো একই পদের জিনিস, অক্ষরের কারসাজিই। তাহলে ছড়া কেন ছড়া? কিসের নিরিখে আমরা তা নির্ধারণ করবো? মানুষের জীবনে উদ্ভূত জটিল জটিল সমস্যাগুলোকে সহজ সরল উদারভাবে দেখার…

সাহিত্যে ছড়ার অবদান কী, বা এর অবস্থান কোথায় ? এ রকম বালখিল্য প্রশ্ন শুনে আঁতেল ব্যক্তিরা হয়তো এক চিমটি মুচকি হাসি দুলিয়ে চলে যাবেন প্রসঙ্গান্তরে। আর আমার মতো মোটাবুদ্ধির লোকেরা ? হয়তো চেয়ে থাকবেন হতভম্ব হয়ে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবে দেখেছেন, হাজার বছরের শ্রুতি-পরিক্রমায় এসেও সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন আর মাটিবর্তী লোকায়ত এ মাধ্যমটিকে নিয়ে এরকম প্রশ্নের সংযোগ সূত্রটি কোথায় লুক্কায়িত ? [...]

সাহিত্যে ছড়ার অবদান কী, বা এর অবস্থান কোথায় ? এ রকম বালখিল্য প্রশ্ন শুনে আঁতেল ব্যক্তিরা হয়তো এক চিমটি মুচকি হাসি দুলিয়ে চলে যাবেন প্রসঙ্গান্তরে। আর আমার মতো মোটাবুদ্ধির লোকেরা ? হয়তো চেয়ে থাকবেন হতভম্ব হয়ে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবে দেখেছেন, হাজার বছরের শ্রুতি-পরিক্রমায় এসেও সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন আর মাটিবর্তী লোকায়ত এ মাধ্যমটিকে নিয়ে এরকম প্রশ্নের সংযোগ সূত্রটি কোথায় লুক্কায়িত ? মাটিলগ্ন গণমানুষের জনভাষ্যের প্রতীকী বিন্যাসে উপস্থাপিত জ্যান্ত ছড়াকে নিয়ে এরকম ধোয়াশা সাহিত্যের কুলীন অঙ্গনে যতোই অস্পষ্টতা ছড়াক না কেন, ব্রাত্যজনের প্রাণের সম্পদ টিকে থাকার চাবিকাঠিটা যে ব্রাত্যজনগোষ্ঠীর হাতেই চিরকাল থেকে যায়, এটা আমরা অনেকেই ভুলে যাই। কিন্তু মহাকাল ভুলে না ঠিকই। আর ভুলে না বলেই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে মেনে নিতেই হয় যে, সাহিত্যের পালকিটাকে সম্মুখবর্তী হতে হলে ওই ব্রাত্যজনের কাঁধে চড়েই এগুতে হয় তাকে। কাসুন্দি ছড়া সাহিত্যের সম্প্রতি প্রকাশিত দু’পাতার একটা প্রকাশনা ‘নিব’ ওল্টেপাল্টে দেখছিলাম। এক জায়গায় এসে চোখ আটকে গেলো। চার লাইনের ছোট্ট একটা ছড়া। ‘ভাতের বদলে আলু / বাবার বদলে খালু / এর চেয়ে তো ভালোই ছিলো / তারেক জিয়া, ফালু।’ একবার পড়েই গেঁথে গেলো মনে। ছড়াটা ছোট্ট, কিন্তু এর ইফেক্টটা কি ছোট্ট রইলো ? মাথার ভেতরে ঢুকে রিনিরিনি বাজাতে লাগলো। দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় আমাদের বহুমাত্রিক নিষ্পেষণের চিত্রগুলোর একটা লিঙ্ক কী চমৎকার ইঙ্গিতময় দক্ষতায় জুড়ে দেয়া হলো ! যেগুলো আনন্দচিত্র নয়, কষ্টচিত্র। ভুক্তভোগী মানুষের বুকের ভেতরে জমে থাকা কষ্টক্ষত। সামান্য ক’টা অক্ষরের যাদুতে ছবির পর ছবি হয়ে যেন ভেসে ওঠতে লাগলো। কৌতুহলী হয়ে মনে করতে চেষ্টা করলাম, মুহিববুল্লাহ জামী নামের এই লেখক বা ছড়াকারের অন্য কোন লেখা আগে পড়েছি কি না। মনে করতে পারলাম না। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই ছড়াকারের নাম আগে কোথাও শুনেছি বলেও মনে হলো না। হতে পারে আমার সীমাবদ্ধতা এটা। কিন্তু বিষয়টা উত্থাপিত হলো ক’দিন যাবৎ সাহিত্যে ছড়ার অবস্থান বা অবদান নিয়ে ভাবনার সূত্র ধরে। বিকেলের এক চায়ের আড্ডায় প্রসঙ্গক্রমেই ছড়াটা আউড়ালাম আবার। এবং উপস্থিত যারা ছিলো, লুফে নিলো সবাই ! যদিও এরা সাহিত্য জগতের কেউ নন বা সাহিত্য রসিকও বলা যাবে না, তবু ছড়াটার প্রতি তাদের আগ্রহে একটুও কমতি দেখলাম…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.