ত্রিশ-দশকে আবির্ভূত একদল শিক্ষিত মেধাবী কবির হাতে ‘স্থূলতা, মেকিত্ব ও প্রাকৃত আবেগ ছেড়ে বাঙলা কবিতা আলিঙ্গন করলো সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা ও রুচিশীলতাকে’ ((প্রসঙ্গ বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্য, আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন, ১৯৯৭, ঢাকা)) ; মহাপরাক্রমশালী রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের বাইরে প্রবাহিত হতে শুরু করলো বাংলা কাব্য-নন্দনের এক নবস্বাদধারা। যেখান থেকে বাংলা কবিতায় ‘আধুনিক’ যুগের ব্যাপকায়তন যাত্রাপাত। ক্ষুদ্রায়তনে ‘আধুনিক’ শব্দটির প্রয়োগ এর আগে মাত্র একজন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছিল। সে ‘আধুনিকতা’ এবং ত্রিশের সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা আর রুচিশীলতাসূচক ‘আধুনিকতা’ এক নয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশি বাহিত হয়ে এখনো অবধি প্রবহমান যে ‘আধুনিকতা (উত্তর-আধুনিকতার কথা মনে রেখেই), তা মধুসূদনের নয়, ত্রিশের। ত্রিশের পাণ্ডবগণের জীবনবাদিতা ছিল ভিন্নরকম। ‘তাঁরা রাজনীতিনিরপেক্ষ, সমাজবিমুখ, ব্যক্তিবাদী কিন্তু জীবনবাদীও এ-অর্থে যে তাঁদের হাতেই বাঙলা কবিতা এই প্রথম স্বপ্নীল ভাবলোকের নিকুঞ্জ ছেড়ে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল জনজীবনের আনাচে-কানাচে, গৃহিণীর হেঁসেলে, গেঁদু মোড়লের সালিশী বৈঠক থেকে নগরীর ফুটপাত, অলিগলি এমনকি পতিতালয়ের নিষিদ্ধ প্রকোষ্ঠে। কিন্তু এত জীবনলগ্ন হয়েও এসব কবিতার অধিকাংশ নির্গত হয়েছে ব্যক্তিমানসের নিঃসঙ্গ অন্তর্লোক থেকে। এই নিঃসঙ্গতা আধুনিক বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে জাত; এই চেতনা যত না কবির স্বসৃষ্ট তারও চেয়ে বেশি বিনষ্ট সময় ও সমাজের দান।’ ((মধ্যদিনের জানালা, আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন, ১৯৯৭, ঢাকা)) --এই যে অস্থিরতার সাথে কবিতাকর্মীদের আত্যন্তিক সাক্ষাৎ ত্রিশ-দশকীয় গবাক্ষপথে; একটিমাত্র দশকান্তরে সেই অস্থির পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অস্থিরতর। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের পাশাপাশি ভারতভূমিতেও এ সময়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমনসব ঘটনাবলি সমুপস্থিত হয়েছে যে চল্লিশদশক আধুনিক ভারতবর্ষের সবচেয়ে কম্পমান, অনিশ্চয়তামণ্ডিত দুর্দশক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এর প্রতিক্রিয়া স্পর্শ করেছে লেখককুলকেও। নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নিঃসঙ্গ হয়েও বাইরে তাঁরা হয়ে উঠেছেন সঙ্গপরিবেষ্টিত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক কবিই যুক্ত হয়ে পড়েছেন বঞ্চিত মানুষের আন্দোলনে। কবিতার বিষয় হিসেবে সময়, সমাজ, মানুষ, মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস হয়ে উঠেছে ব্যক্তিক নৈসঃঙ্গ্যের চেয়েও বড়ো। লিখিত হয়েছে প্রচুর উচ্চকণ্ঠ স্লোগানও। আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) এই উত্তুঙ্গ আন্দোলনমুখর বিনষ্ট সময়েই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭)-এর প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি আহসান হাবীব হিসেবে স্বয়ম্প্রকাশিত। সুতরাং ‘রাত্রিশেষ’-এর মূল্যায়নপ্রয়াস পুরোটাই অর্থহীনতায় পর্যবসিত হবে, যদি না তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটি সামনে নিয়ে আসা হয়। সেটা হবে অসঙ্গত এবং অযৌক্তিকও। এখানে কাজেই রাত্রিশেষের গান…
ত্রিশ-দশকে আবির্ভূত একদল শিক্ষিত মেধাবী কবির হাতে ‘স্থূলতা, মেকিত্ব ও প্রাকৃত আবেগ ছেড়ে বাঙলা কবিতা আলিঙ্গন করলো সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা ও রুচিশীলতাকে’; মহাপরাক্রমশালী রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের বাইরে প্রবাহিত হতে শুরু করলো বাংলা কাব্য-নন্দনের এক নবস্বাদধারা। যেখান থেকে বাংলা কবিতায় ‘আধুনিক যুগের ব্যাপকায়তন যাত্রাপাত [...]