খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন, তিনি কক্ষের দ্বারবন্ধ করে রেখেছেন, শোনা যায় তাঁকে ঘুমপাড়ানি ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুত্রবিয়োগের এই খবর শুনবামাত্র সশরীরে ছুটে গেছেন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানানোর জন্যে, কিন্তু গেট তালাবদ্ধ থাকায় তিনি তা জানাতে পারেননি।
এইপর্যন্ত আমার সবই স্বাভাবিক লাগে, বিরোধীদলীয় নেত্রীও যে নেহায়েত মা, পুত্রবিয়োগের অসহনীয় যাতনায় সমব্যথীর মতন ছুটে আসবেন তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, সেটা স্বাভাবিক, সেটা স্বাস্থ্যকর, সেটাই হবার কথা ছিল। শেখ হাসিনার পরিবারের বাইশজন সদস্যকে হত্যা করার দিনটিতে কেবল পৈশাচিক উল্লাস করবার জন্যে খালেদা জিয়া বছরের পর বছর জন্মদিনের উছিলায় কেক কাটেন- সেটা ভুলে গিয়ে বা পাশে সরিয়ে রেখে শেখ হাসিনা যে এইভাবে শোকসন্তপ্ত খালেদা জিয়ার দরজায় আসতে পেরেছেন, সেটা একটি ইতিবাচক ঘটনা। সঙ্গত কারণে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দেখা হলো না, সেটা মনে রেখে প্রধানমন্ত্রী যদি একটি পুত্রবিয়োগকাতর বিরোধীদলীয় নেত্রীকে একটি শোকবানী পাঠান, সেটা আরো ইতিবাচক ঘটনা হবে।
যা নেতিবাচক, তার দিকে চোখ ফিরাই। আমাদের রাজনীতিসচেতনতা মূলতঃ একরকমের বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়, আমরা আমাদের যাবতীয় পাশবিকবৃত্তিগুলিকে মুক্তি দিই রাজনীতির আশ্রয়ে- আমাদের রাজনৈতিক বোধ সফল সহিংসতার ভিতরে সীমাবদ্ধ, সফল প্রতিশোধপ্রবণতার ভিতরে সীমাবদ্ধ। অধিকার নিয়ে, দায় নিয়ে, দায়বদ্ধতা নিয়ে, কোনটি সঠিক বা ন্যায্য তা নিয়ে আমরা মাথা কমই ঘামাই, ঘামালেও সেই ঘাম কর্তৃপক্ষ অব্দি যায় না। আমরা ব্যতিব্যস্ত অন্য কোলাহলে।
যে বর্বর আমোদের সাথে খালেদা জিয়া ১৫ই অগাস্ট প্রতিবছর জনসমক্ষে কেক কাটেন, যেকোনো সভ্য দেশ হলে এই একটি ঘটনায় তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ অনেক নেমে যেত আমি নিশ্চিত, আমি নিশ্চিত একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল চালানোর মতন পরিণত বিবেক-বুদ্ধি তাঁর আছে কি না, সেটা নিয়েও তর্ক চলতো এবং তর্কাতীতভাবে তিনি বুদ্ধিহীন-বিবেকহীন-হৃদয়হীন প্রমাণিত হতেন। কিন্তু এ যে বাংলাদেশ। তাই খালেদা জিয়া যখন কেক কাটেন, তাঁর আশপাশে বহু লোক বিপুল সমারোহে যোগ দেয়, এই ‘হেসে খলখল গেয়ে কলকল’ কেক-খাওয়া লোকগুলি রাজনীতি করবার যোগ্য কি না তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না।
একইভাবে, খালেদা জিয়ার পুত্রের মৃত্যুর পর দেখলাম বহু রাজনীতিসচেতন বন্ধু সোশ্যাল মিডিয়াতে খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞেস করছেন, এবার বুঝলেন ম্যাডাম, নিজের বাচ্চা মরে গেলে কেমন লাগে? কেমন লেগেছিল বার্ন ইউনিটে সন্তানের মৃত্যু দেখা মায়েদের? অবরোধের কারণে ঝলসে যাওয়া নিরপরাধ বাচ্চার মায়ের ব্যথা আর নানান অপরাধে অপরাধী মৃত পুত্রের মায়ের ব্যথা নিয়ে এইসব তূল্যমূল্য যাচাই যাঁরা করছেন, তাঁরাও রীতিমত ব্যক্তিগত জীবনে সন্তানের অভিভাবক। আচ্ছা, অপরাধীর/অপরাধিনীর শোক থাকতে নেই তাই না, তার শুধু থাকবে পরিতাপ! যাঁর সন্তান সদ্য মৃত্যুবরণ করেছে, তাঁকে কেমন লাগে জিজ্ঞেস করাটা, তাঁর ব্যক্তিগত শোককে পোয়েটিক জাস্টিস হিসেবে প্রমাণ করাটা কি আমাদের রাজনীতিসচেতনতা? হ্যাঁ, সেটাই আমাদের রাজনীতিসচেতনতার স্বরূপ, সেটাই আমাদের বর্বরতার আসল চেহারা- যে চেহারা আমাদের অসুস্থ রাজনীতি আনলীশ করতে-প্রকাশ করতে পুর্ন সহায়তা দান করে।
বার্ন ইউনিটে ধুঁকতে থাকা বাবা-মা-শিশুদের জন্যে গভীর সমবেদনা, আগুন দেবার শাস্তি সভ্যদেশে সাংঘাতিক, শুধু অগ্নিসংযোগের কারণে কি কি ক্ষতি হলো তাই বিচার করা হয় না, তদসঙ্গে বিচার্য্য বিষয় হচ্ছে- আগুন দেয়ার কারণে কি কি ক্ষতি হতে পারতো অথচ হয়নি। ফলে শাস্তিটা খুব চওড়ামাপের হয়, তাই হওয়া উচিত। বড় দুর্ভাগ্যে এমন রাজনৈতিক সচেতনতার দেশে মানুষের জন্ম হয়- যেখানে রাজনীতি একটি ‘করার জিনিস’, ভাবার জিনিস না, পালনের জিনিস না, বিচারের জিনিস না; তাই এমনি কিছু অগ্ন্যুৎসর্গ না করতে পারলে মাঠকর্মীরা চঞ্চল হয়ে ওঠে, অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। নেতানেত্রীদের অসংলগ্নতার দিকে আর কত তাকিয়ে থাকব, তাদের বর্বরতায় নগ্নভাবে যোগ দেয় তো সাধারণ মানুষই, সরি, রাজনীতি-করা রাজনীতিসচেতন(!) সাধারণ মানুষ।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
অদিতি কবির - ২৭ জানুয়ারি ২০১৫ (৫:২৩ পূর্বাহ্ণ)
মানুষ দিনের পর দিন, একটার পর একটা অগ্নিসংযোগ, পোড়া মানুষ দেখতে দেখতে খালেদা জিয়ার পুত্রের মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ করেছে বলে আমার মনে হয়। তাদের আর কিছু করার নেই, হিংসার বলি হওয়া ছাড়া। যে মা-বাবা তাঁদের পরিবারের কর্মক্ষম সন্তানটিকে পেট্রোল বোমায় হারালেন, তাঁদেরকে “আল্লাহর বিচার” বলা বা আনন্দ প্রকাশ না করার কোন যুক্তি দেব?
Pingback: কা কস্য পরিবেদনা » বাংলাদেশী শীর্ষ কমিউনিটি নিউজ পোর্টাল