আলতাব আলী পার্কে আমি বা আমরা পৌঁছবার অনেক আগ থেকেই জামাতীরা-শিবির কর্মীরা যা কিছু ‘আমাদিগের’ হবার কথা (যেমন পার্ক চত্বর, শহীদ মিনারটির পাদদেশ, পার্কের ভিতরের পাকা রাস্তাটুকু) তার সবকিছুর দখল নেয়। আমি যতক্ষণে আমার কর্মক্ষেত্র থেকে অফেন্ডার-ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের চোখ বাঁচিয়ে লন্ডনের ট্রেনে উঠে বসেছি, ততক্ষণে আমার বন্ধুরা ধাওয়া খেয়েছে পার্কে এসে, বিস্মিত চোখে দেখেছে বাংলাদেশের পতাকা (আমাদের চেয়ে শিবিরের হাতে পতাকা ছিল বেশি) দুলিয়ে শিবির পার্কের মাঝখানের রাস্তা আর টিলা দখল করে বসে আছে। ব্যানারে-ফেস্টুনে-প্ল্যাকার্ডে কোথাও কমতি রাখেনি শিবির। এমনকি একটু পরেই তারা যে বানের জলে ভেসে আসেনি এইরকম কিছু প্রবোধ নিজেদের দেবার উদ্দেশ্যেই হয়তো তারা আকাশে তুললো বৃটিশ পতাকা। আমাদের দিকের বেশিরভাগই কম বয়স্ক ছেলেমেয়েরা আর কিছু প্রৌঢ় মানুষ, আমরা বৃটিশ পতাকা তোলা দেখে হাসি চাপতে পারিনি, বলেছি- আর একটু ঝাঁকি দিলে এদের পকেট থেকে ফ্ল্যাগ ‘পম গানা’ও বের হবে, যদি দরকার হয়! তারা তাদের প্ল্যাকার্ডে কোনোকিছুর দোহাই পাড়তে বাদ রাখেনি, ‘স্টপ কিলিং ইন বাংলাদেশ’, ‘স্টপ স্টেট-টেররিজম’, ‘স্টপ কিলিং অফ ইনোসেন্ট চিলড্রেন’, ‘স্টপ র্যাব’, ‘স্টপ এন্টিমুসলিম টেররিজম ইন বাংলাদেশ’ আর আছে বান্ধা বুলি- ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’ আর মানবাধিকারের দোহাই (সেটাতে পরে আসছি), সেটা এক ভাড়াটে শাদা লোককে বাইসাইকেলে চড়িয়ে সামনে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, কালচারাল মেল্টিং পটও হলো, হিউম্যান রাইটও হলো!
আমাদেরকে পার্কের একপাশে অর্ধচন্দ্রাকার একটা জায়গায় গুঁজে রাখবার জন্যে পুলিশ অন্তবিহীন চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এক পা সরলেই পিঠে থাবা- ভেতরে যাও, ভেতরে থাকো!” আমি গিলতে না পেরে খ্যাঁক করে উঠলাম- “আমাদের সরাচ্ছ কেন? ঐ লোকগুলিকে সরাও না কেন?” পুলিশ অম্লানবদনে বল্লো- “মহিলা, ভাল করে তাকিয়ে দেখো আমরা ওদেরও সরাচ্ছি, তোমরা পা পা করে এগিয়ে গিয়ে দূরত্ব কমিয়ে একটা মারপিট বাধাবে, তা হবে না।” একসময় শিবির থেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু হলো, শুরু করেছিল ‘চুর’ / ssoor (উচ্চারণে) দিয়ে, এরপর ‘মালে গনিমাত’ দের সব এই দলে শ্লোগান দিতে দেখে তাদের আসল চরিত্র বেরিয়ে আসতে দেরি হলো না, মেয়ে দেখলেই বেশ্যা মনে হবার এই প্রোগ্রামিং সবক’টা শিবিরের মাথায় কি করে বসিয়ে দেয়া গেছে সেটা জানতে ইচ্ছা করে। এই ইনফ্রারেড চশমা তারা বাড়িতে গিয়েও চোখ থেকে খোলে কি না, তাও জানতে ইচ্ছা করে। ইতোমধ্যে শিবিরের লাইনে লাইন ধরা হচ্ছে দেখি, সমুচা খাবার লাইন। খাদ্য বিতরণ ছাড়া এরা নিশ্চয়ই কোনো জাহেরি-বাতেনি জিহাদ করে না। অল্পবয়স্ক-বেশিবয়স্ক মানুষগুলি বুভুক্ষুর মতো সমুচা খেতে শুরু করে, এদের মুখ বৃটিশ পতাকার ছায়াতেও হাভাতে-বাঙালির চেহারায় রূপ নেয়, চোখের তলায়- হনুর উপরে ভাসন্ত ক্ষুধার রূপ দেখলেই আমার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথা মনে পড়ে। আচ্ছা, ওয়ালীউল্লাহ অপেক্ষা করুন আপাতত।
আমাদের ছেলেমেয়েরা কোত্থেকে ভোজ্য তেলের ড্রাম নিয়ে এসেছে একটা, গাছের তলায় সেটা বসিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুরু করে দিই। আমাদের প্ল্যাকার্ড হাতে লেখা, নয় প্রিন্টারে ছাপানো, গ্লু দিয়ে কার্ডবোর্ডে সাঁটা। আমাদের ড্রাম পিটানোর কাঠি কি না গাছের ডাল। আমাদের জোরালো মাইক নাই- হ্যান্ড মাইকের নামে যা আছে তার চেয়ে বড় ক্বাফ উচ্চারণের জায়গা থেকে মানব-গলবিল বেশি শব্দ উৎপন্ন করতে পারে। আমাদের বাকি বন্ধুরা কি না কামলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভুগছে, কাজে আছে, আসতে দেরি হবে। আমাদের প্রস্তুতি প্রায় দু’শো বছর আগের নারিকেলবাড়িয়ার তিতুমীরের কথা মনে পড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমরা প্রত্যেকে জানি, মানুষের ঘৃণার চেয়ে বড় শক্তি কম আছে। নৈলে ভিয়েতনামে আমেরিকাকে এইভাবে পরাজয় মানতে হতো না, অতদূর যেতে হবে কেন, গামছা ফেরতা দেয়া চাষাভুষা বাঙালীর কাছে তখনকার সবচেয়ে চৌকস আর্মি নিয়ে পাকিস্তানকে এইভাবে হারতে হতো না। আমি একটু কাউমাউ করতে চেষ্টা করি- “আমাদের মাইক নেই, যা আছে তাতে জোর নেই”…আমার পাশ থেকে রাজা (ফয়সল ইফতিখার) খেঁকিয়ে উঠে- নাই তো নাই, গোল্লা বানাইসি দেখেন না? (মানববন্ধন দিয়ে ঘেরাও করেছি জায়গাটুকু) মাঝখানে আগুন দিয়া একাত্তর লিখসি দেখেন না? (টি-লাইট আর মোমবাতি দিয়ে ৭১ লিখেছে ছেলেমেয়েরা)” শিবিরের লোকেরা বারবার চেষ্টা করছিল আমাদের ঠেলে দিতে। যে কেউ পার্কের বাইরে বের হবার সময় কয়েকজন মিলে বের হতে হচ্ছিল, শিবিরের নির্যাতনের ভয়ে। একবার মনে হলো- এই আকাশচুম্বী সিকিউরিটির দেশে এখানে পার্কে দাঁড়িয়ে এত ভয়, যে দেশে পুলিশ হেফাজতে নাকি জুতার ফিতা দিয়ে ছাত্র আত্মহত্যা করে আর তার বিচার হয়না কোনোদিন সেদেশে শাহবাগে কোন দুর্জয় সাহসে আমার ভাইবোনেরা শামিল হয়ে আছে?
এদিকে শিবির গান ধরেছে- ‘বুবুজান বুবুজান/আপনি ভারত চলে যান/ আপনি দিল্লির প্রডাকশান/আপনি ভারতমাতার দান’। এই গান শেষ হবার পর তারা শুরু করলো ভাষণ- জামাতের কষ্টে-নিপীড়নে-বুকের রক্তে (আমরা তো জানি অন্যের পায়ের রগ-কাটা রক্তে) কত কি গড়ে উঠেছে, সেইগুলি তারা নস্যাৎ হতে দেবে না, যে কোনো মূল্যে রক্ষা করবে। শুনলে আপনার স্টার প্লাসে হিন্দি সিরিয়ালের একান্নবর্তী পরিবারের বড় বউয়ের ডায়লগ মনে পড়বে। ভাষণের শেষে তারা শেখমুজিবের স্টাইলে শুরু করলো- “এবারের সংগ্রাম আওয়ামীলীগকে শেষ করার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আল্লার নামে…ইত্যাদি।” আমরা হাসব না কাঁদবো জানি না, তখন থেকে চিৎকার করে চলেছি- তুই রাজাকার!” মঞ্জুলিকাদি চিৎকার করছেন, শামীম আজাদ আপা চিৎকার করছেন- তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা, এতক্ষণে এখানকার অনেক সিলেটি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ জুটেছেন, দুর্জয় ঠান্ডায় আর বৃষ্টিতে কাদামাটিতে পাতা প্রদীপের ৭১ এ যত বাতি নিভে যাচ্ছে সেগুলি বারবার জ্বালাচ্ছেন আর ক্ষণে ক্ষণে শ্লোগান দিচ্ছেন- তুই রাজাকার (হুমায়ূন আহমেদ দেখলে খুশি হতেন হয়তো, ঘৃণ্যকে তুইতোকারি করতে তিনিই শিখিয়েছেন।)।
ইসলাম জামায়াত-শিবিরের পৈতৃক সম্পত্তি, এমন একটা ভাব বজায় আছে বরাবরই, আমার সীমিত ধর্মজ্ঞানে আমি জানি, আল্লাহ বলেছেন- মানুষকে হত্যা করলে হত্যাকারী কাফির হয়ে যায়, সে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত থাকে না, হত্যাকারী-ধর্ষক-নির্যাতকদের জন্যে এই ধর্মে ঠাঁই নাই। কোন ধর্মে আছে? শিবির এরি মধ্যে নারায়ে তকবীর ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে শেষ করে, ইসলামের ঠিকাদারি নিশ্চিত করতে শাদা কাপড় বিছিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়া শুরু করে দিয়েছে। ক্বেবলা অত্যন্ত আয়রনিকালি পার্কের মিনারের দিকে। যে শহীদ মিনারে যাওয়া নিয়ে- বুতপুজারী হওয়া নিয়ে সারাবছর এরা মুখে ফেনা তুলে এলান করে, এখানকার ধর্মভীরু সিলেটিদের দেশের মাটি থেকে-ঐতিহ্য আর উত্তরাধিকার থেকে পর করে দেয়, সেই মিনারকে একেবারে সামনে রেখে তারা সমবেতভাবে নামাজ পড়ে ফেল্লো। তারপর ভাষণ শুরু হলো- ভাইয়েরা, বৃষ্টি শুরু হয়েছে (হৈ হৈ), আল্লার রহমত আমাদের উপর বর্ষিত হচ্ছে (হৈ হৈ), ওদের মোমবাতি নিভতে শুরু করেছে (হৈ হৈ)!” আশ্চর্য এই, যে, এইবার তারা মোমবাতি বা বাতিকে মঙ্গলপ্রদীপ ডাকেনাই।
আর আশ্চর্য ছিল লন্ডন পুলিশের ব্যবহার। তাদের নাকের ডগা দিয়ে আমাদের ডিম মারতে শুরু করে শিবিররা, অনেকে এসে সেটা পুলিশকে দেখায়, পুলিশ বলে- আমি তো নিজচোখে দেখিনাই, দেখলে ধরতাম, এই এত মানুষের ভিতরে কাকে ধরবো?” আমার পিত্তি জ্বলে যায়, আমি পাশ থেকে বলি- আচ্ছা, তাহলে এইদেশে তোমরা দেখলে ধরো আর না দেখলে অপরাধীকে ধরো না?” পুলিশের ধৈর্য তো অসীম নয়, সেও জবাব করে- তোমার যা বলার ঐ সুপারিন্টেন্ডেন্টকে বলো, আমি কিছু জানি না”, আমি হেসে বলি- তোমাকে পুলিশ হিসেবে আমার অনেক পরিচিত লাগছে, জানো?”
সায়মা আহমেদ এসেছিল তার পাঁচ মাসের বাচ্চা আর দেবরকে সাথে নিয়ে, আগের রাতে ‘বেতার-বাংলা’তে দেয়া তার ভাষ্যের সে ব্যত্যয় করেনি, কথা রেখেছিল, প্রেসের লোক হিসেবে শিবির তাকে রেহাই দেয়নি- নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করেছে। পুলিশকে আমি নির্বিকারভাবে কেবল শুনতে দেখেছি।
আমরা তখন কাদার উপরে খবরের কাগজ ছড়িয়ে বসে পড়েছি, বেশিক্ষণ বসবারও উপায় নাই, ঠান্ডা কিলবিলিয়ে উঠছে জুতার তলা দিয়ে, ভেজা কাগজের আসন দিয়ে। তার ভিতরেই অপার উৎসাহে আমরা গাইছিলাম- শিকল পরা ছল…বিচারপতি তোমার বিচার…তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর…
আমরা কী দুঃখী জাতি, নতুন একটি গানের জন্যেও আমাদের যুদ্ধ করতে হয়, নতুন একটি কবিতা লিখতেও আমাদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। এই যুদ্ধ আমার ‘পাখিসব করে রব’ এর জন্যে। এই যুদ্ধ ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ র জন্যে। এই যুদ্ধ আমার দেশের নির্বিচার হত্যার বিচারের জন্যে। আমরা এই নিধিরাম সর্দাররা ঢাল-তরোয়াল ছাড়াই এই যুদ্ধ করতে পারি।
আমার বন্ধুদের কেউ কেউ মানবাধিকারের প্রসঙ্গ তুলেছেন, এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মানের খাতিরে আর আসেন নাই। মানবাধিকার আসলে আমাদের হাতে তুলে দেয়া অভিরাম মিষ্টিবিশেষ, এইটি খাওয়ার আমাদের অধিকার নেই, কেবল হাতে নিয়ে দেখব আর ভাবব আমাকে দেয়া হয়েছে। বিশ্ব-ময়রা যথাসময়ে সেই মিষ্টি ছোঁ মেরে আবার নিয়ে নিতে পারে। হিরোশিমা নাগাসাকিতে বোমা ফেলতে পারে, মাই-লাই ম্যাসাকার করতে পারে, গণহত্যার সমর্থনে নৌবহর পাঠাতে পারে, লুঠ করতে পারে অন্যদেশের মিউজিয়ামের এসিরীয়- আক্কাদীয়-সুমেরীয় সম্পদ, অন্যদেশে শান্তি-সম্প্রীতি-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে নির্বিচারে শিশু-হত্যা করতে পারে, আবু-গারীব এ ধর্ষণ করতে পারে। মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা নিজেরাই বিচার করে অন্য-দেশের রাষ্ট্রপতিকে ফাঁসি দিতে পারে আর নিজের দেশের সিরিয়াল কিলারকে বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় অর্থে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কেউ চিৎকার করে বলবে না- “রাজা তোমার নিজের গায়ে জামা নেই, রাজা তুমি ন্যাংটো!”
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
বর্ণালী সাহা - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (১১:২৯ অপরাহ্ণ)
তোমাদের শ্রদ্ধা। পরদেশের সবধরণের অসহ্য শৈত্য মাথায় নিয়ে তোমরা যা করেছ এবং করছ, তার তুলনা হয় না। যেদিন এই শৈত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারাব, দুঃখী জাতি আমরা সেদিন হব। যুদ্ধ না-করে লেখা নতুন একটি কবিতা কিংবা নতুন একটি গান হতে পারে উৎকৃষ্ট কোনো কবিতা বা গান; কিন্তু সেটি কি আর আমাদের কবিতা? আমাদের গান? যেদিন হার মেনে রণে ভংগ দেব, শুধু সেদিনই হয়তো বুঝব রক্তে-অশ্রুতে-স্বেদে-শৈত্যে অজেয় আমরা দেশে এবং বিদেশে কী কবিতা লিখেছিলাম।